তাজমহল দর্শন শেষে বেলা আটটা নাগাদ আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। সবাইকে বললাম নাস্তার আগে রুমে গিয়ে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে একেবারে তৈরী হয়ে ডাইনিং এ আসার জন্য। নাস্তা করেই আমরা হোটেল হতে চেক আউট করে সোজা চলে যাবো আগ্রা ফোর্ট দেখতে। আগ্রা ফোর্ট ভ্রমণ সমাপ্ত হলে যাবো ফাতেহপুর সিক্রি। সেখান থেকে আজকে সন্ধ্যা নাগাদ জয়পুর গিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপনের জন্য হোটেল বুক করা হয়েছে।
যাই হোক, হোটেলে সানের আবাসনের মত নাস্তাও ভালো ছিলো। সকালের ঘোরাঘুরি সবার ক্ষুধাকে উসকে দিয়েছিলো, তাই তৃপ্তি সহকারে নাস্তা শেষে আয়েশ করে এক কাপ চা পাণের জন্য আরও কিছুটা সময় দেয়া হল। দশটা নাগাদ আমরা রওনা হলাম আগ্রা ফোর্ট এর উদ্দেশ্যে।
গজনভীর গেট
আগ্রা ফোর্ট ভারতীয় মোগল স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন, যদিও এই দুর্গটি মোঘলদের আগমনের পূর্বেই বিদ্যমান ছিলো। ১১ শতকে নির্মিত একটি প্রাচীন দুর্গের সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে আজকের এই আগ্রা ফোর্ট। ইতিহাসে ১০৮০ সালে সর্বপ্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায় যখন গজনভীর সামরিক বাহিনী এই দুর্গ দখল করে। পরবর্তীতে ১৪৭৫ সালে বাদলগড় নামে আগ্রা ফোর্ট এর ইতিহাস মেলে যা ছিলো মূলত রাজা বাদল সিং এর অধীনে ইটনির্মিত একটি সামরিক দুর্গ। এরপর আগ্রা ফোর্টে যে নামটি জড়িয়ে তা হল সিকান্দার লোদি, যিনি ছিলেন সুলতান বাহলুল খান লোদির পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর সিকান্দার লোদি ক্ষমতায় আরোহণ এর পর তার শাসন অঞ্চল গোয়ালিওর ও বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন।
মতি মসজিদ
আর এই গোয়ালিওর দুর্গ জয়ের জন্য সিকান্দার লোদি পাঁচবার আক্রমণ করেন এবং প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হন। তার এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দিল্লী থেকে গোয়ালিওর এর দূরত্বকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করেন সিকান্দার লোদি। তাই তিনি ১৫০৩ সালে আগ্রা শহর নির্মাণের জন্য তিনি অনুমোদন দেন এবং দিল্লী থেকে তার রাজধানী আগ্রায় স্থানান্তর করে সুলতানি আমলে আগ্রা থেকেই রাজকীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত করতে থাকেন। সেই সময় সিকান্দার লোদি এই কেল্লার বেশ কিছু ইমারত ও ইদারা নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৫২৬ সালে দিল্লী জয়ের পর সম্রাট বাবর আগ্রা দুর্গে অবস্থান করেন। তিনি এখানে একটি বাউলি (সিঁড়ি যুক্ত ইদারা) নির্মাণ করেন। ১৫৩০ সালে এই দুর্গে সম্রাট হুমায়ুনের রাজ্যাভিষেক হয়। ১৫৪০ সালে হুমায়ুন বিলগ্রামে শের শাহরে কাছে পরাজিত হন। ১৫৫৫ সাল পর্য়ন্ত এই দুর্গ শের শাহের দখলে থাকে। এরপর হুমায়ন আগ্রা দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। ১৫৫৬ সালে আদিল শাহ শূরীর সেনাপতি হিমু আগ্রা ফোর্ট পুনরায় দখল করে।
চিত্রে হিমু ১৫৫৩ সালে আগ্রা জয় করেন এবং ১৫৫৬ সালে আবার আকবরের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন
এরপর আকবর পুনরায় এর দখল নিয়ে পরবর্তীতে ১৫৫৮ সালে সম্রাট আকবর আগ্রায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। সম্রাট আকবর রাজস্থানের আরাউলি থেকে সংগ্রহীত বেলেপাথর দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আগ্রা দুর্গটির সংস্কার সাধন করেন। দুর্গের ভিতরের অংশে ইটের গাঁথুনি আর বাইরের অংশে আছে বেলেপাথরের আস্তরন। প্রায় ৪ হাজার কর্মী ৮ বছর প্রতিদিন পরিশ্রম করে ১৫৭৩ সালে আগ্রা দুর্গের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে। সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে আগ্রা দুর্গ তার বর্তমান রূপ লাভ করে। শাহাজাহান লাল বেলেপাথরের নির্মিত ইামারতের চেয়ে স্বেত পাথর দ্বারা নির্মিত ভবন অধিকতর পছন্দ করতেন।
খাস মহল
এরপর বিভিন্ন সময়ে মারাঠা ও তাদের শত্রুরা আগ্রা দুর্গের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৭৬১ সালে আহমেদ শাহ আবদালি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজিত করলে পরবর্তী এক দশক মারাঠারা এই দুর্গ দখলের কোন চেষ্টা করতে পারেনি।পরে এই দুর্গ ব্রিটিশ রা দখল করে নেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে এই দুর্গে দেশীয় সিপাহী ও ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
জাহাঙ্গীরের কুয়া
প্রায় আড়াই কিলোমিটার আয়তনের আগ্রা ফোর্ট এর অভ্যন্তরে অনেকগুলো প্রাসাদ, মিনার এবং মসজিদ আছে। এগুলো মূলত ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত হয়। দূর্গের ভেতরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ হলঃ খাস মহল, শীশ মহল, মুহাম্মান বুৰ্জ (এটি অষ্টভূজাকৃতির মিনার), দেওয়ান-ই-খাস (১৬৩৭), দেওয়ান-ই-আম, মোতি মসজিদ (নিৰ্মাণকাল ১৬৪৬-৫৩) এবং নাগিনা মসজিদ (১৬৫৮-১৭০৭)।
দিওয়ান-ই-আম
পুরো দুর্গটি যতটা সময় নিয়ে দেখার দরকার ছিলো আমাদের সংক্ষিপ্ত সফরকালে ততটুকু সময় দিয়ে আমাদের দেখা হলো না। আমি সবাইকে দুই ঘণ্টা সময় দিয়ে ছেড়ে দিলাম নিজেদের মত করে ঘুরে দেখতে। কেননা দলবেঁধে গাইড নিয়ে এই দুর্গ দেখতে গেলে চারপাঁচ ঘন্টার নীচে হবে না। সবাই নিজেদের মত করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ঘুরে দেখতে লাগলো এই মোঘল আমলের অপরূপ নিদর্শন।
আমরা যে সময়টা ভ্রমণে ছিলাম তখন দিল্লী এবং এর আশেপাশের এলাকার তাপমাত্রা ৩৮-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিলো, গরমে সবাই অতিষ্ঠ্ হয়েছিলাম সেইবার। কিন্তু এই ফোর্টের অভ্যন্তরে ভ্রমণে সবাই কমফোর্ট ফিল করতে লাগলো। নিজেদের চর্মচক্ষু এবং যান্ত্রিক ক্যামেরা দুটোতেই বন্দী করে নিলো দেওয়ান ই আম, দেওয়ান ই খাস,জাহাঙ্গিরি মহল, জাহাঙ্গীরের কুয়া, শীশমহল, গজনীর গেট, মতি মসজিদ সহ পুরো দুর্গটিকে। দূর্গ হতে অদূরেই ছিলো দাঁড়িয়ে তাজমহল। তার জীবনের শেষ কয়েক বছরে, শাহজাহান তার পুত্র আওরঙ্গজেব কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত এবং এই দুর্গে বন্দী হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বন্দী শাহজাহান তাজমহলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন বলে ইতিহাসে জানা যায়।
