(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১)
১৩
কদিন ধরে আরিফের ব্যস্ততার শেষ নেই। যদিও এখনও সে ঘুম থেকে আগের মত দেরী করেই উঠছে। তবে প্রতিদিন নিয়ম মাফিক দুপুরে খাওয়ার জন্যে বাসায় আর আসা হয় না। কোথা থেকে মুরগির বাচ্চা কিনলে সবচেয়ে ভাল হবে সেটাই যাচাই বাছাই করার জন্যে মাঝে মাঝে জেলার বাইরেও যেতে হচ্ছে। নশিপুরে আপাতত একদিনের মুরগির বাচ্চা নেই। বাচ্চার বয়স যত বেশী দামও তত বেশী। গত কাল সৈয়দপুরে একটা ফার্মের খোঁজ পেয়েছে। আজ গিয়েছিল সেখানে। তাদের কাছে একদিনের বাচ্চা আছে। সমস্যা হল ওখান থেকে বাচ্চাগুলোকে আনবে কেমন করে? এই ব্যাপারে ওরা কোন সাহায্য করতে পারবে না বলেছে। এখন তাহলে কোন পিক আপ ভ্যানে করে আনতে গেলে তো অনেক খরচ পড়ে যাবে। বাস টার্মিনালে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে বাসে করে আনা যাবে কিনা। মুরগীর তো আবার একটা গন্ধ আছে। যাত্রীবাহী বাসের ছাদে করে যদি আনা যায় তো ভালো। ভিতরে তো নেয়াই যাবে না। যাত্রীরা পিট্টি দেবে। তাহলে তো আবার কাগজের কার্টনে করে বাচ্চা আনা যাবে না। ছাদে দড়ি দিয়ে বাঁধতে গেলে কার্টন, বাচ্চা সব থেঁতলে যাবে। দূরও বেশী সমস্যা হলে নশিপুর থেকেই বড় বাচ্চা কিনবে। রিকশা করেই আনা যাবে।
“স্যার দুইটা টাকা দেন না।” আরিফের চিন্তার সুতাটা কেটে গেল। সামনে একটা ৭/৮ বছরের বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে আরিফের হঠাৎ করে মনে হল, আচ্ছা এই বাচ্চাটা যদি মুরগীর বাচ্চা হত তবে তার দাম কত হত? হাসি পেয়ে গেল আরিফের। হাসি দেখে ছেলেটা উৎসাহ নিয়ে আবার বলল,
“স্যার, দুইদিন ধরে কিছু খাই নাই স্যার।”
চাপাবাজি আর কি। বিরক্ত হল আরিফ। দুইদিন ধরে না খেলে তো বড় মানুষদেরই স্যালাইন দিয়ে রাখতে হয়। তার তুই বাচ্চা একটা মুরগী দুইদিন ধরে খাইস নাই? বেকুব কোথাকার। চাপাবাজিটাও ঠিক মত পারিস না।
“এ্যাই, ভাগ এখান থেকে।” ধমকে উঠল আরিফ।
সৈয়দপুরের বাস থেকে মাত্র নেমেছে আরিফ কলেজ মোড়ে। মনে হচ্ছে যাওয়া আসার খরচটা পানিতে গেল। আর হোটেলে খেতে এত পয়সা লাগে। বীথি এত অল্প পয়সায় সংসার সামলায় কি করে। নাহ্, আর যাওয়া যাবে না দিনাজপুরের বাইরে। এখানেই আসে পাশে থেকেই বাচ্চা কিনতে হবে। নয়ন বলছিল পুলহাটের দিকে নাকি একটা পোল্ট্রি র্ফাম আছে। আজ বিকেলে গিয়ে একবার খোঁজ নিতে হবে ওখানে হ্যাচিং হয় কিনা? ক্লান্ত লাগছে হাঁটতে। বাড়িতে গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে।
“স্যার দুই দিন ধরে কিছু খাই নাই স্যার। স্যার...” এখনও ছেলেটা একটা হাত বাড়িয়ে আরিফের পাশে পাশে হাঁটছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আরিফের। থেমে ছেলেটার দিকে ঘুরে একটা ধমক লাগাল।
“এক চড় মারব। মিথ্যা কথা বলিস ক্যান? দুই দিন ধরে না খাইলে তুই বেঁচে আছিস কেমন করে?”
