(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭)
৮
সারাটা জীবনে মানুষের মাঝে অগণিত পরিবর্তন আসে। বয়োঃসন্ধির পরির্বতনটুকু মেয়েদের শারীরীক প্রক্রিয়ায় বড় রকমের একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেলেও ছেলেদের জীবনে তা নিছকই নিষিদ্ধ কিছু কৌতুহল এবং উত্তেজনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে ছাত্রত্ব শেষ হবার পরিবর্তনটুকু পুরুষদের অস্তিত্বকে আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিয়ে যায়। যৌবন প্রাপ্তি মেয়েদেরকে এই সমাজের বুকে মূল্যায়িত করে। যা কিছু মূল্যবান তার নিরাপত্তাজনিত কিছু ঝুঁকি থাকবেই। তারপরও মূল্যায়ন মানুষের প্রতিষ্ঠার প্রধানতম শর্ত। অপরদিকে পুরুষালী এই পরিবর্তনটুকু সমাজের বুকে একটি ছেলের দিকে তীক্ষ একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
‘কি করতেছ এখন তুমি? কোথায় আছো? কোন অফিসে? সরকারী না বেসরকারী?’
দেয়ার মত উত্তর জানা থাকে তো ভাল। নয়ত মাথা হেঁট করে থাকা ছাড়া কোন উপায় নাই। প্রশ্নটা যে শুধু বাইরের মানুষেরা করে তা নয়। যারা এতদিন খুব কাছের ছিল, ছিল সুখে দুঃখের আশ্রয় তাদের মুখেও যখন এই প্রশ্নটা বারবার ঘোরে তখন তা বড় নির্মম শোনায়। কাল কি অবলীলায় বীথি বলতে পারল,
‘আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও। আমি চলে যাই।’
বীথির চলে যাবার জায়গা আছে, আরিফের নেই। এই অসহায়ত্ব বোধটুকু কাল সারা রাত আরিফেকে ঘুমাতে দেয়নি। একটা মেয়ে তা সে কর্মজীবী হোক বা না হোক এখনও এই সমাজে তার প্রধান মূল্যায়ন রূপ আর গুণ দিয়ে, যা সব মেয়েকেই আল্লাহ কম বেশী দিয়েছে। কিন্তু ছেলেদেরকে তাদের যোগ্যতা নিজেকে অর্জন করতে হয়।
এটা তোমার অবিচার খোদা। মেয়েদের প্রতি স্বজনপ্রীতি।
হঠাৎ করেই মেয়েদের প্রতি একটা দূরত্ব অনুভব করে আরিফ। কাল প্রথমবারের মত আরিফের কাছে নিজের সত্যিকারের অবস্থানটা যেন পরিষ্কার হয়েছে। সে কি চেষ্টা করছে অথবা করছে না সেটা তার মূল্যায়ন নয়। সে কি করতে পেরেছে বা পারছে এটাই তার পরিচিতি এই পৃথিবীর বুকে। তাই তার চেষ্টাগুলো আব্বার চোখে ধরা পড়বে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ফসল কেটে গোলায় তুলতে পারছে।
মেয়ে হয়ে জন্মালো না কেন সে? অক্ষমতার এই দায় আর টানতে পারছে না আরিফ। এমন কি কোন চামারের ঘরে যৌতুকের দায়ে প্রতিদিন র্নিযাতিত হওয়াও অনেক ভাল ছিল। পেপারে খবর আসত ‘নিরীহ গৃহবধু খুন’। সবাই উহু আহা করত। কিন্তু তার এই অবস্থায় কেউ তাকে বিন্দু মাত্র সহানুভুতি দেখাবে না। বরং অপদার্থ বলে গালি দেবে। কোথাও কোন আশ্রয় নেই একজন বেকারের।
ছোট বেলায় পাড়ার কারো সাথে কোন ঝগড়া হলে মা ছিল সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। মা মারা যাওয়ার পরে আব্বাকে সব না হলেও অনেক সমস্যার কথা বলা যেত। আব্বা তার সমাধানও করতেন। মার মত করে হয়ত নয়, কিন্তু করতেন। এখন তো আব্বাই তার কাছে আশ্রয় চাইছেন। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। অসহায় বোধ করে আরিফ। এ পর্যন্ত কি দিতে পেরেছে সে আব্বাকে আর বিথীকে?
