ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
নগ্নবেলা কিস্তি-৪
নগ্নবেলা-৫
নগ্নবেলা-৬
নগ্নবেলা-৭
নগ্নবেলা-৮
নগ্নবেলা-৯
কিস্তি-১০
আঁকা’র বাসায় গেলেন জাফর সাহেব। দরজা খোলাই ছিল। তিনি আঁকাকে ডাকতে ডাকতে ঢুকে গেলেন। ঢুকেই দেখেন মায়ের মাথায় পানি ঢালছে আঁকা। তার চোখ ফোলা। বেশ কেঁদেছে নিশ্চয়ই। চোখের নিচে কালি পড়েছে। তাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রাত জেগেছে বোধহয়। জাফর সাহেবকে দেখে আঁকা বললো- বাবা এসেছো? বসো।
কি হয়েছে আপার।
কাল থেকে খুব জ্বর।
আমাকে খবর দেস নাই কেন?
এই ক’দিনে আঁকার সঙ্গে সম্পর্কটা তুমি থেকে তুই-এ নেমে এসেছে। জাফর সাহেব বললেন-
ও আমার মোবাইল ফোন নেই। আমার বাসার ঠিকানাও তোকে দেয়া হয় নাই। খবর দিবি কেমনে? তা ডাক্তার দেখাইছস?
দেখাইছি।
কি বললো?
তেমন কিছু নয়। দু’দিনেই সেরে যাবে।
খাওয়া-দাওয়া কি করছেন?
খাওয়া-দাওয়ার কথা বলতে গিয়ে জাফর সাহেবের মনে হলো বিরাট ভুল হয়ে গেছে। খালি হাতে আসাটা উচিত হয়নি। কারও বাসায় এলে কিছু নিয়ে আসাটা সাধারণ ভদ্রতা। মস্ত ভুল হয়ে গেছে। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আঁকা বললো- চা খাবে বাবা?
নারে মা।
আঁকার মা বললো- কেমন আছেন ভাইসাহেব।
বলতে বলতে তিনি উঠে বসতে চাইলেন। জাফর সাহেব বাধা দিলেন। বললেন- ওঠার দরকার নেই, আপনি শুয়ে থাকুন। ভাল হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ, কোন চিন্তা করবেন না।
আমার সব চিন্তা তো মাইয়াডারে লইয়া। বাপ নাই। বড় একটা ভাই নাই। আমি চোখ বুঝলে ওর কি হইবো!
যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছেন। তাছাড়া এখন আমি আছি। অহনার মতো আঁকাও তো আমার মেয়ে।
এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন জাফর সাহেব। গুমোট একটা গন্ধ তার নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগছে। উপায় নেই। অসুস্থ একজন মানুষকে রেখে উঠতেও পারছেন না। একটা বিষয় জানার খুব আগ্রহ জাফর সাহেবের। আঁকা যখন অফিসে থাকে তখন অন্ধ এই মহিলা একা একা ঘরে কিভাবে থাকেন। খাওয়া-দাওয়া, টয়লেট! বড় কষ্ট। আল্লাহ মানুষকে কতভাবে রেখেছেন। কেউ থাকে সাততলায় আর কেউ গাছতলায়। বিচিত্র খেলা স্রষ্টার।
আল্লাহকে যারা দমে দমে স্মরণ করে তাদেরকেই কষ্টে রাখেন। গরিব আধপেটা খাওয়া মানুষগুলো উঠতে বসতে আল্লাহকে ডাকে। অথচ আল্লাহ তাদের প্রতি নির্মম।
কেমন জ্বর জ্বর লাগছে জাফর সাহেবের। অসুস্থ মানুষের সংস্পর্শে এলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়। অস্বস্তি লাগে। এ কারণে তিনি সহজে রোগী দেখতে যান না। লোডশেডিংয়ের জন্য রুমের ভেতরে একটি মোমবাতি জ্বলছে। তার শিখা ঠিকমতো জ্বলছে না। জানালা দিয়ে হালকা বাতাস আসছে। এ কারণে আগুনের শিখা একপাশে জ্বলছে। প্রচুর মোম গলে গলে পড়ছে। মোমের গন্ধটা সহ্য করতে পারেন না জাফর সাহেব। বাসায় লোডশেডিং হলে অন্ধকারে বসে থাকেন। তার রুমে মোমবাতি জ্বালানো নিষেধ। সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে যদি তার সামনে মোমবাতি নেভানো হয়। ওই গন্ধে তিনি বমি করে দেন।
বিদ্যুৎ চলে এসেছে। নিশ্চয়ই আঁকা মেয়েটি এখন মোমবাতিটি নেভাতে আসবে। ভেতরে একটা অস্বস্তি শুরু হলো জাফর সাহেবের। আঁকা এলে তাকে বলতে হবে মোমবাতিটি যেন তিনি চলে গেলে নেভানো হয়। তা নাহলে রান্না ঘরে নিয়ে যেন পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে নেভানো হয়। তাতে গন্ধটা কম হয়।
ট্রে-তে করে পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ নিয়ে এ ঘরে এলো আঁকা। অন্য একটা পিরিচে টোস্ট বিস্কুট। ট্রে-টা খাটের কোণায় রাখতে রাখতে বললো- নিন বাবা, চা দিয়ে টোস্ট ভিজিয়ে খান। অফিস থেকে ফিরে এখনও নিশ্চয়ই বাসায় যান নি।
