একজন নবীন লেখকের প্রথম বই ছাপা হবার 'সকরুণ' ইতিহাস
এটা কি তোমার শাড়ি? জিজ্ঞাসা করতেই ঋতু খিলখিল করে হেসে ওঠে গলে পড়ে যায়।
বলি, এত হাসির কী হলো?
ঋতু হাসতে হাসতেই বলে, হঠাৎ 'তুমি' করে সম্বোধন করছো যে?
তুমি এখন বড় হয়েছ না? আমি বলি।
ঋতু আরো জোরে হাসে। বলে, বড় হওয়ার সাথে সাথে সম্বোধন পাল্টে যায় তা জীবনে প্রথম শুনলাম।
কিন্তু আমি অনেক আগেই দেখেছি। একদম ছোটবেলায় যখন কথা বলতে শুরু করেছিলে তখন আমার সাথে তুই তুই করে কথা বলতে। তারপর আপনি করে চললো দীর্ঘ সময়। আমাকে তুমি করে বলছো বছর তিনেকও হয়নি।
ঋতু কথা বলে না, কিন্তু ফুঁসফাঁস করে হাসতে থাকে। ও এমন করে হাসছে কেন?
ঋতু জিজ্ঞাসা করে, এতোদিন কেন আসোনি?
আমি বলি, তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। কার শাড়ি, খালার?
ঋতু বলে, তুমি এখন কী করো, বলো তো? তোমার কাজ কারবার কিছু ধরতে পারি না। পড়াশোনা কি আছে, না নেই?
আমি বলি, তোমার পরীক্ষা কবে শুরু?
ঋতু ক্ষেপে যায়, বলে, খালি কথা এড়াও কেন? যা জিজ্ঞাসা করি তার সাফ সাফ জবাব দাও।
আমিও একটু কঠিন স্বরে বলি, আগে তো কোনদিন জিজ্ঞাসা করোনি আমি কী করি, কী খাই, কোথায় যাই, কোথায় থাকি, কার সাথে মিশি। হঠাৎ আজ জানতে চাচ্ছ কেন?
আমার প্রয়োজন আছে তাই জানতে চাচ্ছি। ঋতু বলে।
আমার সম্পর্কে কারো এতো না ভাবলেও চলবে। কে আমি? আমি কে? আমার ভালোমন্দে কারো কিছু যায় আসে না।
কিন্তু আমার যায় আসে। বলে ঋতু ত্রু²দ্ধ চোখে আমার দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে চোখ নেমে আসে, সে মাটির দিকে তাকায়। বলে, তুমি ভেবো না যে, তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি জানি আমাকে বিয়ে করে তুমি নিজেও সুখে থাকতে পারবে না, আমাকেও শান্তিতে রাখতে পারবে না, তারপরও তোমার চিন্তায় আমি সারাক্ষণ অস্থির থাকি, তোমার কী হবে! এখন বুঝতে পারছি, তুমি দূরে থেকেও আমাকে শান্তি দেবে না- তোমার জন্য না হোক, অন্তত আমার কথাটি ভেবে হলেও তুমি একটু তোমার নিজের দিকে নজর দাও। তুমি কি চাও তোমার জন্য আমার অন্তর পুড়ে খাক হোক সারাটা জীবন?
ঋতুর গলা ধরে আসে। আমি শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ি। চলে যেতে হবে। ঋতু চেয়ার থেকে নেমে সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার বুকের কাছাকাছি এসে ঘন হয়ে দাঁড়ায়। ডান হাতে আমার বোতাম নাড়ে। আমি ওর শরীরের ঘ্রাণ পাই, অদ্ভূত সুঘ্রাণে আমি মাতাল হয়ে ওঠি।
আমার শ্বাস ঘন হয়ে আসে, অতি দ্রুত হৃদ্স্পন্দন হয়। মাথা নিচু করে ঋতু অনবরত আমার বোতাম নেড়ে যাচ্ছে। আমি ওকে পেয়েছি, আমার অন্তরে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ অবশিষ্ট নেই- আমি ঋতুর মন পেয়েছি; যদি চাই, আমি নিশ্চিত, ওর এই লতানো সুন্দর শরীরটাকেও আমি পেতে পারি। আমি জানি, আমার ঘরে সে বউ হয়ে আসবে না, ওর শরীরে একটি ফুল কিংবা কলংক এঁকে দিই, প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন, কোন এক এমন অবসরে ও ভাববে, একদিন আমি অন্য কারো ছিলাম।
আমার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে আসে, জড়ানো স্বরে বলি, শুধু চুমো নয়, তোকে আজ সবটুকু চাই।
ঋতুর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। বলে, শুধু কি আমার শরীরটাই তুমি চাও? মনটা চাও না? এই শরীরটা কি শুধু আমারই শরীর? তোমার নয়? তোমার জিনিস তুমি নষ্ট করে কতোখানি আনন্দ পাবে? নাও, যতোখানি পারো--- নাও। বলে সে আগুন চোখে তাকায়, সেই আগুনে অনেক আকুলতা, অনেক কাতরতা, অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।
আমি পারিনি। মহাপুরুষ হওয়ার আশ্চর্য সংযম নেমে আসে আমার মধ্যে। আমি ঋতুর মন পেতে চেয়েছিলাম, মন পেয়েছিলাম। একদিনের নেশায় আমি সারা জীবনের জন্য ওর বুকের কাঁটা হয়ে থাকতে চাইনি, একটা স্থায়ী বসবাস চেয়েছি ওর মনের গভীর গহন অরণ্যে।
