somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকার আদি বিখ্যাত যত সব বিরিয়ানির কথা (বিরিয়ানিনামা পর্ব ০৭)

০৪ ঠা মে, ২০২৩ রাত ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এটা কোন আট দশটা “ইন্দুবালা ভাতের হোটেল” নয়, “রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি”। আজকের বিরিয়ানি নামার গল্প হবে ঢাকা শহরের আদি তথা পুরাতন কিছু বিরিয়ানির দোকানের জিভে জল আনা বিরিয়ানি নিয়ে। ঢাকা শহরে খাবার হোটেল অর্থাৎ রেস্টুরেন্ট এর প্রচলন এর ইতিহাস শত বছরের বেশী নয়। আগে শুধুমাত্র বাস, লঞ্চ, রেল স্টেশনের কাছের এলাকাগুলোতে ভাতের হোটেল গড়ে উঠেছিলো; পাড়া মহল্লায় বিকেলের নাস্তা, পরবর্তী সময়ে সকালের নাস্তা আর মিষ্টান্ন আইটেম এর খাবার হোটেল গড়ে ওঠে ঢাকা শহর জুড়ে। কালের পরিক্রমায় এই নগরীর বাসিন্দাদের ঘরের খাবারের পাশাপাশি অভিরুচি গড়ে ওঠে বাইরের খাবারের দিকে। সেই অভিরুচির হাত ধরেই ধীরে ধীরে ঢাকা শহরে গড়ে উঠতে থাকে রেস্টুরেন্ট। আগে কয়েকটি পাড়া মহল্লার কেন্দ্রস্থলে একটি করে বড়সড় খাবার হোটেল ছিলো, আর এখন ঢাকা শহরের প্রতিটি গলিতে একাধিক খাবার হোটেল এর দেখা মেলে।

পঞ্চাশের দশকের পোলাও দোকানের তারা অনেকেই ছিলেন নবাববাড়ির রসুই খানার উত্তরাধিকার। চকবাজার মসজিদের সামনে, ইসলামপুর, বাবুবাজার, বেগমবাজার এলাকাতে ছাপরা ঘর বা মোড়ের পাশে পোলাও বা বিরিয়ানি দোকান নিয়ে তারা বসতেন। কাঁঠাল পাতার দাওনা বা ঠোঙায় বিক্রি করতেন সুস্বাদু পোলাও। যা আদি লোকদের স্মৃতিতে ধারণ করা বিখ্যাত সব পোলাও ওয়ালার নামে পোলাও বা বিরিয়ানি। এদের মধ্যে চকবাজারের আজিজ পোলাও ওয়ালা বিক্রি করতেন খাসি ও গরুর তেহারি যা সরিষার তেলে তৈরি হতো। লতিফ পোলাও ওয়ালার মোরগ পোলাও, মতি মিঞা, মিশর পোলাওওয়ালা, বাবুবাজারের চুন্নু মিয়ার তেহারি, বেগমবাজারে গোলাপের মোরগ পোলাও আর ইসলামপুরের “সাইনু পালওয়ানের” মোরগ পোলাও ছিল বিখ্যাত।

যাই হোক, আজ বিরিয়ানিনামা’র এই পর্বে থাকছে ঢাকার আদি কিছু রিরিয়ানি হোটেল এর যেগুলো বাবুর্চিদের নামেই বিখ্যাত হয়েছে। আসুন শুরু করা যাক।

সাইনু পালোয়ানের মোরগ পোলাও
বই পুস্তক থেকে সবচাইতে পুরাতন যে বিরিয়ানি তথা পোলাওয়ের দোকানের নাম শোনা যায়, তা ছিলো সাইনু পালোয়ানের মোরগ পোলাও এর দোকান। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই বইতে এর উল্লেখ আছেঃ “রাস্তা থেকে খুব সরু ও ছোটো গলি, তারপর ২টো ৩টে ধাপ নিচে নামতে হয়। ঘরে ঢোকার আগেই মোরগ পোলাওয়ের গন্ধ মাথা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করে। ওরা বসার কিছুক্ষণের মধ্যে ২টো প্লেট আসে, পোলাওয়ের ওপরে ২টো মুরগির রান। পাশে এনামেলের ২টো পিরিচে কলজে ও গিলা। খেতে খেতে মুখ তুললে দেওয়ালের আয়নায় ওসমান বাঁকা-চোরা প্রতিফলন দ্যাখে। চারিদকের দেওয়াল জুড়ে আয়না, যেদিক তাকানো যায় মোগর-পোলাওতে-মনোযোগী মানুষের মুখ।

একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রয়াত সাংবাদিক, সর্বশেষ দৈনিক সমকাল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, গোলাম সারওয়ার, উনার স্মৃতিচারণ ছিলো এই পালোয়ানের মোরগ পোলাও নিয়ে এরকম, "মধ্যরাতে কাজ শেষ করে সংবাদ থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে যেতাম লায়ন সিনেমা হলের পাশে পালোয়ানের মোরগ পোলাওয়ের দোকানে। একবার খেলে দীর্ঘদিন সেই স্বাদ মুখে লেগে থাকত। দাম ফুল প্লেট দেড় টাকা। হাফ বারো আনা। দিনের বেলা পালোয়ানের দোকানে এক মজার ব্যবস্থা ছিল। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ছিল স্টুডেন্ট কনসেশন। প্রতি প্লেটে আট আনা কম। এখনকার মতো তখন তো আইডেনটিটি কার্ড ছিল না। তা হলে ছাত্রছাত্রী চেনার উপায় কি? কিছু না, হাতে স্কুলের বইপত্র থাকলেই হলো।"

প্রয়াত সাংস্কৃতিক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকের এই পালোয়ানের পোলাও এর স্মৃতিচারণে বলেন, "ইসলামপুরে সেই সময় খুব ভালো মোরগ পোলাও পাওয়া যেত একটি বিশেষ দোকানে। দোকানটি 'পালোয়ানের দোকান' হিসেবে পরিচিত ছিল। আমরা মাঝেমধ্যে এখানে মোরগ পোলাও খেতে যেতাম। একবার ইংরেজি নববর্ষের রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, হল থেকে হেঁটে হেঁটে ইসলামপুরে পালোয়ানের দোকান পর্যন্ত যাব। পথে যারই দেখা পাই তাকে শুভ নববর্ষ জানানো হবে। আমাদের পাগলামি এমন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আমরা শুভ নববর্ষ বলতে বলতে রাত ১১টায় পালোয়ানের দোকানে পৌঁছে গেলাম। ঠিক ১২টায় গরম গরম মোরগ পোলাও দিয়ে নববর্ষ পালিত হলো।"

তো স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে সবচাইতে বিখ্যাত ছিলো এই সাইনু পালোয়ানের পোলাও। পুরাতন ঢাকার ইসলামপুর রোডে লায়ন সিনেমা হলের পাশের গলিতে ছিলো এই বিখ্যাত দোকানটি যার কথা আর শোনা যায় না স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের কোন লেখা বা তথ্য উপাত্তে।

হাজীর বিরিয়ানি
সরিষা তেলে খাসীর মাংসের চারিদিক ঘ্রাণে স্থবির করে দেয়া হাজীর বিরিয়ানির যাত্রা ১৯৩৯ সালে; হাজী মোহাম্মদ হোসেন নামে একজন বাবুর্চির হাত ধরে যাত্রা, আগে থেকেই তার ছিলো খাবার রেস্টুরেন্ট এর ব্যবসা। তিন পুরুষের যাত্রায় বর্তমানে হাজী মোহাম্মদ হোসেন এর নাতি হাজি শাহেদ হোসেন, হাজি শাহাদাত হোসেন ও হাজি তওহিদ হোসেন মিলে চালাচ্ছেন বর্তমানের হাজীর বিরিয়ানি দোকানটি। কাঁঠালের পাতার বিশেষ ঠোঙা ‘দাওনা’র খোলে করে ধোঁয়া ওঠা সুঘ্রাণের হাজীর বিরিয়ানির স্মৃতিচারণ করেন হাজারো আদি ঢাকাবাসী, সেই মান এবং স্বাদ এখন আর না থাকলেও যতটুকু আছে, তাতেও আর দশটা বিরিয়ানির চাইতে স্বতন্ত্র এই হাজীর বিরিয়ানি। নাজিরা বাজারের কাজী আলাউদ্দিন রোডে ৭০ নম্বর দোকানটি আদি হাজী বিরিয়ানি’র দোকান, যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো পথচলা। ১৯৮৭ সালের ৮ জুলাই, বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস–এ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘হাজীর বিরিয়ানির ওপর প্রকাশিত নিবন্ধে বলা তথ্যমতে সেই সময়ে প্রতিদিন প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ হাজীর বিরিয়ানির স্বাদ নিতেন এই কাজী আলাউদ্দিন রোডের দোকানটি হতে। মাঝে পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ি, বসুন্ধরা, বারিধারা ও মতিঝিল এলাকায় শাখা খুললেও নানা জটিলতায় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতি হাফপ্লেট বিরিয়ানির দাম বর্তমানে ২০০ টাকা, দোকান খোলা থাকে দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত।

