(২০০৬ এরদিকে কয়েক বন্ধু মিলে এটা টেলিফ্লিম তৈরী ব্যার্থ চেষ্টা চালাই। সেটার পান্ডুলিপিকেই বর্তমানে গল্প আকারে লিখছি। তাই সেময়কার কিছু তারকা ক্রিকেটারের নাম এখানে এসেছে যাদের অনেকেই এখন আর জাতীয় দলে নেই)
(পর্ব ১) (পর্ব ২)
৩
কাদের ভাইয়ের চায়ের দোকান হল আরিফদের আড্ডা স্থল। প্রতিদিন বিকালে নিয়মিত কনফারেন্স বসে আরিফদের। সেই কলেজ জীবন থেকেই যত সুকাজে আর কুকাজে তারা চার বন্ধু এক সাথে। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে ফাজিল মীম এবং সাগর। এই মুহূর্তে তারা একটা টেবিলের উপর দুই পাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে পাঞ্জা লড়ছে। এই জাতীয় পৌরুষচিত প্রতিযোগীতা তারা প্রায়ই করে থাকে। তবে যে বা যাদের নিয়ে তাদের এমন প্রতিযোগীতা তারা অবশ্য এই লড়াইএর কথা একেবারেই জানে না। জানে না মানে জানানো হয়নি আজ পর্যন্ত। স্কুল জীবনের বাঁধা ধরা গন্ডি পেরুবার পর থেকেই শুরু হয় তাদের এই জাতীয় অভিযান। রাস্তা ঘাটে কোন মেয়েকে পছন্দ হলেই তারা তার পিছু নেয়। কে তার সাথে প্রেম করবে অথবা কে প্রথম কথাটা বলবে এই নিয়েই লড়াই তাদের। অবশ্য এই ব্যাপারে তারা ভীষণ রিজেনেবল। অন্যান্যদের মত মারামারি করে না তারা। অবশ্য সেটা তাদের ধাঁতেও নেই। তারা বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা করে। আজকে তারা দুজনে সাদা মাঠা পাঞ্জা লড়লেও এপর্যন্ত তারা এত অসাধারণ সব প্রতিযোগীতার আবিস্কার করেছে যে, অলিম্পিক কমিটি এদের সাথে যোগাযোগ করলে প্রতিবার একটি করে নুতন ইভেন্ট সংযোজিত হতে পারত অলিম্পিক প্রতিযোগীতায়। এই সব আবিষ্কারের স্বীকৃতি তারা র্নিদ্বিধায় ঐ সমস্ত মেয়েদের দিতে রাজী আছে যাদের দেখে তারা বরাবরই অনুপ্রাণিত হয়েছে। এবং অতি অবশ্যই এই রূপ অনুপ্রেরণা দানকারী মেয়েদের সংখ্যা অগণিত।
এই সমস্ত অনবদ্য প্রতিযোগিতাগুলোতে আরিফের ভূমিকা মূলত দর্শক ও সমালোচকের। আর নয়ন হচ্ছে তাদের দলের মোটামুটি জ্ঞানী ব্যাক্তি। সে এই সমস্ত প্রতিযোগীতার প্রধান উৎসাহদাতা। তবে তার ভুমিকা উৎসাহ প্রদান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। অনেক সময় আরিফ ও নয়নের প্রতিযোগীতার মেয়েটি দেখতে কেমন তাও জানা হয় না। তাদের মূল আগ্রহ অনবদ্য এই সব প্রতিযোগীতা। চারবন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হল তাদের লেখাপড়ার মান প্রায় একই পর্যায়ের। এবং অদ্যাবধি চারজনই বেকার।
এই মূহুর্তে নয়ন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগীতার ধারা বর্ননা দিচ্ছে। আরিফ বরাবরই আড্ডায় লেট কামার ছিল। প্রেমে পড়বার পর তার লেটে আসাটাকে বাকিরা সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছে।
“প্রিয় র্দশক,” মুখের কাছে অদৃশ্য মাইক্রোফোন ধরে আছে নয়ন, “আমন্ত্রণ জানাচ্ছি কাদের ভাইয়ের হোটেলে আজকের রুমা কাপ র্টুনামেন্ট উপভোগ করার জন্যে।”
এই মুহূর্তে আশে পাশে দর্শক বলতে কেবল মাত্র কাদের ভাই-ই আছে। চা পিপাসু লোকজন এখনও আসা শুরু করেনি। কাদের ভাই নয়নদের জন্যে চা বানাচ্ছে।
