(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩)
১৫
আরিফের ঘরে একমাত্র চেয়ারটায় বসে আছে স্বপ্না। তার মুখোমুখি বিছানায় বসে চাপা উত্তেজনা নিয়ে আরিফ তার আগামী পরিকল্পনার কথা শোনালো স্বপ্নাকে। এই পরিকল্পনার কথা সে এখন পর্যন্ত আর কাউকে শোনায়নি।
আরিফের লোন না হওয়ার কথাটা স্বপ্না নয়নের কাছ থেকে শুনেছে। নয়ন স্বপ্নার অফিসে গিয়েছিল তাকে খবরটা দেয়ার জন্যে। তাই অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে এখানে এসেছে স্বপ্না। অফিসে বলে এসেছে ফিরতে একটু দেরী হবে। নয়ন বলেছিল ছেলেটা নাকি ঠিক স্বাভাবিক পর্যায়ে নাই। কিন্তু এতটা আশা করেনি স্বপ্না।
“কি করবি তুই?”
কোন মতে প্রশ্ন করল স্বপ্না। তার সন্দেহ হল আরিফের একক্ষণ ধরে বলা কথাগুলো সে বোধ হয় ঠিক মত শুনতে পায়নি।
“আমার কাছে এখন পুরা ৩০ হাজার টাকা আছে।” স্বপ্নার দিকে ঝুঁকে আবারও বলতে লাগল আরিফ। “একজনের জন্যে যথেষ্ট। আমাকে শুধু এই শহর থেকে ভাগতে হবে। আমি অন্য কোথাও মুরগীর খামার করব, অথবা অন্য কোন ব্যাবসা করব।”
কোথায় যাবে মনে মনে সেটাও ঠিক করে রেখেছে আরিফ। ছোট মামা রংপুরে থাকে। তার বাসায় থেকে মুরগীর খামার করা যাবে। মামার বাড়ির পিছন দিকে একটা পুরানো চালাঘর আছে। চুলা জ্বালাবার খড়ি গাদা করে রাখা হয় সেখানে। মামাকে বলে ঘরটা নেয়া যাবে খামার করার জন্যে। এক দৃষ্টিতে আরিফের দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল স্বপ্না। আরিফ আর যাই হোক অসৎ ছিল না কোন দিন। অভাবে তাহলে সত্যি স্বভাব নষ্ট হয়।
“তুই কি পাগল হইছিস?” ভাংগা গলায় বলল স্বপ্না। “ওরা বিশ্বাস করে তোকে টাকাগুলা দিসে।” আরিফের হাত দুটা শক্ত করে ধরল স্বপ্না। “এইটা করিস না সোনা, প্লিস, এইটা করিস না।”
স্বপ্নার কথায় আরিফের বুকের ভিতরের আগুনটা আবার জ্বলে উঠল। টাকা ছাড়া কারো কোন দাম নাই এই দুনিয়াতে। টাকা আছে তো সব আছে। ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল আরিফ। তার কন্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ল, “তো কি করব?”
কিছু বলল না স্বপ্না। এক দৃষ্টিতে নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থাকল। আরিফকে তার কিছু বলবার নেই। কি শান্তনা দেবে সে ছেলেটাকে। আরিফ তো তার সাধ্য মত করেছে। কিন্তু তাই বলে..
চিন্তার সুতো কেটে যায় স্বপ্নার। ঘরময় এতক্ষন এলোমেলো পায়চারী করছিল আরিফ। অসহায় ভাবে নিজের মাথাটা চেপে ধরে বলল, “স্বপ্না, আব্বাকে আমি কখনও এতটা ...”
