এক নবীন লেখকের প্রথম বই ছাপা হবার 'সকরুণ' ইতিহাস
সুহৃদ রহমান আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। সে একজন নবীন লেখক, যদিও মাঝবয়সী। গল্প, কবিতা, ছড়া লিখতে লিখতে সে বড় হয়েছিল, লিখেছেও ভূরি ভূরি, কিন্তু সাহিত্যমহলে তার আত্মপ্রকাশ ঘটলো ঔপন্যাসিক হিসাবে।
সুহৃদ রহমান তার আসল নাম, কিন্তু বইয়ের ওপর সে এক ছদ্মনাম ছেপে দিল।
আমি বললাম, এই নামে তোকে কে চিনবে?
সুহৃদ বললো, আমাকে চেনার দরকার কী? আমার বইকে চিনলেই হবে। আমি কি আমার নাম 'ফুটাবার' জন্য বই লিখি?
রাগে আমার শরীরে আগুন ধরে যায়। তবু শান্ত স্বরে বলি, তুই যে বনফুল বা শংকর হতে চাস তা কিন্তু পরিষ্কার। যে লোক জীবনে একটি মাত্র বই বের করেন তিনি তাঁর আসল নামেই বের করেন, এবং শুধু তাই নয়, আসল নামের আগে-পিছে যতো রকম লেজুড় আছে সব জুড়ে দিয়ে নিজের চৌদ্দ গুষ্টির নাম ফাটিয়ে দেন। তোর প্রচুর টাকাকড়ি আছে এবং তুই কম করে হলেও আরো বিশটি বই ছাপবি। পত্রপত্রিকায় তোর ছদ্ম নামের পাশাপাশি আসল নামটাও ছাপা হবে। অর্থাৎ তুই যে কেবল তোর একটি নামের খ্যাতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাইছিস না তা কোলের শিশুটিও বোঝে।
সুহৃদ রেগে যায়। বলে, কী বলতে চাস তুই? টাকাকড়ি না থাকলে কি সাহিত্যিক হওয়া যায় না?
না, যায় না। গেলে আমাকেও লোকে সাহিত্যিক বলতো। আমার লেখার ভাণ্ডার কি তোর চাইতে কম নাকি? আমার টাকা নেই বলে বই ছাপতে পারিনি এবং তথাকথিত সাহিত্যিকও হতে পারিনি।
তুই যা লিখেছিস তা কোন লেখা হয়েছে? ওগুলো তো ছাগলেরও 'অখাদ্য'।
আমারও মুখ ফস্কে একটা দাঁত-ভাঙ্গা প্রত্যুত্তর বের হয়ে আসছিল, কিন্তু সংযমের পরীক্ষা দিয়ে তা বলি না। বিনিময়ে ওর কাছে একটা 'গভীর' দর্শন তুলে ধরতে সমর্থ হলাম। প্রত্যেকটা মানুষই কবি। মানুষ ছন্দোবদ্ধভাবে কথা বলতে পছন্দ করে। বক্তা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন, কথার শ্রীবৃদ্ধির জন্য হঠাৎ দু-চার ছত্র কবিতা কিংবা ছড়া আবৃত্তি করলেন, মানুষ মজা পেয়ে হাততালি দিয়ে উঠলো। কবি মাত্রই ভাবুক। এমন কেউ কি আছেন যিনি কোনদিন কিছু ভাবেননি? কবি মাত্রই স্বপ্নচারী। এমন কি কোন মানুষ খুঁজে পাবেন, যিনি সুখের স্বপ্ন দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেননি? তারপরও কি আমরা সব মানুষকে কবি বলি? না, বলি না। কারণ, আমরা সব মানুষের নাম জানি না, কারণ বাজারে সব মানুষেরই অন্তত একটি করে কবিতার বই বের হয়নি। আচ্ছা, যিনি বলেন যে আমি খুব প্রচারবিমুখ কবি, বলতে পারেন কি তিনি তাঁর কবিতার বইটি কেন ছাপেন, বা ছেপেছেন? একটি বই বের হওয়া মানেই তো জনসমক্ষে তাঁর প্রচার ছড়িয়ে পড়া। বস্তুত আমরা যাঁদের নাম শুনি কিংবা জানি তাঁরা কেউ কিন্তু প্রচারবিমুখ নন, হলে আমরা তাঁদের নামই শুনতাম না। অতএব, সুহৃদ রহমান যে খ্যাতির জন্যই এবং দুটি নাম ফুটাবার জন্যই বই ছেপেছে তা বলাই বাহুল্য।
আমার কথা শুনে সুহৃদ নরম হয় এবং আমার কাঁধে হাত রেখে দুঃখ-বিগলিত হয়। বলে, তোর কথাই ঠিক। আমি দুটি নামেরই খ্যাতি চাই। দুটি নাম যেন আমার দুটি পৃথক সত্তা। আমি আমার ছদ্ম নামের ওপর ভর করে সুহৃদ রহমানকে শীর্ষে তুলতে চাই। দুটি নামের মধ্যে অন্তত একটি তো বাঁচবে। যেটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে সেটাই প্রকৃত আমি।
একুশে বই মেলাতে সুহৃদের প্রথম উপন্যাস 'স্খলন' বের হলে 'চারদিকে' তুমুল হৈচৈ পড়ে গেল। এই 'চারদিক' কিন্তু জগৎজোড়া কিংবা দেশজোড়া চারদিক নয়, এর একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে।
সুহৃদের স্ত্রীপুত্রকন্যা।