ধমক পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু শেষের কথাটায় ছেলেটা প্রশ্রয় পেয়ে গেল। আরো উৎসাহের সাথে আবারও বলল,
“স্যার দুইটা টাকা দেন না স্যার? স্যার...”
এবার আরিফের মাঝে সমাজ সেবা ভর করল। দরিদ্র দেশ। অনেক বেকারত্ব। দেশে ফকির মিসকিনের সংখ্যাও অনেক। কিন্তু ভিক্ষা করাটা তো এসবের সমাধান নয়। তাই নসিহত দেবার ভঙ্গিতে বলল,
“এ্যাই, ভিক্ষা করিস ক্যান? কাজ করে খাইতে পারিস না? আমাকে দেখ, আমাকে দেখে শিখ।”
কথাটা বলেই নিজের প্রতি অবিভুত হয়ে গেল আরিফ। ইস এতদিন মানুষ আমাকে কাজ কর্ম করতে বলছে। আর আজকে আমি মানুষকে কাজ কর্ম করতে বলতেছি। দারুন, দারুন। আহ্, জীবনটা এত্ত সুন্দর?! আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করল আরিফের। তবে আরিফের এতসব অনুভবের কোনটাই ছেলেটার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারল না। সে আবারও অভ্যস্ত কন্ঠে বলল,
“স্যার দুই দিন ধরে কিছু খাই নাই স্যার। স্যার...”
হবে না, এদেরকে দিয়ে কিছু হবে না। শেষ। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলার ভবিষৎ একদম শেষ। এরচেয়ে একটা ব্রয়লার মুরগীর বাচ্চার কন্ডিশনও তো অনেক ভাল। যদিও তাদের জীবন মাত্র মাস খানেকের। এরচেয়ে বেশী বড় হলে আবার হাড় শক্ত হয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়া করানোর খরচও বাড়বে। আলম স্যার পই পই করে বলছেন। যত বেশীদিন ব্রয়লার খামারে রাখবা তত তোমার খরচ। এক মাস হলেই বাজারে ছেড়ে দাও। যাই হোক মানুষের বাচ্চা তো আর ব্রয়লার না। তার জীবন পুরা ৫০/৬০ বছরের। এই বয়সেই যদি ভিক্ষা করা আর মিথ্যা কথা বলা শিখে তো দেশের উন্নতি হবে কেমন করে।
“কাজ করবি? হ্যাঁ?” উদার কন্ঠে বলল আরিফ। আরে দারুণ তো, খামারটা শুরু হলে সে তো দুই একজনকে তার খামারে কাজ করার জন্যে রাখতেই পারবে। না না, শব্দটা হবে নিয়োগ দিতে পারবে। আবারও নাচতে ইচ্ছা করল আরিফের। সে এখন নিয়োগদাতা। হোঁয়াও। নি-য়ো-গদাতা। শব্দটার মাঝেই কেমন একটা ওজনদার ভাব আছে। তবে ছেলেটা এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। মনের দুঃখে ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকালো আরিফ। একদম শেষ। শিশু বয়সেই রানীক্ষেতের মড়ক লাগছে।
“করবি না। জানতাম।” বলল আরিফ। “যা ভাগ এখান থেকে।”
হাঁটতে শুরু করল আরিফ। ছেলেটা পিছু ছাড়ল না। হাঁটতে হাঁটতে আবারও বলল,
“স্যার দুই দিন ধরে কিছু খাই ...”
এবার কষে ধমক লাগলো আরিফ,“চুপ। একদম চুপ।”
দাঁড়িয়ে গেল ছেলেটা। ভয় পেয়েছে। হাঁটতে থাকল আরিফ। ক্লান্ত লাগছে। বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে একটা গোছল দিতে হবে। কয়েক পা হাঁটতেই কেন যেন আরিফের মনে হল ছেলেটা বোধ হয় তার পিছন পিছন আসছে। ঘুরে দাঁড়ালো আরিফ। ভড়কে গেল ছেলেটা। থমকে দাঁড়ালো। কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে ছেলেটার দিকে তাকালো আরিফ। কড়া গলায় বলল,
“তুই এখনও গেলি না।”
“স্যার,” সরল কন্ঠে ছেলেটা বলল, “কাজ করলে খাইতে দিবেন?”
