আমরা যে-সময়ে ১ম বা ২য় শ্রেণীতে পড়তাম সে-সময়ে অংকে ২০ নম্বরের ‘মানসাংক’ থাকতো। আমরা একে ‘মানুষ অংক’ বলতাম। একে মানুষ অংক কেন বলতাম তা বু্ঝবার অনেক চেষ্টা করেছি। একটা ধারনা ছিল এরকম- একজন মানুষ (শিক্ষক) বসে বসে মুখে মুখে এ অংক জিজ্ঞাসা করেন বলেই এর নাম ‘মানুষ অংক’ হয়ে থাকবে। ৪-৫টা অংক মুখে মুখে জিজ্ঞাসা করতেন মাস্টার মহাশয়, আমরাও মুখে মুখেই জবাব দিতাম। এরপর শুরু হতো ৮০ নম্বরের লিখিত অংক পরীক্ষা। আপনারা যাঁরা ৭৩-৭৪ সালের দিকে ১ম বা ২য় শ্রেণীতে পড়তেন, তাঁরা হয়তো ‘মানসাংক’র সাথে পরিচিত। বাকিদের ব্যাপারে আমার কোনো আইডিয়া নেই।
আপনারা এখানে কিছু সরল অংকের ধাঁধা দেখেছেন, যেখানে ব্লগার স্বাধীনতার বার্তা ও ভারসাম্য তাঁদের অসামান্য পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন; আবার অংকের জটিলতা দেখে অনেকের মাথা ঘুরে যাবার মতো অবস্থাও হয়ে থাকতে পারে, বিশেষ করে যাঁরা অংককে ভয় পেয়ে থাকেন ব্লগার ভারসাম্য ও স্বাধীনতার বার্তাকে সবিশেষ ধন্যবাদ অংকের ধাঁধায় তাঁদের অদম্য উৎসাহের জন্য। ব্লগার আবিরে রাঙ্গানো'র জন্য আমি এখনো অপেক্ষায় আছি।
এবার আর অংকের ধাঁধা নয়, আসুন, বাল্যকালের স্মৃতি ঘেঁটে কিছু 'মানুষ অংক' কষবার চেষ্টা করি।
ঈদে বাড়িতে গিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল। একদিন রাতে ভাগ্নি, ভাতিজা, মেয়ে, ছোটো ভাইয়ের বউয়ের কাছে ‘ভূত’-এর গল্প শুনছিলাম। তারপরদিন ছিলাম পুরোপুরি ফ্রি। তাই কিছু ‘মানুষ অংক’র খেলা খেলতে সাধ হয়েছিল।
'মানুষ অংক' : পূর্ণ মান - ২০
১। একটা বটগাছে ৫টা পাখি বসে ছিল। একজন শিকারি বন্দুক দিয়ে ২টি পাখি মেরে ফেললো। কয়টা পাখি থাকলো?
২। ৫ গজ দূরে দূরে গাছ লাগানো হলে ২০ গজ জায়গায় কয়টা গাছ লাগানো যাবে? সতর্কতা : যাঁরা বেশি কনফিডেন্ট, তাঁরা দয়া করে নিশ্চিত হয়ে উত্তর দেবেন
৩। পাঁচসিকা নিয়া বাজারে গেলে। দশ পয়সার পান, দুই আনার জর্দা, এক আনার খর ও এক আনার বাতাশা কিনলে। ৫ পাই দিয়ে একটা আইসক্রিম কিনে খেলে। তোমার জিপে কতো থাকলো? (উত্তরদাতারা আশা করি পয়সা, পাই, আনার হিসাব জানেন)।
৪। একটা ম্যাচ বাক্স’র দাম ১০ পাই হলে এক গ্রস ম্যাচবাক্স’র দাম কত?
৫। এক সারিতে ১০টা গাছ লাগালে ১০ সারিতে কয়টা গাছ লাগানো যায়? এটার উত্তর বের করতে খাতার পর খাতা নষ্ট হয়ে যেত! ক্ষেত, ভিটা, ইত্যাদি আঁকাআঁকি করে গাছ লাগাতে হতো
এবার একটু উচ্চতর গণিত
ডিফিকাল্টি লেভেল : ৩য় থেকে ৭ম শ্রেণীর পাঠ্যবই
৬। শতকরা কতো হার সুদে ১০০ টাকা ৫ বছরে সুদে-মূলে ৫ গুণ হবে?
