ভারী ফ্রেমের চশমার আড়ালে এককালের অনেক চেনা চোখদুটো বহুদূর হেঁটে এসে সামনে দাঁড়ায়। আরে, মৌমিতা যে ? শুকনো পাথুরে ঝর্নায় অনেকদিন পর জল গড়িয়ে গেলে যে শব্দ হয়, সে শব্দটা তন্ময়ের ডাকের সাথে কানে ঢুকে মৌয়ের। মাথা উঁচু করে তাকায় সে। তন্ময়!
মনে আছে তাহলে? হেসে ফেলে তন্ময়।
না থাকার তো কোন কারণ দেখছি না। উত্তর দেয় মৌ।
বসতে বলবে না মৌমিতা ? নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে চলে যাবো ?
ভারি পরিবেশগুলো হালকা করতে তন্ময়ের জুড়ি ছিল না, মৌমিতার মনে আছে। সব কিছুই কেমন যেন অতি স্বাভাবিকভাবে নিতো, যার কারণে তন্ময়কে কোন দিন চমকে দিতে পারেনি মৌমিতা। যে কথাগুলোতে অন্যরা চমকে যেত, সেগুলোতে অবলীলায় আচ্ছা, ধুর, বেশ তো- এমন দায়সারা মন্তব্য করে বক্তার আগ্রহে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিতো তন্ময় নিষ্ঠুরভাবে। তন্ময়ের সব কিছুতে এই ড্যামকেয়ার ভাবটা শুরুর দিকে মৌমিতাকে যতটা না আকর্ষণ করতো, শেষেরদিকে ততটাই বিতৃষ্ণায় ভোগাত।
রসিকতার স্বভাবটা আজো যায়নি তোমার, বলে উঠে মৌমিতা। বস প্লিজ। হেসে দেয় সে।
লাউঞ্জের একপাশের টেবিলের সাথে লাগোয়া চেয়ারটা টেনে নেয় তন্ময়। ওপাশে মৌ বসে আছে। মাঝখানের দুহাত দূরত্ব- নো ম্যানস ল্যান্ড। দুইপ্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাস ভেসে এসে জায়গাটা এত উত্তপ্ত করে দিয়েছে যে, আগাগোড়া এসি করা কনভেনশন সেন্টারের ঠাণ্ডা বাতাসেও সে উত্তাপ গলে যাবে না।
কেমন আছো ? মৌ শুরু করে।
ওমা এতক্ষণ পর ? চোখ উল্টিয়ে ফেলে তন্ময়।
হেঁয়ালি করো না তো। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় মৌমিতা।
তন্ময় হাল ছেড়ে দেয়। এইতো আছি, যেমন থাকা দরকার। তুমি? পাল্টা জিজ্ঞেস করে সে। হেসে উত্তর দেয় মৌ, ভালো। কেমন লাগছে রি-ইউনিয়ন ?
চারপাশে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে তন্ময়। দীর্ঘ দশ বছর পর হওয়া পুনর্মিলন অনুষ্ঠান গান স্মৃতিচারণের পালা পেরিয়ে এখন শেষের পথে। একটু পরে ডিনার। আয়োজক মৃদুল মারুফরা খুব ব্যস্ত। মাঝখানে টুকটাক ফটো-সেশন চলছে। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকটা ফটো তোলার আবদার যে আসছে না তা নয়। তন্ময় হাসিমুখে এড়িয়ে বরং অন্যদের উৎসাহ দিচ্ছে, চালিয়ে যাও।
কেমন লাগছে বললে না তো ? মৌমিতা জিজ্ঞেস করে।
তোমাকে যথারীতি অসাধারণ লাগছে, কোন সন্দেহ নেই। তন্ময় উত্তর দেয়।
ধ্যাত, আমি কি আমার কথা বলেছি নাকি ? রি-ইউনিয়ন !