নান্না মিয়ার বিরিয়ানি
১৯৬০-৬২ সালের দিকে মৌলভিবাজারের ছোট্ট একটি দোকানে পাতলা মাদুর বিছিয়ে বিরিয়ানি বিক্রির মাধ্যমে যাত্রা শুরু হাজী নান্না মিয়া বিরিয়ানির। নান্না মিয়া তার ভাই জুম্মুন মিয়া ও চান মিয়াকে সাথে নিয়ে বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু করেন। হাজী নান্না বিরিয়ানির আগে 'আনসার রেস্টুরেন্ট' নামের তাদের ভাইদের আরেকটি হোটেল ছিল যা স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে পুরাতন ঢাকার লালবাগে বেশ বিখ্যাত ছিল। একসময় নান্না মিয়া ও তার বন্ধু পেয়ার বাবুর্চি সিদ্ধান্ত নিলেন তারা বিরিয়ানি রান্না করে সেটি বিক্রি করবেন। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল আজকের জনপ্রিয় নান্না বিরিয়ানির ব্যবসা। পরবর্তীতে ১৯৭৩-৭৪ সালে মৌলভীবাজারের বেচারাম দেউড়ির সরদার ভবনে একটু বড় পরিসরে দোকান দিয়ে যাত্রা, যেটি আসল এবং আদি নান্না মিয়ার বিরিয়ানির দোকান। ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হওয়া বিরিয়ানির ব্যবসা আজ ৭টি শাখা নিয়ে চলছে, শাখাগুলো রয়েছেঃ বেচারাম দেউড়ি, লালবাগ, নাজিরাবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, মতিঝিল, মিরপুর কাজীপাড়া ও মিরপুর বেনারসি পল্লিতে। হাফ প্লেট খাসির বিরিয়ানির দাম ১৭০ টাকা, ফুল প্লেট ৩৪০ টাকা। খাসির বিরিয়ানি এক বোল ৬৮০ টাকা। মোরগ পোলাও হাফ প্লেট ১৬০ টাকা। এখানে প্রতি মাসের ৫ তারিখে আস্ত মোরগের বিরিয়ানি বিক্রি হয় যার প্রতি বোলের মূল্য ৩৭০ টাকা।

ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি
চট্টগ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় আসা ফখরুদ্দিন বাবুর্চি ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের নৈশপ্রহরীর চাকরি নেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে স্কুল কম্পাউন্ডে একটি ক্যান্টিন তৈরী করেন। সেই ক্যান্টিন থেকেই যাত্রা করে আজকের ফখরুদ্দিন বিরিয়ানী ও রেষ্টুরেন্ট। তবে তার আগে ফখরুদ্দিনের বাবুর্চির রন্ধনশিল্পী হয়ে ওঠার শুরু হয় মুর্শিদাবাদের নবাবদের হেঁশেলে। নবাবদের বাবুর্চিখানায় ফখরুদ্দিন সেখানকার প্রসিদ্ধ বাবুর্চি মুসলিম মিয়ার অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়ে নবাবী রান্না, নানান মশলার সেরা ব্যবহার এবং দমে রান্নায় ব্যবহৃত সনাতন প্রণালীগুলো দ্রুত আয়ত্ত করে নেন। ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজে ক্যান্টিন চালু করার পর একটি ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ হামিদা আলী ১০-১৫ জন লোকের জন্য রান্না করার জন্য ফখরুদ্দিনকে অনুরোধ করেছিলেন এবং সেই রান্নার স্বাদে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ধীরে ধীরে ব্যাপ্তি লাভ করে ফখরুদ্দিন বাবুর্চির সুনাম চারিদিকে। আসতে থাকে নানান অর্ডার, আর সেগুলো বিবেচনায় রেখে অধ্যক্ষ হামিদা আলী তার বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে ২০০ বর্গফুটের একটি জায়গা রান্নাঘর হিসেবে বিনামূল্যে দেবার প্রস্তাব দেন যেখান থেকে ফখরুদ্দিন শুরু করেন তার ক্যাটারিং এন্ড রেস্টুরেন্ট বিজনেস। এখনও বেইলি রোডের ভিকারুননিসার চত্বরে ক্যাটারিংয়ের জায়গাটি তাদের মূল ক্যাটারিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নাই, ঢাকা থেকে সারাদেশ হয়ে ফখরুদ্দিন বাবুর্চীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের সীমানা পেড়িয়ে বিদেশেও। আর সেই সূত্র ধরে এখন পর্যন্ত ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানির স্বাদ পৌঁছে গেছে জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর হয়ে জর্ডানের রাজপরিবারের হেঁশেলেও। ঢাকার এই বিরিয়ানির স্বাদ জর্ডানের রাজপরিবারের বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানে নিয়মিত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে ফখরুদ্দিন বাবুর্চীর মৃত্যুর পর এই ব্যবসার হাল ধরেন ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ছেলে মোহাম্মদ রফিক। ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান ও উত্তরায় তিনটি স্বতন্ত্র আউটলেটে সুনামের সাথে ব্যবসা করছে ফখরুদ্দিন রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটারিং।

