somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ইহতিশাম আহমদ
একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে ক্যামেরাপারসন হিসাবে চাকুরীরত। ত্রিকোন চলচ্চিত্র শিক্ষালয় নামে একটি ফিল্ম স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রশিক্ষক। গল্প, কবিতা লেখা ও অভিনয়ের অভ্যাস রয়েছে।

প্রজাপতি স্বপ্নেরা (পর্ব ৫)

১৪ ই জুন, ২০১১ বিকাল ৫:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪)



“তুই আসলে আমার কাছে ঠিক কি চাচ্ছিস?”
অধৈর্য্য কন্ঠে জানতে চাইল লাবু ভাই।
আরিফ আর নয়ন অনেক সকালেই লাবু ভাইয়ের বাসায় এসেছে। তবে তার সাথে কথা বলার সুযোগ মিলল প্রায় ঘন্টা দেড়েক বসে থাকবার পর। সকাল বেলা লাবু ভাইয়ের দরবার যে এতটা ভরপুর থাকে তা জানা ছিল না তাদের। এর এই সমস্যা, তার সেখানে প্রমোশন। এর বলে বউয়ের সাথে বনে না। তার নাকি মেয়ে কোন ছেলের সাথে ভেগে গেছে, এখন থানা পুলিশ চলছে। এসব আচার বিচার দেখতে দেখতে আরিফের মোটামোটি ধারণা হয়ে গেল বোধ হয় এবার তার কিছু একটা হয়ে যাবে।
সবাইকে এক এক করে বিদায় দিয়ে আরিফদের সাথে যখন কথা শুরু করল লাবু ভাই তখনও তার সকালের নাস্তা করা হয়নি। নাস্তা করবার আগে প্রত্যেকদিন গোছলটা সেরে নেয় সে। তারপর নাস্তা শেষে বাইরে বেরিয়ে যায়। আজ এখনও গোছলটাই করা হল না। তাই কিছুটা অস্থির লাবু ভাই। তাছাড়া ঠিক বুঝতেও পারছে না আরিফ আসলে তার কাছে কি চাচ্ছে।
“ক্যান?” অবাক হল আরিফ। “কালকে আপনিই তো বললেন গরু ছাগল আর হাঁস মুরগীর সাথে উঠা বসা করতে।”
“তো কর।” লাবু ভাইয়ের বিরক্তি আরো বেড়ে গেল। “মানা করছে কে?”
“কি ভাবে করব?” রাগ হল আরিফের। একটু আগের আশাবাদী ভাবটা তার উধাও হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
“ও তুই আমার কাছে ইনফরমেশনের জন্যে আসছিস।” এবার যেন বুঝতে পেরেছে লাবু ভাই। দায়সারা ভাবে বলল,
“এক কাজ কর, সোজা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর অফিসে চলে যা। সব একেবারে ডিটেল জানতে পারবি। যা।”
লাবু ভাই উঠছে দেখে ধৈর্য হারালো আরিফ। এখন মনে হচ্ছে অযথাই এসেছে এখানে।
“যুব উন্নয়ন অফিসে গেলে যে সব জানা যাবে সেটা আমি জানি।” ঝাঁঝের সাথে বলল আরিফ। “টিভিতে প্রায়ই এই সব নিয়ে অনুষ্ঠান দেখায়।”
এবার সত্যি সত্যি রেগে যায় লাবু ভাই। ছেলেটা চাচ্ছেটা কি তার কাছে?
“তাইলে আমার কাছে আসছিস ক্যান?”