৭। পিতা ও পুত্রের বর্তমান বয়স একত্রে ৪৪ বছর। ১০ বয়স আগে পিতার বয়স পুত্রের বয়সের ১১ গুণ ছিল। ১০ বছর পর পিতার বয়স পুত্রের বয়সের কতো গুণ হবে?
৮। একটা চৌবাচ্চায় দুটো নল আছে। ১ম নল দিয়ে ১০ মিনিটে এবং ২য় নল দিয়ে ১৫ মিনিটে চৌবাচ্চাটি পূর্ণ হতে পারে। পূর্ণ চৌবাচ্চার নল দুটি একত্রে ছেড়ে দিলে কতো মিনিটে ওটি খালি হবে?
৯। আফগানিস্তান ও গুলিস্তানের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৬৫০ মাইল। বাংলাদেশের একটা বাস ১০০ মাইল বেগে, এবং আফগানিস্তানের একটি বাস ৫০ মাইল বেগে যথাক্রমে কান্দাহার ও গোলাপ শাহ্'র মাজারের দিকে রওনা হলো। বাস দুটোর স্টার্ট টাইম ১২০০ ঘটিকা (গ্রিনিচ মিন টাইম) হলে স্টার্ট করার কতো সময় পর বাস দুটো পরস্পরকে অতিক্রম করবে? সূত্র : সরল অংক করুন। তবে এ অংকটির সাহায্য নিয়ে ক্রিটিক্যাল রেজাল্টও বের করতে পারেন
১০। এটি তৈলাক্ত বানর ও 'আঁইক্কাযুক্ত' বাঁশের অংক। আপনারা যে-যাঁর খুশি মতো অংকটি ফ্রেম করে নিজে কষতে পারেন, অন-এয়ার বা ব্লগেও দিতে পারেন, আমার কোনো আপত্তি নেই
সময় কাটানোর জন্য : ধাঁধাপাগলদের জন্য পোস্ট
শেষ করার আগে আড্ডার কথা
ঈদের কয়েকদিন আগের কথা। শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছুলাম রাত বারটার দিকে। এসে দেখি আমার মেয়ে, ভাগ্নি, ভাতিজা ও ছোটো ভাইয়ের বউ এক রুমে অন্ধকারে জড়ো হয়ে মোবাইলে রেকর্ড করা ভূত-এফএম-এর গল্প শুনছে। আমি ওদের সাথে যোগ দিই। কয়েক মিনিট শুনবার পর বলি, 'চলো, আজ আমি নিজেই তোমাদেরকে ভূতের গল্প বলবো, যেগুলো আমার জীবনে ঘটেছিল।' এ কথা বলতেই সবাই কলকলিয়ে লাফিয়ে উঠে আমার ঘরে চলে এলো। আমি এক একটা গল্প বলি, ওরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়। 'এগুলো কবে ঘটেছিল আপনার জীবনে? আপনি বেঁচে গেলেন কীভাবে?' আমি বলি, 'এগুলো আমার জীবনে ঘটে নি, এগুলো হলো একেকটা বানানো গল্প, যা ইতোমধ্যে 'সবুজ অঙ্গন' লিটল ম্যাগাজিনের বিভিন্ন সংখ্যায় ছাপা হয়ে গেছে, এবং যা নিয়ে আগামীতে একটা বই বের হতে পারে, ২০১৪ বা ২০১৫'র দিকে।' এরপর আমার ঘরে ভূতের গল্প বলার জমজমাট আড্ডা শুরু হলো। ভাগ্নি, ভাতিজা, মেয়ে এবং ছোটো ভাইয়ের বউ একটার পর একটা গল্প বলছে, সবাই শুনছে মুগ্ধ হয়ে। এমন সময়ে ভাতিজা ফ্লোর নিয়ে বললো, 'আমিও একটা ভূতের গল্প বলবো।'
'বলো, বলো।'
ভাতিজা খুব উৎসাহ নিয়ে বলতে লাগলো, 'একদিন আমরা তিন বন্ধু গভীর রাতে মেলা থেকে ফিরছিলাম। দোহারপুরীর কুমার বাড়ি ও চোরামন সাধুর বাড়ির ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসলাম। কিন্তু আমরা কোনো ভূত দেখি নাই।' ক্লাস নাইনে পড়ুয়া ভাতিজার ভূতের গল্প শুনে হাসতে হাসতে আমাদের দম ফাটার অবস্থা
শেষ হয়েও হলো না শেষ - অদ্ভুত অলৌকিক