বুকষ্টলের সামনে বেশ ভিড় দেখতে পেয়ে উর্দ্ধশ্বাসে সেদিকে ছুটে যাই। যা অনুমান করেছিলাম ঠিক তাই হয়েছে। সৌজন্য কপি 'স্খলন' নেয়ার জন্য বই পাগল 'ক্রেতাগণ' খাবলা-খাবলি শুরু করে দিয়েছে। দোকানে ৭০-৭৫টার মতো বই ছিল। প্রথম প্রথম সবাইকে থামিয়ে রাখা হয়েছিল এই বলে যে, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করুন, লেখক এসে সবাইকে অটোগ্রাফ সহ সৌজন্য কপি বই দিবেন। কিন্তু লেখককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি, ক্রেতাগণকেও বেশিক্ষণ মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন- সৌজন্য কপির নামে ভাওতাবাজি? বই দিবেন না তো ঘোষণা দিলেন কেন? বেশ কয়েকজনকে বিজ্ঞাপনের কথাগুলো লাইন বাই লাইন বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল- সৌজন্য কপি সবার জন্য নয়। মাত্র কয়েক লাইনের ছোট বিজ্ঞাপনটাও কেউ মনোযোগ দিয়ে পড়েননি, কেবল সৌজন্য কপি কথাটা মোটা অক্ষরে ছাপা দেখতে পেয়েই বুকস্টলের দিকে ছুট দিয়েছেন। দু-একজন বুদ্ধিমান ক্রেতাকে বুঝিয়ে বলার পর অবশ্য তাঁরা লজ্জা পেয়ে বই না নিয়েই চলে গেছেন। কিন্তু বেড়া ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ার মতো উচ্ছৃঙ্খলতার আশংকা দেখা দেয়া মাত্রই দোকান থেকে বই-বিতরণ শুরু করে দেয়া হয়। বই হস্তগত করার প্রতিযোগিতাটা নাকি দেখার মতো ছিল।
কনক ইসলাম অত্যন্ত সঙ্গোপনে দুটি বই লুকিয়ে রেখেছিলেন, বাকিগুলো সাবার হতে বেশি সময় লাগেনি।
বই না পাওয়া বেশ কয়েকজন ত্রু²দ্ধ ক্রেতা বই শেষ হওয়ার পরও দোকানের সামনে ভিড় করে হট্টগোল করছেন- তাঁদের দাবি একটাই- সৌজন্য কপি স্খলন দিতে হবে। তা না হলে লিফলেট ছাড়া হয়েছে কেন? ধোকা দেয়ার জন্য?
বুকস্টলের সামনে যেতেই কনক এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, খবরদার, লেখক বলে পরিচয় দিবেন না, লোকে খেয়ে ফেলবে কিন্তু।
আমি ঘাবড়ে গেলাম। এখানে থাকা যায় না। দোকানের লোকজন যেভাবে আমাদের সাথে কানাকানি করছে লোকজন ঠিক ঠিকই লেখক-গুষ্টি ভেবে আমাদের ওপর চড়াও হয়ে পড়বে। প্রাণের ভয়ে ছুটে পালাবার জন্য সুহৃদের হাত ধরে টান দিই, চল, কেটে পড়ি।
সুহৃদের এক দৃঢ় চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। ও আমার আহ্বান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভিড় ঠেলে দোকানের ভিতরে ঢুকলো। প্রথমে সে পুরো পরিস্থিতিটা আঁচ করার চেষ্টা করলো। তারপর দরাজ-গম্ভীর গলায় উচ্চারণ করলো- প্লিজ!
এ এক আশ্চর্য সম্মোহনী ক্ষমতা সুহৃদের কণ্ঠস্বরে। মুহূর্তে সকল ডামাডোল থেমে গেল। সুহৃদ বলে, প্লিজ, একটু ধৈর্য্য ধরুন, যাঁরা বই পড়েন তাঁদের প্রত্যেককে বই দেয়ার জন্য চেষ্টা করা হবে।
ক্রেতাদের মধ্যে পুনরায় উত্তেজনা ও গুঞ্জরণ ভেসে ওঠে। কনকের কানে কানে কী কথা বলতেই সুহৃদের হাতে একটি স্খলন চলে আসে। আবার ক্রেতাদের মধ্যে সামনে আসার জন্য ঠেলাঠেলি ও গুঞ্জরণ।
সুহৃদের ঠিক সামনেই একটা ছেলে বই নেয়ার জন্য একবার হাত বাড়ায়, আবার নামায়। সুহৃদ তাকে লক্ষ্য করে বলে, বইটি আপনি কার জন্য নেবেন?
আমার জন্য, আবার কার জন্য নেব? বলেই সে দুদিকে তাকায় আর আলা-ভোলা হাসি হাসে।
কী করবেন বই নিয়ে? সুহৃদ জিজ্ঞাসা করে।
ছেলেটি অবজ্ঞার হাসি হেসে বলে, বই নিয়ে কি করবো, পড়বো।
আপনি খুব বই পড়েন বুঝি?
ছেলেটি হঠাৎ চুপসে যায়, কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, প্রচুর পড়ি।
কার বই আপনি বেশি পড়েন?
ছেলেটি সত্যি হকচকিয়ে গেছে। সে আবারো ডানে বামে তাকায়।
সুহৃদ পুনরায় জিজ্ঞাসা করে, হুমায়ূন আহমেদের সব বই পড়েন?
জ্বি না। ছেলেটির গলা নেমে আসে, সে ধীরে ধীরে নরম হচ্ছে।
মনে আছে, হুমায়ূন আহমেদের কি কি বই পড়েছেন?
জ্বি, মনে আছে।
বলুন তো বইগুলোর নাম।
স্যরি, এই মূহুর্তে নাম মনে পড়ছে না।
আর কার কার বই পড়েছেন?
আর কারো বই পড়িনি।
ভেরি গুড। কোন্ ক্লাসে পড়েন?
ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ার।
ইন্টারমিডিয়েটে পাঠ্য উপন্যাসটার নামটা যেন কী?
পথের পাঁচালী।
আপনি কোন্ ক্লাসে পড়েন?
ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ার।
সত্যি?
জ্বি।
লাল সালুর নাম শুনেছেন?
স্যরি, স্যরি, লাল সালুই আমাদের পাঠ্য। আসলে ওটা এখনো পড়া হয়নি তো। বলতে বলতে সে কানের লতি চুলকায়।
আপনি ক্লাসপাঠ্য বই-ই পড়েন না, গল্প-উপন্যাস পড়বেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
আসলে আমার ভাবীর জন্য নিতে চেয়েছিলাম। ভাবী প্রচুর বই পড়েন তো!
প্লিজ, আর মিথ্যা বলবেন না। আপনি প্রথমেই বলেছিলেন যে আপনার নিজের জন্য বই নিবেন, এখন বলছেন ভাবীর জন্য, কোনটা সত্যি?
ছেলেটি কথা বলে না।
সুহৃদ শান্ত হয়। ছেলেটির মাথায় হাত রাখে সে। বলে, স্যরি ভাই, কিছু মনে করো না, তুমি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তোমার সাথে এরূপ আচরণ করা আমার ঠিক হয়নি। কী নাম তোমার?
সাগর।
চমৎকার। আমার নামে নাম।
এই বইমেলাতে এমন আশ্চর্য ঘটনা চোখের সামনে দেখতে পাব তা ভাবিনি। দক্ষ কৌঁসুলীর মতো যেই না জেরা শুরু হয়েছে, অমনি পেছন থেকে মানুষ কেটে পড়তে শুরু করেছে। কেবল একজন মাঝবয়সী মহিলা একটি ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তখনো বই নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
বইয়ের ভিতরে 'শুভেচ্ছা উপহার' লিখেই সুহৃদ সাগরের দিকে এগিয়ে দেয়, সাগরের চেহারাটি অত্যন্ত করুণ। সে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলে, বই আমি নিব না।
সুহৃদ ওর কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলে, এই দেখ, এতোটুকুতেই তোমার মন খারাপ হয়ে গেল?
সাগর বলে, আসলে আমি আপনার কাছে আরো একটা মিথ্যা বলেছি। তাই নিজের ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছে। এমন কাজ আমি জীবনে করিনি। আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি না, ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছি। আমাকে মাফ করে দেন। বলেই সে সুহৃদের হাত চেপে ধরে।
সুহৃদ হেসে হেসে পরিসিহতি হালকা করে। অনেক বোঝানোর পর ছেলেটি অবশ্য একটি স্খলন নেয়, তবে তার নিজের জন্য নয়, ভাবীর জন্য।
অপেক্ষমান মহিলা সামনে এগিয়ে এলেন, সুন্দরী মহিলা, সর্বাঙ্গে আভিজাত্যের ছাপ।
সুন্দরীদেরকে বই দেয়ার মধ্যে দারুণ রোমাঞ্চ আছে। আমি ভাবতে থাকি, এমন দিন কবে আসবে- চারদিকে- সত্যিকারের চারদিকে সুহৃদের নাম ছড়িয়ে পড়বে- বইমেলায় অটোগ্রাফ শিকারীরা হন্যে হয়ে সুহৃদ বা সাগর রহমানকে খুঁজবে, কিন্তু সাগর রহমান ভীষণ ব্যস্ত লেখক, প্রতিদিন মেলায় আসতে পারেন না, প্রোগ্রাম করে সপ্তাহে একবার বা দুবার এক কী দু-ঘন্টার জন্য আসেন- অটোগ্রাফ দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন- সেই ক্লান্তির মাঝেই ভিড় ঠেলে ভক্ত মা ও মেয়ে একত্রে সুহৃদের দু-পাশে এসে দাঁড়ান; বলেন, প্লিজ, সাগর রহমান ভাইয়া, একটা ক্লিক প্লিজ--- এমন দিন কবে আসবে?
কী যে আজগুবি ভাবনা আমি ভাবি! সুহৃদের এমন সুদিন যদি সত্যিই আসে তো তাতে আমার লাভ কী? সুহৃদ রহমানের নামের সাথে কি আমার নাম উচ্চারিত হবে -দ্য নিউ আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ? সুন্দরী রমণীরা ওর সাথে ছবি তোলার সময় কি তাঁরা আমাকেও ডাকবেন, আসুন, আসুন, করিম ভাইয়া, আসুন, আমি ঠিক আপনার পাশটাতে দাঁড়াতে চাই?
কনক আর সুহৃদকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে বলি, এই ভদ্র এবং সুন্দরী নারীকে অবশ্যই একখানি স্খলন উপহার দাও। যথা আজ্ঞা কাজ হয়। বইয়ের মলাট খুলে শুভেচ্ছা লিখতে উদ্যত হয় সুহৃদ; জিজ্ঞাসা করে, ম্যাডাম, আপনার নামটা?
