দুপুরবেলা। স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলাম।
রাস্তায় একটা টিউবওয়েল দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
উপায় নেই। বাসায় পৌছানোর আগেই কাপড় চোপড় পরিস্কার করে নিতে হবে।নাহয় গতবারের মত আম্মা আবার সেই মার মারবে।
গতবার হয়ত আমার কিছুটা দোষ ছিল। কিন্তু এবার আমার কোন দোষই ছিল না।
শুরুটা করেছিল ওই সাঈদীই।
টিফিন খাচ্ছিলাম। হঠাত কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করল, তোদের একটা জীবন ভাই। চাল, ডাল সবকিছুতেই রেশন। বাপ যতদিন আছে ততদিন ওই রেশনের চালেই জীবন পার করবি। বাপটা মরে গেলে আবার পোষ্য কোটায় সিপাহী হয়ে ঢুকে পরবি। তারপর আবার রেশন। কি মজা। আমরা শালার ট্যাক্স দিব আর আজীবন রেশন পাবি তোরা।
এসব কথা শোনার পর মেজাজ ঠিক থাকে না। হাতটা নিজ দায়িত্বে মুঠি হয়ে সাঈদীর গালে বসে পরল। সাঈদীও পাল্টা ঘুষি মারতে এগিয়ে এল।
আফটার ম্যাথ হিসেবে কাপড়ে ধুলা আর বালি লেগে গেল। আমার কোন দোষ ছিল না।
ওহ শিট। পকেটটা আবার ছিড়ল কখন?
এখন এটার কি?
আজকে কপালে নিশ্চিত মার। আম্মা আজকে একটা হাড্ডিও আস্ত রাখবে না।
ভাবতে ভাবতে কখন বাসার সামনে চলে এসেছি-বুঝতেই পারিনি।
একি?
বাসার সামনে এতগুলা গাড়ি কেন? বেশ কিছু লোকও আসছে দেখি।
ঘটনা কি?
ঘটনা যা-ই হোক, আমার জন্য ভালই হল।বাসায় মেহমান থাকলে আম্মা আর আমার শার্ট নিয়ে মাথা ঘামাবে না।
দোয়া পড়তে পড়তে দরজা ঠেলে বাসায় ঢুকলাম।
একি? আম্মা সোফায় বসে আছেন, হাতে জড়িয়ে ধরেছেন একটা পতাকা। উর্দি পড়া একটা লোক, মনে হয়ে আব্বাদের বড় স্যার ট্যার হবে, আম্মাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে।
-সাজিদ। আমাকে দেখেই আম্মা কেদে উঠল।
-কি হয়েছে আম্মা?আপনি কাঁদেন কেন?
-সব শেষ হয়ে গেল রে বাবা।
-মানে?
আম্মা কোন জবাব দেন না, অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন।
এবার এগিয়ে আসেন সেই উর্দি পড়া বড় স্যার। -দেখ সাজিদ, মনটা শক্ত কর। ভেংগে পড়লে চলবে না। তোমাকে এখন মায়ের শক্তি হতে হবে।
-কি বলছেন এসব? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
-গতকাল রাত সিয়েরা লিওনে, যেখানে তোমার আব্বার পোস্টিং, সেখানে ভয়াবহ গাড়ি বোমা হামলা হয়েছে। তোমার আব্বা...
আমি আর কিছু শুনতে পাইনা। শুধু দেখতে পাই আম্মা একটা পতাকা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
আব্বা শান্তি রক্ষার জন্য গিয়েছিলেন, শুধুমাত্র একটা পতাকা ফেরত এসেছিল ...