আরিফ আর ধরে রাখতে পারে না নিজেকে। হঠাৎ আভিমানে বুকটা ভরে যায়। কত মানুষের কত কিছু হচ্ছে। তারা সবাই-ই কি তার চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে,
“আপনি আমাদের পাড়ার জনদরদী নেতা, এই জন্যে আসছি।” উঠে দাঁড়ায় আরিফ। “স্লামালেকুম।”
নয়ন উঠবে কিনা ভাবছে। আরিফ ততক্ষণে দরজার দিকে ঘুরেছে। ধমকে ওঠে লাবু ভাই।
“এ্যাই, যাচ্ছিস কোথায় শুন, শুন এদিকে।”
দাঁড়ায় আরিফ। লাবু ভাই স্নেহের হাসি হাসে। গোছলের আশা বাদ দিয়েছে লাবু ভাই। ঢেঁকি নাকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। একজন নেতার বোধহয় ব্যাক্তিগত জীবন থাকতে নেই। মানুষের অভাব অভিযোগকে অস্বীকার করে কখনও নেতা হওয়া যায় না। রাজনীতিতে প্রথমে দেশ জাতি জনতা, তারপর দল, তারপর ব্যাক্তি জীবন। হঠাৎ একটা আত্ম প্রসাদ অনুভব করল লাবু ভাই। যে যাই বলুক একজন ভাল রাজনীতিবিদের সবগুলো গুণই সে অর্জন করতে পেরেছে। আত্ম প্রসাদের সাথে সাথে একটা কষ্ট বোধও বুকের মাঝে জেগে উঠল। এই যে না খেয়ে সে জনগনের সেবা করে যাচ্ছে, তারপরও তো মানুষের মন ভরে না। লোকে যদি বুঝত রাজনীতিবিদদের কত কষ্ট করতে হয়।
“এমন এক চড় মারব না।” লাবু ভাই এখন স্নেহময় পিতা। “বদমাইশ হয়ে গেছিস তোরা সব একেবারে। বস এখানে।”
গোঁয়ারের মত দাঁড়িয়ে থাকল আরিফ। নয়ন হাত ধরে টেনে বসাল।
“লাবু ভাই আর ভাল্লাগে না।” প্রায় ডুকরে উঠল আরিফ। অনেক দিন সে বাবার স্নেহ পায় না। “চাকরীর চেষ্টা তো কম করলাম না। আব্বার চাকরী শেষ। বীথি একা একা সংসারটা সামলায়। মা তো কবেই মরছে। এই বয়সে মানুষের কত আব্দার থাকে। আর বিথীকে প্রতিদিন তেল নুন সাবানের হিসাব করতে হয়। আব্বার বকাবকিতে যত না কষ্ট হয় তার চেয়ে....”
নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে আরিফ। তার মনের এই দিকটার খোঁজ কেউ করে না। কে জানে মা থাকলে হয়তবা করত। মাকে তার তেমন করে মনে পড়ে না। এত কিছুর মাঝে সময় কোথায় মনে করবার। আর আব্বা তো আছে তার মত করে।
“নিজেকে বড় অর্থব মনে হয় লাবু ভাই।” মাটির দিকে তাকিয়ে বলল আরিফ। “বীথি মেয়ে হয়ে সংসারের জন্যে যতটুকু করে আমি বাড়ির বড় ছেলে হয়েও তার কিছুই করতে পারি না।”
আরিফের পিঠে একটা হাত রাখে নয়ন। ছেলেটার এখন খানিকটা আশ্রয় দরকার। খারাপ লাগে নয়নের। তার নিজেরই কোন আশ্রয় নেই। আরিফকে কি দেবে। এক মুহূর্তের জন্যে ঘরের সবাই চুপ হয়ে যায়।
“তোর কষ্টটা আমি বুঝি রে আরিফ।” উদাস কন্ঠে বলল লাবু ভাই। হয়ত তার নিজের কোন কষ্টের কথা মনে পড়েছে। আম জনাতার মত জীবনের সংগ্রাম তো তাকেও করতে হয়েছে এক সময়।
“কি করবি বল,” লাবু ভাই এখনও উদাস। “তোরা এমন এক সময় জন্মাইছিস...”
