একজন নবীন লেখকের প্রথম বই ছাপা হবার 'সকরুণ' ইতিহাস
আমার পরের পেশাটি ছিল বড় অদ্ভূত। বিকালে ঘোরাঘুরি করি, পাশের গাঁয়ের এক লোকের লন্ড্রিতে গিয়ে বসি, নিজ হাতে নিজের কাপড় বিনে পয়সায় ডলে আনি। এভাবে একদিন দেখি বেশ ভালোই ডলতে পারি।
ঠাট্টার ছলে কাজটি শুরু করি। বলি, আপনার লন্ড্রিতে আমি পার্টটাইম কাপড় ইস্ত্রি করবো। শুনে আমার ভাইটি মাথায় হাত দিয়ে বলেন, সর্বনাশ, কও কী?
আমি হাসিমুখে তার পরের দিন থেকে নিজের লন্ড্রির মতো কাজ শুরু করে দিলাম।
এভাবে দিন চলে যেতে থাকে- খায়ের কাপড় কাঁচে, আমি তিনবেলা খাবারের জন্য একবেলা রান্না করি, লন্ড্রিতে পার্টটাইম ইস্ত্রির কাজ করি; স্বপন জ্ঞমনের দুঃখেঞ্চ খায়-দায় আর কাঁদে, ওর পড়ায় মন বসে না, রাতে ঘুম আসে না- আমরা শুয়ে পড়লে সে বের হয়ে পাশের এক খোলা মাঠের মাঝখানে গিয়ে চিৎ হয়ে অবশের মতো পড়ে থাকে, তারপর করুণ সুরে গান গাইতে থাকে- চলে যায় যদি কেউ বাঁধন ছিঁড়ে, কাঁদিস কেন মন? অধরা বলেছিল, সে স্বপনের জন্য আমরণ অপেক্ষায় থাকবে, কিন্তু সে কথা রাখেনি। অধরা বলেছিল, স্বপনকে না পেলে সে এই জীবনটাই রাখবে না- কিন্তু তা ছিল শুধু মুখের কথা। কানাডা-প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পেয়ে অধরা হাসিমুখে বিয়ের পিঁড়িতে পা দিয়েছিল, একবারের জন্যও স্বপনের কথা মনে পড়েনি। মেয়েরা এতো নিষ্ঠুর কেন হয়?
নিপার বিয়েতে না-যাওয়াটাই ছিল আমার জন্য বেমানান, কারণ সে আমাদের বন্ধুর বোন, একই বাসা থেকে স্বপন আর খায়ের যদি যায় আমি যাব না কেন? ছোটলোকির একটা সীমা আছে।
কৌশিকদের বাড়িতে গিয়ে ওরা সবাই কতো সহজভাবে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগলো, অথচ আমার শরীর যেন ঠাণ্ডা পাথর, একচুল নড়ানো যায় না, মুখ ভীষণ আড়ষ্ট, কথা বের হয় না। ওদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর কৌশিকের সাথে দেখা হলে সে কথার কথা জিজ্ঞাসা করেছিল, বাসা থেকে চলে এলি কেন? চল ফিরে যাই। ফিরে যাওয়ার কথাটি সে জোর দিয়ে বলেনি, জোর দিয়ে বললেও যে আমি ফিরে যেতে পারি না তা আমি জানি; কিন্তু কৌশিক কি তা জানে?
শিমু আপার জন্য এটা খুবই বেদনাদায়ক ছিল, কৌশিকরাও ছিল নিরুপায়। পঙ্গুত্বের জন্য বড়বোনের বিয়ে হচ্ছে না, তাঁর জন্য ছোটবোনের বিয়ে আটকে রেখে তাকে আইবুড়ো করার কোন অর্থ নেই। উপযুক্ত পাত্র পাওয়া মাত্র নিপার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যায়।
শিমু আপা তাঁর বেদনা নিয়ে নিজের ঘরে বসে চুপচাপ 'কাঁদতে' পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। তিনি উচ্ছ্বল হাসি-তামাশায় তামাম বাড়ি মাতিয়ে রাখছেন, যেন তাঁর কোন এক বড় ভাই বা বোনের বিয়ে, তাঁর আনন্দের সীমা নেই। আমি এবং আরো অনেকেই বুঝতে পারছিলাম, এটা তাঁর মনের কষ্ট আড়াল করার একটা কৌশল মাত্র।
সবাই প্রাণ খুলে আপার সাথে ঠাট্টা-রসিকতা করতে লাগলো, কতো ডামাডোল, আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি, একবার দু-বার মাথা উঁচু করে তাকাই, যদিবা আপার সাথে চোখাচোখি হয়। হ্যাঁ, আপার সাথে হঠাৎ হঠাৎ চোখাচোখি হয় বটে, কিন্তু মুহূর্তে তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। তিনি কতোজনকে কতো কথা জিজ্ঞাসা করেন- দুষ্টুমি করে একেক জনের কান টেনে ধরেন, পিঠে থাপড় মারেন, আদুরে ভর্ৎসনা করেন, কিন্তু আমার সাথে কথাও বলেন না, অমন আদরও দেখান না। কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়, গলা ছেড়ে কাঁদতে মন চায়।
অনুষ্ঠানাদি শেষে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় আপা সবাইকে নাম ধরে ধরে বললেন, আবার এসো- আবার এসো কিন্তু। আমি কতো আশায় তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম- এবার বুঝি আপা আমার নাম ধরে ডাকবেন।
আমার বুকের ভিতরটা দুভাগ করে যদি দেখাতে পারতাম, তাহলে আমার নিষ্ঠুর নির্দয় আপা বুঝতেন আমার অন্তরে তখন কতোখানি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আমার আপা এতো নিষ্ঠুর কেন? আমার ভুলের জন্য আমি ক্ষমা চাই, আমি কি পাব না?
