somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েদের কথা; লজ্জা পুরুষের ভূষণ

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হেডনোট


এ লেখাটা নিয়ে অনেকের মধ্যেই একটা কনফিউশন সৃষ্টি হয়েছে ধারণা করছি। তাঁরা ভাবছেন অনেক বড় একটা সিরিজ একসঙ্গে পোস্ট করে ফেলেছি। ব্যাপারটা তা নয়। আর লেখাগুলো ব্লগে এসেও লেখা হয় নি, লেখা হয়েছিল অনেক আগে; এবং ২০০৪ সালের মহান একুশে বইমেলায় 'অন্তরবাসিনী' নামে উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে ব্লগে প্রথম পোস্টটি পর্ব-১ আকারে পোস্ট করা হয়েছিল, যা পর্বাকারে ২০০৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত চলছিল, যদিও শেষের কয়েকটি পর্ব এখনো পোস্ট করা হয় নি। পর্ব-১ পোস্ট করার পর মোটামুটি ভালো সাড়াই পেয়েছিলাম। কিন্তু এখনকার এ লেখাটা হলো গল্পের শুরু, অথচ এটা আগে পোস্ট করা হয় নি। এজন্য এখানে পোস্ট করা হলো। আগের পোস্টগুলো যাঁরা পড়েছেন, এবং যাঁরা পড়েন নি, তাঁদের সবার প্রতি অসংখ্য ধন্যবাদ, এবং সবিশেষ কৃতজ্ঞতা।


হঠাৎ দেখা

মৌরীর জন্য আমার ভিতরে কতোখানি ভালোবাসা লুকোনো ছিল, ওর সঙ্গে আজ দেখা না হলে কোনোদিনই অনুভব করতে পারতাম না। ওকে এক পলক দেখলাম, একটিমাত্র ঝলক, অমনি আমার মহাসমুদ্র উথালপাথাল গর্জনে জেগে উঠলো। আমি ভিতরে ভিতরে ভাবালুতার অতলান্ত গহ্বরে ডুবে গেলাম, হারিয়ে গেলাম। এতোদিন ওকে না দেখে, ওর কাছ থেকে নিজেকে দূরে রেখে কীভাবে বেঁচে থাকলাম! এই বেঁচে থাকা আমার কাছে এক মহাবিস্ময় মনে হলো। মনে হলো, সেই কতো যুগ আগে, সেই কতো শত বর্ষ আগে আমি শেষবার মৌরীকে দেখেছিলাম, তারপর অকস্মাৎ একদিন জীবন থেকে মৌরী হারিয়ে গিয়েছিল, কিংবা হয়তো আমিই মৌরীর কাছ থেকে নিজেকে আত্মগোপনবাসী করে রেখেছিলাম, কিংবা কে জানে, হয়তোবা মৌরী নিজেই আমার কাছ থেকে ওকে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। আজ মনে হলো, আশ্চর্য, আগে কখনো এমন মনে হয় নি, আজ মনে হলো, শেষবার মৌরীকে দেখার পর আমি ওকে কতো খুঁজেছি- পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য, মহাকাশ, সারা 'বিশ্ব-সংসার তন্ন তন্ন করে' খুঁজেছি। আকুল-ব্যাকুল-উতলা হয়ে যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, ঠিক তখনই, মনে হলো আচমকা আমার সামনে এসে মৌরী দাঁড়ালো। মনে হলো, আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত, শুষ্ক মরুর বুকে তপ্তবুক-পিপাসার্ত আমি, আমার সাধ হলো মৌরীকে সাপটে ধরে বুকে জড়িয়ে নিই; মনে হলো, ওকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেই আমার এতোদিনের তৃষ্ণার্ত বুক শীতল হবে।