ঝট করে তাকাল নয়ন লাবু ভাইয়ের দিকে। বলল,
“সময়কে তো আপনারাই তৈরী করছেন লাবু ভাই।”
আবারও লাবু ভাই শুধুই রাজনীতিবিদ। একবার রাজনীতিতে নাম লেখালে সে বোধ হয় চাইলেও আর কখনওই সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়াতে পারে না। আম জনতা তাকে গ্রহণ করে না। মুখটা তেতো হয়ে গেল লাবু ভাইয়ের।
“তুই বড় বেশী কথা বলিস নয়ন।”
“ভুল কি বললাম?” এক ধমকে থেমে যাওয়ার পাত্র নয় নয়ন। সমান তেজে পাল্টা আক্রমণ চালালো সে। “আপনারা ওপেনাররা ঠিক মত ব্যাডিং করবেন না, আর এখন ম্যাচ হাত ছাড়া হয়ে গেলে দোষ মিডিল অর্ডার ব্যাডসম্যানদের।”
অস্থিতে পড়ে যায় লাবু ভাই। ছেলেটা সব সময় এত বেশী সত্য কথা বলে...
“আমাদের সময়কে,” অন্য কৌশল ধরে লাবু ভাই। “আমরা কেমন করে ব্যবহার করছি তা ঠিক জানি না..”
“স্বীকার করতে চাচ্ছেন না?” নয়ন এখনও লড়াকু মেজাজে। আরিফর চোখ দুটোও এবার নয়নের সাথে যোগ দেয়। দুই জনের তীব্র দৃষ্টির সামনে টিকতে পারে না লাবু ভাই। চোখ নামিয়ে নেয়। মৃদু কন্ঠে বলে,
“হয়ত... হয়ত সত্যিই স্বীকার করতে চাচ্ছি না। কিন্তু তোদের সময়কে তোরা নষ্ট করতেছিস ক্যান?”
শেষ চেষ্টা করল লাবু ভাই। আরিফ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
“বুঝলাম না।”
“তুই এতদিন,” নিজের অবস্থান ফিরিয়ে আনার জন্যে লাবু ভাই ধমকের সুরে বলল, “বেকার বসে না থেকে এই গরু ছাগল লালন পালনের সিদ্ধান্তটা তো আরো আগেই নিতে পারতিস।”
উত্তর দিতে পারল না আরিফ। হাত বাড়িয়ে তাকে থামালো নয়ন।
“উত্তরটা আমি দেয় লাবু ভাই?” নয়ন বলল “রাগ করবেন না তো?”
নিশ্চয় আবার নুতন কোন প্যাঁচ। এই ছেলেটার দু গালে যদি দুটো চড় মারা যেত। রাজনীতিবিদ হবার জন্যে এখন আর আত্মতৃপ্তি অনুভব করছে না লাবু ভাই। বিরক্ত কন্ঠে বলল,
“তোকে নিয়ে আর পারা গেল না।”
এতদিন ধরে মানুষ চরিয়ে এখন দুটো বাচ্চা ছেলের কাছে হেরে যাবে? নড়ে চড়ে বসল লাবু ভাই।
“আচ্ছা, ঠিক আছে রাগ করব না। বল।”
হঠাৎ নয়নের চোখে মুখে কৌতুক খেলে গেল। তবে তার কথা শুরু করা হল না। লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ লোক ঘরে ঢুকল।
“স্লামালেকুম স্যার।”
“কি খবর?” আগ্রহ নিয়ে তাকালো লাবু ভাই।
“স্যার,” জড়সড় ভঙ্গি বৃদ্ধের, “পরশু দিন তারিখ পড়ছে।”
“পরশুদিন।” আনমনে কিছুক্ষণ ভাবল লাবু ভাই।
আরিফের দিকে তাকালো নয়ন। চোখে প্রশ্ন, কিসের তারিখ? কাঁঝ ঝাঁকালো আরিফ। জানে না সে।
“আচ্ছা ঠিক আছে, বাইরে বসেন।” বলল লাবু ভাই, “এদের সাথে কথা শেষ করে নেই। আমি যাব আজকে আপনার সাথে। আমি নিজে উকিলের সাথে কথা বলব।”
ও, উকিল। মানে মামলা মোকদ্দমা। আগ্রহ হারিয়ে ফেলল আরিফরা।
“আচ্ছা।” বাধ্য ছেলের মত মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল বৃদ্ধ।
“সরল সোজা মানুষ।” লাবু ভাই এখনও ভাবছে। “ছেলেকে নিয়ে বড় বিপদে পড়ছে। আমার গ্রামের লোক। ...হ্যাঁ নয়ন, তুই কি যেন বলতেছিলি?”