শিমু আপা নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবেন না কোনদিন, করলে সেদিন আমাকেও নাম ধরে ডেকে বলতেন, করিম, তুমি আজকাল আর বাসায় আসো না কেন? বাসায় এসো। ওসব তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে কিচ্ছু ভেব না। জীবনে এমন কতো হয়!
চার
আমাদের চারদিক চারদিকে প্রসারিত হতে হতে সত্যিকারের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। সুহৃদের এখন প্রচুর পাঠক ও ভক্ত। ওর বই ছাপানোর পেছনে আমার যতোখানি শ্রম ছিল, ওর খ্যাতি ছড়ানোর পেছনে জাহিদের কৌশল ছিল আরো বেশি প্রশংসনীয়। ও এমনিতেই দারুণ মিশুক, ওর সবখানে বন্ধু, যেখানে যায় সেখানেই ওর বন্ধু জুটে যায়। ও খুব রসিক, বুদ্ধিমানও।
জাহিদের অধিকাংশ বন্ধুরাই অবশ্য মেয়ে- এটা হলো ওর বড় শক্তি। ঢাকা শহরে ওর পঞ্চান্ন জন মেয়ে-বন্ধুকে সে ছাপ্পান্নটি স্খলন বিনামূল্যে উপহার দিয়েছে- (একটা মেয়ে তার অন্য এক বান্ধবীর জন্য একটা বই নিয়েছিল বলে পঞ্চান্নর জায়গায় ছাপ্পান্ন হয়েছে)। তবে পঁয়তাল্লিশ জন ছেলে-বন্ধুর কাছে সে একটা কিনলে একটা ফ্রি নীতিতে নব্বইটি বই বিক্রি করেছে। আমি আর সুহৃদ কোন বইয়ের দোকানে বই দিতে পারিনি, কিন্তু জাহিদের কাছ থেকে তারা নাকি আবদার করে বই চেয়ে নিয়েছে। এই আবদারের কারণও কিন্তু আছে- সে কোনদিন একা বের হয় না, ওর সঙ্গে তেমনি কোন ছেলে-বন্ধু থাকে না, সে বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বই বিতরণে বের হয়, তাতে অভূতপূর্ব কার্যসিদ্ধি হয়। আরো একটা কাজ সে করেছে, নীলক্ষেত মার্কেটের বাইরে বসে যারা পুরান বই বেচে, সে তাদের কাছেও বই দিয়েছে। ফার্মগেটের ওভারব্রীজ, পল্টন, বাংলাবাজার- এসব জায়গায় খোলা ফুটপাতে বসে যারা অল্পদামী বই বেচে, জাহিদ সেসব জায়গায় বই দিয়েছে। ওর বন্ধুদের মাধ্যমে অনেকগুলো রেলস্টেশনের বইয়ের দোকানে সে বই পাঠিয়েছে। শুধু তাই নয়, জাহিদ ওর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং নিজের পকেটের টাকা খরচ করে দেশের প্রত্যেকটা পাবলিক লাইব্রেরি ও অন্যান্য নামকরা লাইব্রেরিগুলোতে এক কপি করে বই পাঠিয়েছে। মজুদ বইয়ের সংখ্যা এখন একেবারে কমে গেছে। তবে সুখকর ঘটনা হলো, সে ঘোষণা দিয়েছে, অতি শীঘ্র স্খলনএর পাঁচশো কপি দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ করতে হবে- জাহিদ নিজেই প্রত্যেক অঞ্চলে ভ্রমণ করবে এবং দেশের আনাচে কানাচে স্খলন ছিটিয়ে আসবে- যদিও কোন রিটার্ন আসার ব্যাপারে সে কোন গ্যারান্টি ঘোষণা করেনি।
বাংলাবাজারে কনকের দোকানে একদিন আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। কি জানি কেন আমার মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল।
কনককে বললাম, সেই নামের লিষ্টটা কি আছে?
কোন্টা- কনক জিজ্ঞাসা করেন।
আমি বলি, গত বইমেলায় আমরা যাদের কাছে বিনামূল্যে বই বিক্রি করেছিলাম তাদের নামগুলো আছে না?
কনক একটু মুচকি হেসে বাইরের রুমে যান এবং কিছুক্ষণ পর তেমনি মুচকি হেসে ভিতরে ঢোকেন। তাঁর হাতে একটা খাতা, আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেন, ফোন-ফ্রেন্ড? সেই সাথে আবারও তাঁর মুচকি হাসি।
কনকের খাতা থেকে একটা নম্বর নিয়ে আমার মোবাইলে ঢোকাই---- ০১৭১৯৪৩০১৩---- রিং যেতে থাকে।
হ্যালো--- একটা অদ্ভূত মিষ্টি কণ্ঠ বলে ওঠে-- কে বলছেন?
আপনি কি নুসরাত জাহান? আমি কাঁপা স্বরে জিজ্ঞাসা করি।
জ্বি বলছি। কাকে চাচ্ছেন?
জ্বি, আপনাকেই।
জ্বি! (নুসরাত জাহানের অবাক প্রশ্ন)
মানে, আমি হলাম--- আমার নাম সাগর রহমান।
সাগর রহমান? চিনতে পারছি না যে!
আসলে--- আপনার কি সেই বইমেলার কথা মনে আছে?
কোন্ বইমেলা?
এইতো, একুশে বইমেলা।
হ্যাঁ, পড়ছে।
বইটা কি আপনি পড়েছেন?
কোন্ বইটা যেন?
ঐ যে-- স্খলন।
স্খলন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সাগর রহমান বলছি, আমিই ঐ বইটা লিখেছি।
ও ইয়েস ইয়েস, একটা মাগনা বই দিয়েছিলেন, তাই না? হ্যাঁ, খু-উ-ব মনে পড়ছে। নাইস টকিং টু ইউ। তো, আপনি কেমন আছেন?