কথাটা শেষ করল না আরিফ। স্বপ্নার মনে হল ছেলেটা একটু ভাল করে কাঁদছে না কেন? কাঁদলে হয়ত কষ্টটা কিছুটা কমতো। আরিফের অসহায়ত্ব এবার স্বপ্নাকেও ভর করল। নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ব ছিল তার, যে কোন সময় যে কারো মন সে ভালো করে দিতে পারে।
আজ আর পারল না স্বপ্না, তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ থেকে সে কান্নাটাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছিল। চোখের পানিটা মুছে ফেলতে গিয়েও মুছল না স্বপ্না। আরিফের আর নুতন করে কষ্ট বাড়বার কিছু নেই। ছেলেটা একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁচেছে। এর আগে কখনও আরিফকে তার বাবাকে নিয়ে ভাবতে দেখেনি স্বপ্না। সারাক্ষণই তো শুধু অভিযোগ তার বাবাকে নিয়ে। এক টুকরো ম্লান হাসি ফুটে স্বপ্নার ঠোঁটে। আর কিছু না হোক বাপ ছেলের মাঝে দুরত্ব তো কমেছে।
স্বপ্নার সামনে মাটিতে হাঁটু মুড়ে দাঁড়াল আরিফ। তার হাত দুটো ধরল। চোখে মুখে বেপরোয়া আকুতি, “স্বপ্না আর কত?”
স্বপ্নার অশ্রুগুলো আরেকবার চোখের সীমানা টপকাল। হ্যাঁ, আর কত? একটা হাত ছাড়িয়ে নিল সে। চোখ মুছল। আরিফের চেহারা থেকে বেপরোয়া ভাবটুকু হারিয়ে গেল, আকুতিটা যেন আরো জেঁকে বসল চোখে মুখে। স্বপ্নার অন্য হাতটাও ছেড়ে দিল সে। বসে পড়ে নিজের পায়ের উপর। ভাংগা গলায় বলল,
“চেষ্টা তো করলাম।... আমি একটা সংসার চাই.... একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন।”
আরিফের সাথে তার জীবনটা এক সুতোয় বাঁধা। নিজের বুকের মাঝে দুঃখগুলোকে চেপে রেখে অন্যের দুঃখের দায় ভার নেবার শক্তি সবার থাকে না। স্বপ্না জানে না সে কতদূর পর্যন্ত টানতে পারবে। তবে কতটুকু টানতে পারবে না সে সর্ম্পকে তার স্পষ্ট ধারনা বরাবরই আছে। আরিফের গালে আলতো করে হাত বুলালো স্বপ্না। চোখের দিকে তাকাল। স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
“অন্যের বিশ্বাস নষ্ট করে তুই নিজের জীবন গড়তে চাইস?”
“হ্যাঁ চাই।” উঠে দাঁড়াল আরিফ। “আগে চাইতাম না। এখন চাই।”
“পারবি ভাল থাকতে?” কন্ঠটা ধরে আসে স্বপ্নার। এখনও সে আরিফের চোখের দিকে তাকিয়ে। “পরে যখন প্রশ্ন উঠবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি?”
চোখ সরিয়ে নিল আরিফ। স্বপ্নার প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছা করছে না।
“আমি পারব না।” স্বপ্নার কন্ঠের দৃঢ়তাটুকু কাঁপিয়ে দিল আরিফকে। উঠে দাঁড়ালো স্বপ্না। চলে যেতে ইচ্ছা করছে না তার। কিন্তু যেতে হবে। অনেক কমতি নিয়ে যে সহজ সরল আরিফকে সে ভালবেসেছিল এই আরিফ সেই আরিফ নয়। আর নুতন চালাক চতুর এই আরিফকে মেনে নেয়ার সামর্থ্য তার নাই। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল স্বপ্না। অসহায় ভাবে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল আরিফ। বুকের মাঝে একটা অসহায় ক্রোধ দাঁনা পাকাতে লাগল।
স্বপ্নার জন্যে ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে আসছিল বীথি। স্বপ্না কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা উঠোন পেরিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল দেখে চুপ করে আরিফের ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল বীথি। ঘরের ভিতর আরিফের টেবিল উল্টিয়ে দেয়ার শব্দটা বুকের মধ্যে এসে বিঁধল বীথির। তবে কান্না পেল না তার। সে ঠিক করেছে আর কাঁদবে না কখনও।