স্যরি, কিছু মনে করবেন না, আমি বইটি নিচ্ছি না।
আমি বলি, নিন না, এতো মানুষকে দেয়া হলো, আপনাকে না দিতে পারলে আমরা খুব মর্মাহত হবো।
অতি ভদ্রতা বশত মহিলা বইটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে বললেন, ইটস গুড, কাগজগুলো ভালো, লেখার ষ্টাইলটাও বোধ হয় ভালোই হবে।
তারপর বইটি ফেরত দেয়ার জন্য সুহৃদের দিকে এগিয়ে দেন, সুহৃদ তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখে।
মহিলা বলেন, টাকা দিয়ে বই ছেপেছেন ভালো কথা, তবে এভাবে ফ্রি-ইস্যু বই সাপ্লাই দিলে কিন্তু ঊলুবনে মুক্তো ছড়ানো হবে। আপনাদের বিজ্ঞাপনের কাগজটা আমি পড়েছি। যাঁরা প্রকৃত বই পড়েন তাঁরা আপনার সৌজন্য কপি নিবেন না, এতো বই কিনতে পারলে আপনার এই বইটা কিনতে পারবেন না এটা কি হয়? আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, যারা বই নিয়েছে তারা কেউ-ই সত্যিকারের বই পড়ুয়া নয়। গুড, আপনার ইন্টারভিউটা আমার কাছে খুবই ইন্টারেষ্টিং মনে হয়েছে। তবে, একান্ত ইচ্ছে থাকলে আপনাকে একটা সৎ পরামর্শ দিতে পারি। আমাদের দেশের প্রত্যেকটা জেলায় সরকারি ও বেসরকারি পাবলিক লাইব্রেরি রয়েছে। সত্যিকারের পাঠকের জন্য বই দিতে চাইলে আপনি ওসব লাইব্রেরিতে একটা করে কপি পাঠিয়ে দিন, এতে অবশ্য আপনার আরেকটু বাড়তি খরচ হবে, ডাক খরচ।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাডাম, এমন একটা চমৎকার আইডিয়া উপহার দেয়ার জন্য। সুহৃদ বলে।
আমি বলি, ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে জানতে পারি কি আপনি কী করেন?
অবশ্যই পারেন। আমি তিতুমীর কলেজের বাংলা লেকচারার। জাহানার বেগম আমার নাম।
মুহূর্তে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল- ইচ্ছে হলো, তাঁর পা ধরে বলি, ম্যাডাম, আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমি মনে মনে অনেক অশোভন কথা ভেবেছি।
সুহৃদ বললো, ম্যাডাম, আপনাকে একটা বই দিতে পারলে নিজেকে খুব গর্বিত মনে করবো।
ম্যাডাম হেসে দিয়ে বললেন, বই পড়ার তো খুব একটা সময় নেই রে বাবা, আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে আমার পড়ার সময় হবে না, টেষ্ট পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত থাকতে হবে। তবে বইটি বাসায় নিলে অবশ্য শুধু শুধু পড়ে থাকবে না। আমার বউ খুব বই পড়ে।
মহিলাকে খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করি। হ্যাঁ, এবার তাঁকে শাশুড়িদের মতো বয়স্ক মনে হচ্ছে, গলার স্বরটা তেমনি ভারি। সঙ্গের ছেলেটি কে, নাতি, নাকি নিজের ছেলে?
বই হাতে নিয়ে ম্যাডাম ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে বলেন, দাদুভাই, এটা ধরো। ম্যাডাম সুহৃদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বইয়ের নামকরণের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকবেন। বইয়ের এমন কোন নাম দিবেন না যা শ্রুতিকটু হয়।
ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর সুহৃদকে বেশ কিছুক্ষণ মনক্ষুন্ন দেখি। বলি, দেখ, তোকে আমি আগেই বলেছিলাম স্খলন নামটা বদলে ফেল। এটা কোন ভালো নাম হলো? স্খলন, কিসের স্খলন? -বীর্যস্খলন। না, তুমি তোমার অভিধান বের করে দেখালে জ্ঞস্খলনঞ্চ অর্থ বোঁটা থেকে খসে পড়া, খুলে যাওয়া---। সবাই কি সব সময় হাতে ডিকশনারী নিয়ে ঘোরে? আমার এখন কৌশিক শালার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আমার কথা কানে না দিয়ে কৌশিকের টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাপোর্ট নিয়ে তুই বইয়ের নাম জ্ঞস্খলনঞ্চ রেখেছিস- এবার হলো তো? কৌশিক পাঁচটা বই লিখেছে তাতে কী, ঐ শালা কোন সাহিত্য বোঝে ? ওর ওগুলো কোন বই হয়েছে? ও কোন সাহিত্যের বই পড়ে? রাত জেগে জেগে তো ওর বইয়ের প্রুফ দেখে দিলি, পুরো গল্প পড়লি, কই- তোর স্খলন কি দু-চার পৃষ্ঠা সে পড়েছে? প্রতিদান বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। যদি একটা পৃষ্ঠা পড়েও বলতো, সুহৃদ, তোর লেখার ষ্ট্যান্ডার্ড খুব ভালো রে, তবে বুঝতাম কৌশিকের জন্য তোর এত দরদ দেখানোর একটা সার্থকতা আছে। ঐ বেইমান শালা বললো, আর উনি বইয়ের নাম স্খলন রেখে আকিকা করলেন। এখন ভালো মানুষের মন্তব্য শোন- দেখ স্খলন বলতে মানুষ কী বোঝে?
