(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬)
(পুরোনো পাঠকদের উদ্দেশ্যেঃ পর্ব ৬ এর অধ্যায় ৭ কিছুটা পরির্বতন করা হয়েছে বিধায় লেখার আয়তন বেড়েছে। তাই পোস্টটি আমার লেখার ভার সইতে পারছে না। সুতরাং বাধ্য হয়েই অধ্যায় ৭ নিয়ে নুতন আরেকটি পর্ব বানাতে হল বলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত )
৭
রাতের খাওয়া শেষ। খাটের ধারে বালিশটাকে খাড়া করে তাতে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন আব্বা। এটা আরিফদের বাসার প্রধান বেডরুম। তবে ঘরে দুটো কাঠের সোফাও আছে। অন্য কোন বাড়তি ঘর নেই তাদের আলাদা করে ড্রইংরুম হিসাবে ব্যবহার করার জন্যে। অন্য দুটো রুমের মধ্যে একটাতে আরিফ থাকে। অন্যটাতে বীথি। বীথির ঘরটা অবশ্য ডাইনিং রুম হিসেবেও ব্যবহার হয়। অরিফের ঘরটা ছোট হওয়াতে সেটার আর অন্য কোন ব্যবহার নেই।
সন্ধ্যা থেকেই ভাবছিল আরিফ আব্বাকে ব্যাবসার কথাটা কিভাবে বলা যায়। শেষে নিজে কোন ঝুঁকি না নিয়ে বীথিকে দিল দায়িত্বটা। আব্বার সাথে বীথির বেশ খাতির। অন্ততঃ আরিফের চেয়ে ভাল সম্পর্ক। অবশ্য এর একটা বোধগম্য কারণও আছে। সকাল থেকে সারাটা দিন মেয়েটা এই সংসারের জন্যে খেটে খেটে মরছে। তাছাড়া আব্বার কিছুটা অপরাধ বোধও রয়েছে বীথির নিয়মিত কলেজ যেতে না পারার কারণে। যদি একটা কাজের লোক রাখা যেত তবে মেয়েটা পড়াশুনাটা ভাল মত করতে পারত। এবং বীথির প্রতি এই অপরাধ বোধ থেকেই হয়ত আরিফের প্রতি আব্বার ক্ষোভটা অনেক বেশী তীব্র। মেয়ে হয়ে বীথি যদি এতটা করতে পারে তবে আরিফ কেন পারবে না? সে তো বাড়ির বড় ছেলে।
আব্বার পাশে এসে বসল বীথি। আরিফও সাথে এসেছে। তবে সে এই মুহূর্তে শুধুই র্দশক। আব্বার থেকে যতটা সম্ভব দূরে ঘরের অপর প্রান্তে একটা সোফায় গম্ভীর মুখে বসল আরিফ। বীথি তার কার্যক্রম শুরু করল। আদুরে ভঙ্গিতে আব্বার চুলে বিলি কাটতে শুরু করল সে। এটা সে প্রায়ই করে। আব্বাও বেশ ইনজয় করেন তার ছোট সন্তানের আদরটা। একটু নড়েচড়ে আরো আরাম করে শরীরটা এলিয়ে দিলেন আব্বা।
“আব্বা,” আদুরে কন্ঠ বীথির, “ভাইয়া না একটা কাজ করছে।”
“কি কাজ?” চোখ খুললেন না আব্বা। আরিফের ব্যাপারে আগ্রহ নেই তার।
ইতস্ততঃ করতে লাগল বীথি। হঠাৎ করে তার মনে হল ব্যাপারটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিল ততটা সহজ হবে না। বুকের ভিতরে ভয় দানা পাকাতে লাগল। আব্বা রেগে যাবে না তো? ভাইয়াকে আব্বা ইদানিং সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু ভাইয়া তো চেষ্টা করছে। তা না হলে ভাইয়া এই ব্যবসাটার কথাইবা ভাববে কেন? সংসারের জন্যেই তো। তাহলে আব্বা বুঝবে না কেন? প্রশ্নটা যতটা ঝট করে বীথির মাথায় এল উত্তরটা ততটা তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়। আসলও না। তাই অস্বস্থিটাও কাটল না। আরিফের দিকে তাকালো বীথি। আরিফ গম্ভীর মুখে তার তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল। ভাবখানা, তুই দায়িত্ব নিয়েছিস, তুই সামলা। আমি এখানে নাই।
“আমাদের পাড়ার লাবু ভাই আছে না?” অবার শুরু করল বীথি। তবে শুরু করেই বুঝল শুরুটা ঠিক জমল না।
“হ্যাঁ,” আব্বা আগের মতই চোখ বুজে থাকলেন। “কি হইছে লাবুর?”