নয়ন ভেবেছিল লাবু ভাই আর আগের প্রসংগে যাবে না। মিট মিট করে হাসতে লাগল সে। ভাবখানা যেন এখনও আপনার চান্স আছে আমাকে ওয়াক ওভার দেয়ার।
“বলব? সত্যি রাগ করবেন না তো?”
লাবু ভাইও হাসল। কি আর বলবে নয়ন। দেখা যাক কত ধানে কত চাল?
“বল না রে বাবা, বল। আমি রাগ করব না, বললাম তো।” অভয় দিলেও নিজের অপছন্দটুকু জানাতে ভুলল না লাবু ভাই। “তুই আর মিম, তোরা দুই জনেই বড় ত্যাড়াং ত্যাড়াং কথা বলিস। তবে আমি এতে কিছু মনে করি না। অনেকেই এটাকে বেয়াদবী মনে করে।”
লাবু ভাই এবার উদার। “কি করব বল? আমি তো তোদের অবস্থাটা বুঝি। এটা আসলে ঠিক তোদের দোষ না। তুই বল। কি বলবি নির্দ্বিধায় বল।”
“লাবু ভাই ধরেন,” শুরু করল নয়ন। “আজকে আমি গরু মোটাতাজা করণ কর্মসূচি পালন করে বিড়াট বড়লোক হয়ে গেলাম।”
এক মুর্হূত থামে নয়ন। ওভার ডোজ হয়ে যাবে না তো? ..যাক, যা আছে কপালে। আল্লাহ ভরসা।
“এখন আমার মত একটা গরুওয়ালার সাথে আপনি ছোট মেয়ের বিয়ে দিবেন?”
“এ্যাই, কি বলিস?” আঁতকে উঠে আরিফ।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় লাবু ভাই। এক একটা ইবলিস এই ছেলেগুলো। কত্তো বড় সাহস তার মেয়েকে নিয়ে কথা বলে। অবশ্য নিজেই তো সুযোগটা করে দিয়েছে। বিব্রত ভাবে হাসতে চেষ্টা করে লাবু ভাই।
“তোরা ছেলেগুলা এত বদমাইশ হই গেছিস...”
“লাবু ভাই,” নয়ন আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুলে হাসে। “আপনি কিন্তু রাগ করবেন না বলছিলেন।”
“না, আমি রাগ করি নাই।” অস্বস্থি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করে লাবু ভাই। “তুই কথাটা ঠিকই বলছিস। এই কিছুদিন আগেও মানুষ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জামাই খুঁজত। এখন অবশ্য মানুষ আর র্নিদিষ্ট করে এরকম কিছু খুঁজে না...”