পকেট থেকে দু’টি আমড়া বের করলেন জাফর সাহেব। আমড়া দু’টি হাতে নিয়ে মৃদু হাসলেন। ছিনতাইকারীরা আমড়া দু’টি নেয়নি। বোকা হাঁদারামের দল। পুষ্টিকর ফলও চেনে না। চিনলে অবশ্যই নিয়ে যেত। আমড়া দু’টি আঁকার হাতে দিয়ে বললো- নে, তোর জন্য এনেছি।
আমড়া পেয়ে খুব খুশি হলো আঁকা।
বিছানায় পড়ে থাকা মোবাইল ফোনে কে যেন বার বার মিসড কল দিচ্ছে। আঁকা বার কয়েক ওটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলো। জাফর সাহেব বললেন- ফোনটা ধর। নিশ্চয়ই জরুরি...। তা নাহলে এতবার...।
আঁকার মা উঠে বসতে চাইছেন। পারছেন না। রোগা শরীর। খুব ক্লান্ত। আঁকা তাকে ধরে বসালো। তিনি জাফর সাহেবের উদ্দেশে বললেন- ভাইসাহেব এই যন্ত্রণাটা দয়া করে ফালাইয়া দিয়া যান। এইটার জ্বালায় সারা রাইত ঘুমাইতে পারি না। সারা রাইত ফুসুর-ফুসুর। কার লগে কি এত কথা কয় জানি না। আমি চোখে দেখি না বইলা; নইলে এইটারে আছড়াইয়া ভাঙতাম।
আঁকার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলেন জাফর সাহেব। তারপর বললেন- এটা খুব অন্যায় আঁকা। আর যেন না শুনি। এখন উঠি আপা। ভাল থাকুন। পরে আবার এসে আপনাকে দেখে যাবো। চলি।
রাস্তায় বেরিয়ে জাফর সাহেবের মনে পড়লো- তার ছেলে নিপুণও সারা রাত মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। বাড়ির অন্য কেউ ব্যাপারটি না জানলেও তিনি জানেন। কখনও কখনও কথা বলতে ছেলে বারান্দায় চলে আসে। মোবাইল ফোনটি কোথায় পেল, কে কিনে দিয়েছে তা তিনি জানেন না। নিপুণের কোন ইনকাম সোর্স নেই। মোবাইল ফোনের টাকা পায় কোথায়? ব্যাপারটা জানা দরকার।
গত ভোর রাতের ঘটনা। ফজরের আজান শুনে ঘুম ভেঙে গেল জাফর সাহেবের। তিনি বিছানা ছেড়ে অজু করলেন। নামাজ পড়তে বসেছেন। তখন তিনি সূরা ফাতেহার শেষ পর্যায়ে। এ সময়ে তার কানে এলো বারান্দায় কে যেন কথা বলছে। খুব নিচু স্বরের কথা। অস্পষ্ট। প্রথমে ধরতে পারেন নি। কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার হলো নিপুণ কথা বলছে। কি কথা হচ্ছে তা তিনি বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারছেন ছেলে বেশ উৎফুল্ল চিত্তে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পর পর চাপা হাসি।
নামাজে মনোযোগী হতে পারছেন না জাফর সাহেব। বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তুলছে। মাস্টার্স পাস বেকার ছেলে। এত ভোরে কার সঙ্গে কথা বলছে। নাকি সারা রাত ধরেই কথা বলছে। এটা কোন শুভ লক্ষণ নয়। তবে কি ছেলেটা বখাটে হয়ে যাচ্ছে! নামাজ ছেড়ে কি নিপুণকে ডেকে জিজ্ঞেস করবে? এটা করা খুব বোকামি হবে। তাছাড়া নামাজ ছেড়ে ওঠে যাওয়া খুব গর্হিত কাজ। মস্ত বড় গুনাহর কাজ। তিনি দ্রুত নামাজ শেষ করতে চেষ্টা করলেন। এতে ঝামেলা বাড়লো। সবকিছু জট পাকিয়ে গেল। দু’বার সূরা ফাতিহা পড়লেন। পড়া শেষ হলে মনে হলো হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। আবার পড়া দরকার।
কিছুক্ষণ পর চলে গেল নিপুণ। তৃতীয়বার চেষ্টা করে দুই রাকাত ফরজ আদায় করলেন জাফর সাহেব। ব্যাপারটা ভুলে গেছেন তিনি। আঁকার মায়ের নালিশ শুনে এটা আবার সামনে চলে এলো। আধুনিক বিজ্ঞান কি তাহলে যুবক-যুবতীদের জন্য অভিশাপ?
জাফর সাহেবের চোখে কৈশোর ভেসে ওঠে।
স্কুলে টিফিনের জন্য চার আনা দিতেন বাবা। কখনও দুই আনা খেতেন। কখনও না। বাকিটা জমাতেন। সপ্তাহ শেষে জমানো পয়সায় খাতা-কলম কিনতেন। বড় হয়ে যখন কলেজে ঢুকলেন তখন জমানো পয়সা দিয়ে বই কিনতেন- মাসুদ রানা, দস্যু বনহুর। নানা ধরনের মজার মজার বই। কখনও বা পয়সা জমিয়ে বন্ধুরা মিলে ছবি দেখতেন। কখনও চটপটি, ফুসকা আইসক্রিম। আর আজকালের ছেলেমেয়েদের হয়েছে কি? বই পড়ার প্রতি একেবারে আগ্রহ নেই। দশ টাকা হাতে পেলে মোবাইল ফোনে রিচার্জ। একটু ফাঁকফোকর পেলে টিভি। নতুবা ফোনে গুজুরগুজুর-ফুসুরফুসুর।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





