প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । সপ্তম পর্ব । অষ্টম পর্ব । নবম পর্ব । একাদশ পর্ব
এ অবস্থায় নুরু মিয়া ছাড়া গতি নেই। শালা হেভি ট্যালেন্ট। এখন নুরু মিয়াই প্রধান অবলম্বন। শেষ ভরসা। সে সিদ্ধান্ত নিল আপাতত নুরু মিয়ার ওখানেই উঠবে।
নুরু মিয়ার ওখানে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। নুরু মিয়াকে তার ঘরে পাওয়া গেল। কিন্তু এমন অবস্থায় যে আজগর আলী বিব্রত হয়ে পড়ল।
নুরু মিয়ার ঘরে জুয়ার আড্ডা বসেছে। সঙ্গে নেশার আসর। দু’টো খারাপ মেয়ে লোকও আছে। বিরাট মজমা। এ অবস্থায় আজগর আলী কী করবে বুঝতে পারল না। তাকে দেখেই নুরু মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, ‘আপনের সাবে কই পলাইছে ?’
আজগর আলী কিছু না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। রহমত মিয়া পালাতে যাবে কেন ? তার এমন কী বিপদ হল ? আজগর আলীর হাবলা চাউনি দেখে নুরু মিয়া রসিকতা করতে করতে বলতে লাগল যে সে কিভাবে খারাপ মেয়ে লোক পাঠিয়ে রহমত মিয়াকে অপদস্ত করেছে।
নুরু মিয়ার কুঁতকুতে চোখের চকচকে কুৎসিত চাউনির দিকে তাকিয়ে আজগর আলী শিউরে উঠল। তার মনে হল, তার সামনে একটা জঘন্য হিংস্র গিরগিটি বসে আছে। তার শরীর রি রি করে উঠল। ছিঃ, সামান্য অর্থের জন্য এত অধঃপতন !
আজগর আলী তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে, এই লোকের সঙ্গে আর না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর কিছু ঘটার আগেই এই লোকের সঙ্গ ছাড়তে হবে।
আজগর আলী উঠে দাঁড়াল। অপেক্ষাকৃত কুৎসিত মেয়েলোকটি তাকে জিজ্ঞেস করল,‘কী মিয়া, চইলা যাইতাছেন মনে অয়। আমাগো কি চয়েজ হয় না ?’
পুরো দলটি হো হো করে হেসে উঠল। নুরু মিয়া ওই মেয়ে লোকটিকে কৃত্রিম ধমক দিয়ে বলল, ‘ দূর মাগী, তর ওই পোতাইন্যা চেহারা চয়েজ হইব না। আমার দোস্তের দরকার ফকফইক্কা জিনিস - নিউ মাল।’
মেয়ে লোকটি তার বুকের উপর থেকে আঁচল সরিয়ে বলল, ‘পুরান চাইল বেশি বাড়ে। খাইয়া মজা।’
আজগর আলীর মাথা ঝমঝম করতে লাগল। সে দ্রুততার সঙ্গে বলল, ‘আমার একটা জরুরী কাজ আছে। আমি যাই।’
‘আরে মিয়া, কাজ বাদ দেন। আপনের যা হইছে, তাতে এক বছর বইয়া খাইলেও ফুরাইব না। একটা রাইত মউজ করলে কী এমন আইব যাইব ?’
কোন জবাব না দিয়ে আজগর আলী বেরিয়ে এল। ঘরের ভেতর এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। যেন আজগর আলীর ভাঁড়ামো দেখে তারা খুব মজা পেয়েছে। আজগর আলীর শরীর কাঁপতে লাগল। রাগে নাকি ভয়ে সে তা বুঝতে পারল না। তবে এ কথা বুঝতে পারল, রহমত মিয়া নিজেই এখন দৌড়ের উপর আছে। সুতরাং তার নিজের ভয়ের কিছু নেই। নুরু মিয়া হেভি ট্যালেন্ট।
আজ রাতে সে কোথায় থাকবে ? হঠাৎ মনে হল, এই শহরে সে প্রথম যেই মেসে উঠেছিল, সেখানে গেলে আজ রাত থাকা যেতে পারে। সে তৎক্ষণাৎ রিক্সা নিয়ে নিল।
রিক্সায় বসে পকেটে হাত দিয়ে অবাক হল। পকেটে রহমত মিয়া ফ্ল্যাটের চাবি ! ফ্ল্যাটের যে ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে ছিল, সেটা ফেরত দেয়া হয় নি। একই সাথে তার মনে পড়ল, তার কাপড় চোপড়ও আনা হয় নি। টাকা পয়সা অবশ্য ব্যাংক একাউন্টে। দশ হাজার টাকা চুরি করেই প্রথম ব্যাংক একাউন্ট খোলে সে। এখন সেই একাউন্টে লাখ খানেক টাকা আছে। হোক চোরাই টাকা, তবু সে লাখপতি । লাখের বাতি জ্বালাবে নাকি ?
