ছয়
আজগর আলীর ফ্ল্যাটে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ শাহিদার আনন্দে সময় কাটে। আজও শাহিদার ভালো লাগছে। কী সুন্দর ঘর ! কোন কিছুর অভাব নেই। ফ্রিজ, টিভি, ভিসিপি, দামি সোফা, কার্পেট - সব আছে। এই ফ্ল্যাটে ঢুকলেই শাহিদার আনন্দে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।
শাহিদা ভিসিপিতে একটা ক্যাসেট লাগিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা কোক নিয়ে এল। কোক খুলতে গিয়ে হাত কেটে ফেলল। কাটা আঙ্গুল চুষতে চুষতে সে ভিসিপির সামনে বসল।
ভিসিপিতে শ্রী দেবী আর মিঠুন ঝাকাঝাকি নাচ দিচ্ছে। মিঠুর শ্রীদেবীর শরীরে এমন সব জায়গায় হাত দিচ্ছে যে, শাহিদার কেমন যেন লাগছে। কী সাহস লোকটার ! মেয়ে মানুষের শরীরে কত সহজে হাত দেয়। আর শ্রীদেবীও কেমন । বেহায়ার মতো ফট করে শরীর পেতে দিচ্ছে।
হঠাৎ ভাত-পোড়া গন্ধে শাহিদা ভয় পেয়ে গেল। সর্বনাশ ! এখন কী হবে ? ও দ্রুত হাতে ভিসিপি বন্ধ করে রান্না ঘরে চলে এল।
ভাত দেখে ওর ধড়ে জান ফিরে এল। মাত্র পোড়া ধরেছে। ভাগ্যিস, পুরোটা পুড়ে কয়লা হয় নি। অবশ্য ভাত পুড়লেও আজগর আলী কিছুই বলবে না। সে খুবই লাজুক ও ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। শাহিদা ভাতের মাড় গালতে দিল।
সে নিশ্চিন্ত মনে ড্রয়িং রুমে ফিরে ভিসিপি ছেড়ে দিল। কোক শেষ হয়ে গেছে। অন্য কিছু খাওয়া দরকার। কী খাওয়া যেতে পারে ? থাক, অতো খাওয়ার দরকার নেই। আজগর আলী টের পেলে মুশকিল হবে। অবশ্য আজগর আলী অতো কিছু খেয়াল করে না। বড় ভালো লোক।
ভিসিপিতে এখন নতুন দু’জন নাচছে। মাখামাখি নাচ। পোশাক আশাক সংক্ষিপ্ত। ব্লাউজটাকে ব্লাউজ না বলে সেণ্ডো গেঞ্জি বলাই ভালো। শাহিদার খুব মজা লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে, কোন উপায়ে যদি সেণ্ডো গেঞ্জিটা খুলে ফেলা যেত।
শাহিদার হঠাৎ ইচ্ছে হল, রহমত মিয়ার মতো ন্যাংটো ছবি দেখতে। রহমত মিয়া একটা আজব লোক। কোত্থেকে এই সব ছবি নিয়ে আসে। এই সব ছবি দেখলে মনে হয়, মানুষের আর কোন কাজ নেই , কেবল ওই কাজ ছাড়া।
শাহিদা ওয়্যাররোবের ড্রয়ারগুলো খুঁজল। মাত্র দুটো ক্যাসেট পাওয়া গেল। ক্যাসেটগুলো চালিয়ে দেখল। না, এগুলো ভদ্র ছবি। সে যা চাইছে তা নেই।
সে বিছানার জাজিম তুলে, আলমারি খুলে আতিপাতি করে খুঁজল। না, নেই। আর একটা ক্যাসেটও নেই। সে মন খারাপ করে কার্পেটের উপর বসে রইল।
কিছুই ভালো লাগছে না। কী যেন নেই। সে কিছুক্ষণ কার্পেটের উপর শুয়ে রইল। তারপর উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসল। খুটিয়ে খুটিয়ে নিজের চেহারা দেখল। ফালতু চেহারা। আরেকটু সুন্দর হলে কী এমন ক্ষতি হত ? হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। স্বাস্থ্য মাশআল্লাহ খারাপ না। ইদানিং একটু মোটার ধাত ধরেছে। অবশ্য মোটার ধাত হবে না কেন ? আজগর আলীর এখানে খাওয়া দাওয়া খারাপ হচ্ছে না।