দুপুর বারোটার আগে আগেই আমরা এখান হতে বের হয়ে রওনা দিলাম ফাতেহপুর সিকরির উদ্দেশ্যে, প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্বে আগ্রাফোর্ট হতে এই প্রাক্তন মুঘল সচিবালয় এবং আবাসখানা। আমাদের ভ্রমণের কিছু ছবিঃ
তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ
উইকিপিডিয়া বাংলা
উৎসর্গঃ আমার ভারত ভ্রমণের এই সিরিজটি ব্লগার "কামরুন নাহার বীথি" আপাকে উৎসর্গ করছি। উনি আমার এই ট্যুরে ট্যুরমেট ছিলেন। গত পহেলা জানুয়ারী রাত এগারো ঘটিকায় বীথি আপা আল্লাহ্র ডাকে সারা দিয়ে পরপারে চলে গেছেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে। আল্লাহ্ তার শোকার্ত পরিবারকে এই শোক সইবার ধৈর্য দাণ করুন। আর আপাকে পরপারে আল্লাহ্ সকল গুনাহ (যদি থাকে) মাফ করে তার কবরে আজাব মাফ করুন এবং আখেরাতে বেহেশত নসীব করুন।
প্রথম পর্ব থেকে বীথি আপার এই ট্যুরে যুক্ত হওয়ার ঘটনাটা আবার তুলে ধরলামঃ
ঈদের কয়েকদিন আগে আমি কোন একটা কাজে নীলক্ষেত মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো, কল রিসিভ করতে অপরপাশ থেকে অচেনা কণ্ঠস্বর। আমাদের দলের সাথে যুক্ত হতে চায় এই ট্রিপে। “সামহোয়্যার ইন ব্লগ” এ তখন পর্যন্ত আমার পূর্বপরিচিত কেউ ছাড়া আর কারো সাথে পরিচয় ছিলো না। “সাদা মনের মানুষ” খ্যাত কামাল ভাই এর সাথে পরিচয় ভ্রমণ বাংলাদেশ থেকে। সেই কামাল ভাই এর কাছ থেকে খবর পেয়ে ফোন দিয়ে প্রিয় ব্লগার কামরুন নাহার বীথি আপা। উনি এবং ভাইয়া যুক্ত হতে চাচ্ছেন আমাদের সাথে। আমি একদিন সময় নিয়ে উনাকে কনফার্ম করলাম উনাদের যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা। এরপর উনাদের এয়ার টিকেট এর ব্যবস্থা করা হলো। দল গিয়ে দাড়ালো দশজনের। সিদ্ধান্ত হল চারজনের একটা দল ঈদের দিন রাতে রওনা হয়ে যাবো কলকাতার উদ্দেশ্যে। একদিন পরে বাকী ছয়জন রওনা হবে, যেহেতু কোরবানী ঈদের ছুটি, তাই অনেকেই সারাদিনের কোরবানীর হ্যাপা পোহানোর পর সেদিন রাতেই রওনা হতে রাজী হলো না। ফলে আমরা যে চারজন আগে রওনা হবো, তারা একরাত কলকাতা থেকে পরেরদিন সরাসরি বিমানবন্দর চলে যাবো। অপর দলও সরাসরি বেনাপোল বর্ডার হতে দমদম বিমানবন্দর চলে আসবে। এরপর ঢাকা থেকে সকলের কলকাতার বাসের টিকেট এবং আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে অপেক্ষার পালা চলতে লাগলো….
ভ্রমণকালঃ সেপ্টেম্বর ২০১৬
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর, ২০১৬ এর সকল পর্বঃ
* যাত্রা শুরুর আগের গল্প (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০১)
* কলকাতায় অপেক্ষা... (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০২)
* ফ্লাইট মিসড তো ট্যুর ক্যান্সেলড... টেনশনিত অপেক্ষার শেষে (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০৩)
* আগ্রার পাণে যাত্রা (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০৪)
* আগ্রার ঘাগড়ায়, দেখা হলো না নয়ন জুড়িয়া (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ৫)
* তাজমহলে পদধূলি (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ৬)
* আগ্রা ফোর্ট - বহু ইতিহাসের সাক্ষী (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ৭)
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৪:১৪