এবার বেকায়দায় পড়ে গেল আরিফ। কোমর থেকে হাত দুটো নামিয়ে ভাল মত তাকালো ছেলেটার দিকে। তাকাতেই কেমন যেন মায়ায় পড়ে গেল।
“ভাইয়া, পাগলামীর একটা সীমা থাকে।” বীথির মাথা তালুটা টগবগ করে ফুটছে। “আমাদের নিজেদেরই চলে না, আর এই ছেলেটা এইখানে থাকবে।”
বীথি বারান্দার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে দুই হাত রাখা। আরিফ উঠানে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ যুদ্ধবিদ্যার ভাষায় বীথির দখলে হায়ার গ্রাউন্ড আর আরিফের অবস্থান লোয়ার গ্রাউন্ডে। মানে বীথি আরিফের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বীথি গুলি চালালে গুলির নিজেস্ব শক্তির সাথে সাথে মাধ্যাকর্ষনের টান যুক্ত হবে। অপর দিকে অরিফের গুলিকে মাধ্যার্কষন ভেদ করে যেতে হবে। তাই প্রথম থেকেই রক্ষনাত্মক অবস্থান নিল আরিফ। সাফাই গাইবার ভঙ্গিতে বলল,
“আমার মুরগীর খামার দেখাশোনা করার জন্যে একজন লোক তো লাগবেই। তাই ভাবলাম....”
“তোর খামার এখনও চালু হয় নাই।” ফেটে পড়ল বীথি। “আগে হোক তারপর জমিদারগিরি করিস।”
হাঁপাতে লাগল বীথি। এই বাড়িতে কি সব পাগলরা বসবাস করে? আমি কি ভাবে সংসারটা চালাই এদের তো তা নিয়ে মাথাব্যাথাও নাই। এখন আবার এই ছেলেটাকে ধরে নিয়ে এসেছে। এই প্রথম বারের মত ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকালো বীথি। ছেলেটা তখন থেকে বীথির দিকে তাকিয়েই আছে। চোখগুলো বড় বড়, মায় ভরা। হোক মায়া ভরা। মায়া ধুয়ে কি সে পানি খাবে?
“কে না কে,” বলল বীথি। “চুরি করে তখন ভাগবে।”
“আমি ছেলেটার বাসা দেখে আসছি।” বলল আরিফ। “ওর মা একটা হোটেলে মশলা বাটার কাজ করে। বাপ নাই। মরছে অথবা ভাগছে কিছু একটা হবে।”
আবারও সাফাই গাইল আরিফ। তবে এবার বিরক্ত সে। বীথি তাকে দাম দিচ্ছে না। না হয় সে সংসারটা চালায়। কিন্তু আরিফ তো তার বড় ভাই হয়। শুধু তাই না বাড়ির বড় ছেলে। এতদিন না হয় তার কোন কাজ কর্ম ছিল না। কিন্তু এখন তো একটা ব্যবসা দাঁড়া করছে সে। বিরক্তিতে কাজ হল। বীথি যতই হায়ার গ্রউন্ডে থাকুক। তার সম্বল শুধুই রিভলবার। আর ভাইয়া তো রকেট লঞ্চার চালাচ্ছে।
ছেলেটার দিকে আবার তাকালো বীথি। এখনও চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। বীথি ধমকের সুরে বলল, “নাম কি তোর?”
“দুলাল।”
“দুলাল।” ভেংচি কাটল বীথি। বলল, “বস এখানে।”
বিড় বিড় করে কি যেন বলতে বলতে ঘরে চলে গেল বীথি। আরিফ দুলালের পিঠ চাপড়ে বোঝালো যে আর কোন টেনশন নেই। বিল পাশ। দুলাল বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসল। আরিফ হৃষ্ট চিত্তে নিজের ঘরে গেল। আজ প্রথম কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হল। ইনশাল্লাহ দিনে দিনে আরো অনেককে দেবে।
খামার যেহেতু শুরু হয়নি এখনও তাই আপাতত দুলালের প্রধান কাজ বীথিকে সংসারের কাজ কর্মে সাহায্য করা। তাকে আরিফের পুরোনো একটা টি-শার্ট বের করে দিয়েছে বীথি। মহানন্দে সে ঢলঢলে গেঞ্জিটা পরে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। উঠোনের দরজায় টোকা পড়তেই দুলাল দৌড়ে গেল দরজা খোলার জন্যে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল ফারুক। আরিফ লুঙ্গি পরা অবস্থায় বারান্দার মেঝেতে বসে নয়নের সাথে মুরগী কোথায় কোথায় সাপ্লাই দেয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলাপ করছিল। ফারুককে দেখে আরিফ বলে উঠল,
“কি খবর তোমার ফারুক?”