বারান্দার ধারে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল দুলাল। শব্দ শুনে আরিফের ঘরের দিকে তাকাল ছেলেটা। কিছু বুঝতে না পেরে শেষে বীথির দিকে তাকালো। মৃদু হাসল বীথি। হাত নেড়ে তাকে কাছে ডাকল। কাছে আসতে বিস্কুট ভরা প্লেটটা দুলালের হাতে তুলে দিল বীথি। উৎফুল্ল হল দুলাল। ছেলেটার মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে ঘরে চলে গেল বীথি। অবাক হল দুলাল। এতগুলা বিস্কুট তাকে কেন দেয়া হল বুঝল না সে। অবশ্য বীথিও জানে না কেন সে এমনটা করল। এখন আর সব কিছুর কারণ জানতেও ইচ্ছা করে না। বারান্দায় বসে বিস্কুটগুলো খেতে লাগল দুলাল।
দুলালের অবাক হওয়া তখনও বাকি ছিল। বিকালে তাকে নিয়ে কাদের ভাইয়ের হোটেলে গেল আরিফ। সারাটা দুপুর স্বপ্নাকে মনে মনে অনেক গালি দিয়েছে আরিফ। মেয়েটার জন্যে তার আর উপরে ওঠা হল না। কত মানুষই তো এদিক ওদিক করে বড় হয়ে যায়। তাহলে সে নয় কেন? স্বপ্নার মত মানুষগুলার জন্যে আরিফদের এত কষ্ট। কাল তো আবার তুইই বলবি বেকারের ঘর করব না আমি। শালার এই মেয়েগুলা....
তেতো মুখে ঘরের মাঝে একা একা অনেকক্ষণ বসে ছিল আরিফ। ধীরে ধীরে এক সময় তার মনে হল আসলে সবাই সব কিছু পারে না। স্বপ্না নয়ত আব্বা, তা নাহলে বীথি কিংবা নয়ন কারো না কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কাজটা শেষ পর্যন্ত করতে পারত না সে। অপরাধ করতে সাহস লাগে। সে অতটা সাহসী নয়। সে হল ছা-পোষা সংসারের ছ-পোষা একটা মানুষ। অতি সাধারণ। প্রতিদিন অভাবের মধ্যে দিন কাটাবার জন্যেই তার জন্ম হয়েছে। সুতরাং লড়াই করে কি লাভ। প্রজাপতি তো তাকে ধরা দেবে না। মাঝখান থেকে মানুষের কাছে খারাপ হয়ে লাভটা কি?
কাদের ভাইয়ের দিকে টাকার প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরল আরিফ। কিছু বলল না। কি বলবে। সবই তো জানে কাদের ভাই। টাকাটা হতে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকল কাদের ভাই। সাগর ঠোঁট কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে সে লাবু ভাইকে শায়েস্তা করার একটা করে পরিকল্পনা করছে আর বাতিল করছে। মীমও রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে এই প্রথম সে রিকশা দেখেছে, রিকশায় চড়া মেয়ে নয়।
আরিফের পিঠে হাত রাখল নয়ন। ঘুরে তাকিয়ে হাসল আরিফ। তারপর হাঁটা শুরু করল। দুলাল তার পিছে পিছে আসছে দেখে দাঁড়ালো আরিফ। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মনটা আবার বিদ্রোহ করতে চাইল তার। কি করে সে ছেলেটাকে বলবে যে সে আর নিয়োগদাতা নয়। দুলালকে বুকে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করল আরিফের। কিন্তু করল না। মায়া বাড়িয়ে কি লাভ। ছেলেটাকে তো আবার রাস্তাতেই ফিরে যেতে হবে। দুলালের বুকে হাত দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল আরিফ। তারপর আর কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে লাগল। তাকে দ্রুত পালাতে হবে এখান থেকে।
দিশেহারা ভাবে নয়নের দিকে তাকালো দুলাল। গতবছর তার বাবা এক সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তার জন্যে একটা নুতন গেঞ্জি আনবে বলেছিল। আজ পর্যন্ত আসেনি। মা তাকে রাস্তায় দঁড়িয়ে ভিক্ষা করা শিখিয়েছিল। স্যার তো বলছি কাজ করলে খাইতে দিবে। সে তো সব কাজ ঠিক মতই করেছে। তাহলে? কোন কাজে ভুল হলে সে আবার করবে। আর লাফালাফি করবে না কোনদিন। সব কাজ ঠিক মত করবে। আরিফ অনেকটা দূরে চলে গেছে। ধীরে ধীরে আরো দূরে যাচ্ছে। সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার নয়নের দিকে তাকালো দুলাল।
নয়ন ভাবছে আল্লাহর এক দুয়ার বন্ধ হলে নাকি হাজার দুয়ার খোলে? কোথায় সেই খোলা দুয়ারটা?