আবদুল করিমের সাথে দেখা করবার দরকার ছিল। ওর সাথেও বহুদিন দেখা নেই। মেঘুলা বাজার হয়ে কবি নজরুল গার্ল্‌স হাইস্কুলের উত্তর দিকের পথ ধরে আমি হেঁটে যাচ্ছি করিমদের বাড়ির দিকে। পথের দু ধারে আম, জাম, কড়াই, কাঁঠাল, নাম-ভুলে-যাওয়া আরো হরেক রকম লম্বা গাছের সারি, ঘন ডালপালা আর পত্র-পল্লব ছাতার মতো ছেয়ে দিয়েছে গাঁয়ের সরু পথ। কখনো সখনো দুয়েকটি ডোবা- বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে, ব্যাঙের দাপাদাপি। ঝিল্লির তীক্ষ্ণ স্বর। আমার মনে কোনো নারী কিংবা যুবতীর জন্য ভাবনা ছিল না। বরাবরই আমি খুব অর্থকষ্টে থাকি, কিন্তু তখন আমার মনে অর্থাভাবের কোনো কষ্টবোধও ছিল না। আমি আনমনে কখনো বৃক্ষ-তরুর ছাতার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলাম - বৃষ্টিবিধৌত আকাশ কতো সুনীল, খণ্ড খণ্ড শাদা মেঘের বিক্ষিপ্ত ওড়াউড়ি, প্রখর সূর্য, কখনো দৃষ্টি ফেরাই পথের দু পাশে- ডোবার পানিতে ব্যাঙাচির কিলবিল, দুয়েকটা পাখি উড়ে উড়ে এ-ডাল থেকে ও-ডালে যায়, পিটপিট করে তাকায়, বাতাসে খসে পড়া পাতা টুপ করে মাথায় পড়ে - গড়িয়ে ঘাড়ে নামে, নরম সুড়সুড়ি দিয়ে নিচে পড়ে যায়। কখনো পথের উপরে গর্ত, পানি জমে আছে, এখানে-ওখানে কাদা, ছোটো ছোটো লাফে সেই কাদা পার হই, পিছলে মৃদু ভারসাম্য হারিয়ে পা ফসকে পড়ি, আবার সামলে ওঠি - ঠিক তখনই সামনে টুন করে রিকশার ঘণ্টা বেজে উঠলো, আর আমি চমকে থেমে দেখলাম, মোহন ভঙ্গিমায় রিকশায় বসে উজ্জ্বল মিষ্টি হাসছে অপরূপা সুন্দরী যে মেয়েটি - সে মৌরী।

মৌরীর ইশারায় রাস্তার এক পাশে রিকশা দাঁড়ালো।
আমি আমার নিজের অস্তিত্ত্ব ভুলে গেলাম; আমি আমার নিজের উপস্থিতি বিস্মৃত হলাম; আমি নিশ্চয়ই এ মুহূর্তে কাদা-মাটির মর্ত্যে দাঁড়িয়ে নই; আমার চতুর্পার্শ্বে যে-সব গাছপালার বন-বাদাড় ছিল, তা-ও নিশ্চয়ই সত্য নয়; আমি আছি এমন এক স্বর্গের বাগানে যেখানে ফুটে আছে রাশি রাশি সুগন্ধি ফুল, যার স্নিগ্ধ সৌরভে চারদিক মাতোয়ারা। আমি কি মৌরীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি? আমি ঠিক হারিয়ে গেলাম।

'কেমন আছেন?'
মৌরীর প্রশ্নে আমার ঘোর কাটলো। এবার সজ্ঞানে ওর চোখের দিকে তাকাই - মৌরীর চোখে সাগরের সর্বনাশা ঢেউ।
মৌরী আগের মতোই উজ্জ্বল মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করলো, 'বললেন না যে বড় কেমন আছেন?'
আমার বুঝি ভ্রম হলো। আমার মনের গহীন কন্দরে গিয়ে কথাটি বাজলো, 'এতোদিন কোথায় ছিলেন?'
হ্যাঁ, এতোদিন কোথায় ছিলাম? আমার বনলতা সেন, আমার বিরহে ব্যাকুলা প্রিয়তমা, না জানি কতো নির্ঘুম রাত আমার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে কাটিয়েছে, আমার সময় হয় নি ঘরে ফেরার।
'চিনতে পেরেছেন তো?'
অদ্ভূত মিষ্টি কণ্ঠে প্রশ্ন করতেই পুনরায় আমার ঘোর কাটলো। আমি সলজ্জ হেসে বললাম, 'আপনাকে চিনতে কী করে ভুল হয়, বলুন তো? আপনি মৌরী।'
'বাব্বাহ্‌!' আবারও মৌরীর নিঃশব্দ হাসির ছটা ওর চোখ-মুখ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো। আমার অন্তরের ভুবন কেঁপে উঠলো। মনে হলো, শুধু মৌরীর মুখের এক কণা হাসির জন্যই আমি বিধাতার কাছে সারাটি জনম ভরে কৃতজ্ঞ থাকতে পারি, বিধাতা আমাকে আর কিছু দিন বা না দিন, আমার স্বর্গলাভ হয়ে গেছে। মৌরীর হাসি নিরুপম, ওর হাসির মাহাত্ম্য বোঝানোর কোনো উপমা আমার জানা নেই।