সুহৃদ নিশ্চুপে স্টল থেকে বের হয়ে বাইরের দিকে রওনা দেয়। আমি ওর পিছু নিই না। ও এখন বাসায় যাবে। যাক। ঘুমাক। ঘুমালে শ্রান্তি দূর হবে, মনে প্রশান্তি নামবে। মনটা সতেজ হবে।
পরের চার পাঁচদিন সুহৃদ বইমেলায় আসেনি। কিন্তু যারা এসেছে তারা খুব কাজের মানুষ। বইমেলা শুরু হওয়া থেকে ওদের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায়নি। জাহিদ, সজল, পিয়াল। হারুন এবং ওর সুন্দরী বউ। আরো আছে পিংকি ও ওর পাগলা মামা এবং আবশ্যিকভাবে নায়লা, সঙ্গে ওর দুরন্ত দুই ছেলে।
অতি কাছের যে ছেলেটি এলো না সে কৌশিক। আমার ধারণা, সুহৃদের প্রতি ও প্রচণ্ডভাবে ঈর্ষান্বিত। জাহিদ একদিন কৌশিককে স্খলন-এর তিনটি কভার পৃষ্ঠা দিয়েছিল ওর কোচিং সেন্টারে সেঁটে দিতে। এ আর তেমন কোন পাবলিসিটির জন্য না- কৌশিকের ছাত্র-ছাত্রীরা অন্তত স্খলন নামক একটা নতুন বইয়ের নাম শুনবে যেটি তাদের স্যারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধুর লেখা বই। কিন্তু কৌশিক সেটা দেয়ালে লাগায়নি, আমার ধারণা, কৌশিক হয়তো ভেবেছিল ওর ছাত্র-ছাত্রীরা হঠাৎ এ বইটির জন্য আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে- বইটি পড়ে সুহৃদ রহমানের গুণগান গাইতে শুরু করবে, কৌশিকের সুনাম ম্লান হয়ে যাবে। আরো একটা ব্যাপার আছে, আমরা সবাই কম বেশি স্খলন পড়েছি। কৌশিকের কোচিং সেন্টারে যখন আমাদের আড্ডা বসে, তখন কৌশিকের কোন বইয়ের ব্যাপারে কেউ কোন কথা তোলে না, আলোচনা করে না, কোন ভালো কিংবা খারাপ দিক নিয়ে কথা বলে না। আমি নিশ্চিত, এটা ওকে খুব কষ্ট দেয়। তবে কৌশিকের অনুপসিহতিতে, এবং সুহৃদেরও অবর্তমানে আমরা কিন্তু প্রায়ই বলাবলি করি, কৌশিকের লেখা পড়তে গিয়ে ইন্টারেষ্ট পাই না। পড়া এগোতে চায় না। কোন লেখক তার সমসাময়িক লেখকের গুণগান সইতে পারেন? কৌশিক পারবে কেন? আমার ধারণা, এজন্যই ও আমাদের সাথে বইমেলায় যোগ দিল না।
আমার মুখ খুব ধারালো। একবার কৌশিককে আমি বলেছিলাম, তোর লেখার কিছু কিছু দুর্বলতা আছে বলে পড়তে আগ্রহ জাগে না। যতোই বলি না, নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চাইতে ভালো আসলে বাস্তবে তা কেউ বাসে না। কারণ আমরা মানুষ, মানুষ কৌশিকও। আমার সমালোচনায় কৌশিক কেবলই ফুঁসছিল। শেষ পর্যন্ত বলেছিল, দোস রে, সব লেখা তো আর সবার জন্য না। আমি যেসব বই লিখি তা সবার মাথায় ঢুকবে না।
ওর এই অহংকারী কথা শুনে ক্ষোভে আমার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
অথচ আশ্চর্য, সুহৃদকে দেখি সে কৌশিক নামে পাগল। কৌশিক যেন ওর কাছে একটা দ্বিতীয় হুমায়ূন আহমেদ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কৌশিকের লেখা সে পড়ে আর তারিফ করে। শুধু যে কৌশিককে সন্তুষ্ট করার জন্যই করে তা নয়, ওর অবর্তমানেও করে।
সুহৃদের এই অতি বিনয় ভাব আমার ভালো লাগে না। একদিন ওকে আমি বলেই বসলাম, কৌশিকের লেখার প্রশংসা করার জন্য ও কি তোকে টাকা দেয়? কতো টাকা দেয় রে?
সুহৃদ হেসে বলেছিল, লিখতে পারাটা একটা অসাধারণ প্রতিভা, এটা মানিস? তোর ভিতরে অনেক ভাব আছে, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারলি না, আমরা সেই ভাবের অংশীদারও হতে পারলাম না, তোর এতো ভাবেব মূল্যায়ন করবো কিভাবে? সবাই লিখতে পারে না। কৌশিক যে পাঁচটা বই লিখেছে, যাই লিখুক, আমাদের বন্ধুর লেখা বই, অপরের কাছে অখাদ্য হলেও হতে পারে, কিন্তু আমাদের ওগুলো পড়া উচিৎ। চাটুকারিতা নয়, বইয়ের ভালো অংশটুকু অবশ্যই লেখককে বলতে হবে, এতে সে আরো ভালো লিখতে অনুপ্রাণিত হবে। পাঁচটা বই যে ছেলেটি লিখতে পারে তার মধ্যে সামান্যতম মেধা হলেও থাকা স্বাভাবিক, তাতে স্বল্পতম শিল্পগুণ হলেও বর্তমান আছে, যা আমাদেরকে একটু হলেও আনন্দ দিতে সক্ষম। ঐ জিনিসটা ওকে বলার অর্থ ওকে মাথায় তোলা নয়। আর কোন্টা চাটুকারিতা কোন্টা তা নয়, লেখক নিজেই সেটা বোঝে। তারপরও সুহৃদের সাথে আমি একমত হতে পারিনি। কারণ আমার মধ্যেও একটা অহংকারবোধ আছে, আমি যা বলি বা চাই- আমার ইচ্ছে সবাই তা করুক বা মানুক। সুহৃদ যা বলেছে তার সাথে একমত হওয়ার কোন মানসিকতা আমার নেই।
প্রতিদিন বইমেলায় আমাদের আড্ডা বসে। যেখানে যাই, দল বেঁধে যাই। ক্যান্টিনে, ফুসকার দোকানে, সব জায়গায় আমাদের দলটিকে দেখে সকলে জায়গা ছেড়ে দাঁড়ায়। আমি বুঝতে পারি, এত সম্ভ্রম প্রদর্শনের বড় কারণ আমাদের সঙ্গের তিনটি মেয়ে। পিংকি-নায়লা এবং হারুন পত্নী। এরা তিনজনেই মাশাল্লাহ রূপে এবং কলেবরে সম্ভ্রম পাবার অধিকারিণী।
আমাদের প্রত্যেকের হাতেই একটি করে স্খলন থাকে, হাত-পাখার মতো নাড়ি-চাড়ি। হঠাৎ পরিচিত বন্ধু-বান্ধব কিংবা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের কাউকে পাওয়া গেলে বইটির প্রশংসা ছড়াই, সৌজন্য বিতরণ করি।
গত কয়েকদিনে অবশ্য তিনটি বই সমূল্য-বিক্রি হয়েছে, এটা খুবই আশার কথা। প্রথম বইটা বিক্রির পরই আমি স্টলে গিয়ে বলে এসেছিলাম, যাঁরা বই কিনবেন তাঁদের সবার নাম-ধাম টেলিফোন নম্বর লিখে রাখবেন। কারণ, তাঁরা বুঝেই বইটি কিনলেন, নাকি ভুল করে, না কী ভেবে কিনলেন তা জানার একটা উদগ্র বাসনা আমার এবং সুহৃদ দুজনেরই মনে জাগবে। সুহৃদ তো আবার রীতিমতো একটা গ্রনহ সমালোচনাও চেয়ে বসতে পারে।
প্রথম ক্রেতার নাম ধাম রাখা যায়নি ভেবে আমার খুব আফসোস হচ্ছিল। যেদিন সবাই একত্রে বুকস্টলে গেলাম, নায়লাকে দেখে কনক লাফিয়ে উঠলেন, আরে, এই ম্যাডামই আপনাদের বইটা প্রথম কিনেছিলেন।
আমি ওর চুল ছিঁড়তে গেলাম- বই কিনেছিস বলিসনি কেন?