“তারপরও,” আরিফ বলল, “গরু ছাগলওয়ালাকে মানুষ এখনও ভাল চোখে দেখে না, লাবু ভাই। রোজগার যতই হোক।”
“প্রশ্নটা আসলে রোজগারের না লাবু ভাই।” বিজয়ী ভঙ্গি নয়নের। “প্রশ্নটা স্ট্যাটাসের।”
কথাগুলো বলে আয়েশী ভঙ্গিতে বসল নয়ন। তার যেন আর কিছু বলবার নেই।
“তো, এর পরিবর্তন নিয়ে আয় তোরা।” ধমকের সুরে বলল লাবু ভাই। নেতা সুলভ মেজাজটা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে তার মধ্যে। “আমাদের সময় আমরা কি করছি না করছি সেইটা নিয়ে মাথা না ঘামায় তোদের সময়টাকে তোরা নিজেদের মত করে সাজায় নে।”
“একাই?” ঝট করে আয়েশী ভঙ্গিটা উধাও হয়ে গেল নয়নের মাঝ থেকে।
থমকায় লাবু ভাই। ছেলেটা কি বেয়াদবী করার জন্যেই এমনটা করছে। নাকি এগুলো তার সুতীব্র উপলদ্ধি যা সে চেপে রাখতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাবু ভাই। হয়ত যৌবনের জোশ। মৃদু কন্ঠে বলল,
“না একা কেন হবি?... আমরা বুড়া মানুষগুলা আছি তো তোদের পিছনে।”
উত্তরে সন্তুষ্ট হয় না নয়ন। খোঁচা দেয়ার ভঙ্গিতে বলে,
“সাহায্য করার জন্যে? না উপহাস করার জন্যে?”
নাহ, আর সহ্য করা যায় না। খেঁকিয়ে ওঠে লাবু ভাই।
“তোরা বড় বেশী কথা বলিস রে? যা তো এখন যা।” উঠে দাঁড়ায় লাবু ভাই। “আমাকে বের হইতে হবে। বাইরে লোক দাঁড়ায় আছে। অনেক বেলা হয়ে গেল, তোদের যন্ত্রনায় এখন পর্যন্ত গোছলটা করতে পারলাম না।”
আরিফরাও দাঁড়ায়।
“ফাইনাল কথা তো কিছু বললেন না।” বিভ্রান্ত বোধ করে আরিফ।
লাবু ভাইয়ের চেহারায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি ভাব।
“ঠিক আছে আমি তোকে ট্রেনিং সেন্টারে ঢুকায় দিব।” বলল লাবু ভাই। “ট্রেনিং শেষ করে তো ওরা তোকে ব্যাবসা করার জন্যে পয়সা দিচ্ছেই, ব্যাস। খালি যে পয়সাটা সরকার তোকে দিবে ঐটা নষ্ট করিস না। কাজে লাগাইস।”
“সেইটা করব না।” আরিফের কন্ঠে দৃঢ়তা। “আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।”
আরিফ লাবু ভাইয়কে নিশ্চিত করলেও লাবু ভাইয়ের বলার ভঙ্গিতে সে নিজে ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তাই বোকার মত আবার বলে,
“তাইলে লাবু ভাই আমি আজকে আর যুব উন্নয়ন অফিসে যাচ্ছি না?”
“তুই বাড়ি যা।” দুই বন্ধুকে দরজার দিকে ঠেলতে শুরু করে লাবু ভাই। “যা করার আমি করব। যা ভাগ এখন, যা ভাগ।”
“স্লামালেকুম লাবু ভাই।”
নয়নের সালমের উত্তর দেবার সময় নেই লাবু ভাইয়ের। দরজার বাইরে বেঞ্চে বসে থাকা বৃদ্ধকে হাতের ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল লাবু ভাই।



“তুই?”
অফিসের গেটের বাইরে আরিফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল স্বপ্না। ট্রেনিং চলছে স্বপ্নাদের। কিভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হবে, ফিল্ড ওয়ার্কারদের দায়িত্ব কি, প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরের কাজ কি এই সব গুলিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে রোজ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরিফের কাছে আসল স্বপ্না।
“হ্যাঁ।” হালকা চালে বলল আরিফ। “তোকে দেখতে আসলাম?”
আরিফের মেজাজ যে আজকে ভাল সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হাসল স্বপ্না।
“তাই?”