হঠাৎ করে ইচ্ছে হল শ্রীদেবীর মতো শার্ট প্যান্ট পরলে কেমন হয়। সে আলনা থেকে আজগর আলীর শার্ট প্যান্ট নিল। পরে ফেলল । আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেল। তাকে ইংরেজি ছবির মেমের মতো দেখাচ্ছে। সে চুলে হাত খোঁপা বেঁধে নিল। তারপর আয়নার সামনে একেবেকে নিজেকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ দরজার শব্দে সে আতঙ্কে জমে গেল। আজগর আলী এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল কেন ? তার তো এখন ফেরার কথা নয়। শাহিদা পাগলের মতো শার্ট প্যান্ট খুলে ফেলল। কিন্তু সালোয়ার কামিজ গেল কোথায় ? ও ছোটাছুটি করে খুঁজতে লাগল। পেল খাটের নিচে। ফ্যানের বাতাসে খাটের নিচে চলে গিয়েছিল। ও দ্রুত সেলোয়ার কামিজ পরে ফেলল। হঠাৎ বুঝল, একটা ভুল হয়ে গেছে - সেমিজটা পরা হয় নি। ও প্রায় দৌড়ে দরজার কাছে এসে হাপাতে লাগল,‘ কে, কে ?’
‘আল্লারস্তে দুগা ভিক্ষা দিবেন গো, মা ?’
রাগে শাহিদার শরীর জ্বলে গেল। বদমাশ ফকির আর আসার সময় পেল না। সে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, ‘ভাগো, অহন ভিক্ষা দেওন যাইব না।’
‘আম্মাগো, ইট্টুখানি দ্যান, বহুত সওয়াব হইব।’
‘কইলাম তো, ভিক্ষা দেওন যাইব না।’
শাহিদা গজরাতে গজরাতে রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভাতের মাড় ঝরা হয়ে গেছে। ও ভাতের হাড়ি মিটসেফে তুলে রাখল। দ্রুত হাতে রান্না ঘরের চারপাশ পরিষ্কার করে ফেলল।
রান্না শেষ। এবার গোছল করা যেতে পারে। ও আলনা হতে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখল। কী চমৎকার ! দিন দিন চেহারায় সৌন্দর্যের ছোঁয়া লাগছে। চোখের কোণে মাদকতা বাসা বাঁধছে।
ও শাওয়ারের নিচে দাঁড়ানোর আগে সম্পূর্ণ নগ্ন হল। আচ্ছা, আজগর আলী যদি তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলত তাহলে কী করত ? নুরু মিয়ার মতো ক্ষেপে যেত কি ? মনে হয় না। আজগর আলী খুব ভালো লোক। এত ভালো যে, লোকটাকে শাহিদার ভালো লাগে।
মাস দুয়েক আগের কথা। হঠাৎ ওদের বস্তিতে আজগর আলীকে দেখে অবাক হয়ে গেল শাহিদা।
‘আরে ! আপনে এহেনে ! কী কামে ?’
আজগর আলী ঘাবড়ানো চেহারায় বলল, ‘নুরু মিয়ার কাছে আসছিলাম।’
‘আমাগো ঘরে আহেন।’
‘পরে এক দিন আসমু নে।’
‘এই রহম করেন ক্যান ? গরীব বইল্যা কি আমাগো ঘরে এট্টু বহনও যাইত না ?’
‘না, সেই কথা না। ঠিক আছে, চল। ’
আজগর আলী তাদের ঘরে চলে এল। শাহিদার খুব ভালো লাগল। এ রকম বড়লোক মেহমান তার ঘরে আগে কখনও আসে নি।
ওর মা ঘরে নেই। শাহিদা আজগর আলীকে ঘরে বসিয়ে রেখে দোকানে গেল। ৫ টাকার টোস্ট বিস্কুট কিনে নিয়ে এল। এক কাপ চা আর টোস্ট বিস্কুট আজগর আলীর সামনে দিয়ে বলল, ‘নেন, আমরা গরীব মানুষ, আর কী খাওয়ামু ?’
‘ঠিক আছে, এই চলবে। তোমার মা কই ?’