সুহৃদের জন্য সবচাইতে বিব্রতকর অবস্থা হলো সে যখন লিখতে থাকে ওর বউ তুলি ভাবী তখন গালে হাত দিয়ে এক ধ্যানে খাতার ওপর তাকিয়ে থাকেন। এভাবে চোখের সামনে বসে থাকলে কি স্বচ্ছন্দে লিখা যায়? কিন্তু ভাবীর যেন তর সয় না, সুহৃদ কী লিখলো তা পড়ার জন্য তিনি অধৈর্য্য হয়ে পড়েন। সুহৃদের প্রায় গল্পেই ওর পূর্ব প্রেমের ছায়া থাকে, ওসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাবী পড়েন। ভাবীর মাথায় অবশ্য কিছুটা দুশ্চিন্তাও কাজ করে- সুহৃদের হৃদয় কাননে এখনো কি সেই বিগত প্রেমিকা নাচানাচি করে? এটা জানার জন্য ভাবীর খুব আগ্রহ। স্খলন ছাপা হবার পর ভাবী পড়ে দেখেননি, কেননা তিনি আগেই এর পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। ভাবী বইটি সম্পর্কে বলেন, এটা একটা অতিশয় করুণ গল্প হয়েছে; তাঁর মতে এতো দুঃখের কাহিনী না লিখে হুমায়ূন আহমেদের মতো হাসির গল্প লিখা উচিত। ভাবী যদিও অন্য লেখকের বই তেমন একটা পড়েন না, এমনকি হুমায়ূন আহমেদের গল্পও না, তবুও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দ্বিতীয় ফেভারিট লেখক। বলাই বাহুল্য যে সুহৃদ রহমানই তাঁর প্রিয়তম লেখক। ভাবী সুহৃদকে প্রায়ই বলে থাকেন, টাকা দিয়ে চোখের পানি ফেলতে কে কিনবে তোমার বই? যতোবারই আমি পড়ি, চোখের পানিতে আমার বুক ভেসে যায়। এতো কষ্টের কাহিনী লিখলে আমি আর তোমার কোন বই-ই পড়বো না। সুহৃদের ছেলের বয়স সাত, মেয়ের বয়স পাঁচ। ওরা স্খলন উচ্চারণ করতে পারে না। সলন, খলন, সখলন- ইত্যাকার যেসব উচ্চারণ ওদের মুখে আসে ওরা তার সবই বলে। মাঝে মাঝে ওরা বিরক্ত হয়ে বলে, বইয়ের নাম এত্তো কঠিন কেন? আমাদের পড়ার বইয়ের নাম কতো সহজ- আমার বই, অংক বই.........। বাসায় যে কোন মেহমান এলে ওরা দু-ভাই বোন দ্রুত দুটি বই হাতে নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে হাজির হয়। বই দেখিয়ে বলে- দেখুন, আব্বু কতো সুন্দর বই লিখেছে। বইয়ের মলাট দেখায়, পাতা উল্টে দেখায়। ছেলে ওর ক্লাসে একদিন একটি স্খলন নিয়ে গিয়েছিল তার সহপাঠীদেরকে দেখানোর জন্য। তারা একটি করে বই চেয়েছে, সে সবাইকে কথা দিয়েছে বই তাদেরকে দিবেই। স্কুল থেকে ফেরার সময় বইটি তার ক্লাস-মিসকে দিয়ে এসেছে। ক্লাস-মিস তাকে বাহবা দিয়ে বলেছেন, তুমি তো দেখছি একজন বিরাট লোকের ছেলে! কিভাবে বই লিখতে হয় তা শেখার জন্য একদিন তোমার আব্বুর কাছে যাব।
সুহৃদের বাবা-মা ও ভাই-বোন- পরিবার।
সুহৃদের বাবা-মা বই পড়তে পারেন না, তবে ছেলের বইটি হাতে নিয়ে খুব গর্বের সাথে তাঁরা মানুষকে বলে থাকেন, আমার পুলা একটা বিখ্যাত বই লিইখ্যা ফালাইছে। ওর ভাই-বোন-ভ্রাতৃবধূ-ভগ্নিপতিগণ একসাথে গোল হয়ে বসে বইটি পড়ে। বইটি খুব রহস্যে ভরা। একেকটা অনুচ্ছেদ পড়ার পর তার ওপর পর্যালোচনা চলে। ওটি থেকে কে কতটুকু রসাস্বাদন করতে পারলো, বা কে কী বুঝতে পেরেছে তার ওপর একটা নাতিদীর্ঘ আলোচনা হয়। সবাই তো আর সমান মেধা নিয়ে জন্মায়নি, তাই এক-আধটু ভুল-চুক হতেই পারে, এবং যথারীতি একটু ভুল হলেই সঙ্গে সঙ্গে সুহৃদের ছোট ভাইয়ের বউ আকলিমা কটাক্ষে ভুলকারীর মেধার কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়- অবশ্য সেই সাথে ও-অংশটুকুর সঠিক অর্থটা ধরিয়ে দিয়ে আত্ম-গর্বের হাসি হাসে।
সুহৃদের কতিপয় শ্যালক ও শ্যালিকা।
সুহৃদের শ্যালক-শ্যালিকাদের সঠিক সংখ্যানুধাবন ও নামমালা মুখস্থ করতে বিয়ের পর প্রায় ছয় মাস সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে সে সাত শ্যালক ও পাঁচ শ্যালিকার নাম-ধাম মুখস্ত করতে পেরেছিল। দুলাভাই হিসাবে সুহৃদ অত্যন্ত ভাগ্যবান- ওর শ্যালক-শ্যালিকারা ওকে সর্বদা মাথায় তুলে রাখে। স্খলন এর অবস্থাও ও-রকম মাথায় তুলে রাখার মতো হলো- তারা বইটি নিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিল, কিন্তু কেউ ওটি পড়ে দেখলো না। কারণ, ওদের বই পড়ার কোন অভ্যাস নেই, অক্ষর দেখলে ওদের কান্না পায় দুঃখে- না খেয়ে না খেয়ে অক্ষরগুলোর কী করুণ হাল হয়েছে! সুহৃদ ঘোষণা দিয়েছিল, আমার কোন শ্যালক কিংবা শ্যালিকা যদি বইটি সারা জীবনে অন্তত একবার পড়ে শেষ করতে পারে, তার জন্য আমার নগদ এবং অগ্রিম পুরস্কার রইল দুই হাজার টাকা। ঘোষণার সাথে সাথে অবশ্য ওর সুন্দরী কনিষ্ঠতম শ্যালিকা বই পড়তে শুরু করে দেয় এবং তিন দিনের মাথায় দুই পৃষ্ঠা পড়েও ফেলে। সুহৃদ খুশিতে ডগমগ হয়ে কথামতো দুই হাজার টাকা অগ্রিম পুরস্কার প্রদান করেছিল। এরপর দু-তিনবার তার হাতে বই দেখা গেছে বটে, তবে পড়ার অগ্রগতি হয়েছে বলে সুহৃদের জানা হয়নি। আরেকটি কথা, যদিও এরা কেউ পুরো বইটি পড়েনি, তবু তারা জানতে পেরেছে যে বইটিতে কোন প্রেমের কাহিনী নেই। তারা আক্ষেপ করে বলেছে, দুলাভাই কি জীবনে প্রেম করেননি? তাহলে প্রেমের গল্প লিখেন না কেন? এর পরের বইতে যেন প্রেম থাকে।
