
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনে যখন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত, তখন 'গণতন্ত্রের ইমাম' হিসেবে পরিচিত নাহিদ ইসলামের অভ্যুত্থানের আগের ও পরের ঘটনা নিয়ে স্মৃতিচারণ এবং বিভিন্ন পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার এই অতীতমুখী রাজনীতি দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পর, যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার কথা, তখন নাহিদ ইসলামের মতো নতুন রাজনৈতিক দলের (এনসিপি) নেতার পুরোনো ঘটনা নিয়ে ক্রেডিটবাজি এবং বিভিন্ন শক্তিকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হতাশাজনক। গত বছরের ৫ই আগস্ট থেকেই 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে' শক্তির পুরোনো রাজনীতি ফিরে এসেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও প্রভাবিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে এনসিপির মতো একটি নতুন দলের কাছ থেকে এমন অতীতমুখী রাজনীতি অপ্রত্যাশিত ছিল।
নাহিদ ইসলাম তার ফেসবুক স্ট্যাটাস শুরু করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য দিয়ে। ফখরুল সাহেব বলেছিলেন যে জাতীয় সরকারের কোনো প্রস্তাব ৫ই আগস্ট ছাত্রদের কাছ থেকে আসেনি। নাহিদ এই দাবিকে তীব্রভাবে অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ্যমতে, ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নাহিদ ও বৈষম্য বিরোধীরা তারেক রহমানের সাথে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করে জাতীয় সরকার ও নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছিল। তারেক রহমান তাতে সম্মতি না দিয়ে নাগরিক সমাজ থেকে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা বলেন। তখন বৈষম্য বিরোধীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেন। ফখরুল সাহেবের সাথে গত বছরের ৭ই আগস্ট আবার বৈঠক হয়েছিল এবং উপদেষ্টা পরিষদ শপথ নেওয়ার আগেও তারেক রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল।
এসব তথ্য নতুন নয়। বিএনপির একজন বুদ্ধিজীবী এহসান মাহমুদ মার্চ মাসে তারেক রহমানের সাথে নাহিদদের বৈঠকের কথা বলেছিলেন এবং উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বই থেকেও আমরা এই তথ্য জানতে পেরেছি। বিএনপির জাতীয় সরকার গঠন না করার সিদ্ধান্তটি সম্ভবত বিচক্ষণ ছিল, কারণ দেশের বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থায় জাতীয় সরকার হলে বিএনপির দায়ভার সবচেয়ে বেশি হতো। দেশের একটি অংশ জাতীয়তাবাদী শক্তিকে শেষ করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় আছে, এমন পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠত।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: এই বৈঠকের স্মৃতি এখন কেন পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে? মনে হচ্ছে, যেহেতু চূড়ান্ত সমঝোতার সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাই কে মূল নেতৃত্বে থাকবে এবং কে ভবিষ্যতের রণকৌশল ঠিক করবে, তা নিয়ে নতুন করে পজিশনিং চলছে।
নাহিদ দ্বিতীয় অভিযোগ করেছেন শিবিরের নেতা সাদিক কাইয়ুমের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে। সাদিক কাইয়ুম একটি টকশোতে বলেছিলেন যে শিবির যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, সে অনুযায়ী অভ্যুত্থানে কাজ হয়েছে এবং বৈষম্য বিরোধীরা শিবিরের নেতাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সবসময় কাজ করেছে। এর বিপরীতে নাহিদের দাবি, সাদিক কাইয়ুম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিলেন না এবং ৫ই আগস্টের পর তিনি সমন্বয়ক বনে যান। সাদিক কাইয়ুমের মতো শিবির নেতারা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ঢালাওভাবে প্রচার করেছেন যে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন।
নাহিদ অবশ্য স্বীকার করেছেন যে শিবিরের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল এবং অভ্যুত্থানে শিবিরের ভূমিকাও ছিল। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে এটি কখনোই শিবির দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান ছিল না। নাহিদের সংগঠন, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি, মূলত 'শুক্রবার আড্ডা পাঠচক্র' ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ছাত্র অধিকার পরিষদ' নামক একটি সংগঠন থেকে আলাদা হওয়া অংশ, যেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের 'স্টাডি সার্কেল'ও জড়িত হয়। এই কাঠামো বহুমুখী ও বিকেন্দ্রীভূত ছিল এবং শিবিরের কোনো কেন্দ্রীয় নীতি বা সিদ্ধান্ত এখানে জারি হয়নি।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, ৫ই আগস্ট কেন প্রেস ব্রিফিংয়ে নাহিদদের সাথে সাদিক কাইয়ুমরা ছিল? এর একটিই উত্তর হতে পারে সুবিধাবাদ। যেহেতু শিবিরের ক্যাম্পাসে লোকবল ও সংস্থান ছিল, তাই অভ্যুত্থানে সবাইকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই ব্যবহৃত শক্তি দাবি করছে তারাই মালিক, যা উত্তরণের পর ঘটা ঘটনার ক্লাসিক্যাল বিভাজন। বর্তমানে বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে নাহিদের কাছে প্রশ্ন রাখা হচ্ছে: ১. অভ্যুত্থানের আগে ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকবল কত ছিল? ২. দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কমিটি ছিল? ৩. বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের নাহিদ ইসলাম ৫ই আগস্টের পূর্বে চিনতেন কিনা ?