ভাড়া মিটিয়ে রিকশা ছেড়ে দেয় মৌরী। ওর হাতে বই-খাতা, কলেজে যাচ্ছে।
রাস্তার ধারে একটা বুড়ো গাছের গুঁড়ির কাছে আমি দাঁড়িয়ে। সর্বাঙ্গে নিঃশব্দ অপূর্ব হাসি ছড়িয়ে মৌরী সামনে এসে দাঁড়ায়। মাথাটি ঈষৎ কাত করে সে যখন আমার দিকে তাকালো, আমার ভুবন ভরে গেলো।
মৌরী অনেক বদলে গেছে। মেয়েরা কি এতো তাড়াতাড়িই এতো বদলে যায়? ওকে শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন ও আরেকটু হালকা-পাতলা ও চপল ছিল। আগের সেই গড়ন পূর্ণাঙ্গতায় ভরে গেছে, শরীরের প্রতিটি ভাঁজ এখন শাণিত , হাসিতে আকর্ষণ বেড়েছে শতগুন। মেয়েরা কেমন করে এতো বদলে যায়? বদলে যায় কেন?

মৌরীর জন্য যে আমার ভিতরে এতোখানি আকুলতা লুকোনো ছিল, ওর সঙ্গে আজ দেখা না হলে আমি কোনোদিনই অনুভব করতে পারতাম না। আমি জানি না, এ আমার সুপ্ত কিশোর-প্রেমের জাগরণ, নাকি সহসাই অন্তর থেকে ভালোবাসার বিস্ফোরণ। আমি কি তখন কিশোর ছিলাম? নাকি বালক হয়ে গেছি? কিশোর কিংবা বালক, কিংবা যুবক ছিলাম। আমারও শরীর ছিল, মন ছিল, মনের জমিনে বোনা ছিল ভালোবাসার বীজ। সেই বীজ গা থেকে খোসা ঝেড়ে ফেলে অকস্মাৎ অংকুরিত হলো!



যেখান থেকে শুরু

অন্তরে প্রস্রবণ

এসএসসি. পরীক্ষায় আমাদের সেন্টার ছিল জয়পাড়া। উপজেলার সকল স্কুলের জন্য এই একটি মাত্র সেন্টার। উপজেলা সদরে অবস্থিত জয়পাড়া পাইলট হাইস্কুলের কক্ষগুলোতে আসন ব্যবস্থা করা হয়।
সে সময়ে বাসের ব্যবস্থা তো ছিলই না, এমন কি রিকশারও প্রচলন খুব একটা শুরু হয় নি। পরীক্ষার মৌসুম এলেই সেন্টারের আশেপাশে একটু মাথা গুঁজবার ঠাঁই পেতে হিমসিম খেতে হতো। দূর থেকে যেসব ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিতে আসতো, তাদের গ্রামগুলোর দূরত্ব জয়পাড়া বাজার থেকে পাঁচ-ছয় মাইলেরও বেশি ছিল। উত্তরে নুরুল্লাপুর, কার্তিকপুর, পালমগঞ্জ, রায়পাড়া, হাস্নাবাদ, লটাখোলা, মাঝিকান্দা, বাহ্রা - পূর্বে নিকড়া, বানাঘাটা, কাটাখালি, ডাইয়ারকুম, ডাইয়াগজারিয়া, ঘাড়মোড়া, মুন্সীকান্দা - দক্ষিণে নূরপুর, দোহার, সুতারপাড়া, ঝন্‌কী, মালিকান্দা, মেঘুলা, শিমুলিয়া, নারিশা, মকসুদপুর, সাতভিটা, শাইনপুকুর - পশ্চিমে পদ্মা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল চর এলাকা - এতো দূর-দূরান্ত থেকে আগত ছেলেমেয়েরা জয়পাড়া বাজারের চারপাশে অবস্থিত আবাসিক-অনাবাসিক জায়গাগুলোতে অনেক কষ্টে-সৃষ্টে একটুখানি ঠাঁই করে নিত।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি ছোট কক্ষে আমারও একটুখানি মাথা গুঁজবার ঠাঁই জুটেছিল। এর পেছনে অবশ্য আমার কোনো ভূমিকা কিংবা কৃতিত্বই ছিল না। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জনৈক বড় কর্মকর্তার সঙ্গে আমার সহপাঠী শেরখানের বড় মামার বেশ সুসম্পর্ক ছিল, সেই জোরেই ওর জন্য খুপরির মতো একটি কক্ষ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এবং শেরখানের সঙ্গে যেহেতু আমার সম্পর্কটি 'সু' উপসর্গ যুক্ত ছিল, অতএব ওর রুমমেট পদ-প্রার্থী হওয়ার জন্য আমি ভিন্ন দ্বিতীয়টি কেউ ছিল না।

