টুকরো টুকরো ভালবাসা- ১২,
টুকরো টুকরো ভালবাসা- ১১
রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মেয়েটি। গালে-চোখে মাখানো প্রসাধনীর প্রলেপ, খোপার ফুল, হাতভরা চুড়ি, কানের ঝুমকা - তেমনি থেকে যায়। ফুল-পাতা আঁকা গেরুয়া জমিনের জমকালো শাড়িটাও জড়িয়েই থাকে গায়ে। রাজ্যের অলসতা যেন ভর করে শরীরে। বিছানা-লাগোয়া জানালাটা খুলে সে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। ছাত্রী-হোস্টেল আর কলেজ ভবনের মাঝের চত্বরটা এখন উচ্ছ্বাসের কোলাহলে জমজমাট। অনুষ্ঠান শেষে অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে সবাই আড্ডা জমিয়েছে সেখানে। জুটিরা আলাদা- একটু দূরে দূরে, আধো আলোছায়ায়- আবার অনেকে দলবেঁধে কোরাসে গলা ফাটাচ্ছে। জীবনের ঐ কাকলিতে তারও অংশগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু ছেলেটির অন্যায় ক্রোধ দুজনের আনন্দটাই এখন মাটি করেছে। অন্যায়-ই তো! মঞ্চে উঠে সুরের তালে কয়েক কদম পা ফেলায় কি এমন অপরাধ করেছে মেয়েটি! ফের বিপ্রতীপ ভাবনাও ঢোকে তার মনে। ক্রোধ? নাকি অনুরাগের অভিমান এটা? ভালবাসার যুক্তিহীন দাবী? তবুও... আজ এমনটা না করলেই কি চলতো না ছেলেটির? এক এক বার মেয়েটির মনে হয় ছেলেটিকে ডেকে আনে আবার, চত্বরের ঐ প্রাণের মেলায় যোগ দেয় দুজনে। অলস দৃষ্টি ফেলে সে মুঠোফোনটার দিকে। আবার পরক্ষণেই আহত অভিমান ভেতর থেকে বাধা দেয়। যে অতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তার সামনে কাঙালপনার কি-ই বা দরকার? মুঠোফোনটা বন্ধ করে দেয় মেয়েটি।
কত পরিকল্পনাই না ছিল মনে মনে! অনুষ্ঠান শেষে দুজন রাতের খাওয়াটা সারবে পরিচিত রেস্টুরেন্টগুলোর কোন একটায়- হয়তো নীরব, ভ্যাগাবন্ড বা অস্ট ব্যঞ্জনে। তারপর ফিরে এসে কলেজের ছাদে বসবে পাশাপাশি, হাতে হাত রেখে। একটু-আধটু দুষ্টুমি হয়তো করতে চাইবে ছেলেটি। মেয়েটি চোখের কোণে হাসি ঝুলিয়ে, কৃত্রিম রাগের ভান করে তাকে কিছুটা প্রশ্রয় দেবে, কিন্তু খুব বেশী নয়। মাঝরাত পর্যন্ত তারা বসে থাকবে ‘ছোট ছাদে’ - মূল ভবনের ছাদের প্রায় লাগোয়া ভবনের বর্ধিতাংশের যে ছোট্ট জায়গাটাকে ছেলেটি ‘টং’ বলে। ছাদের ঐ অংশ থেকেই কেবল আকাশের দিকে তাকালে আশপাশের উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো চোখের সামনে তেমন একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ছেলেটির পাশে বসে রাতের নক্ষত্রভরা ঐ আকাশ দেখার ইচ্ছে ছিল আজ তার।
এখন এই রুমের ভিতর থেকে জানালার পাঁচ শিকের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে একটু খানি আকাশ দেখতে পায় মেয়েটি। স্থির জোনাকপোকার মতো ইতিউতি ছড়ানো নক্ষত্রগুলো কেমন যেন ম্লান মনে হয়। এক পাশে চাঁদটাও মনমরা হয়ে পড়ে আছে। তখনই খেয়াল হয়, ময়লা-কালো মেঘগুলো ইতস্তত ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। বৈশাখের এই সময়টায় বিনানোটিশে হঠাৎ হঠাৎ-ই আকাশ রং পাল্টায়। আজ সারাদিন ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো সারসের পালকের মতো সাদাই ছিল। কিন্তু এই রাতে সেগুলো মলিন এখন। ছোট ছোট মেঘগুলো দুর্বিণীত স্পর্ধায় চাঁদকে আড়াল করে দিচ্ছে মাঝে সাঝে। তারপর ছুটে গিয়ে বড় কোন মেঘের সাথে মিশে যাচ্ছে। আকারে আরো বিশাল হচ্ছে মেঘগুলো, আকাশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে নক্ষত্রের অধিকার। আকাশের এই পরাজয়ে বাতাসও যেন মুখ লুকিয়েছে কোথাও।