নিজেকে গোছাতে পুরো একটা দিন সময় লাগল আরিফের। গতরাতে আব্বার বলা কথাগুলো একটু একটু করে মাথার ভিতরে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। শুধু জেগে থাকল বীথির বলা শেষ কথাগুলো। যদিও কথাগুলো বীথি তাকে বলেনি। কি এমন ক্ষতি হত যদি কথাগুলো বীথি আরেকটু আস্তে বলত অথবা সে যদি সে সময় বাসাতেই না থাকত তাহলে তাকে কথাগুলো শুনতে হত না। অবশ্য তাতে করে কথাগুলো মিথ্যা হয়ে যায় না। ব্যবসাটা তাকে যেভাবেই হোক শুরু করতেই হবে।
প্রথমে ভেবেছিল বরাবরের মত নয় কে সঙ্গে নিয়ে লাবু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাবে। পরে একাই যাবার সিদ্ধান্ত নিল। বোধ হয় এটাই তার অযোগ্যতার একটা বড় কারণ। কোন কিছুই সে একা করতে পারে না। তাই বিকালে কাদের ভাইয়ের চায়ের দোকানে যাবার আগে লাবু ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেল আরিফ। নিজের বাড়ির সামনের রাস্তায় জোর কদমে হাঁটছিল লাবু ভাই। মিম ঠিকই বলেছিল, ডায়বেটিস ধরলে শুধু লেফট আর রাইট। আরিফও জোর কদমে হাঁটা শুরু করল লাবু ভাইকে ধরবার জন্যে।
“লাবু ভাই।” কাছে গিয়ে ডাকল আরিফ।
“ও, আরিফ।”
পিছন ফিরে তাকালো একবার লাবু ভাই। তবে থামল না। আরো এগারো বার রাস্তার এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত চক্কর লাগাতে হবে তাকে। তবে হাঁটার গতিটা কমাল লাবু ভাই।
“জ্বী।” লাবু ভাইয়ের পাশে পাশে হাঁটতে লাগল আরিফ।
“তোর ঐটার আমি খোঁজ নিছিলাম।” সামনের দিকে দৃষ্টি লাবু ভাইয়ের। “ওরা ৬ মাস পর পর লোক নেয়। ৬ মাসের কোর্স। চলতি কোর্সটা ২ মাস আগে শুরু হইছে।”
বিভ্রান্ত বোধ করে আরিফ। তাহলে কি......
একটু দম নিল লাবু ভাই। এতক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে গেছে। তাই সামান্য কথা বলতেই ক্লান্ত হয়ে গেল।
“এইটাতে আর ঢুকার সুযোগ নাই।” আবার বলল লাবু ভাই। “তোকে ৪ মাস পরে নেক্সট র্কোসে ঢুকতে হবে।”
“৪ মাস পরে?”
একটা হার্টবিট মিস করল আরিফ। তার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। কাল রাত থেকে সে কি কি ভাবছে আর এখন কি হচ্ছে? আল্লাহ বলে কি কেউ নেই? নাকি তার মত মানুষদের কথা ভাববার সময় আল্লাহর নাই।
আরিফের আতংকিত চেহারাকে পাত্তা দিল না লাবু ভাই। এসব খোঁজ খবর নেয়া তার দায়িত্ব না। তারপরও সে নিয়েছে। তার কাছ থেকে আর কি চায় ছেলেটা। হালকা চালে বলল,
“এতদিন যখন বসেই থাকলি, তখন না হয় আরো ৪ মাস গেল।”
আপনি যদি বুঝতেন আমার অবস্থা লাবু ভাই। এতদিন বসে থাকছি বলেই তো এখন আর বাড়তি কোন সময় আমার হাতে নাই। আবারও আরিফের মাথার ভিতর বেজে উঠল, যেমন করে পার, ল্যাংড়া খোঁড়া যার সাথে পার, আমার একটা বিয়ে দিয়ে দাও। আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাই। বুকটা মুচড়ে উঠল আরিফের। বীথির জন্যে কি তার কিছুই করা হবে না।
“কিন্তু লাবু ভাই,” মরিয়া কন্ঠে বলল আরিফ, “আপনি তো আমার অবস্থা জানেন। আব্বা এল পি আর-এ আছে। আড়াই মাস পরে ফুল রিটায়ার্ড হয়ে যাবে। .... অন্য কোন ব্যবস্থা নাই।”
শেষটায় আরিফের কন্ঠে আকুতি ঝরে পড়ল।
“হুঁম...”
