ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
নগ্নবেলা কিস্তি-৪
নগ্নবেলা-৫
নগ্নবেলা-৬
নগ্নবেলা-৭
নগ্নবেলা-৮
নগ্নবেলা-৯
নগ্নবেলা-১০
কিস্তি-১১
মনটা খারাপ হয়ে গেল জাফর সাহেবের। খুব খারাপ। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। না গিয়েও উপায় নেই। এই বয়সে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা যায় না। ক’টা বাজে? হাতের দিকে তাকাতেই দেখলেন তার হাতে ঘড়ি নেই। ঘড়িটা কোথায় গেল? মাগরিবের সময় হাতেই ছিল। স্পষ্ট মনে আছে। হাত থেকে খুলে তিনি অজু করেছেন। প্যান্টের পকেটে রেখেছিলেন। মসজিদ থেকে বেরিয়ে হাতে দিয়েছেন। তবে কি আঁকার বাসায় রেখে এসেছেন? তাই বা কি করে হয়। আঁকার বাসায় তিনি ঘড়ি খোলেননি। তবে ওই ছেলে দু’টি...।
ভিক্টোরিয়া পার্কে একটু বসবেন ভেবেছিলেন জাফর সাহেব। ঘড়ি হারিয়ে তার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। তিনি বাসার উদ্দেশে রওনা হলেন।
বাসায় ফিরে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। কখনও এমন হয় না। আজ দরজা খোলা কেন? ভেতরে ঢুকে দেখলেন রাবেয়া খাতুন কাঁদছেন। রুমগুলো অন্ধকার। যেখানে বসে রাবেয়া খাতুন কাঁদছেন শুধু সেখানে একটা বাতি জ্বলছে। কি হয়েছে বাসায়? কোন সমস্যা? অহনা, নিপুণ, সামি- ওরা কোথায়? কাউকেই তো দেখছেন না। রাবেয়া খাতুনের কাছে গিয়ে হামেদ সাহেব জানতে চাইলেন কি হয়েছে?
রাবেয়া খাতুন কথা বলছেন না। বিরতিহীন কেঁদে চলেছেন। পেটে যমক্ষুধা লেগেছে জাফর সাহেবের। দুপুরে একটা সিঙ্গারা এক কাপ চা খেয়েছেন। ঘরের যা পরিবেশ তাতে খাবারও চাইতে পারছেন না।
হাত-মুখ ধুয়ে এসে আবার জানতে চাইলেন- কি হইছে? কথা বলো না ক্যান? ওরা সব কোথায়?
হইছে আমার মাথা আর মুণ্ডু। তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলা?
একটু কাজ ছিল।
কিছুদিন ধইরা অফিস থেকে ফিরার পর এমন কি কাজ করো তুমি? ভাবছো আমি কিছু বুঝি না?
অহনা, নিপুণ, সামি- ওরা কোথায়? কাউকেই তো দেখছি না।
এ সময় অহনা ফিরে এলো। জাফর সাহেবকে দেখে বললো- বাবা এসেছো? কখন ফিরলা? কোথায় ছিলা?
একটা কাজ ছিল মা।
এদিকে যে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেছে।
মানে? কি হইছে?
তুমি আসছো না দেখে মা চিন্তা করছিল। আমি মাত্র কাস শেষে ফিরেছি। নিপুণ ঘরে ঘুমাচ্ছিল। মা বললেন- তুমি আসছো না কেন একটু খোঁজ নিতে। পথে কোন সমস্যা হলো কিনা? নিপুণ কথা শুনছিল না। এরই মধ্যে সামি এসে বলে কিনা তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিতে হবে।
আকাশ থেকে যেন পড়লেন জাফর সাহেব। তিনি অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললেন-
মোবাইল ফোন কিনে দিতে হবে মানে? ক্লাস ফাইভে পড়ে মাত্র। ওইটুকুন ছেলে মোবাইল ফোন দিয়ে কি করবে।
ওর বন্ধুদের অনেকেরই আছে। ওর নেই বলে তারা তাকে নানা রকম কথা বলে। ভৎর্সনা করে। ইদানীং দেখছো না টিভিতে মোবাইল ফোনের একটা অ্যাড দিচ্ছে বাচ্চাদের দিয়ে। মোবাইল ফোন কেনার বায়না ধরার পেছনে ওটাও একটা কারণ।
সামি এখন কোথায়?
তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে?
