ঘটনার ধারাবাহিকতার জন্য পড়ে আসুনঃ ভৌতিক গল্পঃ অ-স্পর্শ (প্রথম পর্ব)
……..কিছুক্ষন পরেই রুপা রুপা বলে বেডরুম থেকে অদ্ভুত গুরুগম্ভীর একটা নিনাদ শুনে রিফাত আর রুপা দৌড়ে বেডরুমে যেয়ে ঢুকলো……
ঘরের মেঝেতে বৃত্তাকার আকৃতির একটা চক্র এঁকে তার মাঝখানে সেই ভদ্রলোক চোখ বন্ধ অনেকটাই চন্দ্রাসনের ভঙ্গিতে বসে বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছেন। সমস্ত শরীর অদ্ভুত ভঙ্গিতে দুলছে। ঘরের সব লাইট বন্ধ। চক্রের চারপাশের বিজোড় সংখ্যার মোমবাতিগুলিও কেমন যেন নিভু নিভু করে আবার ধুপ করে জ্বলে জ্বলে উঠছে। সারাঘরে মিষ্টি একটা ঘ্রাণ ময়ময় করছে। রিফাত এই ঘ্রাণটা কিসের না চিনলেও রুপা সাথে সাথেই চিনতে পারলো। কিছুদিন আগেই বিয়ের পর রাতের বেলা এই ঘ্রাণটা ও পেয়েছিল। কিছুটা অবাক চোখে সামনে তাকিয়ে রইল রুপা!
হুট করে উনি চোখ খুলে রুপার দিকে তাকালেন। আর সাথে সাথেই সবগুলি মোমবাতি ধুপ করে একসাথে নিভে গেল আর ঘরের ২টা টিউবলাইটও জ্বলে উঠল।
-রুপা, তুমি এখানে, এই চক্রের ভিতরে চলে আস। এখানে কোন ভয় নেই। এর ভিতরে কেউ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
-রিফাত, রুপার সদ্য ব্যবহার করা যে কোন একটা কাপড় দাও আমাকে। আর কাপড় দেয়ার পর অন্যকোন দিকে না তাকিয়ে তুমি এই ঘর থেকে সোজা বের হয়ে যাবে। এরপর এই রুমের ভিতর থেকে যত কিছুই শুনো, আমি না ডাকা পর্যন্ত এইখানে প্রবেশ করবে না। কারণ এই বৃত্তের মধ্যে আমি নিরাপত্তা দিতে পারবো কিন্তু এর বাইরে পারবো না।
রিফাত ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর, উনি রুপাকে বৃত্তের ভিতরে বসলে জাফরানের রঙ দিয়ে আরবীতে কিছু লেখা একটা কাগজ ধরতে বলে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করা শুরু করলেন। রুপার উত্তরগুলি শুনে সন্তুষ্ট না হয়ে, রুপার বামহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল জোরে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে কিছু পড়তে শুরু করলেন। রুপার চোখ কেন যেন নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে আসল। এরপরেই রুপার মানসপটে এক এক করে এর সাথে সংশ্লিট সব ঘটনাগুলি ভেসে উঠতে লাগলো।
কিছুক্ষন পরে-
-তোমার এতটাই খারাপ অবস্থা হয়েছে আগে জানাও নি কেন? এত আহাম্মক কেন তুমি?
