(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২)
১৪
আতংকে জমে গেল আরিফ লাবু ভাইয়ের কথা শুনে।
“কি বলেন লাবু ভাই?” দিশেহারা কন্ঠে বলল আরিফ, “লোন পাব না?”
এর আগে একবার একা একা এসেছিল আরিফ লাবু ভাইয়ের কাছে। সেবারও আরিফ নেতিবাচক উত্তর পেয়েছিল। নয়ন আর ফারুককে সে বাহাদুর বাজারে পাঠিয়েছে। ওখানকার ব্রয়লার মুরগী বিক্রেতাদের সাথে কথা বলতে। তারা কত টাকায় বর্তমানে মুরগী কেনে সেটা জানার জন্যে। আরিফের ইচ্ছে আছে যদি সম্ভব হয় তবে প্রথম দিকে দুই এক টাকা কম দিয়ে বড় বড় নিয়মিত কিছু খরিদদার তৈরী করা। কিন্তু লোনই যদি না হয় তাহলে.... নয়নকে বোধ হয় সাথে আনা উচিৎ ছিল।
“মটগেজ ছাড়া তো কেউ রাজি হচ্ছে না।” লাবু ভাই যেন কিছুটা বিব্রত।
“লাবু ভাই, আপনি বলার পরও হচ্ছে না।” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল আরিফ “এইটা কেমন কথা?”
“আরে যন্ত্রনা।” ধমকে উঠল লাবু ভাই। আমি কি এই দেশের রাজা যে আমি বললেই সব হবে।”
“আপনি এইখানকার সবচেয়ে বড় নেতা।” মরিয়া কন্ঠে বলল আরিফ।
মুখটা তেতো হয়ে গেল লাবু ভাইয়ের। নেতা হইছি তো কি তোমরা আমার মাথা কিনে নিছো নাকি। এত করেও তোমাদের মন পাওয়া যায় না। শালার। নেতা হওয়ার জন্যে আমাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াইতে হইছে। এমনি এমনি নেতা হই নাই। নিজের যোগ্যতায় নেতা হইছি।
বিরক্তিটুকু মনের ভিতরেই রাখল লাবু ভাই। নেতা হওয়ার জন্যে মনের কথা মনে রাখার প্রাণপণ প্র্যাকটিস তাকে করতে হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে নেতা হয়ে থাকার জন্যে যা যা দরকার সব করে যাচ্ছে সে। এসব এত সহজ না। তাইলে তো সবাই নেতা হয়ে যেত। আর এই ছেলে কি না তার নেতা হওয়া নিয়ে কথা তোলে। বেয়াদপ কোথাকার।
“সব কাজ নেতাদের ক্ষমতাতেও থাকে না রে বাবা।” আরিফের পাশে বসা বৃদ্ধটি বলে উঠল। “দেখেন না, আমার ছেলের কেসটার এখনও কিছু হইল না।”
“লাবু ভাই আমি মারা যাব।” হাহাকার করে উঠল আরিফ। “আমার সব কিছু রেডি, খালি লোনটা পাইলেই....”
“তোর আব্বাকে রাজী করা।” দায়সারা ভঙ্গি লাবু ভাইয়ের। “জমি মটগেজ রাখতে রাজী হয়ে গেলেই....”
