somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'বিজ্ঞান' বা সায়েন্সের 'দার্শনিক' সঙ্কট

২৪ শে জুলাই, ২০২০ রাত ২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অ্যাটমিক বা সাব-অ্যাটমিক লেভেলে পার্টিকলের আচরণ ব্যাখ্যার জন্য আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্স বা ফিজিক্সের শরণাপন্ন হতে হয়। আমাদের প্রতিদিনকার বাস্তবতায় আমরা যা অবজার্ভ করি এসবের জন্য পদার্থের ক্ষুদ্রতর স্তরে আচরণ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের সমস্যা হল তাদের মধ্যে অনেকেই ধর্ম যে জীবনবিধান দিয়েছে সেটা নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন। অর্থাৎ মনোথেয়িস্টিক ধর্মগুলো যখন আমাদের বলে একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট রুলড ওয়েতে জীবন 'যাপন' করতে তখন তারা বিদ্রোহ করেন।

উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায় যে, সূর্যগ্রহণের সময় নবী তার সাহাবাদের বলছেন, দোয়া-দরুদ পড়তে কিংবা কয়েক রাকাত নামায পড়ে ফেলার জন্য। ওদিকে গ্রীক প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা [এনারা আসলে দার্শনিক ছিলেন, এদের প্রকৃতি সম্পর্কিত তথাকথিত পাশ্চাত্য 'দর্শন' থেকেই পরবর্তীতে 'প্রকৃতিবিজ্ঞান' বা আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম] তখন বিস্মিত। কারণ ওদের কাছে খোদা বা আল্লাহ কোন নবী পাঠাননি। অর্থাৎ খোদার সাথে তাদের কোন লিঙ্ক নেই। ফলে প্রকৃতি, প্রকৃতির কাজ-কারবার যেমন: রাতের আকাশে তারা, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি এদের সামনে হাজির হল এক অপার বিস্ময় হিসেবে। এই দুর্বোধ্য প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য তারা উদ্ভাবন করলো নানান তত্ত্বের, নানান যৌক্তিক ব্যাখ্যার। অর্থাৎ খোদা যখন ওহী নাজিল করে কোন ধরনের 'সত্য' তাদের পাঠাচ্ছেন না, তখনই দেখা দিচ্ছে অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তা যেখানে আছে সেখানেই দর্শনের উদ্ভব। অর্থাৎ আপনি যখন থিওরি অব এবরিথিং আবিষ্কার করে ফেলবেন তখনই একমাত্র দর্শনের মৃত্যু ঘটতে পারে, তার আগে নয়।


ওদিকে ওহী মানেই নিশ্চয়তা যেহেতু তা খোদার নির্দেশ, এর উপর কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। ওহী মানেই অ্যাবসুলুট নিশ্চয়তা। নিশ্চয়তা না থাকলেই সেখানে দর্শনের আবির্ভাব। এমনকি অনিশ্চয়তা দেখা দিলেই সেখানে যে দর্শনের উদ্ভব ঘটে সেটা আমরা ধর্মের মধ্যেও দেখতে পাই। দেখুন-- নবীর মৃত্যুর পর খেলাফতের প্রশ্নে কোন ধরনের নিশ্চিত উত্তর ছিলো না জনগনের সামনে যেহেতু ওহী আসা নবীর মৃত্যুর সাথেই বন্ধ হয়ে গেছে। আর আমরা নবীর জীবনী থেকেই অনেকবার দেখেছি যে ওহী-ই তৎকালীন ধর্মানুসারীদের প্রাত্যহিক জীবনের সমাধান-অযোগ্য কঠিন সমস্যাগুলোর সমাধান দিতো ওনার জীবিতাবস্থায়।