মা ওকে মেরেছে। ঘর থেকে কখন বাইরে গেছে কেউ কিছু জানি না। এখন ওকে পাচ্ছি না।
এতক্ষণে রাবেয়ার কান্নার বিষয়টি পরিষ্কার হলো জাফর সাহেবের কাছে। অহনার কথায় তিনি চিন্তিত হলেন না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় অহনাকে বললেন- নিপুণ কোথায়? ওকে দেখছি না।
ও সামিকে খুঁজতে গেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুই এক কাজ কর- আমাকে কিছু খেতে দে। খুব ক্ষুধা লেগেছে।
অহনা খাবার নিয়ে যাচ্ছে দেখে রাবেয়া খাতুন জানতে চাইলেন- ভাত লইয়া যাস কার জন্য।
বাবার জন্য মা।
ছেলেটাকে পাওয়া যাইতাছে না। এই অবস্থায় খাওন চায়! এই সময়ে কেউ খাওন চাইতে পারে? তার কি একটু চিন্তা হচ্ছে না?
অহনা কিছু বললো না। নিরবে খাবার নিয়ে গেল। খাবার খেলেন জাফর সাহেব।
অহনা লক্ষ্য করলো সামি হারিয়ে গেছে কথাটি শুনেও বাবা একেবারে নির্বিকার। তার আচার-আচরণ কথাবার্তায় চিন্তার রেশ মাত্র নেই। সে বুঝলো এর মধ্যে নিগূঢ় কোন রহস্য আছে। নিশ্চয়ই বাবা জানেন সামি কোথায় আছে।
খাওয়া শেষ হলে অহনা বললো- বাবা সামির সঙ্গে তোমার দেখা হলো কোথায়?
গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করতে বললো- তোর মা ওকে মেরেছে। কেন মেরেছে কারণটা যদিও বলেনি।
ও এখন কোথায়?
আঁকার বাসায় রেখে এসেছি। আজ রাতে ও ওখানেই থাকবে।
মা যে ভেঙে পড়েছে।
পড়ুক। একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ছেলে মানুষ বোঝে না। একটা বায়না ধরেছে। তাকে বুঝিয়ে বললেই হলো। এ জন্য মারতে হবে!
রাত যত বাড়ছে রাবেয়া খাতুনের হাপিত্যেশ তত বাড়ছে। তার কান্না থামছে না। ওদিকে ঘটনা আরও একটা ঘটেছে। রাত তখন ১২টা ৪০। সামিকে খুঁজতে গিয়ে ফিরে আসছে না নিপুণ। জাফর সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন। অহনা ঘুম থেকে বাবাকে ডেকে তুললো। বললো- বাবা, রাত দেড়টা বাজে- নিপুণ এখনও ফেরে নি। সে আবার কোথায় গেল। কোন অঘটন ঘটে নি তো বাবা।
চোখ খুলতে পারছেন না জাফর সাহেব। শরীর খুব ক্লান্ত। খাওয়ার অনিয়ম হয়েছে। তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। চোখ খুলে শুধু হুঁ বলে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকে আবার ডাকা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না অহনা। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সে। চিন্তা করছে এ অবস্থায় এখন সে কি করবে। কি করা উচিত? রাত আরও বেড়েছে। আড়াইটা বাজে। অহনার মোবাইল ফোন বাজছে। সে খুব ধীরে সুস্থে উঠে গিয়ে ফোন হাতে নিল। অচেনা নম্বর। ধরবে কি ধরবে না চিন্তা করছে। কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবারও বাজতে শুরু করলো ফোন। হাতে নিয়ে অহনা বললো- হ্যালো। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো-
সূত্রাপুর থানা থেকে বলছি। এটা কি নিপুণদের বাসা?
অহনা বললো- হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
সে আপনাদের কি হয়?
আমার ছোট ভাই।
কি করে?
কিছু করে না। কিন্তু এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
নিপুণ এখন আমাদের থানায়।
কেন থানায় কেন?
সে ছিনতাই করেছে।
কি বলছেন এসব। নিপুণ ছিনতাই করবে কেন? ও একটা এডুকেটেড ছেলে। সে ছিনতাই করবে কেন?