দাঁড়ালো লাবু ভাই। আরিফের মরিয়া ভাবটা তার মনে কেন যেন দাগ কাটল। হয়ত পাড়ার ছেলে বলেই।
“তুই এক কাজ কর,” একটু চিন্তা করে বলল লাবু ভাই। “কেউ কেউ প্রাইভেট ভাবে এইসব ট্রেনিং দেয়। তুই তাদের কাছে শিখতে পারিস।”
“তাইলে তো ভালই হয়।” পায়ের তলে মাটি পেল আরিফ। আল্লাহ তাহলে আছে। বীথিরে ল্যাংড়া খোঁড়ার সাথে তোর বিয়ে আমি হতে দেব না।
“আপনার এই রকম পরিচিত কেউ আছে?” জানতে চাইল আরিফ।
“একজন আছে। আলম সাহেব। রফিকুল আলম।”
“ঠিকানা?” অস্থির কন্ঠে জানতে চাইল আরিফ। লাবু ভাইয়ের বলা ঠিকানাটাকে আরিফের কাছে মনে হল যেন বিশাল সমুদ্রের মাঝে এক মাত্র দ্বীপ। ওখানেই কেবল দাঁড়ানোর মত মাটি আছে।
গ্রীল দিয়ে ঘেরা বারান্দার দেয়ালে লাগানো নেমপ্লেটটা দুই বন্ধুকেই একটু ধাঁধায় ফেলে দিল।
রফিকুল আলম। সহকারী অধ্যাপক। যুক্তিবিদ্যা। দিনাজপুর সরকারী কলেজ।
অবশ্য লাবু ভাইয়ের বলা নামটা ঠিকই আছে। দেখা যাক..। গ্রীলের দরজার পাশে লাগানো কলিং বেলটা টিপল নয়ন। লাবু ভাইয়ের সাথে কথা শেষ করেই কাদের ভাইয়ের দোকান থেকে নয়নকে ধরে এনেছে আরিফ। সব মানুষই কোন না কোন জায়গায় অযোগ্য হয়েই থাকে। তার যদি মানুষের সাথে ঠিক মত কথা বলার যোগ্যতা না থাকে তো নাই। তার গরুর ট্রেনিং নিয়ে কথা। তাছাড়া নয়ন তো তাকে সাহায্য করতে আপত্তি করছে না।
কলিং বেলের শব্দ শুনে ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী একলোক বারান্দায় এসে দাঁড়াল। হাতে গ্রীলের দরজার চাবি। হাবে ভাবে একটা মাস্টারসুলভ ভাব রয়েছে। বোধ হয় ইনিই আলম সাহেব। সুতরাং সালাম দিল নয়ন।
“স্লামালেকুম স্যার।”
দলের মধ্যে একজন সালাম দিলেই নাকি হয়। এই অজুহাতে আরিফ আর সালাম দিল না। তার চিন্তা লাবু ভাই ঠিক লোকের ঠিকানা দিয়েছে তো?
“ওয়ালাইকুম সালাম।” আরিফদের চিনতে চেষ্টা করল লোকটা।
দ্বিধা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে এল আরিফ। আনমনে বারান্দার গ্রীলে এক হাত রাখল। শিক্ষক যখন স্যার বলে সম্বোধন করাই ভাল।
“স্যার একটু কথা ছিল আপনার সাথে।”
তালায় চাবি ঢোকালো লোকটা।
“কোন ইয়ার তোমরা?” হ্যাঁ, এবার নিশ্চিত হওয়া গেল, ইনিই আলম সাহেব। “ভিতরে আসো।”
তালা খুলে দিয়েই ঘরের ভিতরে চলে গেলেন আলম সাহেব। আরিফরা তার পিছু নিল। ঘরের ভেতরে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। এটা স্যারের প্রাইভেট পড়ানোর জায়গা, ভাবল আরিফ, তাহলে গরুর ট্রেনিং কোথায় হয়? স্যার বোধ হয় তাদের ছাত্র ভেবেছে তাই আলাপের শুরুতেই নিজেরটা অবস্থান আলম সাহেবের কাছে পরিস্কার করার তাগিদ অনুভব করল নয়ন।
“আমরা আপনার ছাত্র না স্যার।” বলল নয়ন।
আলম সাহেব একটা বেঞ্চে বসে হাতের ইশারায় আরিফদেরও বসতে বললেন। অন্য একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসল দুই বন্ধু। তাদের দ্বিধা এখনও কাটেনি। তবে কথা শুরু হওয়া দরকার। তাই মুখ খুলল আরিফ।
“আমাদেরকে লাবু ভাই পাঠাইছে।”
মাথা ঝাঁকালেন আলম সাহেব। বললেন, “কেমন আছে উনি?”