“প্রতিদিনের মত আজকের প্রতিযোগী দূর্ধষ প্রেমবাজ জনাব সাগর এবং ভয়ানক প্রেমিক জনাব মীম।”
এই সমস্ত ভয়াবহ টাইটেলগুলো নয়নের উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। এবং অন্যদের কাছে তা সাদরে গৃহীত হওয়ায় বন্ধু মহলে এখন সেগুলো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত।
“আজকের আকাশ মেঘমুক্ত হলেও,” টেবিলে টোকা দেয় নয়ন। টেবিলটা সামান্য ভেজা। “খেলার মাঠ বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। যা হোক, খেলা শুরু হয়ে গেছে প্রিয় র্দশক। তুমুল লড়াই চলছে। একেবারে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। কে হরে কে জিতে বলা মুশকিল। মিম এর ধীর স্থিরতা আমাকে তারকা ব্যাডসম্যান আশরাফুলের কথা স¥রণ করিয়ে দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াকে হারাবার সময় সেঞ্চুরীয়ান মোঃ আশরাফুল যে রকম ধীর স্থিরতার পরিচয় দিয়েছিল, আমাদের মিম বর্তমানে ঠিক সে রকম স্থির এবং নির্ভীক। হাজার হলেও তিনি ভয়ানক প্রেমিক। নির্ভীক তো তিনি হবেনই।”
নয়ন বরাবরই নিরপেক্ষ মানুষ। তাই এবার সে সাগরের বর্ণনা দেয়া শুরু করল।
“অপরদিকে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে দু দুটি সিরিজ জিতবার সময় ক্যাপ্টেন হাবিবুল বাশারের মাঝে যে আত্ম প্রত্যয় বিরাজ করছিল আমাদের সাগরের চোখে মুখে বর্তমানে সেই আত্ম প্রত্যয়ের ছোঁয়া। সুধী দর্শক মূলতঃ তার এই আত্মপ্রত্যয়ের কারণেই তিনি দূর্ধষ প্রেমবাজ খেতাবটি অর্জন করেছেন।”
চা বানাতে বানাতে নিঃশব্দে হাসতে থাকে কাদের ভাই। যদিও এটা প্রতিদিন বিকালের নিয়মিত ঘটনা তারপরও ছেলেগুলোর কাজকর্ম তার বেশ ভালই লাগে। চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে প্রতিযোগীতা দেখতে থাকে সে।
“প্রিয় দর্শক শ্রোতা,” বলে চলছে নয়ন, “দেখা যাক কোথাকার পানি আজকে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।”
মীমের হাতের ধাক্কায় সাগরের হাত সামান্য টলে গেল। সাথে সাথেই নয়নের কন্ঠে জোশ চলে আসল। সেও বাতাসে হাত নাড়াল মীমের মত করে।
“এই মাত্র ভয়ানক প্রেমিক জনাব মিম প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার উদ্দেশ্যে তার হাতের কবজিতে একটা শক্তিশালী মোচড় দিলেন। ঠিক যেন স্পিনার মোঃ রফিক তার কবজি ঘুরিয়ে বলকে ছুঁড়ে মারলেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে।”
সাগরও এত সহজে হেরে যাবার পাত্র নয়। গত কয়েকদিন সে-ই জিতেছে। সুতরাং আজকে হেরে গেলে তার মান সম্মানের বারোটা বেজে যাবে। তাই সর্ব শক্তিতে পাল্টা ঝটকা দিয়ে খেলায় সমতা নিয়ে আসল সে। আবারও সাথে সাথেই নয়নের ধারা ভাষ্যের আবেগে পরির্বতন আসল।
“কি-ন-তু না-আ। বলটি একেবারে উইকেটের পাশ ঘেঁসে কীপার খালেদ মাসুদ পাইলটের গ্লাভস বন্দী হল। অল্পের জন্যে দূর্ধষ প্রেমবাজ সাগরের উইকেটটি রক্ষা পেল দর্শক মন্ডলী।”
