somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় রেজিম চেঞ্জ ?

০২ রা জুলাই, ২০২৫ রাত ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাম্প্রতিক সময়ে ফরহাদ মজহারের "সমকাল"-এ দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং তার পূর্ববর্তী অবস্থানের মধ্যে যে অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষত, গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির ঠিক আগে, তিনি কেন জেফরি স্যাকসের মতো বিদেশি অধ্যাপকের বক্তব্যকে টেনে এনে "রেজিম চেঞ্জ" -এর ধারণাটি সামনে আনছেন, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ফরহাদ মজহারের বিপ্লবী মনোভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি ছাত্রনেতাদের "বিপ্লবী সরকার" গঠনের জন্য শহীদ মিনারে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং পূর্বের সংবিধান বাতিল করে নতুন বিপ্লবী শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। ৮ই আগস্টকে তিনি "সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব" হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং রাজনীতিবিদদের লুটপাটের মানসিকতার সমালোচনা করে একটি "কড়কড়ে বিপ্লবী" সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। তার সেই সময়কার বক্তব্যে বিএনপির মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের নির্বাচনমুখী অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল।

তবে, এখন তার অবস্থান ভিন্ন মনে হচ্ছে। "বিপ্লব", "অভ্যুত্থান", "রেজিম চেঞ্জ" — এই শব্দগুলোর মধ্যে তিনি নিজেই যেন তালগোল পাকাচ্ছেন। এটি প্রশ্ন তোলে যে, কেন জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির মাত্র এক মাস আগে তিনি জেফরি স্যাকসের কথা উল্লেখ করে মার্কিন "ডিপ স্টেট"-এর ভূমিকা নিয়ে কথা বলছেন? সম্ভবত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তার নিজস্ব প্রত্যাশার ভিন্নতার কারণে এই ভাষাগত পরিবর্তন এসেছে। ফরহাদ মজহারের এই দাবি যে, এনসিপির প্রধান ছাত্রনেতারা তার অনুসারী, এবং তিনি মিডিয়ায় বলার আগে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা, তা একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি করে।

ফরহাদ মজহার জেফরি স্যাকসের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, আমেরিকা ইমরান খান এবং শেখ হাসিনা উভয়কেই ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে। ইমরান খানের পতনের কারণ হিসেবে তিনি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় রাশিয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা এবং ডোনাল্ড লু-এর পাকিস্তান সফরকে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার পতনের পেছনে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা, আকসা , কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি চুক্তিতে স্বাক্ষর না করা, BRICS-এ যোগদানের প্রচেষ্টা এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময়ে পারমাণবিক চুল্লীর সরঞ্জামবাহী জাহাজ গ্রহণ করাকে দায়ী করেছেন। স্যাকসের মতে, আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রভাব ঠেকাতে মরিয়া, আর শেখ হাসিনা এতে সায় দেননি। শেখ হাসিনার অভিযোগ ছিল "সাদা চামড়ার লোকেরা" তাকে সরাতে চায় এবং বাংলাদেশে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপন করতে চায় । প্রশ্ন হলো, জেফরি স্যাকসের এই দাবি কতটা সত্য ? ইমরান খান ও শেখ হাসিনার পতনকে একই মাপকাঠিতে মাপা কতটা যৌক্তিক ?

ইমরান খান প্রাথমিকভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও আমেরিকার সহায়তায় ক্ষমতায় এলেও, পরবর্তীতে তিনি ইসলামিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে চাঙ্গা করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা কমাতে চেয়েছিলেন। আইএসআই-এর বিরুদ্ধে কথা বলা এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত চীন-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের "রেডলাইন" অতিক্রম করার কারণে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সাধারণ মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক, এবং তার গ্রেফতারের পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। ইমরান খান বা তার দল পিটিআই ক্ষমতায় থাকাকালীন সাধারণ মানুষের উপর জুলুম করেননি বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মদদ দেননি।

শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ১/১১ সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন, যেখানে আমেরিকার প্রভাব স্পষ্ট ছিল। তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বিডিআর বিদ্রোহ ঘটান, বিএনপি-জামায়াতপন্থি সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করেন এবং বিরোধীদের দমনের জন্য ব্যাপক গুম, হত্যা ও মামলা দেন। ২০১৪ সালে ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে তিনি ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো শুরুতে তাকে সমর্থন করেছিল, তবে ধীরে ধীরে তারা বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়। শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদ দমনের কৌশল ব্যবহার করে পশ্চিমকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, তিনি না থাকলে বাংলাদেশ জঙ্গিদের আখড়ায় পরিণত হবে। একইসাথে তিনি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেন, কারণ এই দেশগুলো গণতন্ত্রের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। তবে, বাইডেন প্রশাসনের সময় এই কৌশল আর কার্যকর হয়নি।