নায়লা হেসে দেয়। বলে, তোকে বলতে হবে কেন, যার বই সে ঠিকই জানে বইটা কে কিনেছে।
বটে! সুহৃদের ওপর আমার ক্ষোভ বেড়ে গিয়েছিল এবং তা মিলিয়েও গিয়েছিল। তবে হাস্যকর ঘটনা হলো, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ব্যক্তির ঠিকানা যখন জানতে চাই দেখা গেল একটা কিনেছে সজল, আরেকটা কিনেছে পিয়াল। আমার রাগটা তখন সত্যিই চরমে পৌঁছে গেল- এই শালারা আমাদের বই জ্ঞদেধারছেঞ্চ কিনে নিচ্ছে আর তা আমাকে জানায় না কেন? এই খবরটাও কি লেখক মহোদয় ঠিকই জানেন?
সাতদিনের মাথায় সুহৃদ আমাদের সাথে যোগ দিল। এতোগুলো কপোত-কপোতীকে এক সাথে দেখতে পেয়ে ও পাগল হয়ে গেল। পারে তো সবাইকে জড়িয়ে ধরে চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলে।
এদিনও ওর হাতে কয়েক বান্ডিল লিফলেট।
জাহিদের মাথায় অনেক বুদ্ধি। জাহিদের বুদ্ধি আমার চেয়েও প্রখর, তবে ও মাঝে মধ্যেই আমাকে স্থূল-বুদ্ধি বলে গালি দেয়; কেন দেয় আমি বুঝতে পারি না। সেটা আমার সীমাবদ্ধতা এবং তা আমার নির্বুদ্ধিতার পরিচায়কও বটে। এখানে আমি আমার নিজের দুর্বলতাটুকু আপনাদের কাছে প্রকাশ করতে মোটেও সংকোচ বোধ করছি না। আমি সর্বদা বিশ্বাস করি, কেবল জ্ঞানী ও মহৎ ব্যক্তিরাই অসংকোচে আপন দুর্বলতা প্রকাশ করতে পারেন, এটা একটা অসাধারণ বিনয়।
সবগুলো লিফলেট জাহিদ ওর নিজের কাছে নিয়ে নিল। তারপর বললো, তোরা আজ সবাই আমার কথা মতো চলবি। এদিক সেদিক করলে 'ছিলে' ফেলবো।
কনকের দোকান থেকে সবাইকে ঘাড় ধরে বের করে ওখানে বসানো হলো পিংকি আর নায়লাকে। বাইরে প্রহরায় সজল, পিয়াল, হারুন ও কনক। সুহৃদকে এক ধমক দিয়ে পগার পার করে দিল- তুই যা ভাগ, ঘুরে ঘুরে মেলা দেখগে।
হারুনের বউ আর আমাকে নিয়ে সে এসে দাঁড়ালো মাঝখানের সংযোগ সহলে। এরপর ওর লিফলেট বিতরণ শুরু হলো। এ এক বিশেষ অভিযান, অতি অভিনব কৌশল। সেই লিফলেট গণহারে সবাইকে দেয়া হয় না। খুব বেছে বেছে দেয়া হয়- যাদের দেখা মাত্র মনে হয় এরা আসমানের পরী। তবে প্রথম বারই একটা ফাঁড়া কাটলো।
একজোড়া উদ্দাম তরুণী রাজ হাঁসের মতো ঘাড় বাঁকিয়ে হেলে দুলে এগিয়ে আসছিল। ওদের সামনে জাহিদ দাঁড়ালো- এই যে খুকুমণিরা, একটু দাঁড়াও।
মেয়ে দুটো ভীষণ ক্ষেপে গেল- This is too stupid! আমরা কি খুকুমণি?
স্যরি খুকুমণিরা, জাহিদ নরম মিষ্টি স্বরে বলে, Let me introduce ourselves- me Mr Zahid now 38 and she is my wife Mrs Zerin, also 38; it’s been 20 years now we are running the ‘happiest’ conjugal life. We have a daughter of 18, very recently married to an American citizen. May I please know your ages my dear Khukumonira?