জ্বি ভালো।
আপনার আর কি কোন বই রিসেন্টলি বের হচ্ছে?
না না, এখনো নয়। তো ম্যাডাম, একটা জিনিস জানার জন্য রিং করেছি।
জ্বি অবশ্যই। বলুন।
বইটি আপনার কেমন লেগেছে?
নুসরাত জাহানের কথা হঠাৎ থেমে যায়। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, শুনতে পাচ্ছেন, ম্যাডাম?
ম্যাডাম খুব দুঃখিত স্বরে বলতে থাকেন, আসলে ব্যাপারটা হলো কী--- আমি গত কমাস ধরে খুব অসুস্থ ছিলাম, তাই বইটা পড়া হয়ে ওঠেনি। তবে আমি কথা দিচ্ছি, হ্যাঁ কথা দিচ্ছি, কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু করবো--- হ্যালো---
আমি ক্যাচ করে লাইন কেটে দিই। দু-মিনিটের মাথায় নুসরাতের রিটার্ন কল আসে। আমি কেটে দিই। এরপর আবারো আসে এবং যথারীতি কেটে দিই।
মাগনা আলকাতরার এই যথার্থ ব্যবহারের কথা সুহৃদকে বলা গেল না। কারণ, ওর সাথে তারপর দেখা হওয়া মাত্রই জানতে পারলাম সে এক বিশাল চমক দেখানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্খলনের পুনর্মুদ্রণ নয়, সে পরের বইমেলায় আরো কমপক্ষে তিনটি নতুন বই বের করবে, যার সবগুলোই হলো উপন্যাস। আমি তো অবাক, স্খলন বের হলো ছয় মাসও হয়নি, এর মধ্যে আরো তিনটি বই? এগুলো সে লিখলো কবে? মাছির ডিমের মতো কি ওর পেট থেকে দ্রুতহারে উপন্যাস বের হতে শুরু করলো নাকি? অনিয়ন্ত্রিত প্রজনন!
সুহৃদের পীড়াপীড়িতে এরই মধ্যে ওকে নিয়ে একদিন জাহানারা ম্যাডামের বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি আমাদেরকে দেখে খুব খুশি হলেন। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো তিনি চিনবেনই না, অথচ দেখামাত্র সহাস্যে বলে উঠলেন, আপনারা সাগর রহমান না?
দুজনে একত্রে তো আর সাগর রহমান হওয়া যায় না, তাই আমি দুজনের আলাদা দুটো নাম ম্যাডামকে খুলে বলে নিজেদের আলাদা পরিচয় দেই।
ম্যাডামকে কিছুটা লজ্জিত হতে দেখে আমরাও বিব্রত হই; চোরা চোখে আমি আর সুহৃদ পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করি- খামোখা তাঁকে লজ্জার মধ্যে ফেলে দিলাম। তিনি হয়তো ভাবছেন এতোদিনেও বইটি পড়তে পারেননি বলে আমরা তাঁর সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা পোষণ করছি।
ম্যাডাম সুহৃদের উদ্দেশ্যে বললেন, লেখালেখি কেমন চলছে আপনার?
সুহৃদ খুব আবেগোত্তেজিত স্বরে বলে, খুব ভালো ম্যাডাম।
বর্তমানে কিছু লিখছেন?
জ্বি ম্যাডাম, অলরেডি দুটো নভেল শেষ করেছি।
ম্যাডাম খুশি হয়ে বললেন, আপনি তো দেখছি বেশ ব্যস্ত লেখক!
সুহৃদ আরো অনুপ্রাণিত হয়ে বলে ওঠে, আরো একটা আছে, সেটিও প্রায় শেষের দিকে। একশো ষাট পৃষ্ঠার মতো হয়েছে।
ম্যাডাম মুখ টিপে হাসেন। তারপর বলেন, এটা খুবই প্রশংসনীয় যে আপনি বড় আকারের উপন্যাস লিখতে পারেন। তবে একটা জিনিস মনে রাখবেন--- স্যরি, নিরুৎসাহিত হবেন না তো?
সুহৃদ বসা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, নো নো ম্যাডাম, নেভার। আপনার একেকটা উপদেশ আমার কাছে অতি মূল্যবান।
ম্যাডাম থ্যাংক ইয়্যু বলে বলতে থাকেন, কেউ বলেন প্রচুর কিন্তু কিছুই প্রকাশ পায় না। আবার অনেকের এক কথায় হাজার কথার সমান ভাব প্রকাশ পায়। লেখার ভিতর সর্বদা অপ্রাসঙ্গিকতা পরিহার করবেন। একেক পৃষ্ঠা বা পরিচ্ছেদ লেখা শেষ হলে ওটি বারবার পড়ুন; পড়তে পড়তে নিজের কাছেই জিজ্ঞাসা করুন অমুক অনুচ্ছেদ, বা অমুক বাক্যটি বা কোন একটি বিশেষ ঘটনা বাদ দেয়া হলে সমগ্র গল্পের ওপর তার প্রভাব পড়ে কিনা, কিংবা ঐ অংশগুলো রাখা হলে তা গল্পের জন্য বাড়তি আবেদন সৃষ্টি করে কিনা। অপ্রয়োজনে কোন নতুন ঘটনা সংযোজন করা হলে কেবল পৃষ্ঠা সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু বইয়ের সামগ্রিক গুণগত মান ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে।
ম্যাডামের কথায় সুহৃদ একটু লজ্জিত হয়, বেচারা বড় পুস্তক লেখার ব্যাপারে কতো গর্ব করে, অথচ ম্যাডাম তাকে ফুটো করে দিলেন।
সুহৃদ বললো, এ দোষটা ম্যাডাম আমার মধ্যে খুবই প্রকট। আমি অবশ্য নিজেই বুঝতে পারি যে এ ঘটনাটা গল্পের জন্য তেমন প্রয়োজন নেই, তারপরও একবার লিখে ফেললে সেটা কেটে ফেলে দিতে খুব কষ্ট হয়, মনে হয় নিজের আঙ্গুল কেটে ফেলছি।