নবী মারা গিয়েছেন, ওহী নাজিল বন্ধ হবার পর খেলাফতের প্রশ্নে তাই দেখা দিল এক ধরনের অনিশ্চয়তা, আর এ অনিশ্চয়তা থেকেই শিয়া ও সুন্নী নাম ধারণ করে দু'টি বিভাজন। এই বিভাজন আর কিছুই নয়, এটি আসলে ওহী না থাকার কারণে অনিশ্চয়তা-সৃষ্ট দার্শনিক সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান সমাধান শিয়া ও সুন্নী নামধারী দু'টো ভিন্ন দল/গোত্র বা খোলস নিয়ে হাজির। অর্থাৎ খেলাফতের পদে কে আসীন হবেন সেই সমস্যার উত্তর বা নিশ্চয়তা নেই দেখেই সমাধানে আসার জন্য দর্শনের উদ্ভব। যে ব্যক্তি মানুষটির দৈনন্দিন জীবনে মানুষ, প্রকৃতি, বিশ্বজগৎ নিয়ে কোন ধরনের অনিশ্চয়তা নেই তার জীবনে দর্শনেরও কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।


তবে আমাদের প্রতিদিনকার ম্যাক্রোওয়ার্ল্ড বা বা প্রাত্যহিক বাস্তবতাকে যদি আমরা অ্যাকুরেইটলি ধরতে চাই তবে নিউটনিয়ান 'দর্শন' দিয়ে আমাদের কাজ চলে না, কারণ এক্ষেত্রে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে আমাদের ম্যাক্রোওয়ার্ল্ড-ও আসলে মাইক্রোওয়ার্ল্ড দিয়েই গঠিত। যেমন: আমাদের খালিচোখে দৃশ্যমান এক ফোটা (অনু) পানি আসলে দু'টো হাইড্রোজেন এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত। আমরা অ্যাটমিক লেভেলে চলে এসেছি, অ্যাটমগুলোকে ভাঙ্গলে আমরা পাবো সাব-অ্যাটমিক লেভেল- যেখানে আছে ইলেকট্রন, প্রোটন নামক পার্টিকেলগুলো। এ পর্যন্ত যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে, "যেহেতু সাব-অ্যাটমিক লেভেলের পার্টিকলগুলো থেকেই পরমাণু, অণু হয়ে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক বাস্তবতায় অবস্থিত পদার্থগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছি, সুতরাং সাব-অ্যাটমিক লেভেলের পার্টিকেলগুলোর আচরণ অ্যাকুরেইটলি প্রেডিক্ট করতে পারলে আমরা আমাদের বাস্তবতাকে এক্সাটলি ব্যাখ্যা করতে পারবো।"

এ জায়গায় সমস্যা বাঁধালো আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপল যেটি অনুসারে সাব-অ্যাটমিক লেভেলে অবস্থিত পার্টিকলগুলোর আচরণ আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় ১০০% অ্যাকুরেসি দিয়ে প্রেডিক্ট করা।


কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ইনটুয়িটিভ ব্যাখ্যার জন্য, আরউইন শ্রডিঙ্গার আরেককাঠি এগিয়ে বললেন যে আসলে মাইক্রোওয়ার্ল্ডের সাথে 'সম্পর্কিত' ম্যাক্রোওয়ার্ল্ডের বাস্তবতা আমাদের পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল।

অর্থাৎ কোন ঘটনা আসলে কি ঘটেছে না ঘটেনি- সেটা পর্যবেক্ষণ না করার আগে আমরা বলতে পারি না। এখানে সবচেয়ে যৌক্তিক বক্তব্য হল- ঘটনাটি হয় ঘটেছে, না হয় ঘটেনি। আমাদের প্রতিদিনকার বাস্তবতায় আমরা যেভাবে যা বুঝি বা দেখি, সে অনুযায়ী ঘটনাটি ঘটার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি (মাইক্রোওয়ার্ল্ডের সাথে যখন আমাদের দৈনন্দিন ম্যাক্রোওয়ার্ল্ডকে কানেক্ট করা হচ্ছে)। কিন্তু আসলে 'ব্যাপারটা' হল- আমরা "জানিনা" আসলে কি হয়েছে, "আসলে" কি হয়েছে সেটা নির্ভর করবে আমাদের পর্যবেক্ষণের উপর। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ করার মূহুর্তেই নির্ধারিত হবে আসলে কি হয়েছে (ঘটনা ঘটেছি কি ঘটেনি)। তার আগে নয়। আমাদের এটা বলা 'ঠিক' হবে না যে "আরে বাবা, ঘটনা একটা না হয় অন্যটা-তো ঘটে গিয়েছেই, এখন পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হলেইতো হয়।" কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী ভয়ঙ্কর সত্যটা হল, "সময়"-এর ধারণায় আমরা যে ভাবছি যে, হয় ঘটনা ঘটেছে, না হয় ঘটনাটা ঘটেনি, এখানে আমরা 'টাইম' দিয়ে যে অতীতের কনসেপশন খাটাচ্ছি তাই ভুল হচ্ছে। সবচেয়ে পারফেক্ট হল, এভাবে বোঝা যে, 'পর্যবেক্ষণ'-এর সময় 'সত্যি' নির্ধারিত হচ্ছে!!