-রিফাত কিছুতেই বিশ্বাস করে না। আমার আব্বু আম্মুকেও বলেছিলাম। আমাদের আব্বু আম্মুও এইসব কিছু বিশ্বাস করে না। উনারা মনে করেছে রিফাতের সাথে ঝগড়াঝাটি করে সংসার ভেঙ্গে দিয়ে আমি চলে আসতে চাইছি।
-এতকিছু গোপন রেখে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছ তুমি।
-আমার কোন উপায় ছিল না। আমি কাউকে কিছু বলতে গেলেই এটা আমাকে শাস্তি দেয়া শুরু করে। প্রথমদিকে বাধা দিতাম দেখে অনেক কষ্ট দিত, সারাশরীরে ব্যথা ব্যথা করে ফেলত। প্রচন্ড মাথাব্যথার সাথে সারা শরীর জ্বলেপুড়ে যেত। কাউকে কিছু জানালেই ঘুমের মধ্যে এসে হাজির হতো, একটা লাল টকটকে আগুনের মুখ বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখাত। হুট করেই ঘুমের মধ্যে আপনা আপনি আমার গায়ের সব জামা কাপড় উধাও হয়ে যেত। একদিন আম্মুকে ফোনে বলেছি দেখে দুপুরবেলা বিছানা থেকে উঁচু করে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। এটার ভয়ে কাউকেই কিছু বলতে পারতাম না কি কষ্ট পাচ্ছি।
-হুম, একটা খবিস জ্বীন এসে আস্তানা গেড়েছে তোমার কাছে। কিন্তু এটা তোমার কাছে আসল কিভাবে? তোমার কোন ধারণা আছে?
-আমি জানি না। বিয়ের আগে আমার এই ধরনের কোন সমস্যাই ছিল না।
-তুমি নিশ্চিত বিয়ের আগে এই ধরনের কোন সমস্যাই ছিল না?
-না, রিফাতের সাথে বিয়ে হবার আগে এই রকম কিছুই হতো না।
রুপার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে, উনি রুপার একটা কাপড় হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন পড়া শুরু করলেন, চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর-
-আচ্ছা রুপা, তোমাকে কি কোন ছেলে বিয়ে করতে চেয়েছিল, খুব করে চেস্টা করেছিল। ভালো করে ভেবে চিন্তে বল!
রুপা অনেকক্ষণ চুপ থেকে কি জানি ভাবলো। এরপর লজ্জায় মাথা নীচু করে অস্ফুটস্বরে বললঃ
-আমাদের বাসার কাছের একটা ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। ছেলেটা মোটেও ভালো না। লেখাপড়াও খুব একটা করে নি। আমার মেঝবোনকেও বিয়ে করতে চেয়েছিল। আব্বু কারও সাথেই এর বিয়ে দেননি। এদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের ফ্যামিলির সাথে কোনভাবেই মানায় না। এর বাবা আমাদের আম-কাঠালের বাগানে আগে কাজ করতো।
-এর নাম কি?
-রফিক উল্লাহ। ডাকনাম রফিক।
-তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর কখনও কোন কাপড়চোপড় চুরি হয়ে যাওয়া কিংবা কিছু অংশ কাটা এইরকম পেয়েছ? তোমার ব্যবহার করা চিরুনি কিংবা চুলের কাঁটা খুঁজে পাওনি? অথবা ব্যবহার্য অন্যকোন কিছু খুঁজে আর পাওনি? খুব ভেবে চিন্তে বলবে!
রুপা অনেকক্ষন চুপ করে থেকে কি জানি ভাবল।
-হলুদের অনুষ্ঠানের দিন বারান্দায় শুকাতে দেয়া আমার নতুন একটা ওড়নার কিছু অংশ কে যেন কেটে নিয়েছিল। আর আমার একটা চিরুনি হারিয়ে গিয়েছিল। চিরুনিটা আমার খুব প্রিয় ছিল। ওটা দিয়েই আমি সবসময় চুল আচড়াতাম।
-ভয় যা পেয়েছিলাম তাই হয়েছে। এইসব জিনিশগুলিই কারও বিরুদ্ধে যাদু করার জন্য কাজে লাগে। বিশেষ করে মেয়েদের বিরুদ্ধে।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে উনি কি জানি ভাবলেন, তারপর রুপার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
