somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যখন বিজ্ঞ পেঁচা অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন ।

২৮ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একদা এক খামারে বিপ্লব হলো। পুরনো মালিক ম্যানর সাহেব যখন পালিয়ে গেলেন, তখন সব প্রাণীরা মিলে ঠিক করলো একজন বিজ্ঞ পেঁচাকে নেতা বানাবে। শুনেছি উনি নাকি দূর পরদেশে পুরস্কার পেয়েছেন, উনার নামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। সবাই ভাবলো, এবার নিশ্চয়ই খামারে সুদিন আসবে। কুকুরগুলো যেমন ল্যাজ নাড়ে, তেমনি সবাই আনন্দে লাফাতে লাগলো। বিজ্ঞ পেঁচা বললেন, "আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন।" সবাই তালি দিলো। ঘোড়া বক্সার পর্যন্ত বললো, "আমি আরো পরিশ্রম করবো!"

কিন্তু বিজ্ঞ পেঁচা যখন প্রথম ভাষণ দিলেন, তখন একটা মজার কথা বললেন। উনি বললেন, "তরুণ ইঁদুরেরা আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।" খামারের বুড়ো ঘোড়া ক্লোভার তখন চোখ কুঁচকে ভাবলো, "আরে, আমরা সবাই তো মিলে চেয়েছিলাম! শুধু ইঁদুরেরা কেন?" কিন্তু বিজ্ঞ পেঁচার পরিকল্পনা ছিলো গভীর। উনি তরুণ ইঁদুরদের বললেন, "তোমরা নিজেদের একটা দল বানাও।" ইঁদুরেরা খুব উৎসাহে লেজ নেড়ে রাজি হয়ে গেলো। এদিকে পুরনো গাধা বেঞ্জামিন বুঝতে পারলো, এই খেলা আগেও দেখেছে। কুকুরদের আটকাতে হলে ইঁদুরদের পোষা বানাও, সহজ অঙ্ক।

বিজ্ঞ পেঁচা তার পরামর্শদাতা হিসেবে কয়েকটা তরুণ পেঁচা নিয়োগ দিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলো খুবই উচ্ছৃঙ্খল, নাম ধরা যাক আউল জুনিয়র। আউল জুনিয়র খামারে ঘুরে ঘুরে যা ইচ্ছে তাই করতে লাগলো। খড়ের গাদায় আগুন দেওয়া, অন্য প্রাণীদের জোর করে কাজে লাগানো, গোপনে দানা চুরি করা—সব কিছু। সবাই বিজ্ঞ পেঁচাকে বলতে লাগলো, "স্যার, ওকে সরিয়ে দিন!" কিন্তু বিজ্ঞ পেঁচা চুপ। মনে হলো উনার নাকে দুর্গন্ধ পৌঁছায় না, যদিও পুরো খামারে তখন পচা গন্ধ। ম্যানর সাহেবের সময় যেমন ছিল, এখনো তেমনই—শুধু মালিকের নাম বদলেছে।

একদিন খামারে একটা নতুন প্রশাসক এলো। নাম ধরা যাক ওয়েসেল দ্য স্নিকি। শোনা যায় উনি আগে অন্য এক খারাপ পেঁচার দলে ছিলেন। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলে, উনি চল্লিশ বস্তা গম ঘুষ দিয়ে এই পদ পেয়েছেন। যার কাছে চল্লিশ বস্তা গম আছে, তার কেন খামারের প্রশাসক হতে হবে? হতেই হবে কারণ উনি আরও গম কামাতে চান। ওয়েসেল দ্য স্নিকি প্রশাসক হয়ে প্রথমেই গোচারণ ভূমির ইজারা নিয়ে এলোমেলো করলেন। একজন সাহসী মোরগ, নাম কোকরেল দ্য ব্রেভ, এই খবর সবাইকে জানালো। কিন্তু আউল জুনিয়রের দল তখন বললো, "এসব মিথ্যা! ওয়েসেল দ্য স্নিকি খুব দক্ষ!" এমনকি যখন প্রমাণ দেখানো হলো যে গোচারণের টাকা উধাও, তখনো একটা দল ওয়েসেলকে বাঁচাতে লেগে রইলো।