আমাদের কতিপয় স্কুল-বন্ধু-বান্ধবী, যেমন-
সজল- সদর ঘাটের এক হাইস্কুলের ইংলিশ টিচার। শিক্ষক হিসাবে অতি অল্প সময়ে সে প্রচুর নাম করেছে। জীবনে সে প্রথম উপন্যাস যেটি পড়েছিল তা হলো শরৎ চন্দ্রের শ্রীকান্ত। আমাদের সময়ে এইচএসসি-তে শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, সজল সেই উপন্যাস থেকে পরীক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবকটি প্রশ্নোত্তরই টানা মুখস্ত করেছিল, যদিও মূল বইটি সে কোনদিন স্পর্শ করেছিল বলে আমাদের কাছে খবর নেই। শ্রীকান্তই এদ্দিন পর্যন্ত সজলের পঠিত বা অ-স্পর্শিত একমাত্র উপন্যাস ছিল। কিন্তু সেই সজলই সুহৃদ রহমানের স্খলন পড়তে পড়তে উন্মাদ হয়ে গেল। স্খলন এর মূল পাণ্ডুলিপি সে পড়বার সুযোগ পায়নি আমার কারণে, ওটি আমি বহুদিন আটকে রেখেছিলাম। ছাপার পর ওটি হাতে পেয়েই সে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলো। সজল রাত দশটার পর নাকি কখনো ঘুমের যন্ত্রণায় জেগে থাকতে পারে না। ও বলেছে, বইটি যেদিন ওর হাতে যায় সেদিন রাত দশটায় পড়তে শুরু করে, একটানা ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পড়ে ওটি শেষ করে ফেলে। ঘুম থেকে ওঠে এগারোটার পর। বিলম্বিত-নাস্তা খেয়ে আবারো পড়তে বসে এবং একটানা ছয় ঘন্টা পড়ে দ্বিতীয়বারের মতো শেষ করে। বইটি ওকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। এমন বই নাকি সে জীবনে পড়েনি। (না পড়ারই কথা। এর আগে সে মাত্র একটি উপন্যাসই তো পড়েছে, যা ছিল শ্রীকান্ত। ও হ্যাঁ, সজল কিছু ইংলিশ নভেল পড়েছে, তবে তা-ও শ্রীকান্তের মতোই পাঠ্য তালিকাভুক্ত ছিল, এবং মূল বইগুলো সে জীবনে চোখে দেখেছে কিনা জানি না, কারণ, ডিগ্রী অর্জনের জন্য মূল পুস্তক পাঠ আবশ্যিক ছিল না, আবশ্যিক ছিল পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় টু-দ্য-পয়েন্ট উত্তর প্রদান)। যাহোক, সদ্য উপন্যাস-নেশাগ্রস্ত সজল আরো বেশি বেশি করে উপন্যাস লেখার জন্য সুহৃদ রহমানকে অনবরত মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রয়োগ করে আসছে। ওদিকে ওর বউ নাকি স্খলন পড়ে হাসতে হাসতে হার্টফেল করতে বসেছিলেন- গোপাল ভাঁড়ের কৌতুক নক্সাকে এ বই হার মানায়। ভাবী সাহেবার সামান্য হার্টের রোগ আছে; দম-ফাটানো হাসি হৃদ-রোগের মহৌষধ- বেশি বেশি হাসি পেতে তিনি নাকি বিশবার স্খলন পাঠ করেছেন। এ অবশ্য সবই আমার শোনা কথা- সজলের কাছ থেকে শুনেছি।
জাহিদ- সদ্য বিদেশ ফেরত সুদর্শন কুমার। সে বিয়ে করতে পাগল, কিন্তু মনের মতো পাত্রী পায় না। যে-বাড়িতে একাধিক যুবতী কন্যা আছে, সেখানে পাত্রী দেখতে গেলে গণ্ডগোল বেঁধে যায়। আসল পাত্রী তো বটেই, অন্য মেয়েরাও গোপনে প্রেমপত্র চালাচালি করতে থাকে- এতোসব মজা করতে করতে ওর ভালোই দিন-মাস-বছর কেটে যাচ্ছে। এমন ভাগ্য যাদের তাদের আর বিয়ের দরকার নেই। সে জীবনে দেশি-বিদেশি প্রচুর লেখকের অসংখ্য বই পড়েছে; স্কুল-জীবনে আমরা ওর কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েছি। বই পড়া যেমন ওর নেশা, তেমনি সে গান গায়। ওর খালি গলায় গাওয়া গান শুনে আমরা মুগ্ধ হয়ে ভাবি, এমন রত্ন দেশে থাকতে আমাদের গানের দশা এমন কেন! কিন্তু তবলা-হারমোনিয়ম-বাদ্যযন্ত্রযোগে মাইকে ওর গান বড়ই বিশ্রী শোনায়। স্কুলে গানের প্রতিযোগিতায় সে হেঁড়ে-গলা সুহৃদ রহমানের চেয়েও কম নম্বর পেয়ে বাইশ জন প্রতিযোগীর মধ্যে বিশতম স্থান অধিকার করেছিল। আসলে জাহিদের সমস্যা হলো, বেশি মানুষের সামনে সে গান গাইতে পারে না। তবে ওর ভিতরে একটা দারুণ জিনিস আছে- তা হলো কবিতা। ও কথায় কথায় কবিতা আওড়ায়। একে তো সুদর্শন, তার ওপর মুখে ফোটে কবিতার খই, মেয়েরা ওর জন্য পাগল হয়ে যায়। সুহৃদ রহমানের জ্ঞস্খলনঞ্চ পড়ে সে বললো, বইটি অসম্ভব ভালো হয়েছে, একশোতে একশো দিলে স্বজন-প্রীতির অভিযোগ উত্থাপিত হবার সমূহ সম্ভাবনা; তাছাড়া এটা একটা সাহিত্য- পরীক্ষার খাতায় সাহিত্যে বড়জোর ৬৫ পার্সেন্ট নম্বর দেয়া হয়ে থাকে- Suhrid Rahman, my nearest dearest and closest ‘Blossom Friend’ has really impressed me by his ‘Skhalan’. I would like to give him a little more marks than others would do, that is, he gets ‘pure’ sixty six from me. জাহিদ ওর মেয়ে-বন্ধুদের মাঝে প্রচুর স্খলন বিতরণ করেছে। ওর দুই ভাই ও দুই ভাবী, তিন বড় বোন ও তিন দুলাভাই, এক ভাগ্নে, দুই ভাগ্নি, তিন ভাতিজি প্রত্যেককে সে একটি করে স্খলন উপহার দিয়েছে। সর্ব সাধারণ্যে ওর গর্ব- আমার এক বন্ধু আছে যে উপন্যাস লিখতে জানে- তার নাম সুহৃদ রহমান।
পিংকি- সে ডিভোর্সি, কিন্তু তার চেহারায় বাঙ্গালি বিধবা নারীর চিরন্তন মলিনতা বা দুঃখের ছাপ নেই। তার হাল-হকিকত আর চলাফেরা, সর্বোপরি তার পোশাক আশাক দেখে তাকে যেমন বিধবা মনে হয় না, আবার তার বয়সও ঠিক ঠাওর করা যায় না। সে যৌবন ধরে রাখতে চায়। তার আট বছরের একটি মেয়ে আছে, মেয়েটি দাদী এবং নানীর আদরে বড় হয়। সে বড্ড স্বাধীনচেতা, সেজন্য বিয়ের দু-বছরের মাথায় স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বারের জন্য স্বামী নামক শৃঙ্খলে সে নিজেকে জড়ায়নি। অবশ্য, যদ্দুর শুনেছি, খুব একটা দেখিনি, স্বামীর সাথে সে কখনো স্বামীর মতো ব্যবহার করেনি, করেছে বন্ধুর মতো। ওরা পার্কে যেত, সংসদ ভবনে যেত, বাদাম খেতে খেতে বসে বসে গল্প করতো, মনে হতো এক যুগল নতুন প্রেমিক-প্রেমিকা। আমরা একত্রে আড্ডায় বসলে পিংকি আজকাল বেশির ভাগ সময় জাহিদের পাশে ওর কাঁধে হাত রেখে বসে। মাঝে মধ্যে পিঠে বা ঘাড়ে চাপড় মারে যেমন আমি বা আমার মতো ছেলেরা অন্য ছেলেদেরকে মেরে থাকি। পিংকি খুব খেয়ালি মেয়ে। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমরা কেউ তেমন একটা কিছু করি না। ও যদি বলে, চল করিম, সাভারে সমৃতিসৌধ ঘুরে আসি, আমি যদি বলি আমার বউ আছে, ও তখন একটা ঝামটা দিবে এবং নিরেট একাকী সাভারের উদ্দেশ্যে বাসের হাতল ধরে ঝুলে হলেও যেতে থাকবে। তবে ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি হলো ওর বড় মামা, যিনি এগারো বার প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে আমৃত্যু চিরকুমার থাকার ব্রত নিয়ে এখন ঘুরে বেড়ান। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি পিংকিকে নিত্য পরামর্শ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকেন। তিনি অবশ্য একজন বিশিষ্ট পাগল হিসাবে পরিবারে অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। পিংকি খুবই ফ্যাশন দুরস্ত। সেলোয়ার কামিজ সে কদাচিৎ পরে, আমাদের স্কুলে কোন মেয়ে কখনো শাড়ি পরে আসেনি, পিংকিকেও দেখিনি; তার সাধারণ পোশাক হলো জিনস আর টি-শার্ট। ওর এ ধরণের পোশাক জাহিদের খুব পছন্দ, পিংকিও এ পোশাকেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কারণ এতে ওড়না পরার ঝামেলা নেই, সবাই ভাবে সুপার সমার্ট ওয়েষ্টার্ন গার্ল। পিংকি লিপস্টিক মাখে না ঠোঁটে, কিন্তু ওর ঠোঁট এতোই রাঙা যে দেখলেই লিপস্টিক মাখা বলে ভ্রম হতে পারে। পিংকি সুন্দরী, এমন সুন্দরী যে স্কুল জীবনে ওর জন্য আমাদের মাথায় সারাক্ষণ চক্কর লেগে থাকতো। আমাদের ঘোর এখন কেটেছে বইকি, তবে জাহিদের খবর জানি না। জাহিদ ওকে ওয়েষ্টার্ন ডিটেক্টিভ পড়তে বলে। গাঁও গেরামের স্টাইলিশ মেয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকেই পুরো ওয়েষ্টার্ন বনে গেছে- পাশের জন্য সে ক্লাসের বই পড়তো। সে অন্য বই পড়ে না, মেয়ে-বন্ধুদের নিয়ে ছেলে-বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত দোয়েল চত্বরে, পাবলিক লাইব্রেরিতে, টি.এস.সি-তে। মেয়ে-বন্ধু আর ছেলে-বন্ধু কথা দুটিকে সে আর মানে না- সে বলে বন্ধু বন্ধুই- স্রেফ ফ্রেন্ড। ছেলে আর মেয়েতে বিভেদ কেন? সে নর-নারীর সমান অধিকার নিয়ে বিতর্ক সভা করে, তার দল জয়লাভও করে। সে তর্কে খুব পটু। সুহৃদ রহমানের স্খলন বের হবার পর সে স্খলনভক্ত হয়ে উঠলো। তার হাতে সর্বদা একখানা স্খলন থাকে, বসে থাকলে তার পাতা উল্টায়, ঠোঁট বিড়বিড় করে পড়ে। আমি ভাবি, বাঃ, মেয়েটা কী দারুণ পড়ুয়া!