পরীক্ষা শুরু হওয়ার দুদিন আগেই শেরখান এবং আমি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে বসবাস শুরু করলাম। অবশ্য শুধু আমরা দুজনই নই, দূর-দূরান্তের আরো বহু ছাত্রছাত্রী এসে উপস্থিত হলো।
দুদিন পরই পরীক্ষা। তা সত্ত্বেও সেদিন বোধ হয় কারো সহসাই পড়ালেখার কথা মনে পড়লো না। বিকেল বেলাটায় যেন মিলন মেলা বসলো - কে কোথায় ঘাঁটি গেড়েছে, কারা কারা বাসা যোগাড় করতে ব্যর্থ হলো, এসব বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া; কার প্রস্তুতি কেমন হলো ইত্যাদি আলোচনায় বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, এবং সন্ধ্যার পরও বেশ কিছুক্ষণ বাইরে বাইরে কাটলো।

সেদিন বহু রাত অব্দি পড়াশুনা করলাম। সকালে উঠতে তাই বেশ দেরি হয়ে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে নিলাম। শেরখান অবশ্য খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসেছে। ও আমার মতো অতো রাত জাগে নি।
ছোটো রুমটার পূব পাশে একটা ডাবল সাইজের খাট যেখানে আমরা দুজন শুই, উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে পড়ার জন্য এক জোড়া করে চেয়ার টেবিল। পশ্চিমে জানালা, উত্তরে এই ছোটো রুমটার জন্য একটা ক্ষুদ্র বারান্দা, যেখানে বসলে উত্তরের আকাশ, পূবের আকাশ, পশ্চিমের আকাশ আর আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত যা কিছু দৃশ্যমান তার সবই দেখতে পাওয়া যায়।

উত্তরের চেয়ার-টেবিল জোড়া শেরখানের জন্য বরাদ্দ, অবশ্য এই বরাদ্দ সে নিজেই করেছিল, যেহেতু বলা যায় পুরো রুমটাই ওর; এবং বরাদ্দ দান এবং বাতিলের অধিকারও একমাত্র ওরই। শেরখান ওর বরাদ্দপ্রাপ্ত জায়গাতে বসেই পড়ালেখা করে, যদিও আমি শুয়ে শুয়ে পড়তেই অভ্যস্ত এবং বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।