ম্যাডাম হেসে দিলেন। বললেন, এটা শুধু আপনারই নয়, লেখক বলতেই এই অভ্যাসটা থাকে। কেউ কেউ অবশ্য ধীরে ধীরে সংযত হয়ে ওঠেন, কেউ কেউ পারেন না। তবে যাঁরা পারেন তাঁরাই কিন্তু গুণী লেখক, এবং তাঁরাই লেখক হিসাবে সার্থক।
সুহৃদ কাচুমাচু করে বলে, আসলে ম্যাডাম সবাই তো আর নিজের প্রকৃত দুর্বলতাটুকু ধরতে পারেন না, যেমন আমিও পারি না, তাই বলছিলাম কি, এখনই নয়, বছর দুই পরে হলেও ক্ষতি নেই, আপনি যখন আমার বইটি পড়বেন দয়া করে একটু পেন্সিল মার্ক করে রাখবেন, কোন্ পৃষ্ঠাটা বা পরিচ্ছেদটা না হলেও গল্পের ওপর কোন প্রভাব পড়তো না, যাতে আমি পরবর্তী বইয়ের জন্য আরেকটু সচেতন হতে পারি।
আমি পড়ে ফেলেছি, ম্যাডাম বলেন, বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়েছি। একজন নতুন লেখক হিসাবে বেশ ভালো লিখেছেন। আপনার লেখায় প্রসপেক্টস আছে। তবে একটা জিনিসের প্রতি আপনাকে অবশ্য অবশ্যই নজর দিতে হবে।
আমি আর সুহৃদ নড়েচড়ে বসি। ম্যাডাম বলেন, বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য এমন কোন জ্ঞভাষাঞ্চ ব্যবহার করবেন না যার দ্বারা আপনার লেখার চিরায়ত সাহিত্যগুণ ক্ষুণ্ন হয়- আশা করি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। অর্থ্যাৎ, আপনার বইটি এমন হতে হবে যা পরিবারের সবাই এক সাথে বসে পড়তে পারে। আমার মতে এমন নির্মল গল্পই সত্যিকারের সাহিত্য।
এবার আমি আর সুহৃদ লজ্জায় লাল হতে থাকি- ম্যাডাম যেরূপ লজ্জারাঙা হয়েছিলেন।
সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা-নগ্নতা বা যৌনতা বিষয়ে সুহৃদ, কৌশিক আর আমার মধ্যে প্রায়ই বিতর্ক হয়ে থাকে- এক পক্ষে সুহৃদ আর কৌশিক, অপর পক্ষে আমি একা, তবে জাহিদ মাঝে মধ্যে আমাদের বিতর্ক বিষয়ে নিরপেক্ষ মন্তব্য পেশ করে থাকে। পাণ্ডিত্যের দিক থেকে সুহৃদ আর কৌশিক আমার চেয়ে বহু ওপরে, এবং সেজন্যই আমার সকল যুক্তিকে ওরা হেসে উড়িয়ে দিয়ে থাকে। ওরা বলে, যৌনতা কোন অশ্লীল বিষয় নয়, মানুষের জীবনে একমাত্র যৌনতাই অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে, জীবনের জন্য এটা একটা অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এটা কোন ফেলনা বিষয় হতে পারে না, এটা হলো শিল্প। নগ্ন বিষয়টাকে তুমি কিভাবে বাইরে প্রকাশ করছো তার ওপরেই নির্ভর করছে ওটা শিল্প হয়েছে কিনা। যেমন, ভেনাসের উলঙ্গ চিত্রটা একটা বিখ্যাত শিল্প, তবে তার খালি পায়ের নিচে এক জোড়া হাইহিল পরিয়ে দিলে সেটা অশ্লীল হয়ে যেত।
ওদের এই অতি উচ্চাঙ্গীয় কথা আমার মগজে খুব কমই ঢোকে। আমি সাধাসিধা ভাবে যা বুঝি তা হলো শিল্প অর্থ সুন্দর, যা দেখে মন-প্রাণ ভরে যায়, যার কাছে সবার সমান প্রবেশাধিকার আছে। ওদের নগ্ন শিল্পের সংজ্ঞা শুনে জাহিদ একবার ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, Dear friends, there are hundreds of artistic styles in intercourse, but can you really demonstrate one of those arts in a public gathering, say in a big houseful stadium, so that the people can enjoy it and learn some lessons? ওরা সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলেছিল, তুই তো দেখছি এখনো সেই মান্ধাতার আমলেই রয়ে গেছিস। পৃথিবী কতোখানি এ্যাডভান্স করেছে তার কিছুই জানিস না। এতোদিন বিদেশে থেকে এলি, কিন্তু তোর চোখ ফুটলো না রে। বিদেশে তো এসব জিনিসের ওপেন ডিসপ্লে হচ্ছে।
জাহিদ বলে, দোস্, তোমরা আমাকে এসব বিষয়ে জ্ঞান দিও না। তোমরা পেপারে দু-একটা জিনিস পড়ে মনে করো না জানি কতো কিছু শিখে ফেলেছো। তোমরা যেই ওপেন ডিসপ্লের কথা বলছো সেটা হলো নাইট ক্লাবের ঘটনা। ওগুলো তো নীলছবির জীবন্ত মহড়া। ওগুলোকে তোমরা শিল্প বলছো? শিল্প সম্পর্কে তোমাদের এতো বিশদ জ্ঞান দেখে সত্যিই আমি চমৎকৃত হচ্ছি।
ওরা তখন জোর দিয়ে বলে, অবশ্যই ওটা শিল্প, ওটা কি দর্শকগণের চিত্তবিনোদন করছে না? দর্শকগণ কি তা উপভোগ করছে না? ওটা একটা মহৎ শিল্প।
জাহিদ হেসে বলে, হ্যাঁ, মহৎ শিল্প তো বটেই, কিন্তু বন্ধুরা বলো তো এই মহৎ শিল্পের জন্য এ পর্যন্ত কয়টা নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছে? এটা যদি শ্রেষ্ঠ শিল্পই হয়ে থাকে, তার জন্য তো শ্রেষ্ঠ পুরস্কারও থাকার কথা, তাই নয় কি?