সাগরের ক্রীড়া নৈপূর্ণ্যে নয়ন রীতিমত মুগ্ধ। হাত বাড়িয়ে সাগরের পিঠ চাপড়ে দিতেই ক্ষিপ্ত হল সাগর। তার সমস্ত মনোযোগ এখন রুমা কাপ টুর্নামেন্টে। পিঠ ঝাঁকিয়ে নয়নের হাতটা সরিয়ে দিল সে। নয়নও বুঝতে পারল তার ভুলটা। টুর্নামেন্টের মাঝে খেলোয়াড়কে বিরক্ত করাটা রীতিমত অন্যায়।
“সরি..” বলল নয়ন।
আরিফ চায়ের দোকানে পা রেখেই দেখল খেলা বেশ জমে উঠেছে। দুই প্রতিযোগী পরস্পরের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চরম অবস্থা। যেন এই প্রতিযোগীতার উপরই নির্ভর করছে রুমাকে পাওয়া না পাওয়া। সুতরাং আরিফও আর্দশ দর্শকের মত সিটি বাজিয়ে উৎসাহ দেয়া শুরু করল। কাজও হল তাতে। দুই খেলোয়াড় গলার রগ ফুলিয়ে গোঁ গোঁ করতে লাগল। কাদের ভাইয়ের চা বানানো শেষ। তার হাসিটা আগের চেয়ে আরো বিস্তৃত হয়েছে এখন।
“এবার সাগরের পালা।” বলল নয়ন, “হ্যাঁ, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তিনি আক্রমন চালালেন। এ যেন মাশরাফী বিন মর্তুজার পেস বল। এবং বো-ল্ড।”
সাগর মিমের হাতকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিয়েছে। আরিফের সিটির আওয়াজ আরো বেড়ে গেল। নয়ন সাগরের এক হাত উপরে তুলে ধরল। সাগরও উঠে দাঁড়িয়ে বিজয় আনন্দে তার হাত ঝাঁকাতে লাগল যেন অলিম্পিক জিতেছে সে।
“প্রিয় র্দশক শ্রোতা” বলল নয়ন, “আজকের এই রুমা কাপ টুর্নামেন্টর চাম্পিয়ান দূর্ধষ প্রেমবাজ জনাব সা-গ-র। অর্থাৎ আজকে সাইকেল চালাবে পরাজিত মিম এবং সাইকেলের সামনে আরাম করে বসবেন প্রেমবাজ সাগর।”
মিমের কব্জিতে লেগেছে। সাগরকে যেন দেখতেই পাচ্ছে না এমন চোখ মুখ করে সে তার কবজি ডলতে লাগল। আরিফের দম ফুরিয়ে গেছে। সিটি বাজানো ছেড়ে সে মিমের পাশে বসে পড়ল। সাগর তখনও বিজয়ী ভঙ্গিতে চর্তুদিকের অদৃশ্য দর্শকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে। অবশ্য এত লম্বা আনন্দ প্রকাশের কারণও আছে তার।
“আজ নিয়ে পর পর তিনদিন রুমা কাপ র্টুনামেন্টে জয় লাভ করে হ্যাট্রিক করলেন জনাব সাগর।” নয়ন এখনও ধারা ভাষ্য দেবার গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। “সেই সাথে প্রমাণিত হল যে নিষ্ঠাবান প্রেমিকদের চেয়ে এই পৃথিবীতে প্রেমবাজ তরুণদেরই দাপট বেশী।”
হাত তালি দিল আরিফ। মিম তখনও আগের মতই নির্বিকারত্বের মুখোশ এঁটে রয়েছে। আরিফের দিকে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো দূর্ধষ প্রেমবাজ সাগর। হাজার হোক হ্যাট্রিক বলে কথা। তার জোশ কমছে না।
“কাদের ভাই চা দেন।” নয়ন বলল।
সাগরের পাশে ঝপ করে বসে পড়ল নয়ন। দেয়াল ঘেঁসে বসতে তার বরাবরই ভাল লাগে। একটু পাশ ফিরে দেয়ালে হেলান দেয় সে। ক্লান্ত হয়ে গেছে। বাপের খেয়ে বন্ধুদের জন্যে অনেক চিৎকার করা হয়ে গেছে। কাদের ভাই চায়ের গ্লাসগুলো এগিয়ে দেয়। সাগর এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার উত্তেজনা এখনও কাটেনি। আরিফ আর নয়ন চা তুলে নেয়। মিম তখনও কবজি ডলছে।
“কাল থেকে অন্য টুর্নামেন্ট হবে।” বলল মিম।
“ক্যান?” দাঁত বের করে হাসল সাগর। বসতে বসতে নিজের চায়ের গ্লাসটা তুলে নিয়ে খোঁচা মারল মিমকে।
“কুলাইতে পারতেছিস না?”