হারুন- ও বলেছিল, বিয়ের আগে বউয়ের সাথে পাক্কা দশ বছর 'অবৈধ প্রেম' করবো। আশ্চর্য মানুষের ভাগ্য, কলেজে পা দিয়েই সে এক ষোড়সী বালিকার প্রেমে পড়ে যায়, তা-ও সেই প্রেম মাত্র দুই মাস বারো দিন স্থায়ী হয়েছিল। প্রেমের দহনে তার জীবন সংশয় দেখা দেয়- শংকিত মা-বাবা আদুরে পুত্রের জীবন রক্ষার্থে দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। ওর বউ বড্ড সুন্দরী- ওরা এক সাথে কলেজ করতো, আমরা ওদের কলেজ করা দেখে মর্মে মরে যেতাম। হারুনের পরিবারে একটা স্খলন আছে, ওটি বেশির ভাগ সময়ে ওদের তিন বছরের মেয়ে টুনির হাতে থাকে- স্খলন টুনির খুব প্রিয় খেলনা, এর সুন্দর মলাটটা ওকে খুব আকৃষ্ট করে। টুনি অকারণে কাঁদলে, বা ওরা দুজন স্ব-কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লে টুনিকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাতে জ্ঞস্খলনঞ্চ ধরিয়ে দেয়। টুনি ওটা আছাড় দেয়, লাথি মারে, মাথায় নিয়ে টুপি পরার মতো পরে, ওর মুখের লালা জড়িয়ে যায় বইটিতে; খেলতে খেলতে হাসতে হাসতে টুনির সময় চলে যায় খুব ভালোই। সুহৃদ হারুনকে আরো একটা স্খলন দিতে চেয়েছিল। ভাবী বলেছিলেন, একটায়ই হবে, আগে তো টুনি পড়তে শিখুক।
পিয়াল- ওর জীবনের লক্ষ্য ছিল সে ভার্সিটির প্রফেসর হবে, কারণ ও ভাবে ওর জ্ঞান খুব বেশি, প্রফেসর হতে পারলে একজন বুদ্ধিজীবী হিসাবে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারবে। ও এখন ব্যবসা করে। তবে ভাব-সাবে মনে হয় সে সত্যিকারেই একজন প্রফেসর- কথায় কথায় যার তার সাথে সে ইংলিশ মেরে থাকে- ভাবখানা এই, ইংলিশই তার মাদার টাং, বাংলায় কথা বলতে খুব কষ্ট হয়। অবশ্য ওর অশুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষায় পীড়াদায়ক ইংলিশ মারা দেখে সজল আর কৌশিক, এমনকি জাহিদও কেবল মুখ টিপে হাসে। নারী-সঙ্গ ওর একটা বিশেষ শখ এবং নারীদের কাছে সে নিজেকে অবিবাহিত বলেই জাহির করে থাকে। ওর পরীর মতো ফর্সা ও রূপবতী বউটি চান না যে আমরা পিয়ালের সাথে মিশি। তাঁর ধারণা, আমরা সবাই উচ্ছন্নে গেছি, পিয়াল এ দলে ভিড়লে নির্ঘাত নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা অবশ্য চান্সে আছি, একদিন তাঁকে একটা উচিৎ এবং কঠিন শিক্ষা দিবই দিব। পিয়ালের বই পড়ার একটা চমৎকার পদ্ধতি আছে। যে কোন উপন্যাস পড়ে শেষ করতে ওর দশ মিনিটের মতো সময় লাগে। প্রথম পৃষ্ঠাটা সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে, বইয়ের মাঝামাঝি পৃষ্ঠা থেকে কয়েক লাইন এবং শেষ পৃষ্ঠার শেষ অনুচ্ছেদ- ব্যস, পুরো গল্প সম্বন্ধে তার সম্যক ধারণা হয়ে গেল। পিয়াল বলে, বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে হয় নাকি, কাজ কর্ম নাই? মাথায় ঘিলু থাকলে এক দুই পৃষ্ঠা পড়েই একটা বই সম্বন্ধে সব জানা যায়। সুহৃদ রহমানের ১৪৪ পৃষ্ঠার জ্ঞস্খলনঞ্চ হাতে নিয়ে সে বললো, এটাকে কী বলবো? ছোটগল্প, নাকি প্রবন্ধ? আমার মেজাজ চড়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ১৪৪ পৃষ্ঠার ছোটগল্প হয় চৌদ্দ জনমে কোনদিন শুনেছিস? পিয়াল বলে, কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাতকাহন, চরিত্রহীন, পূর্ব-পশ্চিম- একেকটা বইয়ের পৃষ্ঠা পাঁচশো, সাতশো, এক হাজার করে, আর স্খলন হলো কত ছোট, মাত্র তো একশো পৃষ্ঠার সামান্য বেশি। এতো ছোট উপন্যাস হয় নাকি? আমি বললাম, শেষের কবিতার সাইজ কতো বড় জানিস? পিয়াল বলে, ওটা তো রবীন্দ্রনাথের লেখা। ও- রবীন্দ্রনাথ ছোট উপন্যাস লিখতে পারবেন আর সুহৃদ রহমান তা পারবেন না, না? বলে পিয়ালকে মৃদু ভর্ৎসনা করি। যাহোক, পিয়াল বইটি ওর বাসায় নিয়ে দশ মিনিটেই শেষ করেছে, ওর বউকেও বইটি সে দেখিয়েছে। ভাবীজান এই একটা ব্যাপারে খুব প্রসন্ন হয়েছেন। তিনি পিয়ালকে খোঁচা মেরে বলেছেন, তোমার বন্ধুরা বই লিখে ফেলেছে আর তুমি বসে বসে কী করছো? তুমিও বই লিখতে লেগে পড়ো। দেখা হলেই পিয়াল আজকাল বলে, সুহৃদের মতো আমিও লিখবো- I will write a very big and ‘dangerous’ book- that will be five times larger than bloody Skhalan. আমি বলেছি, তা তো হতেই পারে, তোর বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠাটি লেখায় ভরা থাকবে, মাঝখানের এক পৃষ্ঠায় কয়েক লাইন, আর শেষের পৃষ্ঠায় গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ- বাকি পৃষ্ঠা ফকফকা সাদা। এভাবে সব্বাই এক হাজার পৃষ্ঠার বই লিখতে পারে। আমার কথায় পিয়াল দাঁত কটমট করে তাকায়।