তার মানে লাবুভাইকে চেনে লোকটা। বোধ হয় ঠিক জায়গাতেই আসছি। ভাবল আরিফ।
“জ্বী, ভাল আছে লাবু ভাই।” বলল আরিফ।
নয়ন আপাতত দর্শক। সে মনোযোগ দিয়ে ঘরের চারদিক দেখছে। আরিফদের ইতস্ততঃ ভাব দেখে নড়ে চড়ে বসলেন আলম সাহেব। কিছুক্ষণ আগে শেষ ব্যাচটাকে ছুটি দিয়েছেন। তার এখন বিশ্রাম দরকার। তাই সোজা সোজি প্রশ্ন করলেন,
“হ্যাঁ, বল কি ব্যাপার?”
দুই বন্ধু এবার পরস্পরের দিকে তাকায়। আরিফের দিকে একবার তাকিয়েই নয়ন আলম সাহেবের দিকে চোখ সরাল। সেখান থেকে তার দৃষ্টি গেল ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে। অর্থাৎ নয়নের কাছে আপাততঃ সাহায্য পাওয়া যাবে না। সুতরাং শেষবারের মত ঘরের চারদিকটা আরেকবার দেখে নিয়ে আরিফ বলল,
“লাবু ভাই বলতেছিল আপনি গরু লালন পালনের উপর ট্রেনিং দেন।”
এবার আরাম করে বসলেন আলম সাহেব। আরিফদের আসবার কারণটা এখন তার কাছে পরিস্কার।
“গরু না তো।” বললেন আলম সাহেব। “আমি মুরগীর উপর ট্রেনিং দেই।”
স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে এক ঝলক নয়নের দিকে তাকালো আরিফ। যাক তাহলে তারা ভুল জায়গা আসেনি। যদিও লোকটা গরুর মত বড় সড় জন্তু নিয়ে কাজ করে না। তারপরও কি যায় আসে ট্রেনিং তো দেয়। তাতেই আপাতত চলবে।
“আমার মুরগীর খামার ছিল আগে।” অনেকটা ক্লাসে লেকচার দেবার ভঙ্গিতে বললেন আলম সাহেব। “কলেজে ঢুকার পরেও আনেকদিন খামার করেছি। পরে আর সময় হয় না বলে বাদ দিয়ে দিসি। এখন মাঝে মাঝে এর উপর কোর্স করাই। তোমরা কোর্স করবে?”
“হ্যাঁ স্যার” হাসল আরিফ। “সেই জন্যেই তো আসলাম।”
মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। গরু বা মুরগীতে কি যায় আসে। একটা কিছুর ব্যবসা হলেই হল। তাছাড়া গরুর চেয়ে বোধহয় মুরগীতে খরচটা কমও হবে।
“ঠিক আছে।” সম্মতি সূচক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন আলম সাহেব। “সামনের শনিবার থেকে আমি একটা ব্যাচ শুরু করতেছি। আসতে চাইলে আসতে পার।”
আরিফ এক পাশে মাথা কাৎ করলো। এত সহজে রাজী হওয়াটা মেনে নিতে পারল না নয়ন। জানতে চাইল,
“এটা কত দিনের র্কোস স্যার?”
আরে তাই তো। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নয়নের দিকে কৃতঞ্জতা নিয়ে তাকালো আরিফ। তার মাথাতে প্রশ্ন আসেনি কেন? নয়নকে সংগে এনে তাহলে ঠিকই করেছে।
“দু সপ্তাহ।”
উত্তর শুনেই ভ্রু কুঁচকে গেল আরিফের। বলে কি? তবে নয়ন এত তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা বুঝতে চাইল।
“কিন্তু স্যার,” বলল নয়ন। “যুব উন্নয়ন ট্রেনিং সেন্টারে তো ছয় মাসের কোর্স।”
“হ্যাঁ।” আবারও সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন আলম সাহেব। “ওরা থিওরীর সাথে সাথে প্র্যাকটিক্যালও করাবে। আমি শুধু তোমাদেরকে বেসিক ব্যাপারগুলো শেখাবো।”
এবার বিভ্রান্ত বোধ করল দুই বন্ধু। তাকালো পরস্পরের দিকে। আলম সাহেব সম্ভবত এই প্রতিক্রিয়াটার সাথে পরিচিত। এর আগেও বোধ হয় অনেককে তার এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে তিনি বললেন।
“এতেই হয়ে যায়। আমার কাছে শিখে অনেকেই তো এখন ভাল ব্যাবসা করতেছে।”