আরিফ বরাবরই চা বেশ আয়েশ করে খায়। দুই কুনুই টেবিলের উপর রেখে দুই হাতের তালু দিয়ে গ্লাসটা মুখের সামনে ধরে আছে সে। ধীরে ধীরে চুমুক দিচ্ছে আর গ্লাসটাকে হাত দুটোর ফাঁকে নাড়াচ্ছে।
“তোরা দুইজন,” আরিফের চোখে মুখে কৌতুক। “দূর্ধষ প্রেমবাজ আর ভয়ানক প্রেমিক, প্রত্যেকদিন যে এই রুমা কাপ টুর্নামেন্ট চালাচ্ছিস, রুমা তো তোদের দিকে ঘুরেও তাকায় না।”
চরম অপমানিত হয়েছে এমন ভাবে আরিফের দিকে ঘুরে তাকাল দুই প্রেমিক। নয়নের চোখে রীতিমত বিস্ময়। বলে কি ছেলেটা। জানে কতটুকু সে আমাদের সর্ম্পকে?
“তোর ধারনা সত্যি নহে।” চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিতান্ত করুণা করার ভঙ্গিতে বলল সাগর। আরিফের মত ছেলেরা এই সব ব্যাপারে কি জানবে। ও তো একটাতেই কাৎ। আমাদের মত ১০/১২টা মেয়ের পিছনে ঘুরলে না বুঝত। বেচারা। তার পক্ষে এরকম ভাবাটাই স্বাভাবিক। মাফ করে দেবার ভঙ্গিতে সাগর বলল,
“রুমা প্রত্যেকদির আমাদের দিকে পিটিস পিটিস করে তাকায়।”
আরিফের মত অর্বাচিনের যেন বুঝতে অসুবিধা না হয় সেজন্যে সাগর তার মাথাটাকে একপাশে সামান্য ঘুরিয়ে চোখ দুটো পিট পিট করে রুমার তাকানোর ভঙ্গিটা বাকায়দা অভিনয় করে দেখাল। মিমও বসে থাকার মানুষ না। অপমানকারী আরিফের কোমরে সাঁই করে একটা খোঁচা মেরে দিল সে।
“পিটিস পিটিস করে, বুঝছিস?” বলল মিম।
আরিফ মিমের প্রতিশোধমূলক খোঁচার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে এক পাশে কাৎ হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু আরাম করে চা খাওয়াটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ালো। দুটো কুনুই-ই টেবিলের উপরে থাকায় খুব বেশী কাৎ হতে পারল না। খোঁচাটার সফলতায় উৎফুল্ল বোধ করল মিম। কবজির ব্যাথা ভুলে গেল। নিজের চায়ের গ্লাসটা তুলে নিল।
“বিকাল বেলা যখনই আমরা,” বলল মিম, “ওর বাড়ির সামনে দিয়ে যাই তখনই তাকায়। এ্যঙ্গেল মেরে তাকায়।”
এবার সাগরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতো দিন ধরে ফিল্ডিং মারছে তারা অথচ মেয়েটা এখনও তাদের দিকে সরাসরি তাকালো না। সহ্যের একটা সীমা থাকা উচিৎ।
“জ্বি,” বিরক্ত কন্ঠে বলল সাগর। “৪৫ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেল। কোনদিন শালার ১৮০ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে তাকাইলো না।”
“তবে,” মিম এখনও উৎফুল্ল। “দুই জনের দিকেই সমান ভাবে তাকায়। কোন পার্শিয়ালটি করে না। বড় ভাল মেয়ে।”
কৃত্রিম সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায় মিম। নয়ন চুপচাপ চা খেতে থকে। হাজার হোক দলের মধ্যে সে সব চেয়ে জ্ঞানী ব্যাক্তি। জ্ঞানীদের কম কথা বলাই ভাল। তাতে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাবটা বেশ বজায় থাকে। আরিফ মিমের দিকে তাকিয়ে হাসে। অর্থাৎ সে তাদের প্রায় নিষ্পাপ হবু প্রেমের মধ্যে কিছু একটা প্যাঁচ লাগানোর ধান্দায় আছে। ভ্রু কুঁচকায় মিম। আরিফে হাসিটা আরো বাড়ে। তার মত করে ভ্রু কুঁচকানোর সামর্থ্য মিমের নেই। এবার সাগরও ভ্রু কুঁচকায়। আরিফের এই জাতীয় হাসি সহ্য করা যায় না। তবে ফেয়ার ফাইট বলে কথা। তাদের দান তারা চেলেছে। এবার আরিফের পালা। সুতরাং অপেক্ষা করতে লাগল দুই প্রেমিক।