নুরু মিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, ফ্ল্যাট এখন খালি। তাহলে ফ্ল্যাটে্ই ফিরে যাওয়া যাক। তারপর কাল সকালে ঠাণ্ডা মাথায় পরবর্তী করণীয় ঠিক করা যাবে। আজগর আলী রিক্সা ঘুরিয়ে দিল।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই তার মনের গ্লানি কেটে গেল। মনে হল, সে রহমত মিয়া হয়ে গেছে। সে এখন পুরো ফ্ল্যাটের মালিক। এর চেয়ে আনন্দের কী আছে ?
আজগর আলী রহমত মিয়ার বেড রুমে ভিসিপি নিয়ে এল। ভিসিপিতে ক্যাসেট লাগিয়ে সে এসে ফ্রিজ খুলল। খাবার তেমন কিছু নেই। বিরিয়ানী, ভুনা মাংস, মিষ্টি আর কিছু হালকা পানীয়। চমৎকার সব খাবার। এতেই চলবে।
আজগর আলী ভিসিপির সামনে খেতে বসল। ইংরেজি ধুমধারাক্কা মার্কা ছবি। হেভি ফাইটিং । জমজমাট কেস। সে পেট দুলাতে দুলাতে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষে সে রহমত মিয়ার বিছানায় শুল। নরম গদিওয়ালা খাট। সে ফোমের ভেতর ডুবে গেল। তখন সে অভাব বোধ করল। একটা বৌ হলে মন্দ হত না। ফাহমিদা ভাবীর মতো একটা বৌ।
‘সাব, যাইবেন কই ?’
আজগর আলী চট্ করে বাস্তবে ফিরে এল। আশ্চর্য, সে এতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল। এ রকম হওয়ার কথা নয়। এ রকম কবি-সাহিত্যিক আর পাগলের হবে। তার হলে তো জীবনে কিচ্ছু হবে না। জীবনটা শেষে বুঝি নষ্টই হয়।
রিক্সা বেশ এগিয়ে গিয়েছিল। সে রিক্সা ঘুরিয়ে এনে রহমত মিয়ার শ্বশুর বাড়ির সামনে থামাল। অনেক দিন যাবৎ রহমত মিয়া শ্বশুর বাড়িতেই থাকে। সেই কাঠ খোয়া যাওয়ার পর থেকে সে আর নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় নি। রিক্সা ছেড়ে দিয়েও আজগর আলী দ্বিধায় ভুগতে লাগল।
দরজা খুলে দিল ফাহমিদা, ‘আরে ! আজগর আলী যে ! তুমি এত দিন কোথায় ছিলে ?’
আজগর আলী দুটো ঢোক গিলে ফেলল। এ রকম হলে তো হবে না। মেয়ে মানুষের সামনে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে গেলে জীবন শেষ। আজগর আলী কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজেকে সহজ করে নিল। প্রশ্ন করল , ‘সাহেব কই ?’
কিন্তু তার গলা দিয়ে ফ্যাসফেসে স্বর বেরুল। সে বিব্রত হয়ে পড়ল। তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল ফাহমিদা। সে গলা খাকড়ি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করল, ‘সাহেব কই ?’
‘ওই ঘরে’, ফাহমিদা ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। আজগর আলী ভয়ে ভয়ে এগুল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখল, রহমত মিয়া শুয়ে আছে। সে দু’বার গলা খাকড়ি দিল। রহমত মিয়ার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। সে সাহস করে ঘরে ঢুকে পড়ল।
‘সাহেব।’
‘ কে, কে ?’, রহমত মিয়া স্প্রিংয়ের মতো লাফ দিয়ে বসল। আজগর আলী ভয় পেয়ে গেল। রহমত মিয়া এতটা চমকাবে তা সে বুঝতে পারে নি। সে দু পা পিছিয়ে গেল।
রহমত মিয়া প্রথমটায় তার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। আজগর আলী থতমত খেয়ে গেল। রহমত মিয়া হুংকার ছাড়ল, ‘তুমি ! তুমি আমার কাছে কী চাও ? কী চাও ?’