নায়লা অতি প্রাণচঞ্চল মহিলা। সে একটা বিরাট বাড়িওয়ালা স্বামী পেয়েছে, যাঁর টাকার হিসাব নাকি তাঁর নিজেরই জানা নেই, (অবশ্য নায়লাই বলেছে, বলার সময় স্বামী-গর্বে ওর বুক স্ফীত হয়)। বাড়িটি অবশ্য নায়লার স্বামী শাহজাহন সাহেব পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। তাঁর বাবা কোন এককালে খুব গরীব ছিলেন, রেস্তরাঁয় বাবুর্চির কাজ করতেন। বাবুর্চি হিসাবে নাম করতে করতে এক সময় দেখা গেল তিনি ঠিকই বাবুর্চি রয়ে গেছেন, তবে মাঝখান থেকে তাঁর একটা রেস্তরাঁও হয়ে গেছে। সেই রেস্তরাঁ একতলা থেকে বড় হতে হতে দোতলা, তিনতলা, বর্তমানে পাঁচতলা হয়েছে। নিচতলায় হোটেল, তৃতীয় তলায় নিজেরা থাকেন, বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়ায় চলে। ইচ্ছে করলে শাহজাহান সাহেব অনায়াসেই এটাকে চাইনিজ রেস্তরাঁ করতে পারেন, কিন্তু করেন না। তিনি বাবার মনের ইচ্ছেটা ধরে রেখেছেন। তাঁর বাবা খুব সাধারণ এবং না-শিক্ষিত লোক ছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য হোটেল করেছিলেন, সাধারণ মানুষকেই খাওয়াতেন, অন্য হোটেলের চেয়ে কমপক্ষে শতকরা দশ টাকা হারে কম দাম রাখতেন, যেমন শাহজাহান সাহেব নিজেও করেন এবং বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রেও তা করে থাকেন। শাহজাহান সাহেব খুব আড্ডাপ্রিয় এবং আড্ডাবাজ, প্রতি সপ্তাহেই আমাদের জন্য পার্টির আয়োজন করতে চান তিনি। কিন্তু নায়লার জন্য তা পারেন না। আমার ধারণা, স্বামীর ঘরের টাকা আমাদের পেছনে খরচ করতে নায়লার বুকে খুব বাঁধে। ওর এই গর্বের একটা ধ্বস কবে দেখবো- আমরা এই প্রতীক্ষায় আছি। ওর দুরন্ত দুই ছেলের জন্য অবশ্য বাসায় গিয়ে আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। বুকে, পিঠে, মাথায় ওদের কিল-ঘুষি, লাথি আর ধস্তাধস্তিতে আমাদের প্রাণান্ত হয়- ওরা মনে করে যে আমাদের শরীর লোহার তৈরি, এতে কোন ব্যথা লাগে না। নায়লা খুব বই পড়ে। জাহিদের মতো সে-ও যে কোন বই পড়ে লেখককে নম্বর দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত সে যতোগুলো উপন্যাস পড়েছে তার মধ্যে সবচাইতে কম নম্বর পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষের কবিতা উপন্যাসের জন্য। তিনি একশো নম্বরের মধ্যে শূন্য পেয়েছেন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় ওর জনৈনক গৃহ-শিক্ষক ওকে শেষের কবিতা পড়তে বলেছিলেন, এটা নাকি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস। সে ওটা পড়ে এক বিন্দু মজা পায়নি, এবং সাথে সাথে বিরক্ত হয়ে, বরং গৃহ-শিক্ষকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সে রবীন্দ্রনাথকে এই নীরস উপন্যাস লেখার জন্য শূন্য দিয়েছিল। তবে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত লেখকও কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শেষের কবিতার এতো গুণগান আর নামডাক কেন, এটা নিয়ে কপোত-কপোতীদের মধ্যে এতো হৈ চৈ কেন- এই রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে সে কম করে হলেও তের বার শেষের কবিতা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সে বলেছে, শেষের কবিতার মতো বই-ই হয় না। আহা, বেচারা বেঁচে নেই, থাকলে তাঁকে একশোতে পুরো একশো সাথে আরো একশো বোনাস নম্বরসহ মোট দুইশো নম্বর প্রাপ্তির একটা অভিন্দন পত্র সে রবীন্দ্রনাথকে পাঠাতো। গৃহ-শিক্ষক তাকে যে মিথ্যা বলেননি কেবল এজন্যই সে তাঁর প্রেমে পড়ে যায় এবং গভীর ভাবে একটি চুম্বন উপহার দিয়ে তাঁকে বিয়ে করে; এখন সে দু-সন্তানের জননী হয়েছে। ও আজকাল এতোই বই পড়ে যে মাঝে মাঝে স্বামীর চেয়ে বই ওর কাছে বেশি প্রিয় মনে হয়। সুহৃদ রহমান নায়লার কাছে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লেখক- প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথের পরেই তার অবস্থান। নায়লা তাকে একশোতে আশি নম্বর দিয়েছে, যদিও কোন বোনাস দেয়া হয়নি। সে বলেছে, পরবর্তী বইয়ে তাকে অবশ্যই বোনাস দেয়া হবে, সুহৃদ যেন এ ব্যাপারে বেশি চিন্তা না করে। যে গৃহ-শিক্ষকের কথায় নায়লা একদিন বই পড়তে শুরু করেছিল, সেই শাহজাহান সাহেব কিন্তু এখন বই পড়েন না। এজন্য তাঁকে খুব একটা দোষও দেয়া যায় না, কারণ, তাঁর পড়ার সময় এখন খুব একটা নেই, অপর দিকে তিনি একজন হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী, সর্বদা মাথা ও ঘাড়ের ব্যথায় অস্থির থাকেন, বই পড়তে গেলে সেই ব্যথা হুহু করে বাড়তে থাকে, চোখে নানা বর্ণের সর্ষে ফুল দেখেন। কিন্তু তিনি একটা দারুণ কাজ করেছেন। তাঁর হোটেলের প্রবেশ দ্বারে এবং ক্যাশবক্সের পেছনের দেয়ালে স্খলনের কভার পৃষ্ঠাগুলো সুন্দর করে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছেন, তার নিচেই একটি বুকশেল্ফ, সেখানে তিনটি বই ডিসপ্লে করা আছে। খদ্দেরগণের কাছ থেকে বিল গ্রহণের ফাঁকে ম্যানেজার সাহেব গর্বের সাথে প্রায়ই বলে থাকেন- এই যে বইটি দেখতে পাচ্ছেন, এটা একজন বিখ্যাত লেখকের বই, যিনি আমার মালিকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু- তাঁর সাথে মাঝে মাঝেই আমার দেখা হয়- তিনি আমাকে এক নামে চেনেন- এই বাসায় প্রায়ই আসেন তো!