“আব্বা রাজী হবে না।” ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকালো আরিফ। অসহায় বোধ করছে সে। তার ভাগ্যটা সব সময় এমন হবে কেন? চোখের সামনে পুরো দুনিয়াটা যেন ঘুরছে। আনমনে বলল,
“যদি আমি ব্যাবসায় লস করি? কোন অসুখে আমার সব মুরগী মারা যায়? তখন আমাদের জমির কি হবে? আমাদের তো আর কোন জমি জায়গা নাই। আব্বা এই রিস্ক নিবে না।”
নিজের অজান্তেই লাবু ভাইয়ের হাতে মোক্ষম অস্ত্রটা তুলে দিল আরিফ। এক মুহূর্ত দেরী না করে হাতিয়ার চালাল লাবু ভাই।
“তোর আব্বাই যেখানে তোর ব্যাপারে রিস্ক নিতে রাজি না,” বলল লাবু ভাই, “সেইখানে আমি তোর ব্যাপারে রিস্ক নিব এইটা তুই আশা করিস কেমন করে।”
“কে কার রিস্ক নেয় বাবা।” আবারও বলল বৃদ্ধ। “দুনিয়াটা বড় কঠিন। কেউ কারো জন্যে নিজের ক্ষতি করতে রাজি হয় না। স্যার তো তবু আমাদের জন্যে অনেক করে।”
আরিফ জীবনে কোনদিন কাউকে অভিশাপ দেয় নাই। আজ দিল। শালার বুড়া, তোর ছেলে জেলে পঁচে মরবে। তুই এই লোকের চামচামি করে কিছু করতে পারবি না। তোর ছেলের ফাঁসি হবে। আমি নাচব তোর ছেলের ফাঁসি হইলে।
“আপনি আমাকে কথা দিছিলেন লাবু ভাই।” আরিফের কন্ঠে উত্তেজনা।
শীতল একটা ভাব ফুটে উঠল লাবু ভাইয়ের দৃষ্টিতে। নেতা হিসাবে মানুষের কথা শুনবার অভ্যাস তার আছে। তবে সেটা একটা র্নিদিষ্ট পরিধির মধ্যে। রাজনীতিতে নেমে সবার প্রথমে সে যেটা শিখেছে তা হল, সবার জন্যেই করতে হবে কিন্তু র্নিধারিত সীমা পর্যন্ত। এতে যদি কেউ কিছু করে নিতে পারে তো নেক। না পারলে তার কিছু করার নাই। সবার দায়িত্ব নেবার জন্যে সে রাজনীতিতে নামেনি। এই ছেলের ক্ষেত্রে সেই সীমা অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। নিজের ক্ষতি করে মানুষের জন্যে করাটা তার রাজনৈতিক শিক্ষা নয়। আরিফকে দেবার কোটা তার পূর্ণ হয়ে গেছে। এবার নেবার কোটা পূরণ করবার পালা। সামনের ইলেকশনে সামান্য কিছু কাজে লাগানো যাবে বিষয়টাকে। যদি অনেক বেশী কাজে লাগানো যেত তাহলে না হয় আরো করার কথা ভাবা যেত। সুতরাং আরিফের অধ্যায়ের এখানেই সমাপ্তি টানতে হবে।
“দেখ আরিফ,” শান্ত কন্ঠে বলল লাবু ভাই, “সব কথা সব সময় রাখা যায় না। আমি বললে তোর লোন হয়ত হবে, কিন্তু যদি সত্যই তুই লস খাইস? তখন তো আমি ফাঁসবো।”
হঠাৎ করে সেই দিনকার অনুভুতিটা আবার ফিরে আসল আরিফের মাঝে। একটা মেয়ের এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যাবার সহজ কিছু সুযোগ আছে। ছেলেদের তা নেই। সিড়ির প্রত্যেকটা ধাপে পা দিয়েই ছেলেদের উপরে উঠতে হয়। আব্বার আস্থা অর্জনের ধাপটুকু সে পার হতে পারেনি। তারও আগে ভাল রেজাল্ট করবার ধাপটুকু তার ভীষণ নড়বড়ে।
“হ্যাঁ, আমার বাপেরই যেখানে আমার উপর ভরসা নাই..” ফিসফিস করে যেন নিজেকেই শোনালো আরিফ, “আমাদের উপর আসলে কারোরই ভরসা নাই।”
কাদের ভাইয়ের চায়ের দোকানে আজ বিকেলে কোন উচ্ছলতা নাই। চার বন্ধু চুপচাপ বসে আছে। রুমা কাপ টুর্নামেন্ট নাই। মুরগীর খামার নিয়ে কোন আলোচনা নাই। এক ঝটকায় চার বন্ধুর জীবন যেন থেমে গেছে।
“কাজটা খুব খারাপ হইল।” ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকালো মীম। “গরীবের কপালে সুখ সহ্য হয় না।”