মেয়ে দুটো একটু লজ্জিত হলো। বললো, স্যরি আংকেল, কি বলবেন ঝটপট বলুন।
This is like good girls. এই নাও, তোমাদের দুজনের জন্য একটি উপহার। এটা একটা টোকেন। ৫৭ নং স্টলে গিয়ে এটা দেখালেই তোমাদেরকে একটা ঝকমকে নতুন উপন্যাস উপহার দেয়া হবে । নাও --- নাও ---।
মেয়ে দুটো পাশ কেটে যেতে যেতে বলে, আমরা কি মাগনা বই নিতে এসেছি নাকি?
আমি জাহিদের কলার চেপে ধরলাম, তুই কি শালা শেষমেষ আমাদের ভরাডুবি করবি? পরের বউকে নিজের বউ বলে চালাচ্ছিস, মেয়ে দুটো যদি তোর এই ভন্ডামী চ্যালেঞ্জ করে বসতো, কি করতি?
পাগল! তোরা কী জন্য আছিস, বসে বসে আঙ্গুল চুষতে? এসব পরিস্থিতিতে কী করতে হবে তারও একটা লেসন তোদেরকে দিতে হবে দেখছি, কয়েকটা দিন সবুর কর।
এরপর শিকার ধরার জন্য ওকে, অর্থাৎ আমাদেরকে প্রচুর অপেক্ষা করতে হলো। এবার ওর সম্বোধনও পাল্টে গেল। হারুন ভাবী লজ্জায় রাঙা হয়ে আছেন, তাঁর সাথে জাহিদের স্বামী-সুলভ আচরণ দেখে কারো বিন্দু মাত্র সন্দেহ করার অবকাশ নেই। আমরা সচরাচর আমাদের কোন বন্ধুর স্ত্রীকে নাম ধরে ডাকি না, বান্ধবীর স্বামীকেও না- হয় দুলাভাই অথবা নামের আগে মিষ্টার শব্দটা জুড়ে দেই। হারুন ভাবীকে জাহিদ অতি স্বাভাবিক ভাবে এই বীথি ইত্যাদি সম্বোধনে ডাকছে, কথা বলে যাচ্ছে। এর মধ্যে একবার তাঁর হাত ধরে টান দিয়ে বলেছে, অমন মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থেকো না তো, ধরো, লিফলেট হাতে নাও। বীথি ভাবী রক্তিম হয়ে হাতে লিফলেট তুলে নিয়েছেন; তাঁর হয়তো একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল, তবে তিনি যে এটা বেশ উপভোগ করছিলেন তা-ও সত্যি।
তারা একজোড়া তরুণ দম্পতি- অবশ্য জাহিদ যেভাবে অন্যের স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সুলভ আচরণ করছে, এ দ্বারা আমার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হলো, এরাও তো সত্যিকারের দম্পতি না-ও হতে পারে। যাহোক, তারা বাদাম খেতে খেতে বেশ হাস্যচ্ছন্দে ঢলাঢলি করে গল্প করতে করতে আসছিল। জাহিদ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা সালাম ঠুকে দিল- আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম খালাম্মা!
তারা দাঁড়ালো, তবে তাদের মুখে হঠাৎ হাসি নেই, মুখ কালো ও কঠিন।
নিশ্চয়ই বই কিনতে এসেছেন? বিনয়-বিগলিত জাহিদ অতি নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করে।
জ্বি। আপনারা? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করে।
আমরা বই বিক্রি করতে এসেছি- না, না, টাকার বিনিময়ে নয়। এই চিরকুটটি পড়ুন। বলে তাদের দুজনের হাতে জাহিদ দুটো লিফলেট তুলে দেয়। তারা দুজনে চোখ আর কপাল কুঞ্চিত করে লিফলেট পড়তে থাকে।
চমৎকার এ্যাড তো! দি লেটেষ্ট স্টাইল। ছেলেটি বলে।
খালাম্মা নিশ্চয়ই বইয়ের পোকা! অবশ্য আজকাল মেয়েরাই বেশি বই পড়েন। যিনি রাঁধেন বইও তিনিই পড়েন! আচ্ছা, খালাম্মার প্রিয় লেখক কি হুমায়ূন আহমেদ?
জাহিদের বাচালতায় মেয়েটির অবয়বে বিরক্তি ভেসে ওঠে। সে তার সঙ্গীকে ঠেলা দিয়ে বলে, ধূর চল তো।
তারা চলে যাচ্ছে, অমনি জাহিদ বলে উঠলো, আপামণি---।
শাট আপ। একটা তীক্ষ্ণ ভর্ৎসনা ছুঁড়ে দিয়ে মেয়েটি তার সঙ্গীর বাহু ঠেলে দ্রুত চলে গেল।
এই উন্মাদের সাথে থাকা যায় না- ওর জন্য পরপর দুটি বড় ফাঁড়া গেছে। ও যখন ঐ দম্পতির সাথে কথা বলছিল তখন ভয়ে আমার বুক কাঁপছিল। কী অদ্ভূত সম্বোধন- এক জোড়া তরুণ নর-নারীর একজনকে ভাইয়া, অপর জনকে খালাম্মা। আন্টি ডাকলেও তবু একটু আভিজাত্য রক্ষা হয়, কিন্তু একেবারে মূর্খের সম্বোধন- খালাম্মা। আমি হলে তো সঙ্গে সঙ্গে এক থাপ্পড়ে ওর দু-পাটি দাঁত নড়িয়ে দিতাম।
দুটি ফাঁড়া থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণ, আমার ধারণা, একমাত্র হারুনের বউ। কোন পুরুষের সঙ্গে সুন্দরী নারী থাকলে তার সাত খুন মাফ হয়। বীথি ভাবী আমাদেরকে বর্মের মতো রক্ষা করেছেন।
জাহিদের এরূপ পাগলামিতে বীথি ভাবীও যারপরনাই বিব্রত। তিনি বললেন, জাহিদ মামা, আমরা বরং লিফলেট বিলি বাদ দিয়ে এক জায়গায় বসে গল্প করি- এগুলো কোন টোকাইকে দিয়ে দিই। বলে রাখি, বীথি ভাবী সবাইকে এক গড়া মামা ডাকেন। নিশ্চয়ই এর একটা ইতিহাস আছে। এখনো জানা যায়নি সেই ইতিহাস, তবে এই উদ্ভট সম্বোধনের শানেনযুল জানতে হবেই আমাকে।
বীথি ভাবীর কথায় জাহিদের চোখ মুখ কঠিন হয়ে গেল। আমাদের দুজনের হাত থেকে লিফলেটগুলো কেড়ে নিয়ে বললো, তোমাদেরকে আগেই বলেছিলাম আজ আমার কথা মতো চলতে হবে। You are so disloyal to me !