শাহ সাহেবের বিরিয়ানি
ভিন্নতর স্বাদ এবং বৈচিত্রের বিরিয়ানির জন্য পুরাতন ঢাকার চকবাজারের শাহ সাহেবের বিরিয়ানির জুড়ি মেলা ভার। সাদা ধবধবে সুগন্ধি চালের স্বাদ ধরে রাখতে পরিমিত মসলার যথাযথ ব্যবহার সাথে দুধের সংযুক্তি এই বিরিয়ানিকে দিয়েছে ভিন্নতা। ১৯৬০ সালের দিকে যাত্রা করা আবদুর রহমান বাবুর্চি তথা শাহ সাহেব এর এই বিরিয়ানির দোকানের যাত্রা। উনার পিতা লতিফ পোলাওওয়ালা নিজেও ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ রন্ধনশিল্পী। শাহ সাহেব এর বিরিয়ানির মজার দিক হচ্ছে এটি শুধুমাত্র সকাল বেলা বিক্রি করা হয় এবং তা পুরাতন ঢাকার চকবাজার এর ইমিটেশন মার্কেটের ভেতরের একটি ছোট্ট দোকানে। এই দোকানেই গত ষাট বছরের বেশী সময় ধরে চলে আসছে এই বিরিয়ানির ব্যবসা। এখন বয়সের ভারে নুয়ে গেছেন, তারপরেও ধরে রেখেছেন এই ব্যবসা। কিন্তু উনার পরবর্তী প্রজন্মের কেউ এই ব্যবসার সাথে জড়িত নেই, ফলে ঢাকার ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতে পারে এই সুপ্রসিদ্ধ খাবারটি। অন্যান্য বিরিয়ানির চাইতে দাম কিছুটা বেশী হলেও মানে এই বিরিয়ানি সেরা নিঃসন্দেহে। বর্তমানে এই বিরিয়ানি খেতে হলে আপনাকে গুনতে হবে ১৬০ টাকা প্রতি প্লেটের জন্য।

বুদ্দুর বিরিয়ানি
বুদ্দু বিরিয়ানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে বাবুর্চি করিম বকশ এর হাত ধরে। পরবর্তী সময়ে তাঁর ছেলে এলাহী বকশ বুদ্দু মিয়া এই ব্যবসার হাল ধরেন আর তার নামানুসারেই এই বিরিয়ানির সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার গেন্ডারিয়াস্থ ফরিদাবাদের হরিচরণ রায় রোডের ৫৬ নম্বর দোকানটিতে বেচাকেনা শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে, চলে মধ্য রাত অবধি। বংশপরম্পরায় এখন বুদ্দু বিরিয়ানির মালিক বুদ্দু মিয়ার ছেলে জাহিদ ব্যবসার দেখভাল করেন। বর্তমানে বাসমতী চাল দিয়ে রান্না করা বুদ্দুর খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়। এখানকার বিরিয়ানির হাফ প্লেটের দাম ১৫০ টাকা, ফুল প্লেটের দাম ২৫০ টাকা। বুদ্দু বিরিয়ানিতে মোরগ পোলাও পাওয়া যায়।