“সেই জন্যেই তো,” আরিফ বলল, “তোদেরকে নিয়ে আমার ভীষণ টেনশন হয় দোস্ত। এক সাথে দুইজন। ব্যাপারটা ভাব একবার। মেয়েটা তোদের মধ্যে একটা ইয়ে লাগানোর চেষ্টা করতেছে।”
দুই প্রেমিকের এক সাথেই সবগুলো দাঁত বেরিয়ে গেল। ভাবখানা যেন আমরা যাহা জানি তাহা তুমি জানো না বন্ধু। সাগর হাত নেড়ে উদার কন্ঠে বলল,
“এটার একটা সমাধান আমরা বের করে ফেলছি দোস্ত।”
“ইয়েস।” উৎফুল্ল ভাবে আরিফে উরুতে চাপড় মারল মিম। এবার আরিফ ভ্রু কুঁচকায়। কথা বলছিস বল। গায়ে হাত কেন? মিমের এসবে খেয়াল নেই। কন্ঠে পরম তৃপ্তি নিয়ে সে বলল,
“আমরা সিদ্ধান্ত নিছি আমরা শেয়ারে বিয়ে করব।”
রীতিমত হোঁচট খায় নয়ন। তার চেহারা থেকে জ্ঞানী ব্যাক্তি গাম্ভীর্য্য খসে পড়ে। আরিফের কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগে। ধীরে ধীরে চায়ের গ্লাস ধরা হাত দুটো মুখের সামনে থেকে নামায় সে।
“কি করবি?” প্রশ্ন করে আরিফ।
কাদের ভাইও মিমদের দিকে তাকায়। এই ছেলেগুলোর অনেক পাগলামী দেখেছে সে। তবে এটা একেবারে লেটেস্ট।
“শেয়ারে বিয়ে করব।” রসিয়ে রসিয়ে শুরু করল সাগর। “তাতে আমাদের বন্ধুত্বটাও চিরস্থায়ী হবে। শুধু বন্ধুত্ব না, রীতিমত একটা আত্মীয়তা তৈরী হবে আমাদের মধ্যে।”
“মারহাবা, মারহাবা।” গ্লাস নামিয়ে রেখে মৃদু হাত তালি দেয় নয়ন।
“আর এই দিকে খরচও কমবে।”
বলতে বলতে আরিফের উরুতে আবারও চাপড় মারল মিম। আর সহ্য করা যায় না। আরিফও এবার ঠাস করে মিমের উরুতে একটা চাপড় বসিয়ে দিল।
“আাঁউ।”
আমি আবার কি করলাম ভঙ্গিতে আরিফের দিকে তাকাল মিম। আরিফের মুখে সন্তুুষ্টির হাসি দেখে মাইন্ড করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত আর করে না। তাদের দুই প্রেমিকের যুগান্তকারী আবিষ্কারটা জনসম্মুখে প্রকাশ করাটাকে প্রথম তাগিদ হিসেবে ধরে নেয় সে।
“একজন থাকব ভাতের দায়িত্বে।” বলল মিম। “আরেকজন থাকব কাপড়ের দায়িত্বে।”
“মারহাবা, মারহাবা।”
নয়ন অবিভূত তার দুই বন্ধুর কৃতিত্বে। আবারও হাত তালি দেয় সে। এবং আগের চেয়ে জোরে। আহা কি বুদ্ধি। একজন ভাত আর একজন কাপড়। অপূর্ব। কাদের ভাইও হাসতে থাকে। শুধু আরিফ অবিভূত হল না। প্রকৃত পক্ষে মেয়েদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে এখানে কেবল সে-ই মিশেছে। সুতরাং এইবার সে যাহা জানে দুই প্রেমিক তাহা জানে না। চায়ের গ্লাসটা আবারও মুখের কাছে তুলে নেয়। মিট মিট করে হাসতে লাগল। চুমুক দিতে দিতে শান্ত কন্ঠে বলল,
“আর কসমেটিকস? ..লিপিষ্টিক ..নেইল পালিশ ..লোশান?”