আরিফ আবারও এই মুহূর্তে নয়নের উপর নির্ভরশীল। তাই সে নয়নের দিকে তাকালো তার মতমত জানার জন্যে। তবে নয়ন আলম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বুঝবার চেষ্ট করছে। তাই আলম সাহেব আরেকটু ব্যাখ্যা দিলেন। তবে এবার কিছুটা টেকনিক্যাল ভাষায়। ইয়ং ছেলে পেলেরা আবার সাদা মাটা কথা বুঝতে একটু সময় নেয়।
“ট্রেনিং সেন্টারে তোমাদেরকে হ্যাচিং আর রেয়ারিং দুটোই শেখাবে। আমি শূধু রেয়ারিংটা শেখাবো।”
“বুঝি নাই স্যার।” বলল আরিফ।
বোধহয় এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিলেন আলম সাহেব। আবারও ছাত্রদের শিখাবার ভঙ্গিতে বললেন,
“আমি শুধু মুরগী লালন পালন করা শেখাবো। ডিম থেকে কিভাবে বাচ্চা ফোটাতে হয় এইটা শেখাবো না। এইটা একটু জটিল। তাছাড়া যন্ত্রপাতিও কিছু লাগে। আমার কাছে ঐসব নাই। এজন্যে আমি শুধু রেয়ারিংএর উপরই কোর্স করাই।”
থামলেন আলম সাহেব। নয়ন এবার আরিফের দিকে তাকাল। অর্থাৎ এখন সিদ্ধান্ত নেবার পালা। আর সেটা আরিফকেই করতে হবে।
“তো স্যার,” বলল আরিফ। “শনিবার কয়টায়?”
“বিকাল পাঁচটায়।” বললেন আলম সাহেব। “শুক্রবার বন্ধ। আর কোর্স বাবদ আমি একটা ফি নিয়ে থাকি। ৪০০ টাকা।”
হোঁচট খেল দুই বন্ধু। আবার টাকা কেন? যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর তো বিনা পয়সায় শেখায়? শালার সবাই দেখি সব কিছু নিয়ে ব্যাবসা করতেছে।
“৪০০ টাকা?” প্রশ্ন করল নয়ন। তার মুড অফ হয়ে গেছে।
“হ্যাঁ।” মাথা ঝাঁকালেন আলম সাহেব। মনে মনে কিছুটা বিরক্তও হলেন। তোমাদেরকে আমি কিছু শেখাবো। আর তোমরা আমাকে তার পারিশ্রমিক দেবে না? আমি কি এসব মাগনা শিখেছি।
“টাকাটা কবে দিতে হবে স্যার?” একটু চিন্তা করে বলল আরিফ।
“শনিবার দিন দিলেই হবে।” বললেন আলম সাহেব।
আর এখানে থাকার কোন মানে হয় না। আলাপ যা হবার হয়ে গেছে। সুতরাং উঠে দাঁড়ালো নয়ন। আরিফও উঠল।
“আচ্ছা স্যার,” নয়ন বলল, “তাইলে আমরা আজকে আসি।”
“ঠিক আছে।” চাবি হাতে উঠলেন আলম সাহেব।
গ্রীলের দরজা দিয়ে বের হয়ে সালাম দিল নয়ন।
“স্লামালেকুম স্যার।”
“ওয়ালাইকুম সালাম।” তালা লাগাতে লাগতে উত্তর দিলেন আলম সাহেব।
এবারও আরিফের সালম দেয়া হল না। সে ঠিক বুঝতে পারছে না তার খুশি হওয়া উচিৎ কিনা। শেষ পর্যন্ত অখুশি হওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল সে। শুধু ৪০০ টাকা না, সে জানে বিভিন্ন ভাবে আরো কিছু টাকা পয়সার ব্যাপার এখানে চলে আসবে। কয়েক পা হেঁটে এসে মাথা ঘুরিয়ে একবার দেখল আলম সাহেব এখনও বারান্দায় আছেন কি না। না নেই।
“ঐখানে বিনা পয়সায় ট্রেনিং হয়।” উত্তেজিত কন্ঠে বলল আরিফ, “আর এইখানে চারশ টাকা।”
“আমি করতেছি না।” চরম বিরক্ত নয়ন।
“ক্যান?” থমকে দাঁড়ায় আরিফ।
“ক্যান আবার কি?” অবাক হয় নয়ন। হাঁটতেই থাকে সে। “চার মাস পরে ট্রেনিং সেন্টারে বিনা পয়সায় করব যদি করতে হয়। এই খানে অযথা চারশ টাকা খরচ করতে যাব ক্যান?”
আরিফ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার কানে আবারও বেজে উঠল বীথির কথাগুলো। ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল। আনমনে একবার বিড় বিড় করল,
“চার মাস?”
(পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩) (শেষ পর্ব)