somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেষ রাতের আঁধারে এসে পৌঁছলুম "ব্যাঙ্গালুরু" - একাকী ফাঁকা রাজপথে

১১ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



গ্রীণলাইন ট্রাভেলস এর স্লিপিং কোচের সিট আরামদায়কই ছিলো আর যাত্রার শুরুর বেশ কিছু সময় পর থেকে সমতলভূমিতেই বুঝি চলেছে গাড়ী, কারণ তেমন কোন বাঁক অনুভূত হয় নাই। ফলে এদিন বাসে আরামে একটা ঘুম দিলাম, কোন ফাঁকে উটি থেকে ব্যাঙ্গালুরু চলে এলাম টেরই পেলাম না। কন্ডাক্টর এর হাঁকডাকে চোখ খুলে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি নিয়ন আলোয় রাতের ফাঁকা রাজপথ দেখা যাচ্ছে, ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি এখনো চারটা বাজে নাই। এই ভোররাতের আগে দিয়ে ব্যাঙ্গালুরু পৌঁছে একটু কি বিপাকেই পড়লাম। বাস হতে নেমে গেলে একে একে সকল যাত্রী নিজেদের গন্তব্যের দিকে চলে গেলে ফাঁকা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম কি করা যায়। বাস আমাকে যে জায়গাটায় নামিয়েছে সেটার নাম “ম্যাজেস্টিক মোড়”। রাস্তার পাশে দেখলাম কয়েকটা আবাসিক হোটেল, তার একটাতে ঢুঁকে রুম খোঁজ করতে পাওয়া গেল কিন্তু বাঁধ সাধলো এখানে ফরেন গেস্ট রাখার পারমিশন নেই।

পরপর তিনটি হোটেলে একই উত্তর পেয়ে কিছুটা হতাশ এবং পরিশ্রান্ত হয়ে তৃতীয় হোটেলের রিসিপশনে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমি কি তোমাদের এখানে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে পারি? আমি রাতের বাসে উটি থেকে ব্যাঙ্গালুরু এসে পৌঁছেছি সবেমাত্র। বাইরে আলো ফোটা মাত্র আমি চলে যাবো”। মধ্য পঞ্চাশের ভদ্রলোক হেসে আমাকে সামনে রাখা রিসিপশনের সিটিং এরিয়ার সোফা দেখিয়ে বললেন ‘নিশ্চিন্তে পারো’। এরপর উনি সেখানকার সবগুলো বাতি জ্বালিয়ে, পাখা ছেড়ে দিলেন। একটা বেল চাপতে একজন সার্ভিস বয় আসলে তাকে কিছু ইন্সট্রাকশন দিলেন স্থানীয় ভাষায়, যার অর্থ কিছুক্ষণ পর বুঝা গেল। এক গ্লাস পানি এবং সেদিনের তিনটা ইংরেজি দৈনিক আমার সামনের টেবিলে রেখে গেল ছেলেটি। খুব অবাক হলাম, এতোটা আশা করি নাই। সলো ট্রিপে একা ছিলাম বলেই এই আলো না ফোটা ভোর রাতে একা একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভরসা পাচ্ছিলাম না।

বেশকিছুটা সময় পরে বাইরে কিছুটা আলো ফুটে উঠলো ভদ্রলোক থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলের বাইরে এলাম। এই সদ্য হওয়া ভোরবেলাতেই দেখলাম বেশ কিছুটা দূরে একটা ট্রাভেল এজেন্সির দোকান খুলেছে, দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালাম। দোকানে ঢুঁকে দেখি বছর চল্লিশের স্থানীয় এক ভদ্রলোক বসে আছেন। তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আশেপাশে ফরেন গেস্ট এলাউড এরকম বাজেট কোন হোটেল আছে কি? ভদ্রলোক আমাকে একটা চেয়ারে বসতে বলে ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কিছুটা সময় পরে জানালেন, হোটেলে পাওয়া গেছে, নন-এসি রুম হবে, এখনই চেকইন করতে পারবো। আমি রাজি হয়ে গেলাম, শুধু রাতে ঘুমানো ছাড়া আগামি দু’দিনে আমার হোটেলে তেমন থাকাই হবে না। উনি জানালেন উনার দোকান হতে হোটেল একটু দূরে, আমি কি অটোরিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো কি না? আমি উনার সাহায্য চাইলে উনি ফোন করে একটা অটো রিকশা ডেকে দিলেন।

