পরদিন সকালে ফিরোজ ভাইর সাথে ফোনে কথা হলো। উনি না থাকায় আমি একটু অস্বস্তি ফিল করছিলাম কারণ মন্টানায় থাকতে শুধু ওনার সাথেই কথা হত, ওনার বাসার বাকি কাউকে চিনতাম না। ফিরোজ ভাই খুবই ভালো মানুষ হওয়ায় আমাকে অনেক আপন করে নিয়েছিলেন না দেখেও। তাই সাগর, সোহেল ভাই, জামাল ভাই থাকা সত্বেও ওনার জায়গাটা পূরণ হচ্ছিল না। ফোনে বললেন আমি কিছুদিনের মধ্যে এসে পড়ব, চিন্তা কোরনা। আমি না আসতে আসতে একটু ঘুরে ফিরে দেখো, নিউ ইয়র্ক চিন, আর দেখো কোনো কাজ-টাজ পাও নাকি। না পেলে সমস্যা নেই, আমি এসে আমার স্টোরেই তোমাকে একটা কাজ ব্যবস্থা করে দিব কনফার্ম। ফিরোজ দেশে গিয়েছিলেন বিয়ে করতে আর ওনার আম্মুকে ডাক্তার দেখাতে। বললেন আর ১৫-২০ দিন লাগবে। দুপুর বেলা ভাবলাম রান্না করব কিন্তু জামাল ভাই নতুন এসেছি দেখে কিছুতেই রান্না করতে দিলেন না, বললেন- "নতুন আসছেন, থাকেন.........রান্না করার জন্য দিন তো পইরাই আছে"।
মন্টানায় জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ খোঁজার সময় ব্যর্থ হওয়ায় এইবার আর ঘুরে ঘুরে কাজ দেখলাম না। সবাইকে বলে রাখলাম কোথাও কাজ পাওয়া যাবে জানলে যেন আমাকে জানায়। কয়েকদিন পর একসাথে দুইটা কাজের খবর এলো। একটা ম্যানহাটনের গিফট শপে আরেকটা জ্যাকসন হাইটসের হাটবাজার রেস্টুরেন্টে। প্রথমেই গেলাম গিফট শপে। শ্রীলংকান মালিক। বলল ৫ ডলার দিবে ঘন্টায়। সপ্তাহে ৩ দিন, প্রতিদিন ১২ ঘন্টা। পুরাটাই ক্যাশে দিবে। আমার পছন্দ হলো না। মন্টানায় আমি কাজ করতাম ৮.২৫ ডলার পার আওয়ার। তিন ডলার এক ধাক্কায় কমে গেল দেখে ভাল্লাগলো না। আমি বললাম ৭ করে দেন। ভদ্রলোক এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যে ভিন গ্রহের প্রাণী দেখেছেন। উনি বলল ৫ ডলারের উপর ১ সেন্ট ও উনি দিতে পারবে না। আমিও না করে দিলাম। এটাই ছিল বড় ভুল। নিউ ইয়র্কে থাকা অবস্থায় আমার শোনা সর্বোচ্চ স্যালারী। এরপর গেলাম হাটবাজারে। কাজ করতে হবে বাস বয়ের। বাস বয় মানে সালাদ কাটাকুটি করা এই শুনে গিয়েছিলাম। যেয়ে দেখলাম সালাদ কাটা থেকে শুরু করে শেফকে হেল্প, প্লেট ধোয়া সবই করতে হবে। স্যালারী? মাত্র ৩ ডলার । কত আওয়ার পাব তা এখনো নিশ্চিত না। পরে ঠিক হবে। মিনিমাম দুই মাস কিচেনে কাজ করতে হবে, তারপর বাইরে কাউন্টারে। একজন কে জিগ্গেস করলাম ভাই কেমন টিপস পাওয়া যায়? বলল যদি লাঞ্চ আর ডিনার দুই শিফট পান তাইলে ভালো উঠবে, টিপস স্যালারী মিলিয়ে ৬-৭ ডলার এর মত ঘন্টা পরবে। কিন্তু শুধু এক শিফটে পড়লে সমস্যা, তেমন কিছুই আসবে না। আর নতুনদের ওই টাইমে দিবেও না। সবাই এই টাইমটা নিতে চায়। আমি তখন পুরা হতাশ। কালকে জানাব বলে চলে আসলাম। হাটবাজার সম্পর্কে কিছু বলা উচিত। জ্যাকসন হাইটসের নামকরা রেস্টুরেন্ট গুলোর মধ্যে একটা, ভীড় লেগেই থাকে সবসময়। খাবারের