কৌশিক আর সুহৃদ চুপসে যায়। সংকোচের কারণে আমি এ বিষয়ে সোচ্চার অংশগ্রহণ করতে পারি না। তবে আমি পরিস্কার বুঝতে পারি যে নগ্নতা বা যৌনতা শিল্প হতে পারে না। যদি পারতো তবে মানুষের পোশাক পরিধান করার প্রয়োজন পড়তো না। প্রাইভেসি বা গোপণীয়তা, লজ্জা ইত্যাদি শব্দগুলোর উদ্ভব ও প্রচলন ঘটতো না। ভেনাসের উলঙ্গ চিত্রকর্মকে যতোই উৎকৃষ্ট শিল্প বলা হোক না কেন, ওটাকে নিজ ঘরের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখে সে-ঘরে একত্রে মা-মেয়ে-বাবা-ছেলেরা বসবাস করতে পারেন না, যদি তাঁরা কদাচিৎ লজ্জা নামক অদৃশ্য বিশেষ্যপদটির সামান্যতম স্পর্শ পেয়ে থাকেন। ঠিক এই কারণেই আমি সুহৃদকে বলেছিলাম, তোর বই থেকে সঙ্গমের দৃশ্যাবলি কেটে দে। সুহৃদ বলেছিল, এটা একটা শিল্প, বাদ দিব কেন? আমি বলেছিলাম, তোর এই শিল্পের দ্বারা যুবকশ্রেণী অধঃপতনে যাবে। ও হেসে বলেছিল, আমার বই আর কটা যুবকে পড়বে রে, আর কেউ যদি বই পড়ে অধঃপতনে যায় তা-ও ভালো, তবু তো সে একটা সন্ত্রাসী হলো না; বই পড়ে যে যুবক অধঃপতনে যায় সে শুধু নিজেই মরে, বই না পড়লে ঐ যুবকটি সন্ত্রাসী হয়ে মানুষ খুন করতো, এবং শুধু খুন করার জন্যই সে নিজে বেঁচে থাকতো, মরতো না।
আমি জানি, সুহৃদ যা বলেছিল তা তর্কের খাতিরেই বলেছিল এবং গল্পে যৌনতার অংশটুকুও নেহায়েত গল্পের প্রয়োজনেই বিধৃত হয়েছিল; কিন্তু তবু আমি ওর ঐ অংশের সংযোজন মেনে নিতে পারিনি, এবং জাহানারা ম্যাডামও ঠিক একই বিষয়ের ওপর কটাক্ষ করেছেন। আমার কথা হলো, পৃথিবীতে কতো বিষয় আছে, কতো বিচিত্র ঘটনাবলি আছে, সঙ্গম আর যৌনতা ছাড়া কি গল্প হতে পারে না? পারলে সেটাই তুমি লিখ, এই বিষয়ে লেখার জন্য কি সুহৃদ রহমানকে কেউ বাধ্য করেছিল?
ম্যাডাম আরো কিছু পরামর্শ দিলেন। তা হলো, লেখার মধ্যে শুধু বিনোদন থাকলেই চলবে না, একটা সুস্পষ্ট মানব কল্যাণকর বক্তব্য থাকতে হবে। সাহিত্য হতে হবে মার্জিত, সুরুচিবোধ সম্পন্ন, নির্ভুল, ব্যাকরণ সম্মত, যুগোপযোগী এবং আধুনিকায়নের স্বার্থে সর্বদা বিবর্তনশীল- যা পড়লেই তার অন্তর্নিহিত বিষয়াবলি মানুষকে ভাবায়, জ্ঞান বৃদ্ধি করে, মনে প্রশান্তি আনে; ভুলে পরিপূর্ণ সাহিত্য পাঠে শিক্ষার্থীগণ বিভ্রান্ত হবে; একজন সচেতন পাঠকের কাছে এরূপ সাহিত্য ও সাহিত্যিকের কোন কদর নেই। আলোচনা প্রসঙ্গে ম্যাডাম আরো একটা বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ করলেন- তা হলো ইসলামের প্রতি আমাদের সমসাময়িক মুসলামন সাহিত্যিকদের প্রচণ্ড উদাসীনতা। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমেদ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকগণ ইসলামী ঐতিহ্যকে পূঁজি করে প্রচুর সাহিত্য রচনা করেছেন; পরিতাপের বিষয় হলো বর্তমান যুগে আমরা ঐরূপ ইসলামপন্থী কোন মুসলমান সাহিত্যিককে দেখছি না। কবিতার ক্ষেত্রে এটা খুব বেশি অনুপস্থিত। এই প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়েই ম্যাডাম চলচ্চিত্রে ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের সিনেমায় খুব কমই দেখা যায় মসজিদে আযান হচ্ছে, মুসল্লীরা নামাজ পড়ছেন, কোরান পড়ছেন। বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম বলে শুরু হয়েছে এমন ছবির সংখ্যাও খুব কম। অথচ অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যাবে এমন খুব কম চলচ্চিত্রই আছে যেগুলো ধর্মীয় বাণী পাঠ ব্যতিত শুরু হয়েছে। শেষমেষ ম্যাডাম বলেছিলেন, আপনার লেখা থেকে যেন প্রতীয়মান হয় আপনি একজন প্রকৃত মানুষ; একজন মুসলমান হিসাবে আপনার লেখায় ইসলামী চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন না থাকলে আপনি প্রকৃত মানুষ হিসাবে বিবেচিত হতে পারেন না, এটা মনে রাখবেন। ম্যাডামের এ কথার জবাবে আমি একটা বেফাঁস প্রশ্ন করে বসেছিলাম- ম্যাডাম, তাহলে এটা তো সর্বজনীন সাহিত্য হলো না, কেবল এক বিশেষ ধর্মীয় গুষ্টির সাহিত্য হিসাবে কি এটা একঘরে হয়ে গেল না? তিনি শিক্ষক-সুলভ গম্ভীর মুচকি হেসে বলেছিলেন, শেক্সপীয়রের চরিত্রগুলো কি