রুমানা মনযুর, হালিমা ইয়াসমিন রুমা, হালিমা ইয়াছমিন - তিনটে নাম, সাম্প্রতিক খবরের কাগজে আসা এই তিনজনই স্বামীর নৃশংস আক্রমনের স্বীকার।
রুমানা মনযুর - মারাত্মক আহত, চোখ দুটো আঙুল ঢুকিয়ে উপড়ে ফেলা হয়েছে।
হালিমা ইয়াসমিন রুমা - স্বামী হারুন গরম পানি ঢেলে রুমার শরীরের ৮০% অংশই ঝলসে দিয়েছে।
হালিমা ইয়াছমিন - ১০ লাখ যৌতুকের দাবীতে অত্যাচার, এরপর শাশুড়ি গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়। স্বামী ম্যাচের কাঠি জ্বেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। হালিমার শরীরের ৩৫ শতাংশ গভীরভাবে পুড়ে গেছে।
এসব নিয়ে বাংলা ব্লগ সরগরম, স্টিকি পোষ্ট, সেটা "লটকানো" দাবী করে পাল্টা স্টিকি পোষ্ট, সুশিলতা, সামাজিকতা, ধর্মীয় আলোচনা, "সমাজ শেষ হয়ে গেল" কম হয় নি। তবে সমস্যা হলো, আমরা কেবলমাত্র ঘটনার একটি অংশ নিয়েই লাফাচ্ছি, "কেন হলো? কে দোষী? মেয়েটি এমন কি করেছে যে স্বামী বাধ্য হয়েছে এমন অমানুষ হয়ে যেতে? ধর্মে কি বলে? সামাজিকতা কি বলে? কে বড়লোক বলে বিচার হবে আর কে গরীব বলে বিচার হবে না" এই আলোচনাতে। কোনো ঘটনার শেষ তক যাওয়া হয় না এখানে কখনোই না।
আসুন একটু পেছনে যাই, ঝালিয়ে নিই আমাদের গোল্ডফিশ মেমরী, যার স্থায়িত্ব তিন সেকেন্ড মাত্র!
হেনাকে ভুলে গেছেন? ৩০/০১/১১ তারিখ দিবাগত রাতে ধর্ষণের শিকার হয় হেনা। পরদিন ‘সমাজপতি’রা ‘ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা’র অভিযোগে ধর্ষকের সাথে সাথে ১৪ বছরের হেনাকেও দোররা মারার ফতোয়া দেয়। সবথেকে অবাক, ধর্ষকের শাস্তি অর্ধেক কমিয়ে ফেলেন তারা তক্ষুনিই! শুরু হয় হেনার উপরে মাতব্বরদের ফতোয়া চর্চা, ৭০/৮০ টা দোররা মারতেই হেনা অচেতন হয়ে যায় এবং সেদিনই গভীর রাতে মারা যায়।
পরে মাহবুব আটক হলেও ওর পিঠে কোনো দোররার ছাপ পাওয়া গেছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। তবে এই ব্লগেই এটুকু শুনতে হয়েছে, "প্রিম্যাচিওর সেক্সুয়াল অ্যাডিকশন- অপরিণত যৌনতা আসক্ত ছিলো হেনা।" যারা এসব এই ব্লগেই প্রমান করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, বাজী ধরে বলতে পারি, ফরেন বসে ২২ ইন্চি মনিটরে এসব বড় বড় টর্ম লিখতেই জানেন তারা, মানুষ, মানবিকতা আর নৈতিকতা সম্পর্কে কোনো ধারনাই তাদের নেই । তাদের চাহিদা, হিট ব্যাবসা, মেকি সুনাম।
রাহেলার ঘটনা মনে আছে? সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ঘন ঝোপ-ঝাড়ের মাঝে গার্মেন্টসের ১৯ বছর বয়সী একজন নারী শ্রমিকের উপর নির্দয়ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে গণধর্ষন ও পাশবিক নির্যাতন করা হয় এবং শেষে তাকে জবাই করে মৃত্যুর মুখে ফেলে রাখা হয়। মেয়েটির নাম রাহেলা লিমা আখতার। সেখানে সে গাছাপালার পুরু পাতারাশির মধ্যে নিরুদ্দেশ তিন দিন পড়ে ছিল। এরপরে নির্যাতকরা সেখানে ফিরে তাকে জীবিত দেখে চেহারায় এসিড মেরে ঝলসে দেয় এবং চুলে আগুণ ধরিয়ে দেয় যেন দেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও তার পরিচয় শনাক্ত করা না যায়। অবশ্য সেই দিনই, ২২শে আগস্ট ২০০৪, একজন বাগান পরিচর্যাকারী তার অস্পষ্ট চিৎকার শুনতে পায়, “আমি মৃত নই, দয়া করে আমাকে বাচান”।
