অনিয়মিত এই সিরিজটা যারা আগে পড়েননি, তাদের জন্য কয়েকটা কথা বলা যেতে পারে। এই লেখাগুলোতে আমি এমন কিছু ঘটনা শেয়ার করে থাকি, যেগুলো আমার সাথে বা আমার চারপাশে ঘটে। এমন কিছু ঘটনা যেগুলো মেজাজ খারাপ করে দেবার জন্যে যথেস্ট। ঘরে বাইরে যথেস্ট ঠান্ডা মেজাজের মানুষ হিসেবে পরিচিত বলেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তাই ব্লগের পাতায় মনে ক্ষোভ টুকু উগড়ে দেয়া! সিরিজের ৯ম পোস্ট টা লেখা হয়েছিলো ২০১২'র নভেম্বরে! কী ভয়ঙ্কর অনিয়মিত সিরিজ!!!
আচ্ছা এবারে শুরু করি তাহলে!
১.
ঈদের ছুটিতে সব বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাবো। হাতে যেহেতু সময় কম তাই ঠিক করা হলো কাছেপিঠেই কোথাও যাওয়া যাক। তো নাটোরের হালতি বিল দেখতে যাবো বলে প্ল্যান করা হলো। নির্দিষ্ট দিনে সকাল সকাল সবাই বেরোলাম, শুধু একটা বন্ধু ছাড়া। ও ঘুমকাতুরে খুব। ফোন দিয়ে তুলতে পারেনি কেউ। আমরা বাসস্ট্যান্ড এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাস ১১টায়। আগে থেকে টিকেট কাটার ঝামেলা ছিলো না, অন স্পট টিকেট দেয়া হয়। আমাদের যে বাসে যাবার কথা সেই বাসটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা তার পরের বাসে যাবো বলে অপেক্ষা করছিলাম। আমি ভাবলাম, অপেক্ষাই যখন করতে হবে তখন ওই বন্ধুটাকে আনার ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখি। যাকেই ফোন দিতে বলি কেউ রাজী হয়না। শেষে আমিই ফোন দিলাম। একবার দুইবার। এভাবে বেশ কয়েকবার দেয়ার পর কল লগে ঢুকলাম। তখন নতুন অ্যান্ড্রয়েড নিয়েছে কেবল। সেখানে কয়টা কল করেছি নামের পাশে আলাদা করে দেখাতো। দেখলাম এরি মধ্যে ২৪ বার কল করে ফেলেছি। ওই ব্যাটার ঘুম তাও ভাঙ্গেনি। জেদ চেপে গেলো। আজকে ওর ঘুম ভাঙ্গিয়েই ছাড়বো। কোন দিক না দেখে ফোন দিয়ে যেতে লাগলাম একটার পর একটা। থামাথামি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বাস আসেনি আমি কল দিয়েই গেছি। ওনার ঘুম ভাঙ্গেনি। বাসে উঠে কল লগ আবার চেক করলাম। ৯৮ বার। আর দুবার কল দিয়ে ফেললাম। এখন অন্তত কাউকে বলতে পারবো, লিটারেলি অমুক কে ১০০ বার ফোন দিয়েও ঘুম থেকে উঠাতে পারিনি। ওকে ছাড়াই গেছিলাম আমরা।
যারা ভাবছেন ফোন সাইলেন্ট ছিলো হয়ত, বেড়ানো শেষে ফিরে এলে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ও বলেছে ফোন সাইলেন্ট ছিলোনা।
২.