-রুপা, এখন তুমি চোখ বন্ধ করবে এবং প্রথম যেদিন এই ঘরে এটা তোমাকে আক্রমণ করে, সেটা মনে করার চেস্টা করবে। আমি জানি এটা এইসব স্মৃতি মনে করতে দেয় না, তবে এখন তুমি চক্রের ভিতরে আছ। এটা কোনভাবেই তোমার কাছে আসতে পারবে না। সাহস করে একবার আমাকে এটার স্বরূপ দেখতে দাও। আমি এটা কোথা থেকে এসেছে জানতে চাই। একমাত্র তুমিও পার এটাকে দেখার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে।
এরপর পাশে রাখা একটা ব্যাগ থেকে চন্দন কাঠের অদ্ভুত একটা পুঁতির মালা বের করে রুপার গলায় পরিয়ে দিলেন। রুপার সাথে সাথে উনিও চোখ বন্ধ করলেন, তবে মনে হলো উনি খুব মৃদুস্বরে কিছু পড়া শুরু করলেন।
পনের মিনিট পরে উনি রুপাকে চোখ খুলে রিফাতকে যেয়ে ডেকে আনতে বললেন।
রিফাত আসার পর উনি আবার কথা শুরু করলেনঃ
-রিফাত, এই পৃথিবীতে সবকিছু লজিক আর বিজ্ঞান মেনে চলে না। তোমার চেনাজানা পৃথিবীর বাইরেও আরেকটা জগত আছে, যেখানে অনেক ভয়ংকর কিছুই সম্ভব, যার মধ্যে কালোযাদু একটা। এই ধরনের যাদুর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন আর নোংরা যাদু হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর কালো যাদু। যতদুর শুনা যায়, সুদূর ব্যাবলনীয় সময়কালে প্রথম এই যাদুর উৎপত্তি হয় হারুত/মারুতের কাছে থেকে। তোমার কাছে অসম্ভব মনে হলেও, রুপার উপর এই কালোযাদু প্রয়োগ করা হয়েছে। যে করিয়েছে সে রুপাকে বিয়ে করতে চায়। রুপা যেন কোনভাবেই তোমার সাথে সংসার করতে না পারে সেই জন্য, এই কালো যাদুর সাথে আবার একটা দুষ্টজ্বীনকেও রুপার উপর চাপিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। এই ধরনের জ্বীন পাঠানো ভয়ংকর কঠিন কাজ, এটা যে কেউ করতে পারে না। যে এইকাজ করেছে সে খুবই শক্তিশালী একজন সাধক। আমি অনেক চেস্টা করেও এর কোন খোঁজখবর বের করতে পারলাম না।
-তুমি এখন থেকে সবসময় রুপার কাছে কাছে থাকবে। বিশেষ করে রুপার ঘুমের সময়। বাসায় অবশ্যই অতিরিক্ত কাউকে এনে রাখার ব্যবস্থা করো। এটা শুধুমাত্র রুপা যখন একা থাকে তখনই আক্রমণ করে। সুতরাং কোনভাবেই রুপার একা থাকা চলবে না।
-তাহলেই কি রুপা’র এইসব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে?
-না। রুপা’র জন্য আমি একটা কবজ তৈরি করে যাবার আগে দিয়ে যাব। এটা রুপার ২৪ঘন্টাই পড়ে থাকতে হবে। যতকিছুই হোক, কোনভাবেই এটা খোলা যাবে না। আমি দেখতে চাচ্ছি এরপর এটা কিভাবে রুপাকে বিরক্ত করে। এটা কিভাবে পড়তে হবে সেটা আমি ভালো করে রুপাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাব। তাছাড়া রুপা’কে বেশ কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।
এরপর রিফাত লজ্জায় মাথা নীচু করে আরেকটা ভয়ংকর সমস্যার কথা ইতঃস্তত করে বলা শুরু করতেই উনি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।
-রিফাত তুমি থাম, আমি জানি। এই কালোযাদুর প্রথম কাজই হচ্ছে এটা বন্ধ করা। এটা দুইভাবে করা হয়। পুরুষকে নির্জীব করে দেয়া হয়, কোনভাবেই যৌন উত্তেজনা আসে না। আর নারীদের মাসিকের রক্তপাত কোনভাবেই বন্ধ হয় না। এটার কোন এলোপ্যাথিক কিংবা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নেই। রুপার এখন কি অবস্থা সেটা আমি শুনেছি। তোমারও কি এই সমস্যা হচ্ছে?
