ক্যাম্পাসে সৌদিরা হাতেম তাই এর মিনি ভার্সন হিসাবে পরিচিত। প্রত্যেক সেমিস্টার শেষে এরা বন্ধুদের মধ্যে ল্যাপটপ, টিভি, সোফা ইত্যাদি বিনামূল্যে দান করার জন্য বিখ্যাত। একজন গাড়িও দান করেছিল। আমার ধারণা এগুলার জন্যই ওদের ফ্রেন্ড সবার চেয়ে বেশি হয়। কারণ ফ্রেন্ড সার্কেলে একটা মালদার সৌদি থাকলে পার্টির কোনো অভাব হয়না। মুসলিম হওয়ার কারণে সৌদি ফ্রেন্ড হতে বেশি সময় লাগেনি। তাই বেশ কিছু পার্টি আমিও পেয়েছি। সবচেয়ে ভালো লাগত ওরা যখন কাবসা রান্না করত। কাবসা দেখতে অনেকটা আমাদের চিকেন বিরিয়ানির মত কিন্তু স্বাদ পুরোপুরি আলাদা। কাবসার যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগত তা হলো, এটা বিরাট একটা থালায় নিয়ে সবাই গোল হয়ে একসাথে খেতে বসা। আমাদের মত ওরা হাত দিয়েই খায় কিন্তু পদ্ধতিটা একটু আলাদা। আমরা খাই হাতের আঙ্গুল ব্যবহার করে, আর ওরা খাবারটা হাতের তালুতে নিয়ে প্রেশার দিয়ে মুঠো বানিয়ে তারপর খায়। ওদের একটা খারাপ ব্যাপার হলো ওরা প্রচুর খাবার নষ্ট করে, যা খাবে তার দ্বিগুন রান্না করবে সবসময়। কাবসায় এই জিনিসটা আরো বেশি হয়। তারপরও বিরাট থালায় সবাই একসাথে খাওয়ার মজাই অন্যরকম।
সৌদিদের মধ্যে সব চেয়ে ভালো বন্ধু ছিল আব্দুল। ওর চুল আর চোখ ছিল ব্রাউন। এত হ্যান্ডস্যাম আর ফর্সা যে আমি প্রথমে আমেরিকান বলে ভুল করেছিলাম। ওর সাথে সৌদি আরবের নানা বিষয় নিয়ে কথা হত। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে, আমরা বাংলাদেশে বসে চিল্লাই সৌদিতে রাজতন্ত্র থাকায় মানুষ কষ্টে আছে। সেখানকার রাজপরিবার তেলের সব পয়সা হজম করে ফেলছে কিন্তু যতগুলো সৌদি ছেলের সাথে পরিচয় হলো কাউকেই দেখলাম না রাজপরিবার নিয়ে অসন্তুষ্ট। ওদের সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আমি দুই একবার রাজপরিবারের স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলায় আমার উপরে খেপে গিয়েছিল। আব্দুল আমাকে বুঝিয়ে বলেছিল পরে। ও আমাকে বলত "তোমরা যা ভাব সৌদি আরব সেরকম নয়। আস্তে আস্তে সবই পাল্টে যাচ্ছে। রাজপরিবার টাকা এদিক ওদিক করলেও তারা উন্নয়ন কম করছে না। তেল পাই নামমাত্র মূল্যে, প্রত্যেকটা শহরে উন্নতি হচ্ছে, মরুভূমির মাঝে শহরগুলোতে সবার জন্য পানি নিশ্চিত করা হচ্ছে। আর দেখো আমরা পড়ছি তার পুরো খরচ দিচ্ছে। আমরা পড়া শেষ করে দেশে ফেরার সাথে সাথে চাকরি নিশ্চিত। আর কি দরকার?" নারী অধিকার নিয়ে কিছুই বলে নাই, কারণ ছেলেরা নারী অধিকার নিয়ে বেশি চিন্তিত হবেনা জানা কথা। আমি ভেবে দেখি কথা ঠিকই। ওরা যদি নিজেদের সরকার নিয়ে খুশি থাকে তাইলে বাইরের মানুষের মাথাব্যাথা করে লাভ কি? তাছাড়া এত বছরের গণতন্ত্র আমাদের কতটুকু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে তা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ। আর আরবদের আমেরিকা থেকে ছাত্রদের পড়িয়ে দেশের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। আমি জানি আমার ছোট্ট দেশটার সামর্থ্য নেই এত সহযোগিতা আমাদের দেয়ার, কিন্তু শোনা যায় আমাদের দুতাবাসগুলো নাকি বিদেশীদের চেয়ে নিজের দেশের মানুষদের হেনস্থা বেশি করে। ভালো ব্যবহার আর একটু সহযোগিতাসম্পন্ন মনোভাব দেখাতে পয়সা লাগেনা। অতোটুকু তো আমরা যারা প্রবাসে আছি তারা তো আশা করতেই পারি.....
আমেরিকায় আসার পর প্রথম দিকে যখন রাশেদ ভাইদের সাথে তেমন একটা খাতির হয় নাই, তখন একা লাগত খুব। তাদের সাথে পরিচয় হওয়ার পরেও সব ব্যাপারে তো আর ফ্রি ভাবে আলাপ করা যেত না, হাজার হলেও বড় ভাই বলে কথা.....তখন খুজতে শুরু করলাম স্কুল,কলেজ, ইউনিভার্সিটির বন্ধু-বান্ধব দের মধ্যে কে কে আছে এখানে। খোজা-খুজির পরে পেলাম স্কুল লাইফের চার বন্ধু কে.......রাজ, অর্ণব, শিবলী, নিবির। চার বদমাইশই স্কুল জীবনের পর লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। ফেসবুকের কল্যানে খুঁজে পাওয়া গেল, ফোন নাম্বার দিল ওরা। অনেকদিন পর স্কুল লাইফের বন্ধুদের সাথে কথা বলে কি যে শান্তি লাগলো !!!!! আমি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ছাত্র। গল্প শুরু হত সেই স্কুল পালানোর দিন গুলা থেকে.....শেষ হত প্রেম অথবা রাজনীতি দিয়ে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, দুই বাঙালি কথা বলবে আর রাজনীতি কথার টপিকসে আসবে না, এটা আবার হয় নাকি ? এর মধ্যে একজন আরেকজন কে পচানি তো চলতই, সেই ফেলে আসা দিনগুলোর মত। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও প্রচুর সময় ওরা দিয়েছিল। আর এখন তো শিবলী, অর্ণব এর সাথে সপ্তাহে একদিন খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা মাস্ট। ভিসা পাবার পরে পরিচয় হয়েছিল চৈতি, সুমি আপু, ইমেল ভাইয়ের সাথে। চৈতি, সুমি আপুর সাথে দুই/তিন দিন পর পরই কথা হত। স্বপ্নগুলোর কথা, হতাশার কথা। সুমি আপু এখন তার হাজবেন্ডকেও নিয়ে এসেছে। দুজনের ছোট্ট সংসার ভালই চলছে। চৈতি কয়েকদিন আগে দেশে যেয়ে বিয়ে করে আসলো..........ওদের জন্য শুভকামনা।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৩:০৯