হঠাৎ লক্ষ করি, শেরখান কিছুক্ষণ পর পরই চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বারান্দায় চলে যায়, কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর আবার আগের জায়গায় এসে পড়তে বসে।
ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় মনে হলো। জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী রে, বার বার বারান্দায় যাচ্ছিস যে?
এমনিই। শেরখান বইয়ের পাতা উল্টোতে উল্টোতে জবাব দেয়।
কিন্তু আমি মনে মনে কিছুতেই মানতে পারলাম না শেরখান শুধু এমনি এমনিই বারান্দায় পায়চারি করতে বেরুবে। ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময়ই থেকে গেলো।
এমনিভাবে শেরখান আরেকবার বারান্দায় বেরুবার পর আমি চুপি চুপি দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, আমার ঘুঘু বন্ধুটি সামনে ঝুঁকে বাঁকা হয়ে বারান্দার কোমর-উঁচু দেয়ালের ওপরে দু-হাতে ভর করে দাঁড়িয়ে, আর তার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয়ে আছে মাত্র বিশ-পঁচিশ গজ দূরে অবস্থিত আমাদেরই এই কোয়ার্টারটির মতো আরেকটি কোয়ার্টারের নিচতলার জানালার ভিতরে। কিন্তু জানালাটি যে একেবারে ফাঁকা, শূন্য, খা খা করছে! আমি অবাক হলাম, কী এমন অপরূপ রূপ আছে ঐ শূন্য জানালার যে, শেরখানের মতো এই ভদ্র যুবকটি এক দৃষ্টিতে সেখানে তাকিয়ে থাকবে?
শেরখান ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলাম এবং দুজনেই ফিক করে হেসে উঠলাম।
আসল ব্যাপারটা বল্‌ না দোস্‌। আমি শেরখানের কাছে ব্যাকুল আকুতি জানাই।
শেরখান মুচকি হেসে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, প্রজাপতি... প্রজাপতি রে দোস্‌, মাথাটায় একদম চক্কর লেগে গেছে।
আমি অভিমান করে বললাম, আমার সঙ্গে এতোখানি বেঈমানি করলি? কাল থেকে কম করে হলেও তুই পঞ্চাশবার প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখেছিস, আমাকে একবারও বললি না?
শেরখান যখন ভিতরে ভিতরে অস্থির থাকে তখন সে দ্রুত বইয়ের পাতা উল্টোতে থাকে, মনে হয় অতি দ্রুত পাতা উল্টিয়ে বইয়ের ভিতরে সে কী যেন খুঁজছে। শেরখান তেমনি দ্রুত পাতা উল্টোতে উল্টোতে আফসোসের স্বরে বলতে থাকে, সেই কথাই বলি রে দোস্‌, পঞ্চাশবার কেন, আর মাত্র একটিবারও যদি চর্ম চক্ষে ঐ জিনিস দেখতে পেতাম, কিসের শালার এই রসকষহীন ফিজিক্স আর ইলেক্টিভ ম্যাথ ঘাঁটাঘাঁটি, আমি বৈরাগী হয়ে বনে চলে যেতাম রে দোস! আমি চাই না এই সংসার-ধর্ম, দুটি চক্ষু বুজে আমি আমৃত্যু সেই সুন্দরের ধ্যান করে যেতাম। আফসোস, প্রজাপতিরা আর এলো না!

আমি শেরখানের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। ওর ঘাড়ে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করি, এমন জিনিস কখন দেখলি, দোস্‌?
গতকাল বিকেলে, শেরখান বলতে থাকে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে মনে 'ফটিক' চরিত্র রিভিশন দিচ্ছিলাম। হঠাৎ ঐ বিল্ডিংয়ের ছাদে আমার চোখ আটকে গেলো। এক ঝাঁক প্রজাপতি, ওদের ঝলকানিতে আমার চোখ একেবারে ঝলসে গেলো। ওরা ছাদের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় হাঁটছিল, আর ওদের প্রতি কদমে আমার হৃৎপিণ্ডে ঘসা লেগে ঠক ঠক করে আওয়াজ হচ্ছিল। আমি নিশ্চিত, ওরা ঐ বিল্ডিংয়েই থাকে। কারণ আমি ওদেরকে ওখান থেকে অন্য কোথাও বের হতে দেখি নি।
আমি বললাম, কিন্তু এটা নিশ্চিত হলি কী করে ওরা ঐ জানালার ধারেই বসবে?
বা রে, শেরখান বলে, ওটা তো এই বিল্ডিংয়ের মতোই। ওপর তলার দুই ফ্ল্যাটে দুই ফ্যামিলি থাকে, নিচতলার অন্য পাশের ফ্ল্যাটে থাকে আরেকটা ফ্যামিলি। আর আমাদের এ-পাশের ফ্ল্যাটটা দেখাই তো যাচ্ছে খালি পড়ে আছে। ওরা খালি ফ্ল্যাটে না ঢুকে কি ভরা ফ্ল্যাটে ঢুকবে?
আমি হেসে দিয়ে বললাম, পাগল হয়েছিস? এক সংগে দশ-বারোটা মেয়ে এক রুমে থাকবে কেমন করে? ওরা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও থেকে এখানে বেড়াতে এসেছিল।
শেরখান তাজ্জব বনে যায়। বলে, দশ-বারোটা মেয়ে পেলি কোথায়?
তুই-ই তো বললি একঝাঁক প্রজাপতি। আমি বললাম।
হ্যাঁ, একঝাঁক বলছি তা ঠিক, শেরখান সংখ্যা-তত্ত্ব বুঝিয়ে বলে, তবে তিন-চারটা মেয়েকে কি একঝাঁক মেয়ে বলা যায় না? ওরা ছিল মোট চারটা প্রজাপতি, যেন বেহেশ্‌ত থেকে নেমে আসা একঝাঁক হুরপরী রে!
আমি কৌতুক করে বলি, তাহলে দোস্‌ আর আফসোস করো না। ওরা বেহেশ্‌তের পাখি বেহেশ্‌তেই ফিরে গেছে।
কিন্তু শেরখানের মনে কি আর আমার প্রবোধ ধরে? সে বার বার চেয়ার ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে পায়চারি করতে থাকলো। আমি খাটের ওপর শুয়ে শুয়ে পরের দিনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার প্রস্তুতি নিলাম।