ঘর অন্ধকার করে টেবিলে মাথা রেখে বসে ছিল আরিফ। অনুভুতিহীন নিঃস্ব একজন মানুষ। হঠাৎ ঘরের লাইট জ্বলে উঠল। চোখ পিটপিট করে তাকালো আরিফ। ফারুক আর নয়ন সবার সামনে দাঁড়িয়ে। তাদের পিছনে ঝন্টু, শফিক আর দুলাল।
“আরিফ ভাই।” ডাকল ফারুক।
শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো আরিফ। তাদের টাকা তো সে দিয়ে দিয়েছে। তাহলে কেন এসেছে এরা। দুলাল এগিয়ে এল।
“স্যার, আমি কি আবার ভিক্ষা করব?” সহজ সরল একটা প্রশ্ন। কিন্তু বুকের ভেতরটা গুঁড়িয়ে দিল আরিফের। জড়িয়ে ধরল সে বাচ্চা ছেলেটাকে।
“আমি জানি না।” বলল আরিফ।
“আরিফ ভাই এত হতাশ হচ্ছেন ক্যান?” ফারুক বলল। “আমাদের কাছে তো এখনও ৩০ হাজার টাকা আছে।”
মাথা নিচু করল আরিফ। ঐ টাকাটা সে মেরে দিতে চেয়েছিল। মৃদু কন্ঠে বলল, “ঐটা তো তোমাদের টাকা।”
“আরিফ ভাই,” ঝন্টু বলল, “আমাদের টাকা আর আপনার জায়গা, আপনার বুদ্ধি। চলেন ব্যবসাটা শুরু করি।”
মাথা তুলল আরিফ। একটা প্রজাপতি যেন তার একেবারে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। সে ভেবেছিল প্রজাপতিরা বোধ হয় তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
“গরীব তো এমনিতেই আছি।” শফিক বলল। “না হয় আরো কয়েকদিন থাকলাম। একদিন না একদিন তো ব্যবসা বড় হবে।”
ভয় হল আরিফের। প্রজাপতিগুলো খুব বদমাশ। কখনও এক জায়গায় স্থির হয় না। এটা আবার পালিয়ে যাবে না তো? ফারুক এসে আরিফের একটা হাত ধরল।
“আরিফ ভাই,” ধীর স্থির বলল ফারুক। “না বলিয়েন না। এক সাথে কাজ করার একটা চিন্তা ভাবনা যখন করছি তখন আর... আমরা আপনার সাথেই ব্যবসা করব আরিফ ভাই।”
ফারুককে কখনও এতটা ধীর স্থির দেখেনি আরিফ। অবাক হল সে। নয়ন এসে আরিফের পিঠে একটা হাত রাখল। চোখে পানি চলে এল অরিফের। উপর নিচে মাথা ঝাঁকালো আরিফ। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল ফারুকরা। সবাই মিলে তখনই উঠোনে নেমে গেল। কালই মুরগীর বাচ্চা কিনে আনা হবে। তাই আজকের মধ্যেই সব কিছু ঠিক করে ফেলতে হবে। আব্বা আর বীথি শব্দ শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এই প্রথম বারের মত আব্বার মনে হল, হ্যাঁ এবার রিটায়ার্ড করা যায়। বীথি এসে আরিফের পাশে দাঁড়ালো। সেও কাজ করবে। বুক ভরে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল আরিফ। আর মাত্র কটা দিন। এই উঠানে বসে সে স্বপ্নার সাথে প্রজাপতিদের উড়ে চলা দেখবে।
(সমাপ্ত)