দেখতে দেখতে মেঘের দল গিলে ফেলল পুরো চাঁদটাকেই। পৃথিবীটাকে ডুবিয়ে দিতে চাইলো গাঢ় অন্ধকারে। কিন্তু এই নাগরিক আয়োজনে কৃত্রিম বিদ্যুতের আলো সে-ই অন্ধকারকে এখানে অতটা গাঢ় হতে দিল না। সেই হতাশায়ই যেন বুনো ষাঁড়ের মতো গর্জন করে উঠলো মেঘগুলো। ক্ষোভ মেটাতে হঠাৎই সিঁদুর-ফোঁটার চেয়ে বড় আকারের রাশি রাশি বৃষ্টি ছুড়ে দিল সেখান থেকে। সেই সাথে হিমালয়ের গা ছুঁয়ে যেন ছুটে এলো জলো হাওয়া।
চত্বরের কলরব তাতে আরো বেড়ে গেল। প্রায় সবাই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছুটলো যার যার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। মেয়েরা ঢুকে পড়লো মেয়েদের হোস্টেলে, ছেলেরা তাদের হোস্টেলের দিকে ছুটলো। কেউ অবশ্য ঐ বৃষ্টির জল গায়ে মেখে আনন্দ নিতে নিতে ছুটে বেড়ালো চত্বরময়। একসময় হাওয়ার বেগ বাড়লো। ছাত্রী হোস্টেলের দেয়ালঘেঁষে উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়া আর নারিকেল গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে নাড়া দিয়ে যেন শাসিয়ে গেল ঝড়ো হাওয়া। নাম জানা-না জানা গাছগুলোকে হাওয়ার শাসানির কাছে মাথা নোয়াতে দেখে বাকি ছেলেমেয়েরাও ফিরে চললো নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে।
খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটিকে। গায়ে কাঁপন ধরাচ্ছিল হিম-বাতাসও। কিন্তু মেয়েটি উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে না। হিম-বাতাসের ছোঁয়ায় তার মনের ভেতর জমাট বাধা অভিমান গলতে থাকে। ঐ গলতে থাকা অভিমানে তার চোখের পাতার নিচের দু দীঘির জলও উপচে পড়ে। নিজেকে আরও অসহায়, একাকী লাগে তার, তবু অনুভূতির জানালাটা বন্ধ করে না সে।
মানুষের তৈরী কৃত্রিম আলো একসময় হার মানে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তির সামনে। কলেজ ভবনের নিচে বা হাসপাতালের সামনে টিমটিম করে জ্বলা বাতিগুলো নিভে যায় হঠাৎ। গিরিখাতের অতল থেকে এক রাশ অন্ধকার কে যেন ছুঁড়ে মারে মেয়েটির জানালার পাশে। বনলতা সেনের চুলের মতো আঁধার হয়ে যায় চারদিক। শুধু কৃষ্ণচূড়া আর নাম-না জানা গাছগুলোর আবছা বিশৃংখল অবয়ব টের পায় মেয়েটি।
অনেকক্ষণ কেটে যায় এভাবেই। হাত উঠিয়ে দুচোখের জল মোছার চেষ্টাও করে না মেয়েটি। অবশ্য বৃষ্টি তার শরীর ছুলেও চোখের পাতা ছোঁয় না, তার ‘এত সাধের কান্নার দাগ’ও তাই ধুয়ে যায় না। বার বারই তার ছেলেটির কথা মনে পড়ে, বেলা-অবেলায় বলা ভালবাসার টুকরো কথাগুলো ফিরে এসে কান ছুঁয়ে যায় যেন, একটা-দুটো পুরনো দৃশ্য ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। দীঘিতে শুধু জল বেড়েই চলে।
