somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৩৫% থেকে ২০% শুল্ক ! ট্রাম্পের নীতিতে কীভাবে বাজিমাত করল বাংলাদেশ ?

০১ লা আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জটিল প্রেক্ষাপটে একটি দেশের অবস্থান প্রায়শই নির্ধারিত হয় সুদূরপ্রসারী কৌশল ও নিপুণ কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাল্টা শুল্ক হার সংশোধন করে বাংলাদেশের জন্য ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনার ঘটনাটি তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই শুল্ক হ্রাসকে "গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যা মূলত অভ্যন্তরীণভাবে জনগণকে আশ্বস্ত করার এবং সরকারের কূটনৈতিক সফলতার দাবি জানানোর একটি কৌশলগত দিক।

তবে এই সাফল্য আসলে একটি বৃহত্তর বাণিজ্য নীতির অংশ, যা বিশ্বব্যাপী অনেক দেশের জন্যই প্রযোজ্য। ১৫ থেকে ২০ শতাংশের এই শুল্ক রেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশের মতো সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের অন্তত ৪৬টি দেশ অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে আফগানিস্তান, বলিভিয়া, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া, ঘানা, মালাউই, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোও রয়েছে।

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার তুলনামূলক অনুরূপ দেশগুলোকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে নিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারক রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই এমন নীতি অনুসরণ করে, যাতে বিস্তৃত গোষ্ঠীভিত্তিক দেশসমূহ একই রকম বাণিজ্যিক বাধার মুখোমুখি হয়।

বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এককভাবে কোনো বিশেষ সুবিধা পায়নি, বরং তার প্রধান প্রতিযোগীদের সমান অবস্থানে থাকার সুযোগ পেয়েছে। এক্ষেত্রে "বিজয়" আসলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে পিছিয়ে না পড়া এবং বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানোকেই বোঝায়। বিজিএমইএ সভাপতির মন্তব্য, "পাল্টা শুল্ক প্রতিযোগীদের সমান এটাই স্বস্তির", এই বাস্তবতাকে সবচেয়ে ভালোভাবে তুলে ধরেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নীতি মূলত একটি বৃহত্তর বাণিজ্য যুদ্ধের অংশ, যা ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে শুরু হয়েছে। এই নীতির মূল লক্ষ্য হলো আমেরিকার বাজারকে বিদেশি পণ্যের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে শক্তিশালী করা। এর ফলস্বরূপ বিশ্বের অনেক দেশই নতুন করে শুল্কের মুখোমুখি হয়।

বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম এবং ভারতের মতো দেশগুলোও একই ধরনের শুল্ক কাঠামোর আওতায় এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমে ২০ শতাংশে এবং পাকিস্তানের ২৯ শতাংশ থেকে কমে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের শুল্কও ২০ শতাংশ এবং ভারতের ২৫ শতাংশে রয়েছে।

এই তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ কোনো একক বিশেষ সুবিধা পায়নি; বরং এটি একটি সামগ্রিক নীতির অংশ, যার ফলে প্রায় সব দেশই একটি নির্দিষ্ট শুল্ক হারের আওতায় এসেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির বিষয় হলো, তার প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের সাথে শুল্ক হার সমান রয়েছে, যা প্রতিযোগিতামূলক সমতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।

এই শুল্ক হ্রাসের পেছনে বাংলাদেশ কী দিয়েছে, সে প্রশ্নটিও গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, তুলা এবং বিমান আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার চুক্তি, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই চুক্তি কেবল বাণিজ্যিক লেনদেনেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপও বটে, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করবে।

এছাড়াও, বাংলাদেশ এক সময় ইউরোপীয় এয়ারবাস কেনার চিন্তা করলেও, সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এসে বোয়িংকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করে যে, বাংলাদেশ তার বাণিজ্য কূটনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। একই সাথে, প্রেস সচিবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, এই শুল্ক হ্রাসের জন্য বাংলাদেশ দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো চুক্তি করেনি।

এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়। প্রথমত, রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্য আনা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ এখনও তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল, যা দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্য, কর ও বিনিয়োগ নীতিতে কার্যকর সংস্কার আনতে হবে, যাতে দেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়াতে পারে। তৃতীয়ত, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা উচিত, যা ভবিষ্যতের সংরক্ষণবাদী চাপ থেকে রক্ষা করবে এবং বিকল্প রপ্তানি প্রবাহ তৈরি করতে সহায়ক হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাসে বাংলাদেশের জন্য কোনো চমক বা সর্বনাশ কোনটিই ঘটেনি। প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমতা বজায় রাখা বৈশ্বিক বাণিজ্যে টিকে থাকার জন্য একটি স্বল্পমেয়াদী সফলতা এনেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টা শুল্ক কাঠামোয় বাংলাদেশের জন্য "বিজয়" শব্দটি যতটা না সুনির্দিষ্ট অর্জনের প্রতীক, তার চেয়েও বেশি এটি প্রতিযোগিতায় সমতা, আত্মবিশ্বাস এবং আগামী দিনের কৌশলগত প্রস্তুতির বার্তা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—দেশের স্বার্থে আপস নয়, বরং কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং বৈচিত্র্যই হতে হবে আমাদের কৌশলের মূলভিত্তি।

---
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×