এই ফাঁকে উনার সাথে মাইশুর ডে ট্রিপ এবং ব্যাঙ্গালুরু ডে ট্রিপের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলাম। বিস্তারিত জেনে উনার কাছ থেকে সেদিনেরই সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে দশটার একটা ট্যুরিস্ট বাসের প্যাকেজ বুক করে নিলাম; সেই সাথে পরের দিনের সারাদিনের ব্যাঙ্গালুরু ডে ট্রিপ এর টিকেট। এগুলো করার মাঝে অটোরিকশা চলে আসলো। অটোরিকশা করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফাঁকা ভোরবেলার রাজপথ পাড়ি দিয়ে চলে এলাম হোটেলে। খুবই সাধারণ মানের হোটেল, ফর্মালিটিস সেরে রুমের চাবি নিয়ে রুমে চলে গেলাম। মোটামুটি চলনসই রুম, কিন্তু সমস্যা হলো হোটেলে ওয়াইফাই ইন্টারনেট নাই! এই ট্যুরে যেহেতু আমার কাছে কোন ভারতীয় মোবাইল সিম ছিলো না, তাই হোটেলের ইন্টারনেটের বদৌলতেই বাসার সাথে যোগাযোগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় রোজনামচা লেখা এগুলো চালিয়ে নিচ্ছিলাম। এবার তো পড়লাম বিপদে, কি আর করার, মেনে নিলাম আগামী দুইতিন দিন সবার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে।

রুমে প্রবেশ করে ঘড়িতে দেখি প্রায় ছয়টা বাজে, তাই আর বিছানায় না গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গোসল করে নিলাম, ভ্রমণজনিত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে সাতটার দিকে বের হয়ে এলাম হোটেল থেকে। এরপর সকালের নাগরিক ব্যস্ততা দেখতে দেখতে হাঁটা শুরু করলাম সেই ট্রাভেল এজেন্সির দিকে। কর্মব্যস্ত দিনের শুরুতে মানুষজন নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটে চলা শুরু করেছে, স্কুলের বাচ্চাদেরও দেখলাম চলছে নিজের গন্তব্যে। খুব ডিসিপ্লিন্ড মনে হল এখানকার মানুষগুলোকে। একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা তিন রাস্তার মোড়ে আমাকে রাস্তা পার হতে হবে। ফুটপাত দিয়ে আরও পথচারীদের সাথে হাঁটছিলাম, সেখানে পৌঁছে ফাঁকা রাস্তা দেখে রাস্তা পার হওয়ার জন্য ফুটপাতে নামতেই মনে হলো আশেপাশে কেউ নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সবাই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। কয়েক মুহূর্ত লাগলো আমার পুরো ব্যাপারটা বুঝতে। ট্রাফিক সিগ্ন্যাল লাইটে তখন পথচারী পারাপারে লাল ক্রস মার্ক জ্বলছে, তা সত্ত্বেও ফাঁকা ফুটপাত দেখে আমি রাস্তায় নেমে পড়ায় সবাই খুব অবাক হয়েছে। দ্রুত আমিও তাদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সবুজ সংকেতের অপেক্ষায়।

সেই ট্রাভেল এজেন্সির দোকানে গিয়ে দেখি বাস তখনো আসে নাই, জানালো মিনিট দশেকের মধ্যে এসে পড়বে। এই ভদ্রলোকের সাহায্য আমার অনেক উপকার করেছে। এই ভোররাতে তার দোকানে বসে বসেই আমার ট্যুরের আগামী দুদিনের সকল কাজ সেরে ফেলতে পেরেছি। পরবর্তীতে সকল টিকেট, হোটেল ভাড়া এবং অটোরিকশা ভাড়া সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছি উনি আমার কাছ থেকে হয়তো সবমিলিয়ে শ’খানেক রুপী অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। একশত রুপীর বিনিময়ে এই সার্ভিস আমার কাছে খুব ভালো ডিল মনে হয়েছে, বরং অনেক বেশী লাভবান বলেই মনে করেছি নিজেকে।

কিছু সময় পরে বাস চলে আসলে আমার সিট জেনে নিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। আমার পাশের সিটে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক এর সিট পড়েছে। উনার সাথে পরিচিত হলাম। সকালের নাস্তা খাওয়া হয় নাই জেনে উনি বললেন আশেপাশের দোকান হতে কিছু শুকনো খাবার কিনে নিতে। গাড়ীর যাত্রীরা প্রায় সবাই নাস্তা করে এসেছে। উনার পরামর্শে গাড়ী হতে নেমে ব্রিটেনিয়া কেক আর লিমকা কিনে নিলাম, সাথে এক বোতল বিসলেরি পানির বোতল। ঠিক সাড়ে সাতটার দিকে যাত্রা শুরু করলো আমাদের আজকের মাইসুর ট্রিপের এই টুরিস্ট বাসটি। আগামী পর্বে সেদিনের মাইসুর ট্রিপের গল্প থাকছে, ফিরছি দ্রুতই। সেই সময় পর্যন্ত সাথেই থাকুন।

আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ -TDTK (Tour D Tamilnadu & Karnataka)
পর্ব - ০৯
ভ্রমণকালঃ জুন-জুলাই, ২০১৭


এই সিরিজের সকল পোস্টঃ
প্রথম পর্বঃ * আবার দক্ষিণ ভারতে ভ্রমণ - শুরুর গল্প
দ্বিতীয় পর্বঃ * চলে এলাম কোদাইকানাল
তৃতীয় পর্বঃ * কোদাইকানাল "ফরেস্ট ডে ট্রিপ"
চতুর্থ পর্বঃ * কোদাইকানাল শহর ভ্রমণ
পঞ্চম পর্বঃ * কোদাইকানালের শেষদিন এর শেষটা আর ভালো হলো না...
ষষ্ঠ পর্বঃ * পাহাড়ি রাস্তায় রাতের যাত্রা - কোদাইকানাল টু কোয়িম্বেতুর
সপ্তম পর্বঃ * উটি পৌঁছে বোনাস বেড়ালাম ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ "নীলগিরি রেলওয়ে"তে চড়ে "কুনুর"
অষ্টম পর্বঃ * "কুইন অফ হিলস" খ্যাত উটি ভ্রমণ
নবম পর্বঃ * শেষ রাতের আঁধারে এসে পৌঁছলুম "ব্যাঙ্গালুরু" - একাকী ফাঁকা রাজপথে

এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৯
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফ্রিতে ১০১ টি AI টুল, কোনটির কি কাজ বাংলায় বর্ণনাসহ!!

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে মে, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪

ফ্রিতে ১০১ টি AI টুল, কোনটির কি কাজ বাংলায় বর্ণনাসহ!!

ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

AI টুল ব্যবহার করে জীবনকে করুন আরও সহজ এবং সৃজনশীল! কয়েক ঘন্টার কাজ করে নিন কয়েক... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৈয়দ মশিউর রহমান বনাম হাসান কালবৈশাখী: একি ঘৃণার নতুন সংস্করণ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৯ শে মে, ২০২৫ সকাল ১১:০৬



ব্লগার সৈয়দ মশিউর রহমান শিল্পী নুসরাত ফারিয়াকে বিমানবন্দর থেকে আটক করার প্রসঙ্গে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেই পোস্টে তিনি আশা করেছেন যে ফারিয়াকে জেলে পাঠানো হবে এবং তাকে ‘ডিম থেরাপি’... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিলিস্তিনের সমাবেশে লাখ লাখ লোক যায় অথচ রোহিঙ্গাদের করিডর বিষয়ে উনারা নিশ্চুপ এটা মোনাফেকী হওয়া গেলো না ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ১৯ শে মে, ২০২৫ দুপুর ২:১৪




রোহিঙ্গাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আমাদের থেকে ভিন্ন সেই জন্য রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাসে ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী না ।জাতিসংঘের মানবিক করিডর বাস্তবায়ন হলে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরত যাওয়ার একটা সুযোগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলা বাক্যে "কি" এবং "কী" এর ব্যবহার; অনেকেরই যা অজানা

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৪:০৬

বাংলা বাক্যে "কি" এবং "কী" এর ব্যবহার; অনেকেরই যা অজানা

বাংলা ভাষায় "কি" এবং "কী" দুটি আলাদা অর্থ ও ব্যবহারে প্রশ্নবোধক বাক্যে ব্যবহৃত হয়। এদের পার্থক্য বোঝার জন্য আমরা ব্যাকরণ, উচ্চারণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যাটায়ার পোস্ট : " মুজিব " ছবিতে অভিনয় করেও জায়েদ খান যে কারণে বেঁচে যেতে পারেন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০১


ইন্টেরিম সরকার দেশ ব্যাপী মারাত্মক সংস্কার শুরু করেছে। সে সংস্কারের অংশ হিসাবে ' মুজিব : একটি জাতির রূপকার ' ছবির সাথে সম্পৃক্ত লোকজনকে সাইজ করতে মাঠে নেমেছে পুলিশ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×