হানিফ বিরিয়ানি
স্থানীয় বাসিন্দাদের দেয়া তথ্যমতে হাজী মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন হাজী বিরিয়ানির হাজী মোহাম্মদ হোসেনের শিষ্য। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে পুরাতন ঢাকার নাজিরা বাজারস্থ কাজী আলাউদ্দিন রোডের ৩০ নম্বর দোকানে শুরু করেন নিজের নামের এই বিরিয়ানি দোকান যা অতি দ্রুতই পুরাতন ঢাকার ভোজন রসিকদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনেকের মতে হাজীর বিরিয়ানির চাইতেও সুস্বাদু এই হানিফের বিরিয়ানি। ২০০৫ সালে হাজী মোহাম্মদ হানিফের মৃত্যুর পর তার ছেলে হাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম এই ব্যবসার হাল ধরেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা অবধি খোলা থাকে এই বিরিয়ানির দোকান। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি শাখা খোলা হয়েছে হানিফের বিরিয়ানির যার মধ্যে পল্টন, চকবাজার, লালবাগ এলাকার শাখা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে হাফ ১৩০ টাকা, ফুল ২৩০ টাকা এবং স্পেশাল ২৬০ টাকায় খাসীর বিরিয়ানি বিক্রি করছে এই হানিফ বিরিয়ানি।

ঝুনুর পোলাও
নারিন্দার ঝুনুর পোলাও এর নাম আদি ঢাকার কেউ শোনেন নাই এমনটা পাওয়া যাবে না। ঝুনুর মোরগ পোলাও এ ব্যবহৃত হয়ে দেশী মোরগ, এটাই এই দোকানের স্বাতন্ত্র্যতা। প্রতি হাফপ্লেট অর্ডারে মিলবে থাকে এক টুকরো মাংস (খুব বড় নয়), একটা ডিম, কিছু গিলা-কলিজা-মাথা আর একটা আলাদা ছোট প্লেটে পেঁয়াজ, লেবু, মরিচের সালাদ। নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির পশ্চিম পাশে ১৯৭০ সালে ১১ নারিন্দা রোডের এই দোকানে মোরগ পোলাও বিক্রি করতে শুরু করেন নূর মোহাম্মদ, তৃতীয় মেয়ের নামানুসারে দোকানের নাম দেন “ঝুনু পোলাও ঘর” যা সবাই ঝুনুর পোলাও নামেই চেনে। ১৯৮৮ সালে নূর মোহাম্মদ মারা গেলে তাঁর ভাই ইসার উদ্দিন দোকানটি পরিচালনা করে আসছিলেন। পরবর্তীতে ইসার উদ্দিন এর মৃত্যুর পর তার ছেলে মো. স্বপন ব্যবসার হাল ধরেন। বর্তমানে ঝুনুর মোরগ পোলাও হাফ প্লেট পাওয়া যাবে ১৭৫ টাকা, ফুল প্লেট ৩৬০ টাকায়। বিক্রি হয়। না খেয়ে থাকলে একদিন চেখে দেখতে পারেন এই মোরগ পোলাও এর স্বাদ। সাথে বোনাস হিসেবে থাকবে ঢাকার সবচাইতে প্রাচীন মসজিদ বিনত বিবি মসজিদের দর্শন, যা ঝুনুর পোলাও এর দোকান হতে কয়েক কদমের পথ।

মুক্তা বিরিয়ানি ঘর
খিলগাঁওয়ের হাড়ভাঙার মোড়ের মুক্তা বিরিয়ানি হাউজের পথচলা শুরু ১৯৮৭ সালের দিকে হলেও এর আদি ইতিহাস আরেকটু পুরাতন। মুক্তিযুদ্ধের আগে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে 'নিজামউদ্দিন হোটেল' নামে তার ভাতের হোটেল ছিল মো. নিজামউদ্দিন খান ওরফে খান সাহেব এর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের দখল নিলে পরিবার নিয়ে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেও দোকান আর ঘরবাড়ি হারান তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেশা পরিবর্তন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় রানি বিল্ডিংয়ের নিচে এক ছোট্ট দোকানে ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে ছোট মেয়ে মুক্তার নামে নতুন করে শুরু করেন 'মুক্তা বিরিয়ানি ঘর'। শুরুর দিকে আইটেম ছিলো একটা, গরুর চাপ-পোলাও। ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে নানান পদ। এর মধ্যে বর্তমানে পাবেন গরুর চাপ-পোলাওয়ের যার দাম ১৬০ টাকা, হাঁসের রোস্ট-পোলাও ২০০ টাকা, আস্ত কবুতর-পোলাও ২০০ টাকা, স্পেশাল কাচ্চি ১৮০ টাকা, বোরহানি প্রতি গ্লাস ৩০ টাকা, জর্দা প্রতি বাটি ৩০ টাকা। ২০১৪ সালে নিজামউদ্দিন খানের মৃত্যুর পর থেকে তার দুই ছেলে আরমান খান আর আকরাম খান দুটি পৃথক দোকানে মুক্তা বিরিয়ানির ব্যবসার উত্তরাধিকার ধরে রেখেছেন।

