জগন্নাথ হল - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৫. প্রত্যক্ষদর্শী কালি রঞ্জন শীলের মুখে ২৫শে মার্চের কাল রাত্রি -
তারা আমাদেরকে মৃতদেহগুলো তুলে গাছের নিচে জড় করতে নির্দেশ দিল। এরপর আমাদেরকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করা হয় এবং আমাদের গ্রুপকে শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় নিয়ে যায় যেখানে ডঃ গুহাঠাকুর্ত বাস করতেন। সেখানে সিঁড়ির নিচে আমরা বেশ কিছু মৃতদেহ দেখতে পাই। আমি ঠিক স্মরন করতে পারছিনা ঠিক কতগুলো মৃতদেহ আমরা সেখান থেকে সরিয়ে ছিলাম। তবে আমি এটা মনে করতে পারছি যে শেষ মৃতদেহটা ছিল ঐ রাতের প্রহরী সুনীলের। তার শরীর তখনও গরম ছিল। এটা হতে পারে তাকে মেরেছিল বেশিক্ষণ হয়নি অথবা উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে। আমি যখন তার মৃতদেহ মাঠের মধ্য দিয়ে বইয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আমি কাছের বস্তিতে মহিলাদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। সেই মহিলারা মাঠে আসতে চাচ্ছিল এবং পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা তাদের গুলি করার ভয় দেখিয়ে বাঁধা দিচ্ছিল। আমি দেখতে পাই আমাদের গ্রুপ থেকে আলাদাকৃত ঝাড়ুদ্বারের গ্রুপকে এলোপাথারী গুলো করে হত্যা করা হয়। আমি চোখের সামনে দর্শনের অধ্যাপক ডঃ গৌর গোবিন্দ দেবের অর্ধালোঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পাই, যাতে নির্মম অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আমাকে যেই ছেলেটি সাহায্য করছিল সে বললো, তারা ডঃ দেবকেও হত্যা করেছে তাহলে আমরা আর মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি কেন? আমি ক্লান্ত শরীরে সুনীল এবং ডঃ দেব এর মৃতদেহের মাঝে শুয়ে পড়ি।
৬. প্রত্যক্ষদর্শী লেখক হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় ফিরোজপুর -
পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা বন্দীদের খেজুর গাছে চড়তে বলে। এরপর তারা তদের গুলি করে মাটিতে ফেলে এবং আনন্দে উল্লোসিত সেনা সদস্যরা খেজুর খুঁজে খাচ্ছিলো। আমি শুনতে পেলাম ভগিরথী নামক একজনকে চলন্ত জীপের সাথে বেঁধে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। প্রতিদিন নদীতে মৃতদেহ ভাসতে দেখতাম। চিল শকুন দেখতাম মৃতদেহের জন্য অপেক্ষায় বসে আছে কিন্তু তারাও এইসব মৃতদেহের প্রতি তাদেরও উৎসাহ ছিল না। কোন শকুনই সেদিন কোন মৃতদেহের উপর বসতে দেখিনি। সেদিন ৩০-৩৫ বৎসরের সবুজ শার্ট পরা মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ এবং ৭-৮ বৎসরের এক মেয়ের তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার হাতে তখনও মেহেদির রং ছিল।
৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অরুন দের মুখে তার বাবা মুধুসুধন দের সম্পর্কে -
২৫শে মার্চের মধ্যরাত থেকেই আমি দেখতে পেয়েছিলাম সেনাবাহিনী জগন্নাথ হল ঘিরে রেখেছিল। চারদিকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। খুব ভোরে আমরা শুনতে পাই কয়েকজন আমাদের দরজা নক করছে। তারা ঢুকেই আমার বাবাকে গুলি করার জন্য দাঁড়াতে বলে। তখন আমার মা তার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিলে তারা আমার মায়ের হাত কেটে ফেলে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং এই নৃশংসতা দেখে দরজা বন্ধ করে দেই। তারা লাথি দিয়ে দরজা খুলে ফেলে। আমি দেখতে পাই মা তখনও বাবার শরীরের উপর পড়ে আছেন আর সেনা সদস্যরা তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষন পরে বাবা দরজার দিকে এগোতে চান কিন্তু তিনি তার ডান হাত এবং পা নাড়াতে পারছিলেন না। বাবার পিঠে বিদ্ধ গুলি দেখে আমি তা বের করি। তখনও বাবার প্রাণ ছিলো। আমার মা, ভাই এবং তার স্ত্রীর মৃতদেহ ১০-১২ দিন ধরে আমাদের ঘরেই পঁচছিলো। পরে প্রতিবেশীরা পৌরসভার লোক ডেকে তা পরিষ্কার করায়। অবশ্য এটা আমি পরে শুনেছি।
৮. ঢাকার শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর মুখে তার স্বামী চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডঃ আলীম চৌধুরীর সম্পর্কে -
৩রা ডিসেম্বর যখন ঢাকায় প্রচন্ড আক্রমন হয় তখন আমরা হাসপাতালে আশ্রয় নেবার পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু মাওলানা আব্দুল মান্নান যাকে আমরা আমাদের নিচের তলায় আশ্রয় দিয়েছিলাম সে বার বার আমাদেরকে থাকার জন্য আশ্বস্ত করছিল এবং আলীম তাকে বিশ্বাস করেছিল। ১৪ই ডিসেম্বর রাতে কারা যেন দরজায় নক করে। আমি যখন আলীমকে জিজ্ঞেস করলাম তখন সে আমাকে খুলতে বলে নিজে মাওলানা মান্নানের দরজার দিকে দৌড়ে যায়। সে মান্নানের দরজা নক করতে থাকে কিন্তু সে দরজা না খুলে বরং বলে তাদের সাথে চলে যেতে, সে পরে সাহায্য করবে। সে মান্নানের মিথ্যায় আশ্বস্ত হয়ে তাদের সাথে যায়। আমি তখনও আলীমকে ফিরিয়ে আনার জন্য মাওলানা মান্নানকে অনুরোধ করছিলাম। কিন্তু সে আমার দিকে ফিরেও দেখলোনা। আলীমকে নিয়ে যাওয়া গাড়ীর আওয়াজ পাই। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। তখন সে আমাকে অভয় দিয়ে বলে তার ছাত্ররা আলীমকে চোখের চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেছে। অবশেযে ১৮ই ডিসেম্বর আমি তাকে খুঁজে পাই। তার মৃতদেহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবিদের সাথে রায়ের বাজার বধ্যভুমিতে পড়ে থাকে। ডঃ রাব্বি, আলীম, লাদু ভাই এবং আরও অনেকের মৃতদেহ ছিল একসাথে।
[চলবে]
পুর্বের পর্বসমুহঃ
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ১
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ২
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৩
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৪
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৫
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৬
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৭
ফিরে দেখুন আমাদের ইতিহাস - ৮