কখনো আল্লাহ্, রাসূল, মুহম্মদ এই ইসলামী শব্দগুলো উচ্চারণ করেছে? রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র বা মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনাবলিতে কি ঐ সকল ইসলামী শব্দের ব্যবহার আছে? সেগুলো কি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ইত্যাদি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য সমাদৃত এবং কালোত্তীর্ণ সাহিত্য হিসাবে যুগ যুগ ধরে পঠিত হয়ে আসছে না? তা থেকে কি আমরা শিক্ষা নিচ্ছি না? তদ্রূপ, ইসলামী ভাবধারা সম্বলিত উৎকৃষ্ট সাহিত্য ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য পাঠযোগ্য হওয়া সম্ভব- যা থেকে যে কেউ সমভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
বিদায় নিয়ে ফেরত আসার পথে সুহৃদ খুব চুপচাপ হয়ে ভাবছিল। আমি ওর বাহুতে ঠেলা দিয়ে বললাম, তুই যদি একজন প্রকৃত সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাস তাহলে তোকে একটা পথ বাতলে দিব।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুহৃদ আমার দিকে তাকায়। আমি বলি, এরপর আর এভাবে নয়, বই বের করার আগে প্রচুর কষ্ট করতে হবে। যাঁরা প্রকৃত সাহিত্য বোঝেন, যেমন জাহানারা ম্যাডাম- তাঁদেরকে দিয়ে আগে বইটি পড়াতে হবে-
সুহৃদ সঙ্গে সঙ্গে বলে বসে, তাহলে তো আর কোন বই-ই বের করা যাবে না।
কেন?
এঁদের হাতে পাণ্ডুলিপি গেলে পাশ নম্বরই জুটবে না।
সেটাই তো তোর আসল পরীক্ষা। যদি পাশ নম্বর না পাস তো ছাপবি না, আর পেয়ে গেলেই তো বুঝতে পারবি সাহিত্যে তোর জন্য একটা স্থান না থেকে যায় না।
সুহৃদ আর কোন কথা বলে না। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকায়। আমি বুঝতে পারি ওর খুব মন খারাপ হয়েছে- বই ছাপানোর নেশায় ওকে ধরেছে- খ্যাতির জন্য সে বই ছাপবেই, পাশ নম্বর সে পাক বা না-পাক।
নায়লাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত ছিল। সেটি শাহজাহান সাহেবের গতানুগতিক আড্ডার আসরের চেয়ে একটু অন্যরকম ছিল- খাবারের মেনুটা ছিল অতি উন্নত- চিকেন বিরিয়ানি, যা শাহজাহান সাহেব নিজ হাতে রান্না করেছিলেন। এর সাথে বোরহানি, যার টকদই বাজার থেকে কেনা যদিও, কিন্তু পুদিনা পাতা বাটাসহ যাবতীয় কাজ কাজের বেটি রহিমার পরিবর্তে নায়লা নিজেই করেছিল। অখাদ্য হবে ভেবে অনেকেই সেই বোরহানি মুখে তুলতে সাহস পাচ্ছিল না, তবে কৌশিককে পর পর দু-গ্লাস সাবার করতে দেখে আমি তো বটেই, পিংকিও শেষ পর্যন্ত তা খেয়ে বলেছিল, হ্যাঁ, বিরিয়ানি আর বোরহানি সমানে সমান। একজন পাকা রাঁধুনি হিসাবে তাকে দশে দশ দিতে গিয়েই নায়লার দুষ্টু ছেলেটি ফাঁস করে দিল, আদতে বোরহানিটা ওদের হোটেলের জনৈক দক্ষ কারিগর দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। শাহজাহান সাহেবের সাধুতার ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ নেই, কারণ, তিনি নিজে এর আগে আরেকবার আমাদের সামনে রান্না করে বিরিয়ানি খাইয়েছিলেন।
খাওয়ার টেবিলে স্খলন বিষয়ক মধুবর্ষণের সূত্রপাত হলো। ঐ সময়ে একজনে চট করে জানিয়ে দিল- সুহৃদ রহমানের আরো তিনটি উপন্যাস বাজারে আসছে- তোমরা প্রস্তুত হও।
নতুন বইয়েরা এখনো আঁতুর ঘরে- ছাপা হবে কি হবে না ঠিক নেই, অথচ এ নিয়ে আগ্রহ-আলোচনার কোন অন্ত রইল না। সবাই বলতে লাগলো, এখনো পরের বইমেলা আসতে চার-পাঁচ মাস বাকি, ততোদিনে তো আরো গোটা পাঁচেক বই লেখা হয়ে যাবে, তাই না? অর্থ্যাৎ, আমরা ধরে নিতে পারি কমপক্ষে ছয়টা বই বের করা কোন সমস্যাই হবে না।
আরেক জনে বলে, বাংলা সাহিত্যে এটা একটা মস্ত বড় রেকর্ড হবে- এক লেখকের এক বইমেলায় ছয়টা বই- শুধু বাংলা সাহিত্যেই বা হবে কেন, ওয়ার্ল্ড সাহিত্যেও এমনটি নেই।
স্খলন কেমন চলছে? শাহজাহান সাহেব জিজ্ঞাসা করেন।
সুহৃদ মুখ হাঁ না করতেই জাহিদ কলকল করে ওঠে, দেধারছে।
আমার ইচ্ছে হলো, কষে জাহিদের কান সুদ্ধ একটা চড় মারি। স্খলন এর নাড়ি-নক্ষত্র সব আমি দেখেছি, আর সে বইগুলো ছিটিয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল?