আজকের এই পর্বে ঢাকা শহরের পঞ্চাশ বছরের আশেপাশে বয়স এমন যত পুরাতন বিরিয়ানি ঘরগুলোর গল্প তুলে ধরা হল। কিছু তথ্যগত প্রমাণের ঘাটতির কারণে সম্প্রতি সময়ে আলোচিত পুরাতন ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার দিগু বাবু লেনের “মানিক চান এর পোলাও” আর রায়সাহেব বাজারের নাসিরুদ্দিন লেনের “মাখন বিরিয়ানি” এই পর্বে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। আগামীতে, ঢাকার হাইপ তোলা বিরিয়ানি নিয়ে একটা পর্বে এই দুটো বিরিয়ানিও থাকবে ইনশাআল্লাহ্‌। আর রেস্টুরেন্ট ভিত্তিক বিরিয়ানি এই পর্বে দেয়া হলো না, কারণ আগামী পর্বে থাকবে ঢাকার নামকরা রেস্টুরেন্ট এর বিরিয়ানি। এই পর্বটি মূলত মূল বাবুর্চির নামে বিখ্যাত ঢাকা শহরের পঞ্চাশ বছর বা তার সমসাময়িক কালের পুরাতন বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকানগুলো নিয়ে। তো আসছি আগামী পর্বের, সেই ফাঁকে একদিন হয়ে যাক পুরাতন ঢাকার বিরিয়ানি চেখে দেখা?

বিরিয়ানিনামার সকল পর্বঃ
বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০১)
মাশালাজাদে মাশালাদার… বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০২)
বিরিয়ানি'র বাহারি রকমফের - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৩)
বিরিয়ানির অমর সব রন্ধনশিল্পীরা - বিরিয়ানিনামা (পর্ব ০৪)
বিশ্ব জুড়ে বিরিয়ানি (বিরিয়ানি নামা – পর্ব ০৫)
বোকা পর্যটকের ভারতীয় বিরিয়ানিতে ডুব (বিরিয়ানি নামা – পর্ব ০৬)
ঢাকার আদি বিখ্যাত যত সব বিরিয়ানির কথা (বিরিয়ানিনামা পর্ব ০৭)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আসাদুজ্জামান নুর - পর্দার নায়ক বাস্তব জীবনে একজন খলনায়ক

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩৩

৮০/৯০ দশকের অন্যতম একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হচ্ছেন আসাদুজ্জামান নুর। অভিনেতা হিসাবে তাকে পছন্দ করে না , বাংলাদেশে এমন মানুষ নাই। হুমায়ুন আহমদের নাটক মানেই সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে আসাদুজ্জামান... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাগ্রত জনতা পার্টি(জাজপা) হচ্ছে তৃতীয় ধারার নতুন দল, বাড়াবে সবার মনোবল।

লিখেছেন রবিন.হুড, ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫০



যারা দেশকে ভালোবেশে দেশ ও দশের জন্য কাজ করতে চায় তাদের জন্য জাজপা। যারা একা একা দেশের কাজ করতে গিয়ে হাপিয়ে উঠেছেন তাদের জন্য দলীয় প্লাটফর্ম জাজপা। যারা আওয়ামী-বিএনপি-জামাতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুই বছরের শিশু সন্তান কে পুড়িয়ে মারে জামাত শিবির বিএনপি

লিখেছেন আহসানের ব্লগ, ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১৫


৫-ই আগষ্টের পরে আওয়ামি লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বাড়িতে আগুন দেয় জামাত-বিএনপির লোকেরা। বাড়িতে আশরাফুল ইসলামের কেউ ছিলেন না। ছিলেন দারোয়ান, তার স্ত্রী এবং তাদের দুই বছরের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের আর কোন বিকল্প নেই

লিখেছেন সরকার পায়েল, ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪৬

বিকল্প রাস্তাগুলো সব ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে l রাজপথে, সমাবেশে, রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সকলের কণ্ঠেই হতাশা l কি হচ্ছে ⁉️ এভাবে কি দেশ চলে ⁉️ চলবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Every action has an equal and opposite reaction....."!

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪৯

"Every action has an equal and opposite reaction.....".

নিউটনের থার্ড ল' যাকে নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলি- যে দুটি বস্তু যখন পারস্পরিক ক্রিয়া করে, তখন তারা একে অপরের উপর বল প্রয়োগ করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×