কিন্তু আমারও পড়ায় মন বসছিল না। আমার সমস্যাটা আবার শেরখানের মতো প্রজাপতি কিংবা মেয়েঘটিত নয়। মেয়েঘটিত কোনো সমস্যা যে আমার জীবনে কোনোদিন ঘটবে না সে সম্পর্কে আমি একশত ভাগ নিশ্চিত ছিলাম। কেননা, আমি সর্বদা মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলেছি। মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলার কথাটা অবশ্য আমি একটু ঘুরিয়ে অন্যভাবে বলেছি। আসল ঘটনা হলো মেয়েদের সামনে আমি নিজেকে উপস্থাপন করতে পারি না। ওদের সামনে লজ্জায় আপনা-আপনি আমার মাথা নিচু হয়ে আসে, একেবারে অকারণেই। এবং কী কারণে ওদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হবো সেটাও একটা উপযুক্ত প্রশ্ন বটে। ছেলে বন্ধুদের দ্বারাই অনায়াসে যে কাজটার সমাধান সম্ভব, তার জন্য মেয়েদের দ্বারস্থ হওয়া অত্যন্ত অসঙ্গত ব্যাপার। মেয়েরা এতে খোটা দিতে মুহূর্তকাল বিলম্ব করে না, বলে, ছেলেটা কী নারীঘেঁষা রে বাবা, একেবারে নির্লজ্জ! বেহায়া!
আরেকটি কথা হলো, মেয়েদের সাথে দু-চারটে অত্যাবশ্যক কথা বলতে গেলে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, মুখে কথা সরে না। অতীতে বহুবার এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছি। মেয়েরা মুখে ওড়না চেপে ঘ্যাঁৎ ঘুঁৎ করে চাপা হাসি হেসেছে, আমার বহুবার মরে যেতে ইচ্ছে করেছে।

বলছিলাম, আমারও পড়ায় মন বসছিল না। তাহলে আমার সমস্যাটি কী ছিল? সেটা অত্যন্ত কঠিন সমস্যাই বটে। তা আর কিচ্ছুটি নয়, ছাত্রদের ঘোড়ারোগ - কবিতা লেখার ব্যাকুল বাসনা। আমার কেবলই ইচ্ছে হচ্ছিল বইপত্র চুলোয় ঢুকিয়ে কবিতা লিখতে বসে পড়ি। কিন্তু মনে ইচ্ছে হলেই তো আর তা করা হয়ে ওঠে না। পরীক্ষা পাশের আমার কোনো প্রয়োজন না থাকতে পারে, কিন্তু আমার পাশের জন্য যে বাবা-মা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, অনেক আশায় বুক বেঁধে আছেন, তাঁদের মনে তো আর আঘাত দিতে পারি না। আবার, আমার বাবা-মা হয়তো 'পাশ' নামক একটা সাধারণ সনদ পেয়েই পরম সন্তুষ্টি লাভ করবেন, কিন্তু একটা দুর্দান্ত ফলার্জনের আশায় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও শুভাকাঙ্ক্ষীগণ আমার পেছনে যে শ্রম দিয়েছেন, সেজন্য আমি কিছুতেই তাঁদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না; তাঁদের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতা ও সম্মানবোধ আছে।



অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪

পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
পুরো উপন্যাসের পিডিএফ কপি
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১২:০৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×