“স্লামালেকুম আরিফ ভাই।” ভিতরে ঢুকল ফারুক। তার পিছনে আরো দুটো ছেলে।
“তুমি যে সেই দিন কথা বলে গেলা,” বলল আরিফ, “তারপরে তো আর কোন খবর নাই?”
হাসল ফারুক। তারপর উৎসাহ নিয়ে তড়বড় করে বলল,
“আমার বন্ধুদের কথা বলছিলাম যে....”
“হ্যাঁ।” মনে আছে আরিফের সেকথা। তাকালো ছেলেদুটোর দিকে। ছেলেদুটো শব্দ না করে শুধু ঠোঁট নেড়ে আর বুক পর্যন্ত হাত তুলে সালাম দিল আরিফকে। আরিফও মাথা ঝাঁকালো উত্তরে।
“এ ঝন্টু, আর এ শফিক।” পরিচয় করিয়ে দিল ফারুক।
“বস।” বলল আরিফ। “বীথি, চেয়ার দে।”
“লাগবে না।” ঝন্টু বলল। “আমরা এখানেই বসতেছি।”
আরিফের পাশে বসল ঝন্টু আর শফিক। ফারুক আরিফের আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করল। বাড়িয়ে ধরল আরিফের দিকে।
“আরিফ ভাই এইখানে ৩০ হাজার টাকা আছে। রাখেন।”
“কিসের টাকা?” হতভম্ব বোধ করল আরিফ। “আগে আমি কাজ শুরু করি তারপর দিও।”
“ভাইয়া আপনার কাছে রাখতে বলছে।” টাকাটা আরিফের দিকে বাড়িয়েই রাখল ফারুক। “আমাদের কাছে খরচ হয়ে যাইতে পারে। তাছাড়া মুরগীর খামার তো শিগ্রি শুরু হচ্ছে।”
ফারুকের দুই বন্ধুর দিকে একবার তাকালো আরিফ। বুজতে চেষ্টা করল তাদের সম্মতি আছে কিনা। কারো চোখেই কোন অসম্মতি দেখল না। প্যাকেটটা হাতে নিল আরিফ। বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা বাষ্প অনুভব করল। একই সাথে প্রাপ্তির আনন্দ, সেই সাথে দায়ভার। বিশ্বাস রক্ষার দায়ভার। প্যাকেটাটা দিয়েই উঠানের চারদিকে চোখ বোলালো ফারুক। বলল,
“এইখানেই তো হবে, না?”
“হ্যাঁ।” উঠে দাঁড়ালো আরিফ। ঘরে ঢুকবার মুখে বীথির সাথে দেখা হল আরিফের। টাকার প্যাকেটটা তার হাতে দিল।
“এইগুলা রাখ।” বলল আরিফ “ব্যাংকে জমা দিতে হবে। আমার খামারে ওদের শেয়ার।”
আচমকা কেঁদে ফেলল বীথি। এতদিন ধরে সে বিশ্বাস করেছে আরিফ কিছু একটা করতে পারবে। কিন্তু আজ টাকাটা হাতে পেয়ে বুঝল তার বিশ্বাসের কোথায় যেন সামান্য সন্দেহ ছিল। আসলে তাদের সংসারে সুখ সহজে আসেনি তো কোনদিন। তাই মন মানতে চায় না। আজ মানল তাদের সংসারে টাকা আসবে। সে আবার নিয়মিত কলেজে যাবে। আব্বার সাথে ভাইয়ার আর কথায় কথায় ঝগড়া হবে না। তার কোন ভাল ঘরে বিয়ে হবে।
“কর ভাইয়া।” নাক টেনে বলল বীথি। “একটা কিছু কর। এভাবে আর ভাল লাগে না।”
ছোট বোনটার পিঠে হাত রাখল আরিফ। বোনটাকে তার কখনও আদর করা হয় না। মাথার উপরে অভাবের তলোয়ার ঝোলানো থাকলে অনেক কিছুই আর করা হয় না। টাকা আসলে অনেক বড় জিনিস। চোখ মুছল বীথি। টাকার প্যাকেটটা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভিতরে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে একটা র্দীঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে দাঁড়ালো আরিফ।
“আরিফ ভাই।” উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল ফারুক, “জায়গাটা তো পরিস্কার করতে হবে।”
“হ্যাঁ।” বারান্দার ধারে এসে দাঁড়ালো আরিফ।
নিজের দুই হাত ঘষতে ঘষতে দুই বন্ধুর দিকে তাকালো ফারুক। নিজেদের মধ্য চোখে চোখে কি যেন কথা হল। তারপর আরিফকে অবাক করে দিয়ে ফারুক বলল,
“তো আজকেই শুরু করে দেই।”
হেসে ফেলল নয়ন। এতক্ষণ ধরে সে মনে মনে ফারুককে যাচাই করছিল। আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্ষতি কি?”