পাশাপাশি হাঁটতে থাকে তারা দুজনে। চুপচাপ। ইতস্ততঃ করে আরিফ। কিভাবে শুরু করবে কথাটা। স্বপ্না ব্যাপারটা ভাল ভাবে নাও নিতে পারে। শেষে সরাসরি বলার সিদ্ধান্ত নিল আরিফ।
“আমি একটা ডিসিশন নিলাম।”
নাহ। কথাটা পুরোপুরি সরাসরি হল না।
“কি?”
আরিফের দিকে তাকাল স্বপ্না। চোখাচোখি হল দুজনের। স্বপ্নার চেহারাটা বোধ হয় পাল্টেছে আগের থেকে। কেমন যেন একটা সুখী সুখী ভাব এসেছে। হয়ত চাকরীটার জন্যে। ভাবল আরিফ। চোখ নামিয়ে নিল। আমারও শুরু হচ্ছে, দাঁড়া। আত্ম প্রত্যয়ী কন্ঠে বলল,
“আমি আর চাকরী খুঁজব না।”
আরিফের আত্ম প্রত্যয়টা ঠিক ধরতে পারেনি স্বপ্না। তাই দরদী কন্ঠে আরিফকে বোঝাতে চেষ্টা করে।
“আরিফ, এত হতাশ হচ্ছিস...”
দ্রুত ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকায় আরিফ। মেয়েটা কি গাধা নাকি? আমার চেহারায় কোথাও কি হতাশা আছে?
“আমি ব্যবসা করব।” ছোট্ট করে বলল আরিফ।
হ্যাঁ, এবার সরাসরি হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে এক মুর্হূত ভাবল স্বপ্না।
“টাকা?” স্বপ্নার প্রশ্ন।
“সেটার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
এখন পর্যন্ত কথাবার্তা সব ঠিক ঠাক চলছে। তবু অস্থিরতা কমছে না আরিফের। পা দিয়ে একটা ছোট ইটের টুকরোকে লাথি মারে আরিফ। গড়াতে গড়াতে সামনে এগিয়ে যায় ইটটা। স্বপ্না আর বেশী মাথা ঘামায় না বিষয়টা নিয়ে।
“ও কে।” মাথা ঝাঁকায় স্বপ্না। “কিসের ব্যাবসা?”
নির্দোষ প্রশ্ন। কিন্তু আরিফের অস্বস্থিটুকু বেড়ে যায়। স্বপ্নার দিকে তাকায় এক পলক। তারপর দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।
“গরু কিনব। মোটাতাজা করব। বিক্রি করব।”
হঠাৎ আরিফ তড়বড় করে বলে ওঠে,
“কাজটা তোর পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু কাজটা আমি করব।”
মুখ শক্ত করে এক মুর্হূত চুপ করে থাকে স্বপ্নার প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্যে। স্বপ্না ঠিক বুঝতে পারছে না। ছেলেটা এমন করছে কেন? চোখ সরু করে তাকায় সে আরিফের দিকে। মন খারাপ হয়ে যায় আরিফের। যা ভেবেছিল তাই। স্বপ্না তার কাজটা পছন্দ করছে না। মৃদু কন্ঠে বলল,
“তুই ইচ্ছা করলে আমার সাথে সর্ম্পক নষ্ট করতে ....”
থমকে দাঁড়াল স্বপ্না। হতভম্ব সে। কি, বলে কি ছাগলটা। চেঁচিয়ে উঠল,
“এ্যাই?! তোর সাথে আমি সর্ম্পক নষ্ট করব কেন? আশ্চর্য?”
আরিফ অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে স্বপ্নার সামনে। মেয়েটা ক্ষেপেছে। তার চোখের দিকে এই মুহূর্তে তাকানোর সাহস নেই আরিফের। তাই মাথা নিচু করে থাকল। রাগটাকে সামলাতে সময় লাগে স্বপ্নার। হাঁপাতে থাকে। হিস হিস করে বলল,
“হ্যাঁ, আমি চাইতাম তুই বড় কোন চাকরী কর। কিন্তু তাই বলে তুই গরু নিয়ে ব্যাবসা করবি বলে আমি তোকে ছেড়ে চলে যাব?!