ও, তাই বলো। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশে বুড়িয়ে যাওয়া ছেলেদের দলে যে আমি শুধু একা নই, এখানের বাকি সবাইকে দেখে আশ্বস্ত হচ্ছি। হাহাহা।
দুজনেই হেসে ফেলে ওরা। তারপর এক আশ্চর্য নীরবতা। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা ফুটে না। লাউঞ্জের ওদিক থেকে গুঞ্জন ভেসে আসে শুধু। ঠাট্টা তামাশা, ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দগুলো বিশাল সিলিঙকে কেন্দ্র করে বনবন করে ঘুরতে থাকে।
নীরবতা ভাঙ্গে তন্ময়। দেশে ফিরলে কত বছর পর ?
উমম, আট। সাড়ে আট। চোখ সরু করে ফেলে মৌ।
আছো কিছুদিন ?
পরশু ফ্লাইট। চলে যাচ্ছি। রি-ইউনিয়নের কারণেই আসা।
ও!
তোমার হবিকে দেখছি না, আসে নি প্রোগ্রামে ? মৌমিতার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে তন্ময়।
অমিত তো এসেছিলো। একটু আগেই বেরিয়ে গেলো। কি যেন জরুরী কাজ পড়ে গেছে। তোমার খবর বল।
কি খবর? আগ্রহের সাথে জানতে চায় তন্ময়।
তুমি কি একা এসেছ ?
তন্ময় মাথা নাড়ে। ইঙ্গিতে মৌমিতার পিছনের দিকটা দেখায় সে। মৌমিতা ফিরে দেখে বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে ওদের টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সিলভি, আমার ওয়াইফ। পরিচয় করিয়ে দেয় তন্ময়।
হাই, সিলভির দিকে তাকিয়ে হাসে মৌমিতা। মিষ্টি হেসে হ্যালো জানায় সিলভি। পাশে বসতেই মৌমিতা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সিলভিকে। নিজেকে যথেষ্ট সুন্দরী ভাবে মৌমিতা। সবাই বলে সে আসলেই তাই। কিন্তু পাশে বসা মেয়েটা তার চেয়ে কোন অংশে কম নয় ভেবে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয় সে।
সিলভি, এ হচ্ছে মৌমিতা। মাঝখান থেকে কথা শুরু করে তন্ময়। যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।
মৌমিতা ভাবে, সিলভির চেয়ারটায় সিলভির জায়গায় তার বসাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। বরং গ্রাজুয়েশন শেষ করার সাথে সাথে তন্ময় মৌমিতার বিয়ে হবে ব্যাচের সবাই ধরে নিয়েছিলো। ধরবেই না কেন- গলায় গলায় প্রেম ছিল, স্পর্শে তাদের ভালোবাসা-বাসি ছিল।
ল্যান্ডফোনের যুগগুলোতে প্রেম। সে রাত গুলোয় লাইনের দুইপ্রান্তের মাউথপীসে দুজনের ঠোঁট লেগে লাগতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তন্ময় বলত, মৌমিতা তোমার ঠোঁট মিষ্টি। মৌমিতা জিজ্ঞেস করতো, কিভাবে বুঝলে ?
ইথারে লিপস্টিক চেখে দেখেছি। হাহাহা। অরেঞ্জ ফ্লেভার। আমুদে হাসি হেসে উত্তর দিত তন্ময়।
অবশ্য সত্যি করে ঠোঁট চেখে দেখতে পেরেছিল সাত সাগর দূরের অমিত। ইউএস গ্রিন কার্ড হোল্ডার, গ্রাজুয়েশনে ক্যালটেকের ছাপ যার, এমন কেউ প্রস্তাব পাঠালে অমত করা অসম্ভব ছিল। অনিশ্চিত রোমান্সের চেয়ে নিশ্চিত যান্ত্রিক সম্পর্কে কে খারাপ বলবে ?
দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর মৌ শুনেছিলো, তন্ময় বদলে গেছে। সস্তা গল্পের ব্যর্থ প্রেমিকের মতো প্যাথেডিন নেওয়া শিখেছে। তারপর অনেকদিন খোঁজ পায়নি ওর। তন্ময় সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি মৌমিতার ভাবনার বিশাল জগতটা থেকে তখনই হারিয়ে গেছিলো। আজকের আগ পর্যন্ত যা সত্যি নিখোঁজ ছিল।
একসময় ডিনার শেষে দেখা যায়, সিলভি আর মৌয়ের এরমধ্যে খুব মিল হয়ে গেছে। দুজনের শ্যানেল ভালো লাগে, গুচ্চি প্রেফার দুজনেই করে। তাদের ফেভারিট হানিমুনের জায়গাও একই, মালদ্বীপ। কথা প্রসঙ্গে সিলভি মৌমিতাকে অনুরোধ করে এরপর দেশে আসলে ওরা যেন তন্ময়ের বনানী ডুপ্লেক্সে উঠে। ওটা ফুল ফার্নিশড অথচ অনেকদিন খালি পড়ে আছে। তন্ময়ের দিকে তাকায় মৌ। তন্ময় মাথা দুলিয়ে সায় দেয় সিলভির সাথে।
মৌমিতা তন্ময়ের নির্লিপ্ততা মেপে দেখে। আশ্চর্য প্রশান্তি তন্ময়ের চোখে মুখে ভাসছে। শেষ পর্যন্ত একই ভাবলেশহীন চেহারা নিয়ে তন্ময়, সাথে সিলভি মৌমিতাকে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ড্রাইভার মৌমিতার প্রিমো স্টার্ট দেওয়ার পর পাশ থেকে একটা লেটেস্ট নিশানের রাজকীয় ইঞ্জিন চালু হয়। জানালা থেকে হাত নেড়ে বিদায় জানায় সিলভি। পাশে তন্ময়ের হাসি হাসি মুখটা দেখা যায়। জোর করে দেখানো নয়, অল্প অভিব্যক্তিতে যেখানে প্রকাশ পায়, তন্ময় বরং অনেক সুখে আছে। টিভিতে স্ক্রল করা ব্রেকিং নিউজ বা ট্যাবলয়েডের প্রথম পাতার ঢাউস বিজ্ঞাপনের মত মৌমিতার সচেতন আর অবচেতন মন প্রথমে দখল করে নেয় তন্ময় ও তার সুন্দরী স্ত্রী, তারপরে কিছুটা ঈর্ষা।
পাশাপাশি দুটো গাড়ি চলতে থাকে। মোড়ে এসে দুদিকে আলাদা হয়ে যায়। ভিউ মিররে তন্ময় তাকিয়ে দেখে মৌমিতার গাড়িটা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে এরমধ্যেই। স্বভাবজাত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে তন্ময়। এরপর একহাতে সিলভিকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে একটা চুমু খায় সে।
বিশাল একটা বিল্ডিঙের সামনে গাড়িটা দাঁড় করায় তন্ময়। আঙুলে চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে ঢুকে পড়ে সে নিচ তলার কর্পোরেট অফিসে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থেকে বেরিয়ে মেইন গেটের সামনে দাঁড়ায় সিলভি। তন্ময় আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
রেন্ট এ কারের ওরা খুব বেশী টাকা রেখেছে।
তো ? প্রশ্ন করে বসে সিলভি।
এছাড়া স্যুট খরচ তো আছেই। তোমাকে পাঁচ হাজার দিচ্ছি। চলবে ? তন্ময় একটা খাম বের করে দেয় সিলভির দিকে।
সিলভি খামটা লুফে নেয়। টাকাগুলো গুনে দেখে। শেষে দীর্ঘশ্বাস মেশানো গলায় বলে, আচ্ছা ঠিক আছে।
তবে, অসাধারণ অভিনয় করেছো। মানতেই হয়। তন্ময়ের কণ্ঠে প্রশংসা ঝরে পড়ে।
থ্যাংকস। হেসে হাতটা ছাড়িয়ে সিলভি। তারপর সিএনজির জন্য পা বাড়ায় সে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৩ দুপুর ২:৫৪