কোন ক্ষতি নেই। কাজ যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় তত ভাল। সার্ট খুলে, প্যান্টের পা গুটিয়ে কাজ শুরু করে দিল সাড়ে পাঁচজন পুরুষ। সবচেয়ে বেশী লাফা ঝাপা করল দুলাল। আছাড়ও খেল সে সবচেয়ে বেশী। তাই নিয়ে হাসাহাসি হল। হৈ চৈ শুনে আব্বা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অবাক হয়ে দেখেলেন তার অপদার্থ ছেলেটা কয়েকটা ছেলেকে সংগে নিয়ে উঠানের ঝাড় জঙ্গল পরিষ্কার করছে। হঠাৎ করে কেন যেন একটা ভাল লাগা বাসা বাঁধল তার বুকের মাঝে। তবে ব্যাপারটাকে তিনি পছন্দ করতে পারলেন না। নিজেকে বোঝালেন, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়? আরিফের কোন ভরসা নাই।
বীথি এসে আব্বার পাশে দাঁড়ালো। আনন্দিত হতে তার কোথাও কোন বাঁধা নেই। তাই ঝলমলে চেহারায় সে আব্বার দিকে তাকালো একবার। আহলাদে আব্বার একটা বাহু ধরে আরিফদের কাজ দেখতে লাগল। আব্বা ঘুরে দাঁড়ালেন। করুক ছেলেটা কাজ, দেখা যাক কি হয় শেষ পর্যন্ত। ঘরে গিয়ে আরাম করে সোফায় বসে পেপারটা হাতে তুলে নিলেন তিনি।
বীথি রান্নাঘরে ঢুকে পিঁয়াজ কাটল, মরিচ কাটল, চায়ের পানি চড়িয়ে রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আরিফদের কাজ দেখতে লাগল। যুগে যুগে সব মেয়েরাই বোধ হয় পুরুষদের কর্মঠ ভঙ্গিতে দেখতে পছন্দ করে। বীথির কেন যেন অকারণেই মনে হল এখানে সবার মধ্যে সবচেয়ে বেশী কাজ নয়ন করছে।
কাজ শেষে হাত পা ধুয়ে বারান্দায় পাতা মাদুরে বসে সবাই মুড়ি মাখা আর চা খেতে লাগল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্যাবসার রূপরেখা ঠিক করতে লাগল আরিফরা। নয়নের কেন যেন মনে হল বীথি অনেকক্ষণ ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুরে তাকালো নয়ন। বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বীথি। নয়ন তাকাতেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ সরিয়ে নিল। তবে চলে গেল না। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার নজর ফেরালো নয়নের দিকে। নয়ন তখনও তাকিয়ে ছিল বীথির দিকে। এবার বেকায়দায় পড়ে গেল বীথি। হঠাৎ করে কোন কাজ মনে পড়েছে এমন ভাব করে সরে গেল ওখান থেকে। পুরো ব্যাপারটা চোখে পড়েছে আরিফের। তবে কিছু বলল না সে। নয়ন যদিও এই মুহূর্তে বেকার তবে এটা নিশ্চিত যে সে কোন ল্যাংড়া খোঁড়া নয়।
(পর্ব ১৩) (শেষ পর্ব)