‘মায় কামে গেছে।’
‘ও আচ্ছা। তা, আমি এখন উঠি।’
‘এইডা কী কন ! একটা বিস্কুটও তো খাইলেন না।’
বাধ্য হয়ে আজগর আলী বসল। টোস্ট খেল। পানি খেল। চা নিল। কিন্তু তার অস্বস্তিভাব কাটল না। কেমন নিজেকে গুটিয়ে রাখল। বোঝাই যাচ্ছে, মেয়েদের সামনে সে স্বাভাবিক থাকতে শিখেছি।
শাহিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আজগর আলী বেরিয়ে এল। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র শাহিদার মায়ের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেল। শাহিদার মা অবাক হল, ‘আরে আপনে ! ভুল দেখতাছি না তো ?’
আজগর আলীর চেহারা অস্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন সে এক মহাচোর এবং চুরি করে ধরা পড়েছে। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘ভুল দেখবে কেন ? আমি আজগর আলী। নুরু মিয়ার কাছে আসছিলাম।’
শাহিদার মা বলল, ‘আমাগো ঘরে না বইয়াই চইল্যা যাইতেছেন যে ?’
‘তোমার ঘরে বসেছি।’
‘ওই বয়ায় অইব না। খাওন দাওন কইরা যান।’
‘মাথা খারাপ ? আমার অনেক কাজ। এখন আসি।’
আজগর আলী মাথা নিচু করে কাচুমাচু ভঙ্গি করে চলে গেল। শাহিদা বুঝল, আজগর আলী লজ্জা পেয়েছে। এ রকম লাজুক আর ভদ্র পুরুষ তার প্রথম দেখা। তার খুব ভালো লাগল লোকটিকে।
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শাহিদা আপন মনে হাসতে লাগল। আজগর আলী কখনও নুরু মিয়ার মতো মেয়ে মানুষ নিয়ে খেলবে না। মেয়ে মানুষ চেনেই না এ লোক। কয়েক দিন পরীক্ষা করে এই ব্যাপারটা বুঝেছে।
সে দিন শাহিদা ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। গায়ে ওড়না নেই। বুকের কাছে কামিজটা টোল খেয়ে নেমে পড়েছে।
আজগর আলী তখন ঘরে ঢুকল। শাহিদা জিজ্ঞেস করল, ‘আজকা কী রানমু ?’
আজগর আলী কোন জবাব না দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। শাহিদা বুঝতে পারল, আজগর আলীর চোখ কোথায় পড়েছে। সে মুখ চেপে হাসি থামাল। চিৎকার করে আজগর আলীকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজান, কইলেন না কী রানমু ?’
বাইরে থেকে ক্ষীণ স্বরে উত্তর এল, ‘যা খুশি রান্না কর।’
শাহিদা ঝাঁট দেয়া শেষ করে ঘর হতে বেরিয়ে দেখে আজগর আলী বেরিয়ে গেছে। সে হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল। কী আশ্চর্য পদের পুরুষ লোক ! রহমত মিয়া কিংবা নুরু মিয়া এ রকম দেখলে হতভম্ব হয়ে যাবে।
বাইরের দরজায় খুট খুট শব্দ হচ্ছে। সেই ভিখিরিটাই ফিরে এল নাকি ? তালকানা ভিখিরি। থাক, ব্যাটা দাঁড়িয়ে। ফাজিল কাঁহাতক।
শাহিদা সিদ্ধান্ত নিল একদিন আজগর আলীর সঙ্গে ফাজলেমি করবে। তাকে সুযোগ দেবে। ঠিক যে রকম সুযোগ রহমত মিয়াকে দিয়েছিল। আজগর আলী নিশ্চয় ঘাবড়ে গিয়ে উল্টা পাল্টা কাজ করবে। হয়তো পালিয়ে যাবে খুব দ্রুত। আর যদি নুরু মিয়াকে সুযোগ দেয়া যায় ? ওরে বাপরে ! এই খোদাই ষাড় যে কোন কিছু করে বসতে পারে। তবু একদিন কেবল একদিন নুরু মিয়াকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে। এই সুযোগ পাওয়ার জন্য নুরু মিয়া এখনও ছোঁক ছোঁক করে।
চলবে ....
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । সপ্তম পর্ব । অষ্টম পর্ব । নবম পর্ব । দশম পর্ব । দ্বাদশ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