“না লাবু ভাইয়ের তো কিছু হয় নাই।” আরিফের দিকে শেষবারের মত তাকালো বীথি। আরিফের দৃষ্টি অন্য দিকে। “ভাইয়া গেছিল লাবু ভাইয়ের সাথে কথা বলতে।”
আব্বার মাঝে এবারও কথাটার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হল না। চোখ বুজেই মাথাটা অপর পাশে কাৎ করলেন তিনি যেন বীথি অন্যপাশের চুলগুলোতেও বিলি কাটতে পারে।
“আরিফ লাবু ভাইয়ের সাথে কথা বলছে তো এতে নাচার কি হইল?” শুষ্ক কন্ঠ আব্বার। “আসল কথা বল।”
সোফার মধ্যে নড়েচড়ে বসল আরিফ। মাথার ভিতরটা টগবগ করে ফুটতে শুরু করল তার। সে জানত আব্বা এমনই করবে। বীথির বিলি কাটা বন্ধ হয়ে গেল। তিক্ত একটা পরিস্থিতির সূচনা হতে যাচ্ছে কোন সন্দেহ নাই। নিজের উপর রাগ হল বীথির। কেন সে দায়িত্বটা নিতে গেল? তেতো গলায় বলল,
“আসল কথা আবার কি। ভাইয়া একটা গরুর খামার করবে।”
“কি করবে?” এবার চোখ খুললেন আব্বা। পালা করে তাকালেন দুই ছেলেমেয়ের দিকে।
আরিফের দিকে তাকালো বীথি। ফেটে পড়বার জন্যে ছটফট করছে সে। হতাশ হল বীথি। ভাইয়াও তো ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারে। আব্বার বয়স হয়েছে।
“গরু পুষবে।” সাবধানে বলল বীথি। “মোটা তাজা করে বিক্রি করবে।”
“হুম...” আবার চোখ বুঁজলেন আব্বা। এবং আব্বার কথা বলার ভঙ্গিতে বীথি নিশ্চিত হয়ে গেল যে ঝগড়াটা লাগতে যাচ্ছে তা সে থামাতে পারবে না।
“জীবনে কোনদিন শুনি নাই যে,” ধারালো র্নিবিকার কন্ঠ আব্বার। “গাধা গরু লালন পালন করে।”
“বলছিলাম না?” ফেটে পড়ল আরিফ। “পৃথিবীর সব মানুষ আমার কাজ পছন্দ করলেও আব্বা করবে না।”
নড়ে চড়ে আরাম করে শুলেন আব্বা। আরিফের ব্যবসার কথা শুনে তার এতক্ষণের আরাম ছুটে গেছে। ছেলেটা বরাবর শুধু যন্ত্রনাই করে গেল।
“গরু যে পালবি,” বললেন আব্বা, “গরুর গায়ে হাত দিছিস কোনদিন? গোবর পরিষ্কার করতে কেমন লাগে জানিস সেইটা?”
প্রচন্ড বিরক্তি আব্বার কন্ঠে। আরিফের উত্তরের অপেক্ষা না করে আনমনে আবার বললেন আব্বা উপহাসের সুরে, “গরু পালবে।”
উপহাসটা খুব লাগল আরিফের। তবে চুপ করে থাকল। আব্বা কাছে এরচেয়ে ভাল কোন প্রতিক্রিয়া সে আশা করে না। স্রেফ স্বপ্না বলেছিল বলে আব্বার সাথে এই বিষয়ে কথা বলছে সে। নয়ত তাকে কি পাগলা কুত্তা কামড়িয়েছে যে আব্বার সাথে সে যেচে কথা বলতে যাবে।
হঠাৎ করেই বীথির কেন যেন মনে হল ভাইয়াকে খুঁচিয়ে আব্বা বোধ হয় আজকাল বেশ মজা পান। কথাটা মনে হতেই নিজেকে খুব ছোট মনে হল তার। আব্বা অযথা এরকম করবে কেন? ভাইয়া কি তার ছেলে না?