বানিজ্যমেলায় তো প্রতিবারই যাওয়া হয়। মেলার খাবারের দোকানগুলোতে খেয়েছেন কখনো? বছরদুয়েক আগের বানিজ্যমেলায় আমি আর আমার এক বন্ধু ঘুরছি। দুপুর হয়ে গেছে। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। বানিজ্যেমেলায় খাবারের দাম বেশি হয় এটা জানি। তবে আমরা আরো কিছুক্ষণ ঘুরবো। এত ক্ষুধা নিয়ে যে মেলা ঘুরে শেষ করে বাইরে গিয়ে খেয়ে নেবো সেটাও হচ্ছিল না। ভাবলাম খেয়েই ফেলি। "হাজী বিরিয়ানী" নাম দেয়া একটা দোকানে গিয়ে বসলাম। মেনু কার্ডে কোন খাবারেরই দাম লেখা নেই। আমার বন্ধুটা বলল, দুই হাফ কাচ্চিই মেরে দেই। দাম খুব বেশি হলে কতই আর হবে? দুই আড়াইশর বেশি তো আর না। অর্ডার দিলাম। খাবার এল। পরিমাণে বেশ কম, স্বাদ ও যে খুব ভালো ছিলো তা বলবো না। সাথে শসা আর লেবু দিয়ে গেলো। খাওয়া শেষ করে বিল চাইলাম। বিল নিয়ে এলো ১১০০ টাকা! হাফ কাচ্চি ৫০০ করে আর ঐ শসা লেবু কাটা ১০০ টাকা। বহুত ধানাইপানাই করে, কনট্রোল রুমে কমপ্লেইন দেয়ার ভয় দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি। শেষে ওই বিলই দিতে হয়েছিলো। এরপর থেকে বানিজ্যমেলায় কখনো কিছু খাইনা। এখন অবশ্য দোকানের বাইরে প্রাইস লিস্ট দিতে হয়। লিস্টের চেয়ে বেশি দাম নিলে ডিসিপ্লিনারি একশন নেয়ার কথা। কিন্তু কই এবারো তো শুনলাম একপ্লেট ফুচকা নাকি ৫০০ করে নিয়েছে। মানুষের ভোগান্তি দেখার কেউ নেই।
৩.
গত বছরের মাঝামাঝি। আম্মু বেশ অসুস্থ তাই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। বারডেমে ভর্তি। ট্রিটমেন্ট চলছে। রাতে আম্মুর সাথে আমিই থাকি কেবিনে। কোন কোনদিন আব্বু থাকে। মাঝে মাঝে ঢাকায় থাকা রিলেটিভ দের কেউ কেউ এসে দেখে যায়। এর মধ্যে একদিন আমার এক চাচী এসেছে। আম্মুর শরীর সেদিন বেশ খারাপ। মনটা খারাপ হয়ে আছে। এরিমধ্যে ওই চাচী আম্মুর সাথে মরে যাওয়া বিষয়ক আলাপ আলোচনা শুরু করেছেন। আমার তখনি বিরক্তি ধরে যাচ্ছিলো। এরপর উনি ওনার মোবাইল ফোন বের করে গান বাজানো শুরু করলেন। মমতাজ, মনির খানের কিছু চলে যাবো একদিন ওপারে টাইপ গান আছে সেগুলো। মেজাজ এমন খারাপ হচ্ছিলো বলার মত না। কোথায় অসুস্থ মানুষটাকে একটু সাহস যোগাবে তা না মেন্টালি উইক করে দিচ্ছে! খুব কষ্ট হয়েছিলো আমার হাত পা গুটিয়ে বাকী সময়টা বসে থাকতে।
৪.
আমার একটা কাজিন আছে। ও খরগোশ পছন্দ করে বলে ওকে একবার একজোড়া খরগোশ কিনে গিফট করেছিলাম জন্মদিনে। বেশ কিছুদিন ভালোমতই গেলো। খাঁচা টাচা এনে খাবার দাবার দিয়ে ভালোমতই পুষছিলো। ওর আম্মু অবশ্য শুরু থেকেই অপছন্দ করতেন। ঘর নোংরা করে নাকি। তারপরো বেশ কিছুদিন ভালোই ছিলো। মাঝে অবশ্য একবার ভুল করে একটাকে পোলাও খাইয়ে দেয়ার পর থেকে ওটার গায়ের পশম পড়ে যাচ্ছিলো! আমার কাজিন একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। একদিন সকালে উঠে ও দেখলো, ওর খরগোশের খাঁচা খালি। সারা বাড়ি খুজেও না পেয়ে ও মায়ের কাছে গেলো জিজ্ঞাসা করতে। বেশ কিছুক্ষণ চাপাচাপি করার পর উনি স্বীকার করেছেন ওগুলো ফেলে দিয়েছেন। কোথায় থেকে জানেন? ওরা ২২ তলায় থাকে। সেই ২২ তলার বারান্দা থেকে! ও নিচে গিয়ে অনেক খুজেও ওদের লাশ পায়নি। হয়ত কোন বাসার কার্নিশে আটকে গেছে!