“হাবামার, হাবামার।”
হেসে ফেলল নয়ন। দাবার গুটি উল্টে গেছে। তাই নয়নও তার প্রশংসাসূচক শব্দটাকে উল্টে দিল। তবে এবার আর হাত তালি দিল না। চায়ের গ্লাস তুলে নিয়ে তার নিয়মিত পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় চলে গেল।
অন্তরের অন্তর স্থলে ধাক্কা খেল দুই প্রেমিক। এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কি করে তাদের চোখ এড়িয়ে গেল। এই জন্যেই তাদের রেজাল্ট খারাপ। একটা চাকরীও আজ পর্যন্ত হল না। যা হোক, নিজেকে সামলে নেয় সাগর। একটা মহৎ পরিকল্পনা যখন তারা হাতে নিয়েছে তখন তো আর মাঝ পথে তা থেমে যেতে দেয়া যাওয়া যায় না। শত শত দরিদ্র যুবকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের এই প্রজেক্টের উপরে।
“এইটা তো ভাবি নাই দোস্ত।” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সাগর। সাথে সাথে সমাধানও খুঁজে পেল। “তাইলে তো আরেকজন পার্টনার জোগাড় করতে হয়।”
মিমও চিন্তিত। আরিফের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুই তো শালা অলরেডি ক্লিন বোল্ড। তোকে দিয়ে হবে না।”
সুতরাং সাগর আর মিম এবার এক সাথে নয়নের দিকে তাকায়। তবে লাভ হয় না তাতে। সাগরদের পাগলামীকে নয়ন ইনজয় করে এটা ঠিক। কিন্তু তাদের সাথে পাগলামীতে যোগ দেবার কোন ইচ্ছা তার কোন কালেই ছিল না। বিরক্ত হয় নয়ন।
“আমার দিকে তাকাবি না। শালার কামাই রোজগার কিছু নাই। আর বিয়ের চিন্তা।”
মনটা খারাপ হয়ে যায় সাগর আর মিমের। নয়নটা কেন যে তাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে তারা একদল বেকার ছাড়া আর কিছুই না। বেশ ভালই তো চলছিল সব কিছু। বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোটা কি এতই জরুরী। সবার কি এত শক্তি থাকে। সাগরদের চেহারার কোথায় যেন একটা চাপা কষ্টের ছাপ ফুটে উঠে। ভয় হল আরিফের। সবাই নয়নের মত শক্ত হয় না। প্রতি মুহূর্তের বঞ্চনাগুলোকে তারা ছেলেমানুষী দিয়ে বাক্স বন্দি করে রেখেছে। বাক্স খুললে তারা আর ...
“ও বলা হয় নাই,” পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করে আরিফ। “স্বপ্নার একটা চাকরী হইছে।”
“গুড, সুখবর।” উৎফুল্ল হয় নয়ন। সেও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। “মিষ্টি কে খাওয়াবে? তুই না স্বপ্না?”
উত্তরটা দেয়া হয় না আরিফের। বাস্তবতা থেকে কি করে পালাতে হয় তা এতদিনে ভাল মত শিখে নিয়েছে মিমরা। সুতরাং এই সুযোগ তাদের হাতছাড়া করার কথা না। চোখ মুখ সিরিয়াস করে টেবিল চাপড়ালো মিম।
“আমার মাথায় এই মাত্র একটা চিন্তা আসল দোস্ত।”
“কি?” আরাম করে বসে জানতে চাইল আরিফ। দুই বন্ধু যে আবার ফর্মে চলে এসেছে সেটা বুঝে গেছে সে।
“দেখ,” দার্শনিক ভঙ্গিতে বলতে লাগল মিম। “যুগ যুগ ধরে আমরা পুরুষরা বরাবরই বেকার কোন মেয়েকে বিয়ে করি।”
তার বক্তব্যের প্রভাব লক্ষ্য করবার জন্যে থামল মিম। নয়ন ভ্রু কুঁচকালো। এরা শুধরাবে না।
“তাইলে,” আবারও শুরু করল মিম, “আজকে যখন আমাদের দূর্দিন তখন কি চাকরীজীবী মেয়েদের উচিৎ না আমাদের মত বেকারদের বিয়ে করা। বল?”
সর্মথনের আশায় বন্ধুদের দিকে তাকায় মিম। আরিফ হেসে ফেলে। নয়নের ভ্রু এখনও কুঁচকানো। চায়ে মনোযোগ দেয় সে। শুধু সাগর উত্তেজিত হয় মিমের কথায়।
“রাইট।” বলল সাগর। “দোস্ত রুমা কি কোন চাকরী করে?”
(পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩) (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৫৬