পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেনা কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কাকুল-এ। সেখানে পাকি সেনা কর্মকর্তারা গর্ব করে দাবী করতো, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী । ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ বাঙ্গালীর কাছে চরম অপমাণজনকভাবে পরাজিত হওয়ার পর তাদের দাবী নিয়ে পৃথিবীর সবাই খুব মজা করতো।
কিন্ত আসলে কথাটা মিথ্যা ছিলো না।
বৃটিশরা তাদের তৈরী যোদ্ধা জাতির তালিকায় বাঙ্গালীদের নাম রাখেনি। ( প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এখন পর্যন্ত কোন বাঙ্গালী রেজিমেন্ট নাই। বাঙ্গালীরা অন্য রেজিমেন্টের অধীনে যুক্ত হয়।) বৃটিশ সেনাবাহিনীতে বেঙ্গল রেজিমেন্ট থাকলেও সেখানে বাঙ্গালীদের পরিবর্তে অন্যান্য জাতির লোকজনই ছিলো বেশী। আমার ধারণা , সম্ভবত এর পিছনে পরস্পরবিরোধী ২টা কারণ আছে।
প্রথমটা হচ্ছে , বাঙ্গালীরা প্রচন্ড পরশ্রীকাতর ও দলাদলি প্রিয় জাতি । এজন্য তারা হাজার বছরের মধ্যে নিজেরা নিজেদের কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে শাসন করতে পারেনি। তাদের দেশ শাসন করেছে বিদেশী সেন, তুর্কি,আরব মোগল ও পাঠানরা। তারা তাদের অধীনে সেনাবাহিনীতে চাকরী করে বীরত্বের পরিচয় দিলেও কখনো কোনো বাঙ্গালী সৈন্য ক্ষমতা দখল করে নিজে রাজা হয়নি।
আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, হয়তো তারা ভয় পাচ্ছিলো , যেহেতু বাংলা দখল করেই পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে বৃটিশ শাসন শুরু হয়েছিলো এবং তাদের সীমাহীন লুটপাট ও অত্যাচারের ফলে সমৃদ্ধশালী বাংলা দূর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হয়েছিলো, তাই বাঙ্গালীদের সেনাবাহিনীতে নিলে তারা হয়তো প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিদ্রোহ করতে পারে।
কারণ ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই বাংলায় ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ, সাওতাল বিদ্রোহসহ বৃটিশবিরোধী অনেক বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিলো, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় কোনোটাই সফল হয়নি। ১৮৫৭ সালে বৃটিশ শাসকদের প্রায় বিতাড়িত করা মহাবিদ্রোহ শুরুই হয়েছিলো বাংলার ব্যারাকপুরে। এই বিদ্রোহের সূচনাকারী মঙ্গল পান্ডে ছিলেন ৩৪তম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির একজন সৈনিক । তবে তিনি বাঙ্গালী ছিলেন না। বৃটিশরা এঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে চাচ্ছিলো।
তাই তারা বাঙ্গালীদের বাদ দিয়ে তাদের বানানো যোদ্ধা তালিকায় স্থান দিয়েছিলো পাঠান,পাঞ্জাবী,বেলুচ, মারাঠী,রাজপূত,শিখ, গুর্খাদের। এদের দিয়েই তারা টিপু সুলতানকে পরাজিত, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ও সূর্যসেনের বিদ্রোহসহ বৃটিশবিরোধী সব স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করেছে এবং বার্মা, শ্রীলংকা, মালয়শিয়া, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ দখল করেছে। দুই বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
বৃটিশ সেনাবাহিনীতে সাদা চামড়ার বৃটিশদের চেয়ে ভারতীয় বিভিন্ন জাতির সদস্য সংখ্যা ছিলো অনেক বেশী।
এই তালিকার মধ্যে পাঠান,পাঞ্জাবী আর বেলুচরা পাকিস্তানী জাতি এবং সেনাবাহিনীতে তাদের সংখ্যা ছিলো অনেক। এই প্রতিটা রেজিমেন্ট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতে পাঠানো হয়েছিলো। এদের মধ্যে আফগান পাঠানরা আবার পৃথিবীর অন্যতম ভয়ংকর যোদ্ধা জাতি হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে। আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিস খানের মতো নৃশংস আক্রমণকারীর বিরুদ্ধেও তারা লড়াই চালিয়ে গেছে। মোহাম্মদ ঘোরীর সময় থেকেই এরা বারবার ভারত আক্রমণ করেছে। বাংলা আক্রমণকারীর প্রথম মুসলমান ইখতিয়ারউদ্দিন পাঠান না হলেও সে ছিলো আফগানিস্তানেরই তুর্কি অধিবাসী।
আফগান শাসকরা দীর্ঘদিন বাংলা শাসন করেছেন। পাঠান শেরশাহের সাথে যুদ্ধে হুমায়ন বারবার হেরে যাওয়ার ফলে মোগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়েছিলো। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে তারা মারাঠীদের এই অঞ্চলে হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপনের পকিল্পনাও ব্যার্থ করে দেয়। বৃটিশরা বহু চেষ্টা করেও আফগানিস্তান দখল করতে পারেনি। বরং তাদের সাথে কয়েকবার যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলো। দক্ষিণ এশিয়ায় এক নেপাল ছাড়া আফগানিস্তান বৃটিশরা অনেক চেষ্টা করেও দখল করতে পারেনি এবং তারা সবসময়ই স্বাধীন ছিলো।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে পাঠান-আফগানরা।
২০০১ সাল থেকে এখনো আফগানরা এ্যামেরিকান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।