কী পরিমাণ মেন্টালি ডিস্টার্বড হলে একটা মানুষ কোন প্রাণীকে এইভাবে হত্যা করতে পারে?
৫.
২১শে ফেব্রুয়ারী শহিদ মিনারে গিয়েছিলাম ফটোগ্রাফি ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট মাথায় নিয়ে। ওখানে পেলাম এই ভদ্রলোকদের। ওনারাও এসেছিলেন শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে।
[
৬.
আমরা ক্যানো চরমপন্থি হয়ে যাচ্ছি? একটা দেশ, কিন্তু আমরা কোনকিছুতে একমত হতে পারিনা ক্যানো? আমাদের জাতীয় ঐক্য নেই ক্যানো? আমরা সহনশীলতা ক্যানো ভুলে যাচ্ছি? রাস্তার টোকাই ছেলেটার গালে হাত তুলতে যেমনি আমাদের বাধে না, তেমনি যখন একজন মানুষকে তার যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার কারণে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়, আমরা সেই খুনের জাস্টিফিকেশনে নিজেদের সমস্ত ঈমানী শক্তি নিয়ে ক্যানো ঝাপিয়ে পড়ছি? আমরা ক্যানো প্রতিনিয়ত খুন হচ্ছি সরকারী ও বিরোধী দলের সন্ত্রাসী হামলায়? যারা আমাদের বোমা মেরে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে, যারা আমাদের করের টাকায় সুইস ব্যাঙ্কের রিজার্ভ বাড়াচ্ছে, যারা দূর্নীতি করে দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে, আমরা তাদেরকেই আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবো! কোন দলের কথা বলছিনা, কোন গোষ্ঠির কথা নয়। আজ ক্ষমতাসীন সরকার থাকতে বিরোধীদল যা করছে, সরকার পরিবর্তন হয়ে ওরা বিরোধীদল হলে সেই একই পথে হাটবে। তাদের আন্দোলনের আগুনে নিজেদের আত্নাহুতি দেবো, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে। ওদের আন্দোলন বেগবান হবে। আমাদের শরীর ঝলসে যাবে, আমাদের সংসার পুড়বে। পোড়া স্বপ্ন নিয়ে তবু আমরা ভাববো দিনবদল ওই আসছে। যাদের ওপর ভরসা করে আমরা দিনবদলের স্বপ্ন দেখবো তাড়াই পুড়িয়ে দেবে শহর, সভ্যতা আর নতুন স্বপ্নবাজ তরুণদল। এভাবেই চলছে, চলবে। শেষ পর্যন্ত আমরা কী পাবো??
এই লেখাটা খুব এবং খুবই সম্ভবত এই সিরিজের শেষ লেখা। চারিদকে এত অশান্তি, অনিয়ম আর মানুষের কুৎসিত রুপ দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত! আমার আর আগের মতো সুবোধ বালকটি হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না, দর্শক সেজে বসে থাকতে ইচ্ছে করেনা। আমার ইচ্ছে করে রুখে দাড়াতে, যারা অযাচিত আচরণ করে তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে। ইদানীং বলিও। মনে হয় প্রত্যেকেরই বলা উচিত।
-ডাচম্যান।
সিরিজের আগের পোস্টগুলোঃ ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ২:৩৩