লাবু ভাইয়ের বাসা থেকে যখন বের হচ্ছিল তখন নিজেকে বঞ্চিত মনে হচ্ছিল আরিফের। এখন আর কিছুই মনে হচ্ছে না। একটা মানুষকে অনেকক্ষণ ধরে পেটালে যেমন খানিক পরে তার শরীরে আর কোন রকম অনুভুতি কাজ করে না। তেমন অনুভুতিহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। দুর্ভাগ্যের মার আর কত সহ্য করা যায়? হঠাৎ করে আরিফের কদিন আগে স্বপ্নার একটা প্রজাপতির পিছনে ছুটবার কথা মনে পড়ল। প্রজাপতিটা কখনওই সোজা সোজি উড়ছিল না। কখনও উপরে তো কখনও নীচে। স্বপ্না যেন প্রজাপতিটার লাগাল পেয়েও পাচ্ছিল না। তার ভাগ্যটা বোধ হয় ঐ প্রজাপতিটার মতন। কাছে আসছে বরবার কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা দিচ্ছে না।
লাবু ভাইয়ের বাসায় বৃদ্ধকে তখন অভিশাপ দেয়াতে এখন খারাপ লাগছে আরিফের। তার আর কি এমন ক্ষতি হয়েছে। আবারও নাহয় তার আব্বার সাথে যখন তখন ঝগড়া হবে। বীথির কোন ল্যাংড়া খোঁড়ার সাথে বিয়ে হবে। স্বপ্না হয়ত তার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে অফিসের কোন কলিগকে বিয়ে করে নেবে। এই তো। এরচেয়ে বেশী কিছু তো আর না। কিন্তু বৃদ্ধের ছেলে তো মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে। ছেলের যদি ফাঁসি হয়ে যায় তো এই বয়সে লোকটা যাবে কোথায়? অভিশাপ ফেরৎ নেয়া যায় না খোদা?
“আমি তো আগেই বলছিলাম,” চেঁচিয়ে উঠল সাগর, “লাবু ভাইয়ের কথায় নাচিস না। এখন হইল।”
রাজনীতি করা লোকদের কোনদিনই বিশ্বাস করে নাই নয়ন। তারপরও কেন যেন মনে হয়েছিল এখান থেকে আরিফের যদি কিছু একটা হয়ে যায় তো খারাপ কি? আরিফের দিকে একবার তাকালো নয়ন। চুপচাপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে আরিফ। পুরো ব্যপারটাতে নয়ন আরিফের সাথে ছিল। তাকে নিয়ে আরিফ এখন কি ভাবছে কে জানে? একটা র্দীঘশ্বাস ফেলল নয়ন। খসখসে কন্ঠে বলল,
“লাবু ভাইয়ের দোষ দিচ্ছিস কেন? সে তার দিকটা দেখবে এটাই স্বাভাবিক।”
“তাইলে নেতা হইছে কি জন্যে?” আরো রেগে গেল সাগর।
তিক্ত হাসি হাসল নয়ন। “নেতা হইলেই নিজের বাড়ি ঘর সব কিছু জনগণের জন্যে বিলায় দিতে হবে?”
“হজরত ওমর ফারুক দিছিল।” মৃদু কন্ঠে বলল মীম।
আবারও হাসল নয়ন। এবার একটু জোরে। “ওরা মহামানব। মহা-মহামানব।”
“তো ফাইনালী ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে?” সাগরের রাগ কমছেই না। “আমরা বেকার বেকারই থাকব? বাড়ির কুপুত্র, সমাজের বোঝা?” টেবিলে একটা চাপড় মারল সাগর। “তাইলে তো হাইজ্যাকিং করা ভাল। অথবা স্মাগলিং।”
বন্ধুদের দিকে তাকালো আরিফ। এরা কেন এই বিষয়টা নিয়ে এত উত্তেজিত হচ্ছে। সে তো ঠিক আছে। কত বারই তো জীবনে ব্যর্থ হয়েছে সে। এটা তো নুতন কিছু না। হ্যাঁ, এর আগে বীথি কখনও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায়নি। আর স্বপ্নার আগে কোন চাকরী ছিল না, এখন আছে। এই-ই তো তফাৎ। ...হ্যাঁ, অরো একটা তফাৎ আছে। আব্বার এখন আর চাকরী নেই। বুকের ভিতরটা চেপে ধরল আরিফের। এখানে কি আজকে বাতাস কম? শ্বাস নিতে পারছে না কেন? উঠে দাঁড়ালো আরিফ। বাতাস দরকার তার। কারো সাথে কোন কথা না বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল সে। আরিফের চলে যাওয়া দেখে অসহায় অক্রোশে টেবিলের পায়ে একটা লাথি হাঁকালো সাগর। বাকিরা চুপচাপ বসে রইল।