এইসব যোদ্ধা জাতিগুলির রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতো হিংস্র আক্রমণকে যখন ভেতো, ভীরু, যুদ্ধে অনভিজ্ঞ দূর্বল আকৃতির বাঙ্গালীরা লড়াই করে পরাজিত করে, পৃথিবীর ইতিহাসে সেটা বিস্ময় হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
প্রায় নিরস্ত্র একটা জাতির মধ্যরাতে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার মতো ঘটনাও ইতিহাসে বিরল।
সেদিন এদেশের প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন একজন তিতুমীর, একজন সূর্যসেন-যারা জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছিলেন।
এদেশের সাধারণ মানুষের মতো সেনা কর্মকর্তারাও নৈতিকতা ও বীরত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ দিয়েছিলেন। অনেকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে দেশে এসে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আবার অনেকে দেশে থেকেই বিদ্রোহ করেছিলেন।মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর তাহের, মেজর হায়দার, মেজর হুদাসহ অরো অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্য সেদিন যে দেশপ্রেম ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার চূড়ান্ত ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
পাকিস্তান থেকে বিমান নিয়ে দেশে পালিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা মতিউর। অনেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে পরিবারসহ চরম অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিলেন ,যাদের বিচারের নেতৃত্ব দিয়েছিলো যুদ্ধ না করে পাকিস্তানে চলে যাওয়া বিশ্বাসঘাতক , পরে দেশের ক্ষমতা দখল করা এরশাদ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এমন অনেক জেনারেল ছিলো, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিলো। কিন্ত জীবনে অস্ত্র হাতে লড়াই না করা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার অবিশ্বাস্য রণ-নৈপূণ্যর সামনে তাদের কাকুল মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষণ কোনো কাজে লাগেনি।
কোনো যুদ্ধে প্রাণ বাচানোর জন্য ৯০ হাজারের বেশী সৈন্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদসহ যখন আত্মসমর্পণ করে তখন বুঝতে হবে, তারা কি পরিমাণ আতংকিত হয়েছিলো।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যদি সেদিন এই সাহস সাহস ও বীরত্ব না দেখাতেন, তাহলে আজ বাংলাদেশের জনগণের অবস্থা হতো হয় উত্তর ও দক্ষিণ এ্যামেরিকার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আদিবাসীদের মতো অথবা এখনো ফিলিস্তিন,কাশ্মীর সিন্ধু, বেলুচ, সীমান্ত প্রদেশ ও কুর্দি জনগণের মতো, যাদের জীবন ক্রীতদাসের চেয়েও খারাপ।
টিক্কা তার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলো, এদেশের মানুষ না, শুধু মাটি চাই। বাঙ্গালীদের জাতীয় পরিচয় পাল্টে দেয়ার জন্য সব বাঙ্গালী নারীর গর্ভে পাকিস্তানী সন্তান জন্মানোর পরিকল্পনাও ছিলো।
বাঙ্গালীরা কোনোদিনই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতো না যদিনা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ স্বাধীনতার জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে লড়াই করতো ।
সেটা ছিলো একটা সময়, যখন পরশ্রীকাতর, দলাদলি আর ষড়যন্ত্র প্রিয় বাঙ্গালীরা প্রথমবারের মতো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো।
কিন্ত সবচেয়ে দু:খজনক বিষয়, স্বাধীনতার পর বাঙ্গালীর এই নৈতিকতা, দেশপ্রেম বা ঐক্য – কোনোটাই আর থাকেনি, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। তারা সবচেয়ে নিকৃষ্টভাবে চুরি-দুর্নীতি, ঘুষ, বিদেশে টাকা পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ এবং এবং লোভ, হিংসা, স্বার্থপরতা, পরশ্রীকাতর, দলাদলির মতো সবরকম ধ্বংসকারী আচরণের চর্চা করে মহা মূল্যবান এই স্বাধীনতার সুফল লাভ করা থেকে নিজেরাই নিজেদের বঞ্চিত করছে।
অথচ এসবের পরিবর্তে দেশের প্রতিটা নাগরিক প্রকৃত সৎ, নীতিবান ও দেশপ্রেমিক ব্যাক্তিদের নির্দেশনা মানলে, নিজেরা এসব নোংরা আচরণ ও কর্মকান্ড থেকে বিরত হয়ে দেশের আইন মেনে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে বাংলাদেশের একটা অভাব-দারিদ্র ও প্রায় বেকারত্বমুক্ত দেশ হতে ৯ মাসই লাগতো।
কিন্ত এই ২০২০ সালে এসেও তারা নিজেদের উন্নত জাতি ও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না, এটাই সবচেয়ে দু:খ ও লজ্জার ব্যাপার।
বাংলাদেশের একটা উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হওয়ার মতো সব সম্পদ ও সম্ভবনা আছে কিন্ত নাই শুধু জনগণের নৈতিকতা, যেটা না থাকলে কোনো উন্নয়নই সম্ভব না শুধু ধ্বংস ছাড়া।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:০২