না, রাহেলার বিচারের রায়ে আমি তেমন খুশি হতে পারিনি, মিডিয়া তার দায় সেরেছে ছোট্ট একটি নিউজ করে, যেখানে উচিৎ ছিলো লিটনের মৃত্যু দন্ড চ্যানেলে চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার আর পত্রিকার হেডলাইন করা, যাতে একটু হলেও ধাক্কা খায় লিটনের সমমনারা।
মনে করুন ছোট্ট জনিকে, বয়স এক বছর। মৃতা মায়ের স্তন চুষতে চেষ্টা করছিলো ক্ষিধের জ্বালায় । মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী রাজনগর উপজেলার মরিচা গ্রামের গৃহবধু রুবি বেগমকে গত ৯ অক্টোবর রাতে নির্মম ভাবে শ্বাষরোদ্ধ করে হত্যা করে তার শ্বশুরবাড়ির লোকরা। তিন সন্তানের জননী গৃহবধু রুবি বেগমকে হত্যা করে নদীর পাশে রেখে যায় তার ১ বয়সের জীবিত কন্যা শিশু কন্যা জনিকে । পরদিন গ্রামবাসী ক্ষেতে আসলে শিশুটির কান্না শুনে এগিয়ে এসে দেখতে পায় মৃত গৃহবধু রুবি ও তার জীবিত শিশুটি মৃত মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে ও কান্নাকাটি করছে।
নুরজাহান, সিলেট অন্চলের চটকছাড়া গ্রামের ২১ বছর বয়সী সেই হতভাগ্য তরুনী, যাঁকে ফতোয়াবাজরা মাটিতে পুতে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো ... নাহ্.. হাজার বছর আগের কোন ঘটনা নয়। মধ্যযুগীয় ববর্রোচিত ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৯৯৩ সালের ১০ই জানুয়ারি!!
নুরজাহানের অপরাধ ছিলো, তিনি প্রথম স্বামী তালাক দেবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলনে। কি ভীষণ স্পর্ধা! তালাক প্রাপ্তা গ্রাম্য নারী(সুন্দরী তরুনী), সে স্থানীয় হায়নাদের লালসার খোরাক না হয়ে পূণরায় ঘর বাঁধবে, সংসার করবে.. এ কেমন কথা!!
তাই, গ্রামের কাঠ মোল্লারা ছলা বলে তার দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ ঘোষণা করে তাঁর বিরুদ্ধে “বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের” অভিযোগ এনে এই শাস্তির বিধান দেয়।
১৯৯৫ সালের ২৪ আগষ্ট কিছু বিপথগামী পুলিশ সদস্য কর্তৃক ধর্ষিত ও নিহত হন গার্মেন্টস শ্রমিক ইয়াসমিন। ঢাকা থেকে অসুস্থ পিতাকে দেখতে দিনাজপুর গেলে সেখানে কিছু পুলিশ সদস্যের খপ্পরে পড়েন ইয়াসমিন। পুলিশ সদস্যরা তাকে ধর্ষন এবং হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে যায়। পরবর্তী বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে চরিত্রহীন পতিতা হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা চালায়। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সাধারণ মানুষ। পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় বিক্ষুব্ধ মানুষের উপর। মারা যান সাত জন নিরহ মানুষ। বিচারে তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসির আদেশ হয়। ২০০৪ সালে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়, তবু সেটা অনুচ্চারিত আরো একটা সধা ঘটনাই থেকে যায় দৃষ্টান্তমূলক প্রচারের অভাবে।
"সামাজিকতার ভয়ে" চেপে যেতে হচ্ছে ধর্ষনের কথা, যৌন হয়রানীর কথা ।
একটা বস্তব কথোপকথনের একাংশ, লেখিকা তার পরিচিতা এক এমন ধর্ষিতার জবানবন্দী পরে আর কন্টিনিউ করেননি
প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয়, একজন ধর্ষকের কী সাজা হওয়া উচিত?