এই 'চারদিকে'র আওতায় আরো যারা পড়েন তাঁরা হলেন আমাদের কয়েকজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, শিক্ষক-পত্নী, যেমন- সফিকুল ইসলাম স্যার, মাবুদ স্যার, প্রমুখ। সফিক স্যার বই হাতে পেয়ে খুব তারিফ করেছেন- ভালো, খুব ভালো- তোমরা যদি বই না লিখ তবে কারা লিখবে? তোমরাই তো আগামী দিনের নজরুল-রবীন্দ্রনাথ। সফিক স্যার ব্যস্ত মানুষ, সারাদিন অংক আর রাসায়নিক সমীকরণ নিয়ে গবেষণায় মগ্ন থাকেন, স্খলন পড়ার সময় তাঁর নেই। তবে সফিক স্যারের বউ নাকি এই এক স্খলন এক সপ্তাহে তিনবার পড়েছেন। বই পড়তে পড়তে তিনি আপন মনে হেসে ওঠেন, আবার আপন মনেই কাঁদতে থাকেন। যুগপৎ হাসি-কান্নার উপাদানে ভরপুর এমন বই নাকি বাজারে খুবই বিরল।
সুহৃদের বই নিয়ে হৈ চৈ করা ছিল কতো স্বাভাবিক, কিন্তু একবারও মুখ খোলেনি- আমাদের এমন অন্তরঙ্গ বন্ধুও কিন্তু আছে। সে-কথা যথাসময়ে হবে। সময় হলে বা সুযোগ এলে আমার কথাটিও বলা যাবে।
হৈচৈ-এ মত্ত চারদিকের আওতায় অবধারিতভাবে যাঁদের নাম উচ্চারিত হয় তাঁরা হলেন কনক ইসলাম, আরেক নব্য কবি ইমন মজুমদার, শহীদ খোনকার এবং বিনয়ী ও মুচকি হাসির স্বত্বাধিকারী, চাষী কবিতাপত্র খ্যাত কবিসম্পাদক প্রদীপ মিত্র।
তিনি একজন জনদরদী কবি, সারাদেশের তরুণ-তরুণীদেরকে কবি বানাবার মহৎ বাসনায় তিনি একটি সংসদ-ভবন গড়েছেন; এক পক্ষ পর পর অতি উৎসাহী উদীয়মান কবি-কবিনিগণ তাঁর সংসদে এসে কবিতার ডালি নিয়ে উপস্থিত হোন; সবাই কবিতা পাঠ করেন, অপরের কবিতা ও সরব গুঞ্জন মনোযোগ দিয়ে শোনেন, নব নব সাহিত্য রচনার গম্ভীর ভাব-রসের সঞ্চার হয়, আরো আরো উৎকৃষ্ট কবিতার জন্ম হয় তাঁদের হাতে। তিনি যদিও প্রকাশক, তবে কবি ও ছড়াকার হিসাবেই তিনি খ্যাতি পেতে চান। তাঁর খ্যাতি ও যশ এই বয়সেই অনেক নামীদামী কবিসাহিত্যিকদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছে, তাঁর এই অকালে প্রাপ্ত এতো খ্যাতির মূলে রয়েছে একটি মাত্র কারণ- তা হলো তাঁর মুখে সর্বদা লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটুকু। প্রথম দিন, তাঁর সাথে আমাদের কথা ও পরিচয় হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে, একটি মেয়ের সাথে তাঁকে সহাস্যে কথা বলতে দেখে আমাদের মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই এই মেয়েটির সাথে তাঁর কোন গভীর ও গোপন ভাব রয়েছে; তাঁর ও-রকম হাসি সেই নিকটতম ও প্রিয়তম মানসী ছাড়া আর কারো জন্য নিবেদিত হতে পারে না। কিন্তু আমাদের সাথেও তিনি একই হাসির ফোঁয়ারা ছুঁড়ে দিতে শুরু করলেন। তখন বুঝলাম, তাঁর এ হাসি অতি সহজাত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকেই তিনি তা জ্ঞঅকাতরেঞ্চ উপহার দিয়ে থাকেন। আপনারা তো জানেন আমি কার কথা বলতে চাইছি; হ্যাঁ, তিনিই কনক ইসলাম। তিনি যাকেই সামনে পান বলেন, সুহৃদ রহমানের স্খলন পড়েছেন? এ এক অসাধারণ উপন্যাস, এই বয়সেই কি সাংঘাতিক এক উপন্যাস লিখে ফেলেছেন তিনি- আপনারা দেখবেন উনি এদেশের একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠবেন, আর বেশিদিন বাকি নেই। কনককে যিনি টেনে তুলছেন তিনি কবি প্রদীপ মিত্র- আমি লক্ষ্য করি, এক আশ্চর্য দরদ দিয়ে তিনি সুহৃদ রহমানকেও টেনে তুলতে কতো চেষ্টা করছেন। যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখককে সামনে পেলেই তিনি সুহৃদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে তাঁর সামন দাঁড় করান, বলেন, আমার ছোট ভাই সুহৃদ রহমান একটা বিখ্যাত বই লিখেছে, বইটি পড়ে দেখবেন। শহীদ খোনকার এবং ইমন মজুমদার- কবিতা লিখেন, সারাদিন ব্যস্ত থাকেন, সুহৃদের লেখা পড়বার কোন সময় তাঁরা পান না, তবে কারো মুখে সুহৃদের কোন প্রশংসা শোনামাত্র তাঁরা তা অনতিবিলম্বে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। কনকের সংসদ-ভবনে দূর-দূরান্ত থেকে কবি-লেখকগণ আসেন। কনক তাঁদের প্রত্যেককেই বইটি পড়তে দিয়েছিলেন। তাঁরা খুবই বিশ্বস্ত পাঠক। অল্পদিনেই বই পড়ে তাঁরা সুহৃদ রহমানকে মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া জানানঃ
আপনার উপন্যাসটি পড়ে মনেই হয়নি যে এটা আপনার প্রথম উপন্যাস।
আপনি নিজেকে নবীন লেখক বলছেন কেন? আর কোন বই না লিখলেও বাংলা সহিত্যে আপনার একটা পাকাপোক্ত সহান থাকবে।