গল্পঃ পতাকা
২২.০৪.২০১৯
-এই শালা মুক্তি, শেষবারের মত প্রশ্ন করছি, বল তোর সাথিরা কোথায়? গর্জে ওঠে মেজর সরফরাজ।
জাহাংগীর একবার চারপাশে তাকায়। মাথার ওপর ঝকঝক করছে শরতের নীল আকাশ, এমন দিনে বন্ধুদের নিয়ে মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়ানোর কথা ছিল, কথা ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর।
জাহাংগীর মাঠে আছে ঠিকই, কিন্তু দৌড়ানোর কোন সুযোগ ওর নেই। কিংবা হয়তে আছে, কিন্তু পালানোর মত কাপুরুষ ও নয়।
-না। দৃঢ় কন্ঠে জবাব দেয় সে।
-বলবি না? ভেবে দেখ, তোর ওই দুই সাথীর মতই পরিণতি হবে।
জাহাংগীর বামে তাকায়। নূর আর আমিন মাটিতে পড়ে আছে, একটু আগেই ওদের মাথায় গলি করেছে সরফরাজ।
জাহাংগীর জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজনবোধ করে না, ওর ঠোটের কোনে উপহাসের হাসি ফুটে ওঠে।
অবাক হয় সরফরাজ। কি দিয়ে তৈরী এই কিশোর? পাশেই দুই সহযোদ্ধার লাশ, কপালে তাক করে রাখা বন্দুক-তবুও ছেলেটা হাসছে?
-শেষবারের মত বলছি...
কথাটা শেষ করতে পারে না সরফরাজ, একদলা থুথু ওর মুখে এসে পরে।
আর দেরী হয় না, সরফরাজ ট্রিগারে চাপ দেয়।লুটিয়ে পড়ে জাহাংগীর।
ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার আগে কি মনে করে পেছনে তাকায় সরফরাজ। সবুজ মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে লাল, তিন কিশোরের লাল রক্ত...
গল্পঃ সবুজ মাঠে লাল রক্ত
২২.০৪.২০১৯
দোকানের সামনে একটা বাইক এসে থামে। কালাম সাহেব লক্ষ্য করেন তিন যুবক তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
-কোন ওষুধ লাগবে, বাবাজিরা? কালাম সাহেব হাসি মুখে জানতে চান।
- কোন ওষুধ-টষুধ লাগব না। বিকালের মধ্যে চান্দা রেডি রাখবেন।মাঝেরজন বলে।
-চাদা? কিসের চাদা? কালাম সাহেব জানতে চান।
-কাইল ২৬ শে মার্চের প্রোগ্রাম। লিডার আসবে, বড় প্রোগ্রাম হবে। মার্কেটের সবাই চান্দা দিছে, আপনিও বিকালের মধ্যে রেডি রাখবেন।
-ঠিক আছে, যদি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পার, তাহলে চাদা দেব।
-কি প্রশ্ন?
-বলত, ২৬শে মার্চ কি আমাদের বিজয় দিবস? নাকি স্বাধীনতা দিবস?
হঠাত মাঝেরজনের হাত নেমে আসে কালাম সাহেবের গাল বরাবর, দোকানের ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
-এই শুয়োরের বাচ্চা, হয় বিকালের মধ্যে চান্দা রেডি রাখবি, নাহয় কাইল থেইকা তোর দোকান বন্ধ।
ফ্লোর থেকেই কালাম সাহেব বাইক স্টার্ট হওয়ার শব্দ শুনতে পান। কোনক্রমে উঠে দাড়ান তিনি। মাথায় শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরতে থাকে, ১৯৭১ সালে যে বীরবিক্রমে বিদেশী শত্রুদের সাথে লড়েছিলেন, আজ ২০১৯ সালে নিজের ঘরের এইসব কুলাংগারের সাথে লড়ার জন্য সেই সাহসের সামান্যতম অংশও জড়ো করতে পারছেন না কেন?
গল্পঃ প্রশ্ন
২২.০৪.২০১৯
===============================================================
সিরিজের আগের পর্বসমূহঃ
পরমাণু গল্পসমগ্র-১
পরমাণু গল্পসমগ্র-২
পরমাণু গল্পসমগ্র-৩
পরমাণু গল্পসমগ্র-৪
পরমাণু গল্পসমগ্র-৫
পরমাণু গল্পসমগ্র-৬
পরমাণু গল্পসমগ্র-৭
পরমাণু গল্পসমগ্র-৮
পরমাণু গল্পসমগ্র-৯
পরমাণু গল্পসমগ্র-১০
পরমাণু গল্পসমগ্র-১১
পরমাণু গল্পসমগ্র-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:০৮