কাছে কোথাও বাজ পড়ার প্রচন্ড শব্দ হয়। কেঁপে ওঠে পুরো পৃথিবী। মেয়েটিকেও কাঁপিয়ে দিয়ে যেন বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। কয়েক সেকেন্ড পরই ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মতো উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। একটা ঝলক মাত্র। পরমুহূর্তেই নিভে যায় মেঘ ফূঁড়ে নেমে আসা সাদা আলো। কিন্তু ঐ এক মুহূর্তেই চত্বরে মিলনের কবরের পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটা চোখে পড়ে মেয়েটির। চমকে ওঠে সে। মাঝে মাঝে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য ঝলসানো বিদ্যুতে অবয়বটা হয়তো অস্পষ্টভাবে আগেও চোখে পড়েছে তার, কিন্তু সেই অবয়বটা এতক্ষণ ভেতরটা জুড়ে ছিল এত প্রচন্ডভাবে যে, বাইরের দিকটায় মনোযোগই ছিল না মেয়েটির।
মৃত পড়ে থাকা মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে তাতে জীবনের স্পর্শ দেয় মেয়েটি। ফোন করে ছেলেটিকে। ভেজাস্বরে প্রশ্ন করে - ‘কি?’
ছেলেটির আওয়াজ স্পষ্ট শোনানোর জন্যই যেন বৃষ্টি তার নিজের আওয়াজ কমিয়ে দেয়। তবুও বোঝা যায় ছেলেটি কথা বলছে ম্লান, নিচু স্বরে- ‘কিছু না’।
‘কখন এসেছো?’
‘এই তো।’
মেয়েটি বোঝে, ছেলেটি সত্যি কথা বলছে না।
‘রুমে যাও।’ - নরম গলায় বলে মেয়েটি।
‘হু’। বলে ছেলেটি, কিন্তু সে যে নিশ্চল মূর্তির মতো ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের এ প্রান্ত থেকেও তা বোঝে মেয়েটি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। কেউ কথা বলে না।
‘আচ্ছা যাও না এখন, সকালে কথা বলবো।’ মেয়েটি অবশেষে নীরবতা ভাঙে।
‘স্যরি।’ ভাঙা, বৃষ্টিভেজা স্বর ছেলেটির।
আবার দীঘি উপচায়। এবার দীঘিতে আর অভিমানের ঢেউ নেই, আনন্দের স্রোত খলবলিয়ে ওঠে। গাঢ় স্বরে মেয়েটি বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, তোমাকে আর ভিজতে হবে না। যাও। কালকে কিন্তু পুষিয়ে দিতে হবে, মনে রেখ।’
‘অবশ্যই, সুদে -আসলে। আমি আসলেই দুঃখিত সোনা। মাপ চাই।’ অপরাধবোধের সাথে স্বস্তি আর আনন্দের মিশেল ছেলেটির কন্ঠে।
বৃষ্টির ধারা ক্ষীণ হয়ে আসে। মেঘের নীচে চাপা পড়া নক্ষত্রগুলোও উঁকি ঝুঁকি দেয়া শুরু করে। অন্ধকারের তেজ কমে আসায় ছেলেটিকে আবছামতো দেখতে পায় এখন মেয়েটি। কিন্তু ঐ দূর থেকে ছেলেটি জানালার শিকের ওপারে থাকা মেয়েটিকে দেখতে পায় না, শুধু অনুভব করে সেখানে তার উপস্থিতি। তবু ঐ জানালা লক্ষ্য করে মেয়েটির উদ্দেশ্যে হাত নাড়িয়ে ছেলেটি রওয়ানা দেয় হোস্টেলের দিকে।
ছেলেটা দৃষ্টিসীমানার বাইরে না যাওয়া পর্যন্ত চোখের পলকও ফেলে না মেয়েটি।
..................................................................................................
টুকরো - ১০, টুকরো - ৯, টুকরো - ৮, টুকরো - ৭, টুকরো - ৬, টুকরো - ৫, টুকরো - ৪, টুকরো - ৩, টুকরো - ২, টুকরো - ১
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ২:৩৬