“তুমিও না আব্বা,” পরিবেশটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করল বীথি, “আগে তো ভাইয়া ট্রেনিং নিবে। তারপর গরু কিনবে। আমাদের উঠানে গোয়াল ঘর বানাবে।”
“শেষ পর্যন্ত যদি তুই গরুই হবি,” বিরস কন্ঠ আব্বার, “তাইলে আর এত পয়সা খরচ করে ভার্সিটিতে পড়ায় তোকে মানুষ করার চেষ্টা করলাম ক্যান?”
গুম হয়ে বসে থাকা আরিফের দিকে তাকালো বিথী। মনে মনে খুব করে কামনা করল ব্যাপারটা যেন এই পর্যন্তই থাকে। আব্বা যেন আর কিছু না বলে। কিন্তু আব্বা এত সহজে থেমে যাওয়ার পাত্র নন। আবারও মুখ খুললেন তিনি।
“কর যা ইচ্ছা।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আব্বা। “তবে আমি কোন টাকা পয়সা তোকে দিতে পারব না। সামনে পেনশন যা পাব তার বাইরে আমার হাতে আর কোন পয়সা কড়ি নাই। সব তো তোদের পিছনে খরচ হইছে।”
ডিনামাইটের সলতেয় যেন আগুন লাগালো কথাটা। লাফিয়ে উঠল আরিফ।
“কি আমাদের পিছনে খরচ করছ তুমি?” ক্ষেপাটে কন্ঠ আরিফের। “মন্ডা মিঠাই খাওয়াইছো প্রত্যেকদিন? হ্যাঁ? সব সময় খালি এক কথা। আমাদের পিছনে খরচ হইছে। আমাদেরকে তো রাজা বাদশার হালে রাখছো...”
মুখ শক্ত করে শুয়ে থাকলেন আব্বা। বিরক্ত লাগল বীথির। কেন এরা এমন করছে? প্রতি দিনকার এই হাঁউকাঁউ আর ভাল লাগে না। ধমকে উঠল সে।
“ভাইয়া থাম। ভাইয়া।”
ধমকে কাজ হল না। বরং আরিফের গলা আরেক ধাপ উপরে উঠল।
“আমি টাকা চাইছি আব্বার কাছে?” বীথিকে বলল আরিফ। “আমি বুঝি না সংসারের কি অবস্থা? আমার চোখ কান নাই?”
আব্বা আগের মতই কাঠ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলেন। হঠাৎ করে বীথির কাছে সব কিছু যেন অপার্থিব মনে হতে লাগল। আরিফ, আব্বা, কারো কথাই তার কানে এখন আর স্পষ্ট নয়। ধোঁয়াটে সব। এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল বীথি। কেন এমন হচ্ছে? কেন? কেন?
“আমি যে সংসারের কথা ভাবতে পারি,” আরিফ তখনও বলে যাচ্ছে, “এইটা তো আব্বা বিশ্বাসই করে না।”
“ভাবলে,” চোখ খুললেন আব্বা। ছাদের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন, “এতদিনে তোর একটা কিছু হয়ে যাইত।”
বীথির চোখ দুটো সরু হল। এখনও সে মাটির দিকে তাকিয়ে। সে ঠিক বুঝল না আব্বার এই কথাটা এখন বলার কি মানে। আব্বা কি তাহলে ইচ্ছা করে এমনটা করছে? কেন? কেন? এই সময়গুলোতে মাকে তার খুব করে মনে পড়ে। তার জীবনটা অন্য আর দশটা মেয়ের মত নয় কেন? কেন নয়? কি পাপ করেছে সে?
“দেখলি? দেখলি?” বীথিকে বলল আরিফ। আরো কিছু হয়তবা বলল। কিন্তু রাগের মাত্রাটা এত বেশী যে কথা বলবার শক্তি হারিয়ে ফেলল আরিফ। গটগট করে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে। আব্বার দিকে তাকালো বীথি। জীবনের সমস্ত বিতৃষ্ণা যেন বুকে এসে ভর করল তার।
“আব্বা, তুমি এক কাজ কর।” অস্বাভাবিক শান্ত আর তীক্ষè কন্ঠে বলল বীথি। “যেমন করে পার, ল্যাংড়া খোঁড়া যার সাথে পার, আমার একটা বিয়ে দিয়ে দাও। আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাই।”
কথাগুলো বলে বীথিও গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শুন্য দৃষ্টিতে ছাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বুঝলেন আব্বা। নিজের অজান্তেই বন্ধ চোখের ফাঁক বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
(পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩)
(শেষ পর্ব)