নিউ ইয়র্ক !!!!! নিউ ইয়র্ক !!!!!
সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইটের পরে অবশেষে নিউ ইয়র্ক। লাগারডিয়া এয়ারপোর্ট। সেদিন নিউ ইয়র্ক ছিল বৃষ্টিস্নাত। বৃষ্টির মাঝে ঝলমলে নিউ ইয়র্ক সিটিকে প্লেনের মোটা কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে ঝাপসা লাগছিল। চার মাস পর এমন আলো ঝলমলে শহরের মধ্যে !!!!! শিবলীকে বলে রেখেছিলাম আমাকে পিক আপ করার জন্য। ভায়া নিজের বিশাল গাড়ি নিয়ে হাজির। ৮ বছর পর শিবলীর সাথে দেখা হলো। ঠিক সেরকমই আছে যেমন ছিল স্কুলে। ওকে দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেল। মনে হলো একজন পুরনো আপন বন্ধুতো আছে এখানে। পরম একটা শান্তি। গাড়িতে উঠে বসলাম, সাথে সাথে বেনসন !!!!! আহ্হ্হঃ......বললাম দোস্ত খাঁটি বাঙালি খাবার কই পাওয়া যাবে, ঐখানে চল প্রথমে। বাকি সব পরে। ও বলল চল তাইলে জ্যাকসন হাইটস, পনের মিনিট লাগবে মাত্র। জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ স্ট্রিটে যেয়ে আমি পুরাই অবাক। এক দোকানে বাংলায় লেখা "এখানে সিডি ভাড়া পাওয়া যায়" !!!!! এরপর চারিদিকে চেয়ে দেখি সব বাংলায় লেখা। শিবলী নিয়ে গেল প্রিমিয়াম নামে একটা রেস্টুরেন্টে। মেন্যু কার্ড নিয়ে আমি তো পুরাই টাশকি !!!!! ভর্তা, শুটকি, ভাজি, শাক, কাবাব, পরোটা, তন্দুর রুটি, গ্রিল চিকেন, নানান রকম বিরিয়ানি কি নাই সেখানে। কথা না বাড়িয়ে ঝটপট দুই প্লেট তেহারী অর্ডার করে দিলাম। শিবলী তেহারী মুখে দিয়েই বলল জঘন্য হইছে। কিন্তু এতদিন পরে খেয়ে আমার মনে হলো এরচেয়ে ভালো রান্না আর কি হতে পারে? চরম তৃপ্তি সহকারে চেটেপুটে শেষ দানাটুকু পর্যন্ত খেয়ে নিলাম। বিল বেশি না, মাত্র ১৪/১৫ ডলারের মত হয়েছিল। খেয়ে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম তার কাছে এই টাকা কিছুই না। ব্যাপক ধস্তাধস্তির পরও শিবলী কিছুতেই বিল দিতে দিল না। দুইটা কোক নিয়ে আবার সুখী মানুষের মত হালকা বৃষ্টির মধ্যে চরম ফিলিংসে বেনসন টানতে লাগলাম।
ইউ.এস.এ'র বাইরের কোনো স্টেটে থেকে এসে সরাসরি জ্যাকসন হাইটসে গেলে কিছু কিছু ব্যাপার চোখে লাগবে খুব। রাস্তা চরম অপরিস্কার, যেখানে সেখানে গারবেজ রাখা, রাস্তার মাঝখানেই গাড়ি থামিয়ে লোকজন উঠা-নামা করছে, সিগারেটের গোড়া, কোকের ক্যান, প্লাস্টিকের চায়ের কাপ অথবা পানের পিক যেখানে খুশি সেখানে ফেলছে, গ্রোসারী শপগুলো সামনের ফুটপাতেও নিজেদের মাল রেখেছে। আমার এগুলো তেমন গায়ে লাগে নাই, ২৫ বছর এগুলার মাঝেই তো পার করলাম। তবে অবাক হয়েছিলাম। আমেরিকায় কিভাবে এগুলা করে !!!!! সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার বেশিরভাগ মানুষই একদম আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। প্রথমদিন যেয়ে ঘন্টা তিনেক থাকার পর ও আমি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে একটা মানুষকেও শুনিনি ।
এরপর গন্তব্য ব্রঙ্কস। ফিরোজ ভাইয়ের বাসা। আমি যেতে যেতে ফিরোজ ভাইয়ের আম্মু অসুস্থ হয়ে পরায় ওনাকে দেশে যেতে হয়। কিন্তু আমি যেয়ে যেন ওনার বাসাতেই উঠতে পারি তার ব্যবস্থা উনি করে গিয়েছিলেন। তখন রাত প্রায় ১২ টা ছুই ছুই। ফিরোজ ভাইয়ের রুমমেট জামাল ভাইকে আমি আসছি বলে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। এখান থেকেই আমার অস্বস্তির শুরু। মন্টানার সেই পাহাড়ের পাশের নির্জন রাস্তার সাথে নিউ ইয়র্কের রাস্তার পার্থক্য বড় বেশি লাগছিল। ট্র্যাফিক, পিছনের গাড়ির হর্ন, অসংখ্য রাস্তা, মাথার উপর দিয়ে বিকট শব্দে ট্রেন যাওয়া আমাকে বিরক্ত করে তুলেছিল। যেতে যেতে শিবলী বলল- "ব্রঙ্কস, এইটা তো খাতারনাক এরিয়া, এই জায়গায় থাকে কেন?" ব্রঙ্কসে পৌছে আমার তেমন খাতারনাক মনে হলো না। মোটামুটি ভীড় ছাড়া রাস্তা, আমি যে জায়গায় গিয়েছিলাম, মেট্রোপলিটন এভেনিউ, সেখানে রাস্তার দুই পাশে বিরাট সব এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। জামাল ভাই নিচে এসে নিয়ে গেলেন। শিবলী বলল পরে আমার সাথে আবার দেখা করবে। জামাল ভাইয়ের সাথে বাসায় যেয়ে আমার মন পুরাই দমে গেল। পিচ্চি একটা বাসা। দুইটা রুম সেখানে চারজন থাকে। কাঠের ফ্লোরে প্রচুর দাগ। রান্নাঘরে তেলাপোকার অভাব নাই। বাংলাদেশেও আমি এত তেলাপোকা একসাথে দেখি নাই। এইখানে নতুন জীবন শুরু হবে দেখে আমি পুরা চিপ্সা বেলুন। যাই হোক হাত-মুখ ধুয়ে শুয়ে পরলাম। রাত প্রায় তিনটার দিকে শুরু হলো আরেক আপদ। রাস্তায় ক্রমাগত গাড়ির আওয়াজ আর বিকট শব্দে গান। আমি চমকে উঠে বসলাম। ফিরোজ ভাইয়ের আরেক রুমমেট সোহেল ভাই বিড়বিড় করে বললেন- "শালার কাউলা গো জ্বালায় আর শান্তি নাই"। মাথার উপরে আরেকটা বালিশ চাপা দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরলাম।
(চলবে)
অন্যান্য পর্ব:
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ১৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২০)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২১)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২২)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৩)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৪)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৫)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৬)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৭)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৮)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (পর্ব ২৯)
আমেরিকায় এক বছর এবং মধ্যবিত্ত ছাত্রদের বাস্তবতা (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৩:০৯