নায়লা গদগদ হয়ে বলে উঠলো, স্খলনটা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রে। ওর মুখ থেকে মধু ঝরে পড়তে থাকে।
নায়লার ওপরও আমার বিরক্তি ও রাগের শেষ থাকে না।
সেই আসরে স্খলন এর এতোই স্তূতি শুরু হলো যে আমার মনে হয়েছিল সুহৃদ রহমান একটা জীবন্ত কিংবদন্তি। আমিও কিংবদন্তি হতে চাই, আমার প্রখর মেধা নেই যদিও, তবুও আমি খ্যাতি চাই, সুহৃদের মতো খ্যাতি চাই।
কিন্তু সুহৃদের মতো উপন্যাস লেখার সাধ্য আমার নেই, যদিও কথায় কথায় ওকে সর্বদাই একটি খোটা দিয়ে থাকি- তোর চেয়ে কি আমার লেখার ভাণ্ডার কম? ভাণ্ডার বলতে যা বোঝায় আমার তা নেই। ওর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়তে পড়তে ওর প্রতি আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিলাম- তাই বলেছিলাম, এটা এখনই ছাপবার কোন দরকার নেই- আগে লিখে লিখে হাত পাকা কর। আমার কথায় সুহৃদ খানিকটা মনক্ষুন্ন হয়েছিল, কারণ, আমার মতামতকে সে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ওর মতো উপন্যাস লেখার ক্ষমতা হয়তো আমার নেই, কিন্তু সাহিত্য ওর চেয়ে কম পড়েছি বলে আমি বিশ্বাস করি না। কোন এককালে টুকিটাকি কবিতা লিখতাম, এখনো লিখি, ডায়েরির পাতা ভরে গেছে, ওটা সুহৃদ ওর বাসায় নিয়েছে বহুদিন হলো, আমাকে সে অনেক বলেছে, এটা তুই কাব্যগ্রন্থ আকারে বের করে ফেল- আমি বলেছি, গাদা গাদা কবিতা লেখার চেয়ে জীবনে মাত্র একটি কবিতা লিখলেই হবে। জীবনানন্দ শুধু বনলতা সেন লিখলেই চলতো, রবীন্দ্রনাথ শুধু শেষের কবিতা লিখলেই চলতো, নজরুলের বিদ্রোহী, জসীম উদ্দীনের কবর- কেবল একটি কবিতার জন্যই তাঁরা কবি হিসাবে অমর হতে পারতেন, তদ্রূপ, আমিও জীবনে একটা মাত্র কবিতাই লিখবো- মানুষের এতো কবিতা পড়ার সময় নেই। স্যাটেলাইটের যুগে বইয়ের কীট কেউ হতে চায় না।
কিন্তু তবুও একটা কালোত্তীর্ণ অমর কবিতা রচনার ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী নই। একই সঙ্গে কাব্যগ্রন্থ ছাপতেও অনাগ্রহী, অথচ খ্যাতি চাই। সত্যি বলছি, সুহৃদের বই সম্পর্কে ওকে আমার মনের কথাটি বলিনি, অর্থ্যাৎ সত্য কথাটি গোপন রেখেছি, স্খলন আমার মতে একটা অতি উন্নত মানের সাহিত্য-সৃষ্টি, এর দ্বারা সুহৃদ রহমান একদিন প্রচুর খ্যাতি পাবে, আমার বিশ্বাস, ওর অমরত্ব হবে; আমিও খ্যাতি চাই, অমরত্ব চাই। কিন্তু কিভাবে?
আমার মাথায় চট করে একটা 'অভিনব' বুদ্ধি খেলে গেল। বললাম, আমি তোদের সবাইকে সুহৃদের মতো শ্রেষ্ঠ লেখক বানাবো।
সবাই প্রায় একযোগে বলে উঠলো, কিভাবে? কিভাবে?
আগে বল, তোরা সবাই আমার সঙ্গে আছিস তো?
আলবৎ আছি। কী করতে হবে সেটা আগে বল।
একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করলে কেমন হয়?