মজার ব্যাপার হলো, নাহিদ নিজেই জামাত-শিবিরের হাতে 'গ্রুমিং' পেয়েছেন বলে জামাতের নায়েবে আমীর আবদুল্লাহ তাহের বিএনপির একজন নেতাকে একবার টকশোতে বলেছিলেন। তাহলে কেন এই কামড়াকামড়ি? সবই ক্ষমতা এবং রাজনীতির চক্কর। ক্রেডিট দাবি করে রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট করা ছাড়া আর কোনো কাজ হচ্ছে না।
সবশেষে নাহিদ ৫ই আগস্টের পূর্বের একটি সম্ভাব্য ক্যু এবং সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের গংদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নাহিদ দাবি করেছেন যে গত বছরের ২রা আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশ নাকি জুলকারনাইন সায়ের গংদের প্ররোচনায় ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। নাহিদদের দাবি, তারা সে সময় এটিকে বাধা দিয়ে বলেছিলেন, "জনগণের মধ্য থেকে একদফা ঘোষণা দিতে হবে, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর চলবে না।" নাহিদ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলে নাকি আবার ১/১১ ফিরে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজকের সেনাবাহিনী ২০০৭ সালের মতো নয়। আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি অভ্যুত্থানের পরে আবার আওয়ামী লীগকেই যদি সেনাবাহিনী ক্ষমতায় বসায় এ ধরনের কল্পনা শুধুই গুজব এবং ষড়যন্ত্র-সংশ্লিষ্ট চিন্তা।
নাহিদের অভিযোগ, জুলকারনাইন সায়ের গং নাকি নাহিদদের পাল্টা নেতৃত্ব দাঁড় করানোর জন্য শিবির নেতা সাদিক কাইয়ুমকে ব্যবহার করছেন। এনসিপির বিরুদ্ধে তাই চাঁদাবাজি, তদবির, ফোনকল ফাঁস সহ নানাভাবে চরিত্রহরণের চেষ্টা চলছে । নাহিদ সবার গোমর ফাঁস করার হুমকি দিতেসে। কিন্তু সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরকে দোষ দিয়ে নাহিদ কী করবে, যখন ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজেই এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দুর্নীতির কথা বলেছেন এবং নাহিদ সে বিষয়ে কিছু বলছেন না?
এদিকে সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন যে সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্য বিরোধীদের একজন সমন্বয়ক রিয়াদের চাঁদাবাজির শেল্টারদাতা নাহিদ ইসলাম। নাহিদের প্রভাব খাটিয়েই সে এসব কুকর্ম করেছে। তবে এসব ফাঁস হওয়ার পেছনে সায়েরের কোনো হাত নেই।
আজকের দিনটি ছিল জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার দিন। কেন নাহিদ ইসলাম আজ পুরোনো গল্পের ঝুলি খুললেন? এই দিনটায় হওয়া উচিত ছিল জাতীয় ঐক্যের ঘোষণার। অথচ আজকে আমরা দেখছি নেতৃত্বের দখল, রাজনৈতিক ক্রেডিট কে নেবে সেই যুদ্ধে ফিরতি কামড়াকামড়ি। নাহিদ ইসলাম হোক কিংবা অন্য কেউ এই মুহূর্তে অতীত ঘেঁটে নয়, বরং ভবিষ্যতের সুর বেঁধে এগিয়ে যাওয়া দরকার। অন্যথায়, এই রাজনীতি আবারও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। প্রশ্নটা একটাই থেকে যাবে: আপনারা নতুন বাংলাদেশ গড়তে এসেছেন, না পুরনো চর্চা পুনরাবৃত্তি করতে?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ৮:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