ইমরান খান এবং শেখ হাসিনার পতনকে একই মাপকাঠিতে দেখা কঠিন। ইমরান খানের বিরুদ্ধে যেখানে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল না, সেখানে শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক গুম, হত্যা এবং বিরোধীদের দমনের অভিযোগ রয়েছে। ইমরান খান জনসমর্থনে বলীয়ান ছিলেন, যা তার গ্রেফতারের পর জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদে প্রমাণিত হয়। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় ছিল এবং তার পতনের পর আওয়ামী লীগ বা সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। এটি ইঙ্গিত করে যে, শেখ হাসিনা মূলত বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, উন্নয়নের জোরে নয়।

একজন বয়স্ক চা দোকানদারের মন্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, যিনি শেখ হাসিনার পতনে সৃষ্ট জনমনে স্বস্তির চিত্র তুলে ধরেছিলেন। তার মতে, জনগণের প্রার্থনা ও আকাঙ্ক্ষাই ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মূল কারণ, এবং বিদেশি শক্তির ভূমিকা এক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন মাত্র। ১৪ বা ১৮ সালের ভুলগুলো পশ্চিমারা ৫ আগস্টের মাধ্যমে শোধরালো কিনা, এ প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ ও ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও ওঠে, যা বিদেশি শক্তির বিশেষ কোনো গ্যারান্টি প্রদানের ইঙ্গিত দিতে পারে। ইমরানের খানের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস তাকে জেফরি স্যাকসের একপেশে বক্তব্যের শিকার করেছে। শেখ হাসিনার জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় থাকা সত্ত্বেও, কেবল আমেরিকার হস্তক্ষেপই তার পতন ঘটায়নি; বরং শক্তিশালী জনমত এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তির হিসাব-নিকাশের ফলশ্রুতিতেই এই পরিবর্তন এসেছে।

ফরহাদ মজহারের এই আকস্মিক "রেজিম চেঞ্জ" আলোচনার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেহেতু তার স্ত্রী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা এবং তিনি সরকারের বিভিন্ন আলোচনায় অবগত, তাই অনুমান করা যায় যে, তিনি হয়তো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথ সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছেন। মজহার গং সম্ভবত চেয়েছিলেন যে, বিপ্লবের মোড়কে ক্ষমতা ভোগ করার সুযোগ আরো কিছুদিন থাকবে। যেহেতু প্রফেসর ইউনূসকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, তারা হয়তো ভেবেছিলেন যে, আমেরিকা সহসা নির্বাচনের চাপ দেবে না, এবং এই সুযোগে সবাই নিজ নিজ উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে।

আমেরিকয় সরকার বদলানোতে হয়তো এই হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। ফরহাদ মজহার তাই মনে করছেন, প্রফেসর ইউনূস তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেননি, যার ফলে আমেরিকা দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে তিনি এখন কেবল একটি "রেজিম চেঞ্জ" হিসেবে দেখছেন, পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব হিসেবে নয়। ফরহাদ মজহারের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিশেষত "বিপ্লব" থেকে "রেজিম চেঞ্জ"-এর দিকে, তা নিয়ে সবজায়গায় আলোচনা শুরু হবে কয়েকদিনের মাঝে ।


@ গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় রেজিম চেঞ্জ -সমকাল ।

@ Jeffrey Sachs: The US Professor who exposed deep state's role in Bangladesh uprising ।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২৫ রাত ১১:২৭
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনূস সরকার- অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?

লিখেছেন রাবব১৯৭১, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫০

ইউনূস সরকার –অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?
আজকের বাংলাদেশ এক অস্থির, আতঙ্কিত ও শোষণমুখর সময় পার করছে। রাজনৈতিকভাবে যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘অন্তবর্তীকালীন’ সরকার হিসেবে। আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৮০

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:২৬



প্রিয় কন্যা আমার-
সেদিন খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি এবং তোমার মা সাতার জানি না। তুমিও সাতার জানো না। বিকেলে আমরা তূরাগ নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ১৬ বছরে রাজনৈতিক স্পেস না পাওয়া জামায়াতের এমন সমাবেশ ‘অবিশ্বাস্য’:

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯





বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আজকের জাতীয় সমাবেশকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যায়িত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি মনে করেন, এ সমাবেশ বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউ আর সুনামির ঢেউ আলাদা

লিখেছেন অপলক , ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১



সব কিছু একটা রিদমে চলে। সেই রিদম ভেঙ্গে গেলে ধ্বংস বা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীব বৈচিত্র একটা সমন্বয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

“নুহাশ পল্লীর যাদুকর“

লিখেছেন আহেমদ ইউসুফ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৮

এইখানে শুয়ে আছে স্বপ্নের কারিগর
আবেগের ফেরি করে, হৃদয়ে ঝড় তুলে
থেমে গেছে এক যাদুকর।
নুহাশ পল্লীতে মিশে আছে একাকার।

হিমুর চোখে জল, মিসিরের শোকানল
শুভ্রর শুদ্ধতা, রুপার কোমল মন,
আজও ঠিক অম্লান।

হাজারো ভক্তের মনে
মিশে আছ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×