আপনার বইটির নামটা অত্যন্ত চমৎকার, কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী। নামকরণটিকে অত্যাধুনিক বললে কম বলা হয়, এটি আধুনিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে।
একদম খরার দিনেও কনকের বুকস্টলের ভিতরে কিংবা সামনে উপচে পড়া ভিড়। যারা এসে ভিড় করে তারা সবাই কিন্তু আমাদেরই বন্ধু-জ্ঞাতি-গুষ্টি, আর কনকের সংসদ-সদস্য। তাদের প্রত্যেকের হাতেই থাকে একটি-দুটি করে স্খলন।
বইয়ের পাতা নাড়ে কেউ। হাত পাখার মতো করে কেউ বাতাস খাওয়ার ভঙ্গি করে, কিন্তু খায় না, শীতকাল বলে। দুজনে সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বই খুলে বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে জোর করে হাসে, ভাবখানা এই যে এতে দম-ফাটানো হাসির কথা আছে; তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যাবলী আওড়ায় এবং কুশলী লেখার তারিফ করে, ভাবখানা হলো এতে অতি গভীর জীবনবোধের কথা লেখা হয়েছে।
এই বইটির তারিফ করার আরো একটা বিশেষ বিষয় আছে। নবীন লেখকদের বইগুলো নাকি সাধারণত ৩২ পৃষ্ঠা, ৪৮ পৃষ্ঠা বা বড়জোর ৬৪ পৃষ্ঠার হয়ে থাকে। কেবল নবীন লেখকদের কেন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক এঁদের প্রায় বই-ই তো ৬৪ কিংবা ৮০ পৃষ্ঠায় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু একটা জিনিস বটে, সুহৃদের বইটি পাক্কা ১৪৪ পৃষ্ঠার। কোন একটা দৈনিক, যার নাম আমি বইমেলায়ই প্রথম শুনেছিলাম- সেখানে লিখেছিল- এই সুবৃহৎ বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন.........। মর্মান্তিক বিষয় হলো সুহৃদের নামটি সেখানে ছাপা হয়নি। দৈনিক পত্রিকায় তার নাম ছাপা হয়নি তাতে কী, তার এতোগুলো বইয়ের ওপর তো নিজের নামটি ছাপা হয়েছে! ঐ অখ্যাত-অজানা দৈনিকে নাম ছাপা না হলেও ক্ষতি নেই। তারপরও ঐ পত্রিকার প্রতি সুহৃদের কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটটি বই দেয়া হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টারগণকে, যে কেউ এসে কোন এক পত্রিকার প্রতিনিধি বলে পরিচয় দিলেই তাঁর হাতে বই তুলে দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য- এঁরা এঁদের পত্রিকায় নতুন বইয়ের তালিকায় লিখবেন- স্খলন। ব্যস, এতোটুকুতেই সারবে। সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ সেই বইটির নাম পড়বে, লেখকের নাম জানবে। কিন্তু অন্য কোন পত্রিকায়ই সুহৃদের বইয়ের খবরটি ছাপা হয়নি। পত্রিকাওয়ালারা বিনে পয়সায় বই পেয়ে এতোখানি নির্দয় কী করে হতে পারলেন? তাঁদের ওপর সুহৃদের দারুণ ক্ষোভ।
স্খলনের সুদৃশ্য প্রচ্ছদ আর মনোরম মলাটের ছটায় চোখ ঝলসে যায়। কিন্তু এতো সহজেই এরূপ মিলেনি, এর পেছনে রয়েছে এক হৃদয়-বিদারক ও কষ্টদায়ক ইতিহাস।
আমাদের বন্ধু-বান্ধবীরা সবাই স্খলন ও এর জনক সুহৃদ রহমানের অনেক স্তূতি গেয়েছে, কিন্তু এর সাথে লেগে থাকার মতো ধৈর্য্য কিংবা দক্ষতা অন্য কারো ছিল না।
উপন্যাস লেখার শুরু থেকে ছাপা, বিলি পর্যন্ত সাবর্ক্ষণিক আমি সুহৃদের পাশে ছায়ার মতো থেকেছি। সেই সময়ে মানুষ কখনো বা ভেবেছে আমিই বইটির জনক। অনেকে আমাকে ওর প্রাইভেট সেক্রেটারিও ভেবেছে হয়তো। আবার যখন ময়লা হয়ে যাওয়া কিংবা ছেঁড়া-ফাটা জামা পরেছি, কেউ হয়তো ভেবেছে আমি ওর কাজের লোক।
সে যাকগে। বই ছাপানো একটা বিরাট বিস্ময়কর ব্যাপার। বই ছাপা হবে, হাজারে হাজারে বই ছাপা হবে- দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিক্রয় কেন্দ্রে ওগুলো পৌঁছে যাবে- বইখেকো তরুণ-তরুণীরা বই কিনতে গিয়ে দেখবে স্খলন নামক একখানা সুবৃহৎ বই বাজারে বেরিয়েছে যার রচয়িতা সাগর রহমান। কে এই রত্নটি? মুখে মুখে দেশ জুড়ে সাগর রহমানের নাম ছড়িয়ে পড়বে। পত্রিকাওয়ালারা সাগর রহমানের খোঁজে এসে জানতে পারবেন ওটা আসলে তার ছদ্ম নাম, আসল নাম হলো সুহৃদ রহমান। সাগর রহমান আর সুহৃদ রহমান- দুই নামে সে তরতর করে খ্যাতির শিখরে উঠতে থাকবে।
খ্যাতির লাগিয়া, উপন্যাস, প্রকাশিত একুশে বইমেলা ২০০৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-২
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৩
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