আমার প্রস্তাবে সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল- সৃষ্টিশীলতার একটা নতুন দিগন্ত বটে-আত্মপ্রকাশের সুবর্ণ সুযোগ দেখতে পেয়ে সবারই মনের ভিতরে উত্তেজনা দানা বাঁধে- এ জিনিসটা এতোদিন ওদের কারো মাথায় ঢোকেনি বলে সবাই সপ্রশংস চোখে আমার দিকে তাকালো। একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করতে পারলে প্রচুর খ্যাতি হবে। প্রথমত, যেহেতু আমাদের নিজস্ব পত্রিকা, অতএব প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর স্বরূপ গল্প, কবিতা, ছড়া, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস ছাপতে পারবো। উন্নত মানের না হলেও লেখা বাদ পড়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ, কে তা বাদ দিবে? ছাপবো তো আমরাই। বউয়ের শাড়ি-কাপড়-ব্লাউজের কিংবা হাজব্যান্ডের স্যুট-টাই-প্যান্টের লিষ্ট ছাপলেও কেউ মানা করার নেই। এটা আমাদের পত্রিকা, আমাদের যা খুশি আমরা তাই ছাপবো।
আমি আমার ম্যাগাজিনের নাম রাখলাম তরুণ কণ্ঠ। আমি নিশ্চিত, তরুণ কণ্ঠ দ্বারা একদিন আমার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, এমনকি সুহৃদ রহমানকেও হয়তো সেই খ্যাতি ছাড়িয়ে যাবে।
নায়লা সবচাইতে বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লো। বললো, আমার বড় ছেলের অনেকগুলো ভালো কবিতা আছে। স্কুলের বার্ষিকীতে সে নিয়মিত লেখে।
নায়লা আরো বললো, তার পাশের ফ্ল্যাটের এক মহিলা এনজিওতে চাকরি করেন, সেই এনজিওতে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মিণী আছেন, সেই সহকর্মিণীর ননদের রুমমেট, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী মারিয়া, কিছুদিন আগে বেড়াতে এসে বেশ কিছু স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শুনিয়ে গেছে। মারিয়ার ঠিকানা নায়লার জানা আছে। একটা উন্নত মানের পত্রিকা বের করতে হলে মারিয়ার মতো তুখোড় কবিনিদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গতি নেই। পত্রিকার মানোন্নয়নের জন্য অবশ্যই তার কাছ থেকে কিছু ভালো কবিতা বাগিয়ে আনতে হবে। নায়লা অবশ্য নিজে থেকেই এই দুঃসাধ্য কাজটির দায়িত্বভার গ্রহণ করলো।
সজলও বেশ উচ্ছ্বসিত হলো, বললো, তোদের পদক্ষেপকে আমি সাধুবাদ জানাই। এই পত্রিকায় আমাদের সকলের নাম ছাপবার ব্যবসহাটা থাকতে হবে যাতে দেশ-বিদেশে আমাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সে খুশিতে ডগমগভাবে আরো জানালো, আসলে তোদের ভাগ্যটা খুব ভালো রে। মাত্র কিছুদিন আগে আমি আমার জীবনের প্রথম কবিতাটা লিখেছি। কবির জীবনের প্রথম কবিতাটা কোন পত্রিকায় ছাপা হওয়া মানে ঐ পত্রিকার ঐতিহাসিক মূল্যটা বহুগুণ বেড়ে যাওয়া। আমার কবিতার বিষয়বস্তুটাও চমৎকার- অবশ্য মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু থেকে ধার করা- তুমি কী? মুখে তোমাকে অনেকেই অনর্থের মূল বলে থাকে, কিন্তু তুমি না হলে বিরিয়ানি- বোরহানি জোটে না, চা বিস্কুট কিছুই খাওয়া যায় না। সিনেমা-ভিসিআর দেখা যায় না। বই কেনা যায় না। এখন সর্বশেষ আরেকটি লাইন জুড়ে দিতে হবে- তরুণ-তরুণীদের সাহিত্য বিকাশের জন্য একটি পত্রিকা বের করতেও তোমার দারসহ হতে হয়। তুমি কী? তুমি হলে টাকা।
নিজেদের লেখায় পত্রিকার পাতা ভরে ফেলা যাবে, কিন্তু এ পত্রিকা তো শুধু আমরাই পড়বো না। দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে দিতে হবে এ পত্রিকা, দেশ-বিদেশে প্রবাসীদের কাছেও। কিন্তু কে কিনবে আমাদের পত্রিকা?
আমাদের পত্রিকার টার্গেট গ্রূপ হলো দেশের উদীয়মান প্রতিভা যারা জন্ম থেকেই দিনের পর দিন লিখে যাচ্ছেন, কিন্তু প্রতিভা বিকাশের কোন সুযোগ পাচ্ছেন না। এসব তরুণ-তরুণীর লেখার সম্ভারে পত্রিকা সাজালে তাঁরা প্রত্যেকেই দিব্যচক্ষে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার তীব্র বাসনায় অধীর আগ্রহে দিন গুণবেন। তাঁদের দ্বারে দ্বারে পত্রিকা পৌঁছে যাবে, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দিগুণ, তিনগুণ- অনেক গুণ চড়া দামে একাধিক কপি পত্রিকা কিনবেন- এক কপি নিজের সংগ্রহে রাখতে, অপর কপি প্রিয়জনকে উপহার দিতে, যাঁরা তাঁদের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন।
কিন্তু এসব প্রতিভার কাছ থেকে কিভাবে লেখা সংগ্রহ করি? সুহৃদ রহমান সামনে এগিয়ে এলো। বললো, এ ব্যাপারে আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো, ঢাকা শহরের প্রত্যেকটা স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে, হোস্টেল এবং হলে লেখা আহ্বান পোস্টার লাগানো, লিফলেট বিতরণ করা।
সর্বদাই নায়লার উচ্ছ্বাস সবচাইতে বেশি। সে প্রায় লাফিয়ে উঠে বললো, তাহলে আর দেরি কেন, আজই কাজ শুরু করে দে। দশ-বারো দিনের মধ্যেই পত্রিকা বের করা চাই, নইলে আমার শান্তি নেই রে!
দশ-বারো দিনের মধ্যে কোন নতুন পত্রিকা বের করা যায় না। আমি বললাম, এতো অল্প দিনে কোন লেখাই জমা হবে না।
আরে ধূর, নায়লা বলে, লেখার জন্য তুই এতো চিন্তা করছিস কেন? আমি একাই তোকে অর্ধেক লেখা যোগাড় করে দিব। একেবারেই যদি না পাওয়া যায়, তবে যে কটা লেখা হাতে জমা পড়ে তা দিয়েই পত্রিকা বের করতে হবে। যে করেই হোক, একবার প্রথম সংখ্যাটা বের করতে পারলেই হলো।
এতো সোজা না, জাহিদ বলে, তোর শাড়ি-ব্লাউজ আর ব্রেসিয়ারের লিষ্ট কে পড়বে?
নায়লা ফুটো হওয়া বেলুনের মতো চুপসে যায়।
খ্যাতির লাগিয়া, উপন্যাস, প্রকাশিত একুশে বইমেলা ২০০৪
খ্যাতির লাগিয়া, উপন্যাস, প্রকাশিত একুশে বইমেলা ২০০৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-১
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-২
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৩
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৫
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৬
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৭
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৮ (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:৩১