সাগর মহাসাগর দাপিয়ে বিভিন্ন দেশকে ভয় দেখিয়ে বেড়াত যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার USS Roosevelt. সেই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সৈনিকদের মধ্যে করোনা দেখা গেল। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে বেইজে ঢোকার অনুমতি দেয়া হলো না। মাঝ সমুদ্রে পড়ে থাকল।
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ক্যাপ্টেন পেন্টাগনে চিঠি লিখলেন। চিঠিতে বললেন, এখন তো যুদ্ধ চলছে না। তাহলে আমার সৈনিকেরা সাগরের মাঝে মারা যাবে কেন?
চিঠির উত্তরে পেন্টাগন ঐ ক্যাপ্টেনকে অপেশাদার আচরণের অজুহাতে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিল।
আর USS Roosevelt এর সৈনিকেরা বনের খেয়ে বনের মোষ মেরে সেটা নিয়ে আসত ঘরে। সেখান থেকে তাদের অল্প কিছু জুটত। আমাদের দেশেও মোটামুটি এই অবস্থাই চলছে এখন। চাকরি বাঁচাতে পেটের দায়ে হাজার হাজার শ্রমিক এখন ঢাকামুখী। নিজের দায়, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতেই তারা ছুটে আসছে। তবে পার্থক্যটা হচ্ছে, এদের পেটে যদি ভাত না জোটে, এই দেশের পেটেও ভাত জুটবে না।
বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বাইরের দেয়ালগুলোতে দেখবেন বিশাল ভেন্টেলেটর ফ্যান দেয়া আছে। ঐ ফ্যানগুলোর সামনে আপনি দুই মিনিটও দাঁড়াতে পারবেন না।
বাংলাদেশ পুরোটা দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টস শিল্পের উপরে। জিডিপির প্রায় পুরোটাই আসে এখান থেকে। বৈদেশিক যে রিজার্ভ আছে তারও বেশিরভাগটাই এখান থেকে আসে। এই যে বিশাল জিডিপি, বিশাল রিজার্ভ- পুরোটা এসেছে এই গার্মেন্টস কর্মীদের হাত ধরেই। ঐ আগুন গরম ফ্যাক্টরীতে বসেই তারা এই দেশের অর্থনীতির ভিত দাঁড় করিয়েছে, বিশাল রিজার্ভ দিয়েছে, বিশাল জিডিপি দিয়েছে। আর আপনার আমার পক্ষে সেই ফ্যাক্টরির বাইরেই টেকা সম্ভব না।
বিনিময়ে তারা কি পায় জানেন? খুব সামান্য কিছু টাকা বেতন পায়। দুপুরে পাখির মতো উড়তে উড়তে বাসায় গিয়ে নাকে-মুখে দুটো গুঁজে আবার ফ্যাক্টরীতে চলে আসে। ফ্যাক্টরীতে আগুন লাগলে মেইন গেটে তালা দিয়ে দেয়া হয়। কারণ, আগুন লেগেছে এই গুজব ছড়িয়ে বানানো পোশাক গুলো নিয়ে যেতে পারে তারা। ২০০৬-৭ এর দিকে হবে হয়তো। টঙ্গীতে এক গার্মেন্টস শ্রমিককে তো পিটিয়ে মেরেই ফেলা হয়েছিল । অপরাধ- ফ্যাক্টরী থেকে নিজের বানানো একটি পোলো টি-শার্ট গায়ে দিয়েছিল সে।
এই রিজার্ভ আর জিডিপি এসেছে আমাদের এই গার্মেন্টস শ্রমিক ভাই-বোনদের রক্ত আর ঘাম বিক্রি করে। এদেশের যে প্রাইভেট সেক্টরের এত চাকুরীর সুযোগ হয়েছে, তাও এই গার্মেন্টেসের হাত ধরেই। বিশাল শপিং কমপ্লেক্স হয়েছে একের পর এক, ঢাকা শহর ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কাদের জন্য? এই গার্মেন্টস কর্মীদের জন্যই।
করোনা হানা দেয়া পর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। যারা এই পোশাকগুলো কিনত, তারাই তো হাসপাতালে। পোশাক কিনবে কে? এই যে যারা আজ ফেরী বোঝাই করে ফিরছে, এদের কিছু হলে এদেশ কি টিকবে? কোন শিল্পই টিকবে না। একটাও না। শ্রমিক না থাকলে শিল্পও যে টিকবে না।
গার্মেন্টসগুলো খোলা রাখতে এক প্রকার বাধ্য মালিকশ্রেণী। অর্থের লোভ তো আছেই। আর কাজ না করলে শ্রমিকের পেটেও ভাত জুটবে না। কাকে ছেড়ে কাকে দোষ দিবেন? আপনার ব্যবসায় ১০ টাকা লাভ হলে সেখান থেকে না আপনি আপনার কর্মচারীর বেতন দিবেন। নিজের পকেট থেকে তো আর দিবেন না।
মালিকশ্রেণী এই ঘাম আর রক্তের টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু যারা ঘাম দিল, রক্ত দিল তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। এদের দিকে সরকার বলুন আর মালিকশ্রেণী বলুন, কেউই ফিরে তাকায়নি কোনদিন। মালিকশ্রেণী সব সময় দায়সারা গোছের একটা ক্ষতিপূরণ গছিয়ে গেছে। তাজরিন ফ্যাশনস থেকে রানা প্লাজা, মারা গেছে আমার এই শ্রমিক ভাই-বোনেরাই। আর দিয়ে গেছে বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ।
এই ঢাকা শহরে আজ থেকে ২০ বছর আগেও কয়জন মানুষ ছিল? এখনকার মতো এত লোক ছিল না। আর এখন ঢাকা শহর শুরু হয়েছে জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে, আর শেষ হয়েছে নরসিংদীতে গিয়ে। আল্লাহপাক যদি করোনার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন, তাহলে এই শহরের ব্যপ্তি আরও বাড়বে। শপিং মল হবে, রিয়েল এস্টেট বাড়বে। কিন্তু যারা এই ঘাম রক্ত দিয়ে এই দেশটাকে গড়ে দিয়ে গেল, তাদের ভাগ্য পাল্টাবে না। এইযে এতগুলো লোক একজনের ঘাড়ের উপর উঠে আরেকজন আসছে, কাল আল্লাহ না করুক এদের কিছু হলে এদের দেখবে কে? এদের কিছু হলে এদেশটাও যে বসে যাবে।
একবার ভাবুন এদের কথা।
প্লিজ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:২৪