প্রকৃতিবিজ্ঞানের দার্শনিক সঙ্কট কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই জায়গায় স্পষ্ট।

প্রকৃতিবিজ্ঞান শুরু হয়েছিলো ন্যাচারাল ফিলোসফি নাম দিয়ে। তারপর প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা 'দর্শন' থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। হকিং এ কারণে তার ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমে ঘোষণা দিলেন যে, 'ফিলোসফি ইজ ডেড।'

হকিং-এর মতে, দর্শন প্রথমে গ্রীকদের হাতে শুরু হয়েছিলো প্রকৃতিকে অবজার্ভ করার মধ্যে দিয়ে এবং একে ব্যাখ্যা করার বা বোঝার একটা পদ্ধতি হিসেবে। তখন জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা ছিলো অল্প। তাই একজন মাত্র ব্যক্তির পক্ষেও সম্ভব ছিলো একাধারে সকল বিষয়ে পারদর্শী হওয়া। কিন্তু বর্তমানে "জ্ঞান" বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এত বেশি বিকশিত হয়ে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে যে একজন দার্শনিকের পক্ষে কখনই সম্ভব নয় সকল বিষয়ে সমানভাবে পারদর্শী হওয়া। বিশেষ করে বর্তমানে আমরা দার্শনিক বলতে যাদের বুঝি এরা আসলে বিজ্ঞানের দার্শনিক, এরা পদার্থবিজ্ঞান বোঝেন না।


হকিং -এর এককথায় দর্শন ডেড হয়ে যাচ্ছে না। তাছাড়া দর্শনের উচিৎ ছিলো এই প্রশ্ন তোলা যে পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যখন ম্যাক্রোওয়ার্ল্ডের সত্য নির্ধারিত হচ্ছে তখন একজন খাটি দার্শনিক কিভাবে নিজের মৃত্যু কামনা করতে পারেন? পর্যবেক্ষণ করার সাথে সাথেই সত্যি নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে, তার দার্শনিক মনের মৃত্যু ঘটছে। অর্থাৎ দর্শনের জন্ম অনিশ্চয়তা থেকে এবং পর্যবেক্ষণ সকল অনিশ্চয়তা দূর করে দিচ্ছে। যদিও দার্শনিক সত্যের সন্ধানী, সুতরাং সৎ হলে পর্যবেক্ষণকে তার অস্বীকার করা 'উচিৎ' নয়। কিন্তু নিউটনিয়ান জগতে থেকে সে এতদিন ভেবেছিলো 'সময়' অ্যাবসোলুট, ঘটনাটা যেহেতু 'অতীতে' ঘটেছে বা ঘটেনি সে 'এখন' স্রেফ পর্যবেক্ষণ করে জেনে নিলেই হল। অথচ এখন সে জানছে সময় নিজেও আপেক্ষিক একটা 'জিনিস'। তার নিজের পর্যবেক্ষণের ওপরই আসলে নির্ভর করছে 'সত্য'।

এখন একটি প্যান্ডোরার বাক্স সে কি খুলবে না কি খুলবে না, তা একমাত্র নির্ভর করছে তার প্রজ্ঞার ওপর।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ২:৫৬
১৫টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×