টেস্টও অন্যান্য জায়গার থেকে ভালো। কিন্তু এদের কিচেনের যে পরিবেশ আমি নিজ চোখে দেখেছি তাতে কিভাবে এরা ইন্সপেকশনে ক্লিয়ারেন্স পায় তা আমার কাছে অষ্ঠম আশ্চর্যের বিষয়। আমি কাজ না করলেও আমার কিছু পরিচিত ছেলে হাটবাজারে কাজ করে। তাদের কাছে যা শুনেছি তা হলো- বিরানি জাতীয় জিনিস হাটবাজারে খাওয়া সেফ কারণ এইটা দিনেরটা দিনেই শেষ হয়। যা শেষ হয় না তা রাত্রে সেলে বিক্রি করে দেওয়া হয় নয়তো ফেলে দেয়। কিন্তু সবজি-ভাজি, মাছ এগুলার অবস্থা শোচনীয়। হাটবাজারের রেস্টুরেন্টের সাথে গ্রোসারি শপ। এখানে যে সবজি নষ্ট হওয়া শুরু করে তা রেস্টুরেন্টে রান্না করা হয়। যে মাছ অনেক দিন বিক্রি না হওয়ায় নরম হয়ে যায় ঐগুলা আজকের তাজা মাছ বলে বিক্রি করে ওরা। ভাবতে পারেন !!!!! এরা প্রতিদিন যে পরিমান ব্যবসা করে, তাতে এই ধরনের বাটপারি না করলেও হয় ।
এর পর বেশ কিছু দিন ঘরে বসা। শিবলী, রাজীব, অর্ণব কারো সাথেই দেখা করতে গেলাম না। মন মেজাজের যাচ্ছেতাই অবস্থা। একদিন ব্রঙ্কসে হাঁটতে হাঁটতে একটা জব দেখলাম। ফোন কার্ডের দোকানে। কলিং কার্ড বিক্রি করার কাজ। ৪ ডলার ঘন্টা। টিপস ও নেই এখানে। এর চেয়ে সামারের চার মাস এম.এস.ইউ তে কাজ করে আসাই ভালো ছিল। সামারে ৪০ ঘন্টা জব করতে পারতাম মিনিমাম ৮ ডলারে। আমার তখন মাথার চুল ছিড়তে বাকি। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারি না। কিভাবে টিউশন ফিস এর টাকা উঠবে আর কিভাবে থাকা-খাওয়া ম্যানেজ করব.............আমি ট্রান্সফার হয়েছিলাম হোসটোস কমিউনিটি কলেজে। প্রতি সেমিস্টার যেখানে সব মিলিয়ে পরবে প্রায় ৩৬০০ ডলার। আমি যা ভেবে এসেছিলাম যে ৫০ ঘন্টা কাজ করব মিনিমাম ৭ ডলারে, তাহলে প্রতি সপ্তাহে ৫০ x ৭= ৩৫০ ডলার, মাসে ৩৫০ x ৪= ১৪০০ ডলার। থাকা-খাওয়া ৫০০ ডলার + মেট্রো কার্ড ১০৪ ডলার + মোবাইল আর ইন্টারনেট ৫০ ডলার + এক্সট্রা খরচ ১০০ ডলার= ৭৫৪ ডলার। মাসে ১৪০০ - ৭৫৪= ৬৪৬ ডলার সেভ। ১২ মাসে জমাতে পারব ৭৭৫২ ডলার। বছরে দুইটা সেমিস্টারে টোটাল খরচ হবে ৭২০০ ডলার। তারপরও হাতে ৫৫২ ডলার থাকে। এছাড়া সামারের বন্ধে অনেক বেশি কাজ করা যাবে, এক্সট্রা টাকার দরকার হলে ঐখান থেকে পুষিয়ে নেয়া যাবে অথবা জমবে। কিন্তু ৫০ ঘন্টা ৭ ডলার করে কাজ পাওয়া তো দুরের কথা ৪০ ঘন্টাও পাচ্ছি না। আর স্যালারি হাইয়েস্ট শুনলাম ৫ ডলার। কেমনে কি? এখন ভরসা শুধু ফিরোজ ভাই। কিন্তু বাংলায় প্রবাদ আছে "অভাগা যেইদিকে যায়, সাগর ঐদিকেই শুকিয়ে যায়"। ফিরোজ ভাইয়ের আম্মু'র শরীর বেশি খারাপ হয়ে গেল। আন্টিকে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলেন ফিরোজ ভাই। কবে আসবেন অনিশ্চিত। ওনার আসার তারিখ পিছানোর সাথে সাথে আমার আশার আলো ও নিস্প্রভ হতে লাগলো।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৩:০৭