কোকরেল দ্য ব্রেভ প্রতিদিন ডাকাডাকি করতো, "দুর্নীতি হচ্ছে! দুর্নীতি হচ্ছে!" কিন্তু বিজ্ঞ পেঁচা তখন তার কানে তুলো গুঁজে বসে আছেন। অবশেষে খামারের তদন্ত বিভাগ, যেটাকে সবাই "ডিপ ফ্রিজার" বলে ডাকে, একদিন নাড়াচাড়া শুরু করলো। তারা আবিষ্কার করলো ওয়েসেল দ্য স্নিকি টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, সব করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ডিপ ফ্রিজার কি এই মাংস রান্না করার সাহস পাবে? নাকি আবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবে? কারণ, কান টানলে তো মাথা আসবেই। ওয়েসেল দ্য স্নিকির পেছনে যে লম্বা লেজ, সেটা কার সাথে জড়ানো কে জানে!

খামারের প্রাণীরা তখন মনে মনে হিসাব করতে লাগলো। ম্যানর সাহেব ছিলেন ষোল বছর, তার দলের অনেক উপ-মালিকদের নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। কিন্তু এই নতুন বিজ্ঞ পেঁচা মাত্র দেড় বছরে যা করলেন, তাতে তো মাথা ঘোরে। বুড়ো গাধা বেঞ্জামিন তখন বললো, "আমি তো বলেছিলাম, সব খামারই একই রকম। মালিক বদলায়, কিন্তু চাবুক একই থাকে।" ঘোড়া বক্সার এখনও বিশ্বাস রাখতে চায়, সে বলে, "হয়তো বিজ্ঞ পেঁচা জানেন না। উনি তো ভালো।" কিন্তু ভেড়ার পাল মেঁ মেঁ করে বলে, "সংস্কার চাই! সংস্কার চাই!" শব্দ শুনতে চমৎকার, কিন্তু অর্থ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

বিজ্ঞ পেঁচা একদিন ঘোষণা দিলেন, "আমরা জেলা প্রশাসকদের লটারি করে নিয়োগ দেবো!" সবাই তাকিয়ে রইলো। লটারি মানে যোগ্যতা নয়, ভাগ্য। এই কি সেই সংস্কার? নাকি এটা শুধু দেখানোর জন্য একটা নাটক? খামারের মুরগীরা ফিসফিস করে বলাবলি করতে লাগলো, "হয়তো উনি নিরপেক্ষ হতে চাইছেন, কিন্তু আসলে দুর্বল।" মুরগীদের কথায় সবসময় সত্যি থাকে, কারণ তারা মাটিতে থাকে, উপরে উড়ে বেড়ায় না।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞ পেঁচা বলেছিলেন "আমি পুরো খামার সংস্কার করবো।" কিন্তু উনি নিজের গাছের কোটর কখনো পরিষ্কার করেননি। আউল জুনিয়র আর ওয়েসেল দ্য স্নিকির মতো প্রাণীরা ময়লা করে যাচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞ পেঁচা সেদিকে তাকান না। উনি ব্যস্ত ম্যানর সাহেবের পুরনো শস্যাগার ভাঙতে, ইতিহাসের বই লিখতে, নতুন নিয়ম বানাতে। কিন্তু নিজের ঘরের পচা খড় সরানোর সময় নেই। অথচ খামারের সবাই জানে, সংস্কার শুরু হয় নিজের ঘর থেকে, নিজের দল থেকে।

একটা দিন আসবে যখন নির্বাচন হবে। তখন ওয়েসেল দ্য স্নিকি দৌড়ে এসে পশু পার্লামেন্টে দাঁড়াবে। আউল জুনিয়রও আসবে। কারণ পার্লামেন্টে ঢুকলে আইনি সুরক্ষা পাওয়া যায়, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। বিজ্ঞ পেঁচা তখন হয়তো বলবেন, "আমি তো জানতামই না!" কিন্তু পুরো খামার জানে, যে চোখ বন্ধ রাখে সে অন্ধ নয়, সে ভান করছে।