আজগর আলী পুরোই ভয় পেয়ে গেল। আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু গলা আবারও ফ্যাসফেসে হয়ে কিছুই বোঝা গেল না। সে গলা খাকড়ি দিয়ে পরিষ্কার করার সাহসও পেল না।
রহমত মিয়ার স্বর আরও এক ধাপ চড়ল, ‘বাহির হ তুই। হারামীর বাচ্চা, বাইর হ।’
আজগর আলী পুরো ঘাবড়ে গেল। তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। বুকের খাঁচা ছেড়ে সব কলকব্জা বেরিয়ে যেতে চাইল। সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই ফাহমিদার মুখোমুখি হয়ে গেল।
চেঁচামেচিতে ফাহমিদা ছুটে এসেছে। তাকে দেখে রহমত মিয়া বীর দর্পে লাফাতে লাগল। চেঁচিয়ে বলল, ‘হারামীর বাচ্চারে পাছায় লাত্থি মাইরা বাইর কইরা দেও। হারামীর বাচ্চা। আমার এত বড় ক্ষতি কইরা অহন চেহারা দেহাইতে আইছে।’
ফাহমিদা ধমক দিল, ‘তুমি চুপ কর।’
রহমত মিয়ার তেজ আরও বেড়ে গেল, ‘চুপ করমু ক্যা ? হারামীর বাচ্চার পাছায় আগে একটা লাত্থি মার, হেরপর চুপ করমু।
‘এইটা ভদ্রলোকের বাড়ি।’
‘এইটা কার বাড়ি আমি জানি।’
‘জানলে চুপ কর।’
‘তুমিই চুপ মারো, আর এরে বাইর কর।’
আজগর আলী কাচুমাচু হয়ে বলল, ‘থাউক ভাবী, আমি যাইতাছি।’
‘অতো ভদ্রতা লাগত না, তুই বাইর হ। ’
আজগর আলী বেরিয়ে এল। ফাহমিদা রহমত মিয়াকে শাসিয়ে পেছন পেছন এল। আজগর আলী সিঁড়ির দরজার কাছে পৌঁছতেই পেছন থেকে ফাহমিদা বলল,‘আজগর আলী, একটু দাঁড়াও।’
আজগর আলী দাঁড়াল। ফাহমিদা তার কাছাকাছি এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল, ‘ব্যবসায় লস খেয়ে লোকটার মাথার ঠিক নেই। খামোখাই তোমাকে সন্দেহ করে। তুমি নাকি এই চুরির সাথে জড়িত। যাক, তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না।’
‘আমি কিছু মনে করি নাই।’
‘তুমি কেন এলে তা তো বললে না।’
‘ তেমন কিছু না, ভাবী। আমি একটা দোকান দিছি। অবশ্য পার্টনারশীপে।’
‘খুব বড় সুসংবাদ । কিসের দোকান ?’
‘কাঠের দোকান। আজ বিকালে চালু করমু। তাই সাহেবকে মিলাদের দাওয়াত দিতে আসছিলাম।’
‘আহা, কী একটা ঘটনা ঘটে গেল। তুমি কিন্তু কিছু মনে করো না। পারলে তোমার সাহেবকে পাঠাব।’
আজগর আলী সালাম দিয়ে বেরিয়ে এল। রাগে তার শরীর কাঁপছে। হারামজাদা, সন্দেহ করে। সন্দেহ করে কোন কচু ছিঁড়বে তুমি ? দু নম্বরী কাঠের ব্যবসা করে তো ভালোই মাল কামিয়েছ। নুরু মিয়া যা করেছে ঠিকই করেছে। আরও বেশি কাঠ সরানো দরকার ছিল। এখনও তেজ কত ! এই তেজ কমাতে হবে। যে করেই হোক।
আজগর আলী রিক্সা নিয়ে সোজা নুরু মিয়ার বস্তিতে চলে এল। এই লোক এত মাল কামায়, তারপরও বস্তি ছাড়তে পারে না। বলে, এই বস্তি নাকি তার সৌভাগ্যের কারণ। এই বস্তিতে থাকে বলেই এত মাল কামাতে পারছে। কী জানি ?
নুরু মিয়ার ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। আজগর আলী দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে কে যেন জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিল। আজগর আলী দ্বিতীয়বার টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। ইতর মেয়ে লোকটি। কাপড় চোপড় অগোছালো। তাকে দেখে মেয়ে লোকটি শরীরে ঢেউ তুলে হেসে উঠল, ‘ও আমার ভদ্র নাগর, এত দিনে খাউজানি উঠল ?’
আজগর আলী কী বলবে ভেবে পেল না। তার মাথার ভেতর বাষ্প জমা হচ্ছে। অর্ধনগ্ন নারীদেহ সব ওলট পালট করে দিচ্ছে। সে রুমাল দিয়ে গলার কাছের ঘাম মুছল। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, ‘নুরু মিয়া কই ?’
মেয়ে লোকটির শরীরের ঢেউ আরও বাড়ল। বলল, ‘হেরে কী দরকার ? খাউজানি উঠলে তো আমারেই দরকার।’
মেয়ে লোকটির অশ্লীল কথা আজগর আলীর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। সে দ্বিতীয় কথা না বলে ঘুরে রওয়ানা হল। বেহায়া মেয়ে লোক । সব পুরুষকে মর্দা কুকুর মনে করে। কিন্তু এই মেয়ে লোক দিনের বেলাও নুরু মিয়ার ঘরে কেন ? নুরু মিয়া কি একে রক্ষিতা বানিয়ে ফেলল ? শালার মাস্তানের আবার বড়লোকী রোগ ধরেছে।
হঠাৎ হাসির শব্দে আজগর আলী সচকিত হল। পেছন থেকে মেয়ে লোকটি তাকে বিদ্রুপ করছে। তার কাপুরুষতায় মেয়ে লোকটি খুব মজা পেয়েছে।
চলবে .....
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । সপ্তম পর্ব । অষ্টম পর্ব । নবম পর্ব । একাদশ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