রিফাত দ্রুতই মাথা উপর নীচ করল।
-রাতের বেলা রুপার কাছে যেতেই ইচ্ছে করে না। ওর গায়ের সাথে গা লাগলেও বিরক্ত লাগে।
-আচ্ছা ঠিক আছে। এটা ঠিক করে দেয়া যাবে। তবে তোমাদের দুইজনকেই আমি যেভাবে চলতে বলবো ঠিক সেইভাবে চলবে।
পরেরদিন সকাল এগারোটা দিকে উনি সবকিছু সুন্দর করে দুইজনকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
সাত
হুট করেই রুপা আর রিফাতের দাম্পত্য সর্ম্পক আবার খুব মধুর হয়ে উঠল। বাসায় পালা করে রুপার আর রিফাতের মা রুপার সাথে থাকা শুরু করলেন। রাতেরবেলা মাঝে মাঝে হালকা কিছু দুঃস্বপ্ন দেখা ছাড়া রুপার আর কোন সমস্যাই হলো না।
দেখতে দেখতে প্রায় একমাস পার হয়ে গেল। এর মাঝে একদিন রিফাতের এক কলিগের বাসায় রাতের বেলা দাওয়াত খেয়ে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিল দুইজন। রিফাত জানতো না আজকে পূর্ণ অমাবস্যা। বাসা থেকে একটু দূরেই রিকশার পিছনের একটা চাকা, যেদিকে রুপা বসেছিল সেটা আচমকা বাঁকা হয়ে গেল। ভারসাম্য হারিয়ে ওরা দুইজনই ছিটকে পরে গেল রাস্তায়। তেমন কোন ব্যাথা না পেলেও আরেকটা রিকশায় বাসায় ফেরার সময় রুপা ফিসফিস করে রিফাতকে জানালো যে রুপার কোমড়ে বাধা কবজটার সুতা ছিড়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। রুপা ছেড়া কবজটা ভেনিটিব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। কবজটার বেশ কিছু জায়গায় ছিড়ে ছিড়ে গেছে।
বাসায় ফেরার পর রুপা কিংবা রিফাত দুইজনই বেমালুম সেই কবজের কথা ভুলে গেল।
পরেরদিন সকালবেলা রিফাতের ছোটবোনের প্রচন্ড জ্বর আসলো। ডাক্তার কিছুতেই জ্বর কমাতে পারছে না। হু হু গায়ের তাপমাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। তাড়াহুড়া করে রিফাতের মা নিজের গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন রুপাকে একদম একা রেখে।
আট
ফাঁকা বাসায় রুপার কিছুটা ভয় লাগতে শুরু করলে রিফাতকে ফোন সবকিছু জানিয়ে আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসতে বললো। একা একা ঘুমাতে রুপাকে নিষেধ করা আছে দেখে, দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর রান্নাঘরে এসে রুপা পায়েস রান্না করা শুরু করল। রিফাত ওর রান্না করা পায়েস খুব পছন্দ করে। দুধ গরম হয়ে যাবার পর ডেকচিতে চিনির প্যাকেট থেকে চিনি ঢালা শুরু করল রুপা। কিন্তু রুপা অবাক হয়ে দেখল, যতই চিনি ঢালছে সবগুলিই ডেকচির ভিতরে টগবগ করা দুধের অনেক উপর থেকেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আস্ত এককেজি প্যাকেটের চিনি যখন ওর চোখের সামনে এভাবেই অদৃশ্য হয়ে গেল, রুপার সারাশরীরে রীতিমতো কাঁটা দিয়ে উঠল। শরীর ঘামিয়ে উঠলে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল মুছার সময় সহসাই রুপার উন্মুক্ত কাঁধে হালকা গরম বাতাস এসে পড়লো, যেন কেউ পিছনে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলছে। ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে রুপা ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে উঠল, কিন্তু কেন যেন একটা শব্দও ওর গলা দিয়ে বের হলো না। গরগর করে কিছু শুনা যাচ্ছে শুধু। রুপা জ্ঞান হারিয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগে শেষবারের মতো দেখল ওর লম্বা চুলের ঝুটি ধরে ওকে কোথায় যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে…………
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত@ নীল আকাশ, নভেম্বর ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৭