লক্ষ্মীবাজারে গত রাতে বেশ কয়েকটা ছিনতাই হয়েছে। ইনফরমেশন পেয়ে আমরা অভিযানে যাই। ওই সময় সে ছাড়া রাস্তায় আর কেউ ছিল না।
তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেলেন সে ছিনতাইকারী। অদ্ভুত আপনাদের অবজারভেশন।
কোন ভদ্রঘরের ছেলে এত রাতে রাস্তায় ঘুরঘুর করে না।
শুনুন, নিপুণ খুব ভাল ছেলে। ও আমার ছোট ভাই। মাস্টার্স কমপ্লিট করা ছেলে।
দেখুন, ভাল-মন্দের বিচার করার আমরা কেউ নই। ওটা করবে কোর্ট। ছেলেটা হাতে-পায়ে ধরে নম্বরটা দিল- তাই ফোন করলাম। আপনারা সকালে কোর্টে আসুন।
সকালে নয়, আমরা এখনই আসছি।
অহনা ও জাফর সাহেব থানায় এলেন। ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে বিস্তারিত খুলে বললেন। বোঝালেন- সামি নামে ওর এক ছোট ভাই আছে। ক্লাস ফাইভে পড়ে। সে হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল নিপুণ। ওই সময় আপনারা ওকে ধরে এনেছেন। ওকে ছেড়ে দিন।
ডিউটি অফিসার বললেন- রেজিস্টারে এন্ট্রি হয়ে গেছে। এখন ছেড়ে দেয়ার উপায় নেই। সকালে কোর্টে চালান করা হবে। ওখান থেকে আপনারা ছাড়িয়ে নেবেন।
বহু অনুনয় বিনয় করলেন অহনা ও জাফর সাহেব। ডিউটি অফিসারের মন গললো না। অগত্যা তারা ফিরে আসতে চাইলে এক কনস্টেবল জাফর সাহেবকে পাশে ডেকে নিয়ে বললো- টাকা-পয়সা কত আনছেন দ্যান। ডিউটি অফিসার লোক খুব ভাল। আমি বুঝিয়ে আপনার ছেলেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছি।
জাফর সাহেব বললো- আমার সঙ্গে কোন টাকা পয়সা নেই। বাসা থেকে আনতে হবে। কত লাগবে?
কনস্টেবল রহস্য হাসি বললো- বুঝলেন না, দিনকাল যা পড়ছে। সব জিনিসপত্রের দাম মাথার ওপরে। হাজার দশেক নিয়ে আসুন।
বলেন কি দশ হাজার! এত টাকা!
ছেলের চেয়ে কি টাকার দাম বেশি? বাজারে গেলে তো ২৫ টাকার চাল ৪৫ টাকায় কেনেন। তখন তো মাথায় হাত দেন না। থানায় এলে সব শালা চুপসে যায়। বলি আমরা কি আসমানে থাকি- আমাদের কি বউ-বাচ্চা সংসার নাই? তারা কি হাওয়া খাইয়া বাঁচবো? আমরা বাজার থাইক্যা কিন্না খাই না?
জাফর সাহেব ইতস্তত করে বললেন- না মানে, বাবা এত টাকা আমার কাছে নেই।
আপনে মুরুব্বি মানুষ। দেখে মনে হয় ভদ্রলোক। তাই কমই চাইছি। কি আর করা- তাইলে চইলা যান। সকালে কোর্টে গিয়া ছাড়াইয়া আইনেন। তবে কি জানেন- ডিউটি অফিসার বলছিল- ছেলের কাছে নাকি পিস্তলও পাইছে। অস্ত্র মামলা- কম কইরা হইলেও...।
দূর থেকে অহনা সব দেখছিল। বাবার চেহারা দেখে মনে হলো বড় ধরনের কোন গোলমাল হয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে বললো- কি হয়েছে? যা বলার আমাকে বলেন।
কনস্টেবল বললো- যা বলার বইলা দিছি। আপনি চাচার কাছ থাইক্যা জাইন্যা নেন।
সব শুনে অহনা বাবাকে বললো- তুমি বসো বাবা, আমি সব ব্যবস্থা করছি। ডিউটি অফিসারের সঙ্গে আমি কথা বলছি।
জাফর সাহেব দেখলেন ডিউটি অফিসারের সঙ্গে খুব নিচু গলায় কথা বলছে অহনা। ডিউটি অফিসারের চেহারায় একটা পরিবর্তন এসেছে। কিছুক্ষণ আগেও বেশ রুক্ষ ভাব ছিল চোখে-মুখে। এখন তেমনটা নেই। তার চোখ চকচক করছে। মুখে মৃদু হাসি।
ব্যাগ খুলে অহনা কিছু টাকা দিতে চাইলেন ডিউটি অফিসারকে। তিনি জিহ্বায় কামড় দিলেন। বোঝালেন- লজ্জা দেবেন না। এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তিনি একজন কনস্টেবলকে দেখিয়ে দিলেন। ওই কনস্টেবলের হাতে কিছু টাকা দিলো অহনা। কত টাকা এটা বুঝতে পারলেন না জাফর সাহেব। তিনি দূরে বসে সব দেখছেন।
ডিউটি অফিসার চাবি দিয়ে কনস্টেবলকে ইশারা দিলেন। কনস্টেবল চাবি নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর নিপুণকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো। অহনা, নিপুণ ও জাফর সাহেব থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:২৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