উত্তর: আমার মনে হয়, ঐ *******দের নপুংশক করে দেওয়া উচিত। একটু একটু করে শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া উচিত, তাতে লবণ লাগিয়ে দেওয়া উচিত। সুযোগ থাকলে, শরীরের যত প্রবর্ধন আছে তার অগ্রভাগে আগুন ধরিয়ে দেওয়া উচিত।এমন আগুন যা সিগারেটের মত জ্বলে; প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় আগুন একটু একটু করে জ্বলে ওঠে।নিঃশ্বাস না নিয়েও থাকতে পারবে না, আর প্রতিবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় তীব্রতম যন্ত্রণা অনুভব করবে। ঐ ******** যেন নিজের অস্তিত্বের ধ্বংস নিজ চোখে দেখে তিলে তিলে মরে....। আর এর চেয়ে জঘন্য কোন শাস্তি থাকলে তাও দেওয়া দরকার....
এত জঘণ্য এরা কোন গালি দিয়ে শান্তি পাই না... খালি মনে হয় গালিটার অপমান হচ্ছে.... নিকৃষ্টতম গালি দরকার ঐ ********দের জন্য।
আরো আছে, ভারতের সদ্য খবর, "যৌন কাজের বিনিময়ে অর্থ আয়ের জন্য মেয়ে বিক্রি করল পাষণ্ড বাবা " যেখানে মেয়েটির দাবী, বাবা নিজেই তাকে ধর্ষন করছে এবং না খেতে দিয়ে রেখেছে, তাতেও মেয়েটিকে দমাতে না পেরে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে এবং মাত্র কয়েকটা দিনেই অন্ততঃ দু'শ' ব্যক্তি মেয়েটির ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। সুশিলতা ছেড়ে বলতে গেলে, মেয়েটিকে গত কয়েকদিনে অন্ততঃ দু'শ' বার ধর্ষনের স্বীকার হতে হয়েছে।
পাকিস্তানে সেদিন নগ্ন করে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়েছে ৫০ বছর বয়সী এক মা কে, ছেলের পাপের সাজা দেওয়া হয়েছে তার মা কে!, চার বন্দুকধারীর মাঝে সেই মা কে হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে সারা গ্রাম, সমাজপতিদের রায়ে, নগ্ন হয়ে!
এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি এসব ঘটছে রোজই, আমরা ব্যাস্ত জীবনে কোনো খোঁজই রাখি না যতক্ষন না মিডিয়া ফলাও করে ছাপিয়ে আমাদের নজরে আনছে?
খেয়াল করুন, ইভটিজিং - নারীর ওপর একেরপর এক নৃশংস আর সহিংস ঘটনা মিডিয়া সামনে এনে দিলো, তারপর মিডিয়াও চুপ, আমরাও। অথচ থামেনি ইভটিজিং, নৃশংসতা আর সহিংসতা। মিডিয়া তার সাময়িক কাটতি আর জনপ্রিয়তার ব্যাবসা করে থেমে গিয়েছে। মেয়েদের ওপর। স্ত্রীর ওপর, নারীর ওপর এই নৃশংস অত্যাচার গুলোও কি তেমনই? রোজই ঘটে, তবে মিডিয়া সময় করে কয়েকটা তুলে আনবে, কাটতি শেষে আবার ভুলে যাবো আমরা?
মানুষ নয়, মেয়ে মানুষ - এই ভুল ধারনাটা কবে শুধরোবে আমাদের?
অফটপিকঃ চল্লিশ বছর আগের গন-ধর্ষন আর যৌনদাসী হতে বাধ্য করা কমবেশী দু'লক্ষ নারীকে (সংখাটা দ্বিগুনও হতে পারে!!!) - ভুলে গেছেন?
ব্যাকআপ
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:৩৯