মনটা খারাপ হয়ে গেল কাদের ভাইয়ের। ছোট ভাইটার জন্যে সে চিন্তা করে না। সেরকম হলে না হয় তার দোকানে বসবে ফারুক। দুই ভাই মিলে হোটেল চালাবে। আসলে আরিফদের প্রত্যেক দিনের হাসি ঠাট্টায় কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে কাদের ভাই। ছেলেগুলো স্কুল জীবন থেকেই তার এখানে আড্ডা মারে।
“তাইলে কি ব্যাবসা হবে না?” জানতে চাইল কাদের ভাই।
বিরক্ত ভঙ্গিতে হাসল সাগর। নয়ন কিছুক্ষণ কাদের ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“দেখা যাক। আল্লাহর এক দুয়ার বন্ধ হইলে নাকি হাজার দুয়ার খুলে।”
অস্থির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো মীম। দুই পা হাঁটল হোটেলের ভিতরে।
“নাহ।” বলল মীম, “শালার রূমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায়....”
কথাটা শেষ করল না মীম। বুকের ভিতরটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। আমি আর সাগর না হয় হাজারটা মেয়ে নিয়ে আছি। কিন্তু আরিফ তো শুধু স্বপ্নাকে নিয়েই থাকল বরাবর। তার কেন এমন হবে?
হোটেলের দেয়ালে হেলান দিল সাগর। দুহাত দিয়ে মাথার চুলগুলো পিছন দিকে টেনে ধরল। রূমার বিয়ে হয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।
“হ্যাঁ,” বলল সাগর। “একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ভুলে ছিলাম সব কিছু।”
“দোস্ত রিক্সা চালানো যায় না?” ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল মীম। “কোন টাকা পয়সা লাগবে না। গ্যারেজ থেকে একটা রিক্সা নিলাম, রাত্রে ৫০/১০০ যা হয় মাহাজনকে দিয়ে দিলাম।”
হসতে চেষ্টা করল নয়ন। “তাইলে তোকে এই শহর ছাড়তে হবে।”
“হ্যাঁ।” বলল মীম। “ভাবতেছি তাই করব।”
মীমের দিকে তাকালো সাগর। এই প্রথম সে তার এতদিনের সাথীর কথার অর্থ ধরতে পারল না। অবশ্য কথাটা কোন মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে ছিল না।
রাতে সব কথা শুনে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন আব্বা। ছেলেকে বকলেন না। ছেলের ভুল ধরলেন না। এমনকি ছেলের ব্যর্থতায় বিরক্তও হলেন না। শুধু ভাঙ্গা গলায় বললেন,
“তাইলে হইল না। ... কি আর করবি, আমাদের কপালে নাই।”
হতভম্ব হল আরিফ। সোফার হাতলে বসা বীথির দিকে তাকাল। না তার চোখেও কোন অভিযোগ নাই। আবার বুকটা চেপে ধরল আরিফের। আব্বা চোখ বন্ধ করে বসে আছে কেন? কেন এখনও বলছে না সে একটা অপদার্থ। তার মত ছেলের হাতে কেউ কখনও মেয়ে দেবে না। উঠে দাঁড়ালো আরিফ। হা করে শ্বাস নিল। বাতাস দরকার তার। বাইরে যেতে হবে। দরজার পর্যন্ত যেতেই আবার কথা বললেন আব্বা। আরিফকে ডাকলেন, “আরিফ..”
যন্ত্র চালিতের মত ঘুরে দাঁড়ালো আরিফ। আব্বা এখনও আগের মতই চোখ বুঁজে আছে।
“আমাকে ভুল বুঝিস না বাপ।” কেঁপে উঠল আব্বার গলা। “এই বাড়িটাই আমার সম্বল। এই বয়সে আর ওতো সাহসও আমার নাই।”
নিজের বাপের জন্যে এই প্রথম বুক ভেঙ্গে কান্না পেল আরিফের।
(শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৫০