জাহিদ উধাও হয়ে গেল। আমি আর ভাবী স্টলে ফেরত এসে ওদের সাথে যোগ দিলাম।
সেদিন আমরা গণে গণে দশটি বই বিক্রি করেছিলাম, তবে বিনে পয়সায় নয়, টাকার বিনিময়ে।
জাহিদের প্রতিভা আছে বটে। সে বেছে বেছে দশটি মেয়েকে লিফলেট দিয়েছিল, আমার বিশ্বাস, বইমেলায় সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলে ঐ দশটি মেয়েই ঐদিন শীর্ষ দশ সুন্দরীর তালিকায় থাকতো।
যে কোন বই কিনলে ১০-১৫ পার্সেন্ট কমিশন পাওয়া যায়। মেয়েগুলো এসে কমিশন বাড়ানোর জন্য দর কষাকষি করেনি; কেউ ১২০ টাকা বের করে দিয়েছে, কেউ ১৫০ টাকা, বিনিময়ে তাকে পুরো ৫০ টাকা ফেরত; কেউ ২০০ টাকা দিয়ে ভাংতি চেয়েছে, তাকেও একশো টাকা দাম রেখে বাকি ১০০ টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে।
কনকের সহকারী শহীদ খোনকার কোন ভুল করেননি- তিনি সবকটা মেয়ের মোবাইলসহ পুরো ঠিকানা টুকে রেখেছেন, যেমনটি 'মাগনা' গ্রহণকারিণীদের বেলায় করেছিলেন।
মেলা ভাঙ্গার সময় জাহিদ উদয় হয়। একা নয়, সঙ্গে আরো দুটি মেয়ে, যথারীতি সুন্দরী। যদিও এই চোখে সবাইকেই সুন্দরী লাগে, তবু বলি, মেয়ে দুটোকে যে কেউই সুন্দরী বলবেন; জাহিদের পছন্দ সর্বদাই সেরা পছন্দ।
দূর থেকে সে খল খল করে ওঠে- খবর কী রে দোস, কেউ আসছিল?
কে আসবে আবার? কেউ আসেনি। আমি বলি।
কেউ আসেনি? দশ দশটা মেয়েকে আমি 'তেল' মেরেছি, কেউ আসলো না?
আমি আগের মতোই কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকি, বাকিরা মিটিমিটি হাসে।
জাহিদ বলে, দোস করিম, পনরটা বই দে তো।
এতো বই দিয়ে তুই কী করবি?
আমার কয়েকজন পিয়ারের মেয়ে আছে- ওদের 'স্খলন' এর দরকার।
পনরটা পাবি না, দুইটা নে।
দুইটা কেন?
তোর সাথে তো মাত্র দুইটা মেয়ে।
ওদের প্রত্যেকের সাথে আছে আরো তিনটা করে এবং তাদের প্রত্যেকের সাথে আরো চারটা করে- মোট কয়টা লাগে? মোট ৩২ টা লাগে। আর আমি চাইছি মাত্র পনরটা।
এই পণ্ডিতের ধাঁধা আমার মাথায় ঢোকে না। আমি জানি, এটা ওর ভাওতাবাজি। ও নিজের কাছে বই নিয়ে রাখবে, পছন্দের সুন্দরীগণকে বিলাবে আর বাহবা কুড়াবে।
বলি, আমি তোকে বই দিব না।
জাহিদ বোকার মতো এক পাটি দাঁত বের করে একটা প্রাণখোলা নিঃশব্দ হাসি দেয়, তারপর ভিতরে ঢোকে। বলে, তোর কাছে বই চেয়েছি এজন্য তোর গর্ব করা উচিৎ ছিল যে আমি তোর কাছে হাত পেতেছি। আমি কারো কাছে হাত পাতি নাকি রে? আমি সব কিছু নিজের মনে করে নিই।
অতঃপর সে এক বান্ডিল বই দেখিয়ে শহীদ খোনকারকে জিজ্ঞাসা করে, এখানে কয়টা বই আছে দেখুন তো।
৪০টা।
এখান থেকে খুলে দশটা বই বের করুন। বাকি ত্রিশটা সুন্দর ভাবে বেঁধে দিন।
জাহিদকে আর কিছু বলতে পারি না। বাইরে বেরিয়ে সে মেয়ে দুটোকে দেয় পাঁচটা করে, তারপর ত্রিশটা বইয়ের গাঁট্টি লয়ে জাহিদ হনহন করে চলে যায়; কারো কাছ থেকে বিদায় নেয় না, আমরা যেন ওর পরিচিত কেউ নই।
খ্যাতির লাগিয়া, উপন্যাস, প্রকাশিত একুশে বইমেলা ২০০৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-১
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-২
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৩
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৪
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৫
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৬
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৭
খ্যাতির লাগিয়া পর্ব-৮ (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:৩১