অনেক আগে আমার বাবার কাছে একটা অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছিলাম, যার উপর ভিত্তি করে 'চৈতিবিবির দিঘি' নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। গল্পটি লিখবার পর মনে হয়েছিল বাবা গল্পটি ঠিক এভাবে বলেন নি; কিন্তু কীভাবে বলেছিলেন তাও মনে করতে পারছিলাম না। ভূতের আড্ডা যেদিন বসলো, তার কদিন পর বাবার কাছ থেকে সেই পুরোনো গল্পটি পুনর্বার শুনলাম।
এ গল্পটি আমার বাবা ছোটোবেলায় তাঁর বাবার কাছে শুনেছিলেন; তাঁর বাবা (আমার দাদা) তাঁর ছোটোবেলায় তাঁর দাদার কাছে শুনেছিলেন, যিনি তাঁদের ছোটোবেলায় তাঁদের দাদাদের কাছে এটি শুনেছিলেন বলে জানা যায়। আদতে এটি কবে ঘটেছিল তার কোনো সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই।
আমাদের গ্রামের পশ্চিমে গাজীরটেক, তারও পশ্চিমে গভীর বনজঙ্গলে ছাওয়া দোহারপুরী। দোহারপুরীর রাহীম চুকদার একবার একটা বিশাল দিঘি খনন করেছিলেন। আশ্বিনে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর দিঘি খনন শুরু হয়; প্রতিদিন শত শত কোদালি উদয়াস্ত মাটি কেটে সেই দিঘি খনন করতে লাগলো। দিঘির তলদেশ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকলো। কিন্তু আশ্চর্য, দিঘির তলায় কোনো পানির আভাস নেই। এখানে-সেখানে অল্প কয়েক হাত কূয়া খনন করলেই ডগডগিয়ে পানি উঠতে থাকে, অথচ রাহীম চুকদারের দিঘির তলদেশ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। তিনি খুব চিন্তিত হলেন। রহস্য কী? একদিন রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ ধান-দূর্বা দিয়ে দিঘিতে সাতপাঁক ঘুরে বর দান করলেই পাতাল থেকে পানি উঠে দিঘি ভরে যাবে। স্বপ্নের কথা শুনে পুত্রবধু বরদানে রাজি হলো।
একদিন নির্জন ভরদুপুরে পুত্রবধূ ধান ও দূর্বার বর নিয়ে শুকনো দিঘিতে নামলো। দিঘির চারকোনায় ঘুরে সাত পাঁক পুরো করতেই প্রবলবেগে পাতাল থেকে পানি উঠতে থাকলো, এবং চোখের পলকে সুবিশাল দিঘি কানায় কানায় ভরে উঠলো। কিন্তু হায়, পুত্রবধূ দিঘির গভীর তলদেশে হারিয়ে গেলো।
ঐ পুত্রবধূর একটা দেড় বছরের পুত্রসন্তান ছিল। একদিন বাড়ির এক ভৃত্য দুপুরবেলায় দিঘির পাড়ে এসেই চমকে উঠলো- দিঘির পানিতে পা ডুবিয়ে পাড়ে বসে পুত্রকে দুধ খাওয়াচ্ছে পানিতে ডুবে যাওয়া পুত্রবধূ। হায় হায় রব ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। এবং কিছুদিন পর পরই এ দৃশ্য অনেকের চোখে ধরা পড়তে থাকলো। এমনই একদিন দুধ খাওয়ানোর সময় রাহীম চুকদারের ছেলে তার স্ত্রীকে দেখে সবেগে বুকে জড়িয়ে ধরে। স্ত্রীকে সে কিছুতেই যেতে দেবে না। কিন্তু তার ফিরে না গিয়ে উপায় নেই। তার 'মহাজন'ই তাকে দূর থেকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সময় জোরজবরদস্তি করে স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পানিতে ডুব দিল। এরপর আর কোনোদিন তাকে দেখা যায় নি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১০:৪৯