এখন খামারের প্রাণীরা দাঁড়িয়ে আছে এক বিচিত্র জায়গায়। তারা ম্যানর সাহেবকে তাড়িয়েছিল স্বপ্ন দেখে, পরিবর্তনের স্বপ্ন। তারা ভেবেছিল বিজ্ঞ পেঁচা আলাদা, কারণ উনি পুরস্কার পেয়েছেন, উনি শিক্ষিত, উনি রাজনীতির বাইরের। কিন্তু খামারের পুরনো নিয়ম হলো—যে ক্ষমতার কাছে যায়, ক্ষমতা তাকে বদলে দেয়। পেঁচা থাকে পেঁচাই, তা সে বিজ্ঞই হোক, বা সাধারণই হোক। শুধু গাছের কোটরের ঘ্রাণ আলাদা হয়।

মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞ পেঁচা বলেছিলেন উনি নতুন খামার বানাবেন। কিন্তু দেড় বছরে যা দেখা গেলো তা হলো পুরনো খামারের নতুন সংস্করণ। আগে যেমন দুর্নীতিবাজদের ফাইল ডিপ ফ্রিজে যেত, এখনো যায়। আগে যেমন নিয়োগ হতো পয়সা আর ক্ষমতার বিনিময়ে, এখনো তাই। আগে যেমন তদন্ত হতো কিন্তু শাস্তি হতো না, এখনো তাই। শুধু গেটে ঝুলানো সাইনবোর্ডটা বদলেছে। আগে লেখা ছিল "ম্যানর ফার্ম," এখন লেখা "অ্যানিমাল ফার্ম।" কিন্তু ভেতরে একই গন্ধ, একই শব্দ, একই খেলা।

খামারের বাচ্চারা এখন বুড়োদের জিজ্ঞেস করে, "বিজ্ঞ পেঁচা কি সত্যিই বিজ্ঞ?" বুড়ো গাধা বেঞ্জামিন তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "বিজ্ঞতা আর সততা এক জিনিস নয়, ছোকরা। একটা বিজ্ঞ পেঁচা বিপ্লব করতে পারে, কিন্তু বিপ্লব রক্ষা করতে পারে শুধু সৎ পেঁচা।" ঘোড়া বক্সার তখনও আশা ছাড়েনি, সে বলে, "হয়তো পরেরবার ভালো হবে।" কিন্তু ভেড়ার দল এখনও মেঁ মেঁ করে গাইছে, "বিজ্ঞ পেঁচা ভালো! বিজ্ঞ পেঁচা ভালো!" অভ্যাস বড় কঠিন জিনিস।

কোকরেল দ্য ব্রেভ মোরগটা এখনও প্রতিদিন ভোরে ডাক দেয়। সে বলে, "জেগে ওঠো! জেগে ওঠো!" কিন্তু খামারের অধিকাংশ প্রাণী এখন ঘুমোতে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখতে সহজ, বাস্তব দেখতে কষ্ট। একসময় তারা ম্যানর সাহেবের বিরুদ্ধে জেগেছিল। এখন তারা ক্লান্ত। বিজ্ঞ পেঁচার প্রতি তাদের আর সেই উচ্ছ্বাস নেই। শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাথায়: পেঁচা স্যার, এমন হওয়ার তো কথা ছিলো না!"

রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, বুড়ো গাধা বেঞ্জামিন একা দাঁড়িয়ে থাকে আর ভাবে। সে ভাবে কীভাবে একটা স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যায়। কীভাবে বিপ্লব পচে যায়। কীভাবে আশা হতাশায় পরিণত হয়। আর সে বিড়বিড় করে বলে, "আমি তো জানতাম। সব খামারেই একই হয়। কিন্তু কেউ শোনে না।" চাঁদ উঠে খামারে আলো ফেলে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সব শান্ত, সব সুন্দর। কিন্তু ভেতরে পচন ধরেছে। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, যে বিজ্ঞ পেঁচা এই পচন পরিষ্কার করার কথা ছিল, সেই পেঁচা এখন পচনের অংশ হয়ে গেছে।

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৫৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×