মনটা ভাল হয়ে গেল আরিফের। তাহলে নয়ন আর লাবু ভাইয়ের সাথে যে আলাপগুলো হচ্ছিল তা সবার ক্ষেত্রে খাটে না। অন্ততঃ স্বপ্নার ক্ষেত্রে তো খাটেই না। নাচতে ইচ্ছা করল আরিফের। চোখ তুলে তাকালো মেয়েটার দিকে। স্বপ্নার রাগ তখনও কমেনি। দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
“আরিফ তোকে ছাড়তে চাইলে আমি অনেক আগেই ছাড়তে পারতাম।”
হুম। মেয়েটাকে বেশী কষ্ট দেয়া হয়ে গেছে। উচিৎ হয়নি। কি আর করা। কৈফিয়ৎ দেবার চেষ্টা করল আরিফ।
“তোর আব্বা আমার সাথে তোর বিয়ে দিতে রাজী হবে না।”
“সেটা আমি বুঝব।” ধমকে ওঠে স্বপ্না।
“ও কে।”
হাল ছেড়ে দেয় আরিফ। তবে এই পরাজয়েও আনন্দ আছে। নিজেকে হালকা লাগে তার। পাশ দিয়ে একটা রিকশা এগিয়ে যায়। সেটাতে তাদের ট্রেইনারকে বসে থাকতে দেখে নিজেকে সামলায় স্বপ্না।
“স্লামালেকুম ভাইয়া।”
মাথা ঝাঁকায় ট্রেইনার। আরিফের দিকে তাকায় একবার। রিকশা তাদের ছেড়ে এগিয়ে যায়। রাগ পড়ে যাওয়ার পর গোটা ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে স্বপ্নার। আরিফ তাহলে কিছু একটা করবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে নিজের মাঝে একটা রিনরিনে অনুভুতি খেলা করতে শুরু করল স্বপ্নার। আবার অভিমানও হল। আরিফ তাকে ছেড়ে যাবার কথা বলল কেন? অবশ্য গাধাটা তো এই রকমই। কখন কি বলে তার ঠিক নাই। গাধা, রাম গাধা। কিচ্ছু ঠিক মত পারে না।
“তোর আব্বা জানে তোর ডিসিশনটার কথা?” স্বপ্না এখন আরিফের মুরুব্বী।
“না।” বিরক্ত মুখে হাঁটতে শুরু করে আরিফ।
“তোর এই স্বভাবটাই আমার ভাল লাগে না।” আবার ধমকে ওঠে স্বপ্না। “কেন বলিস নাই চাচাকে?”
“আব্বাকে বললে আব্বা এইটা নিয়েই খালি বকবক করতে থাকবে।” আরিফও রাগ দেখায়।
“একটু না হয় করল বকবক।” কতৃর্ত্বের সুর স্বপ্নার কন্ঠে। “এক্ষুণি বাসায় যায় বলবি চাচাকে।”
“এখন বলতে পারব না। রাতে বলব।”
গোঁয়ারের মত বলল আরিফ। এত কর্তৃত্ব ভাল লাগে? বাসায় আব্বা। আর বাইরে এই মেয়েটা। সবাই তার উপর শুধু কর্তৃত্ব খাটায়। চুপচাপ হাঁটবে দুজনে। এভাবে হাঁটতে ভাল লাগে আরিফের। হঠাৎ মৃদু কন্ঠে বলে,
“থ্যাংকস।”
“কি জন্যে?”
হাসল আরিফ। মেয়েটা অবশ্যই জানে কি জন্যে। তারপরও আমার মুখে শুনতে চাচ্ছে। যা, বলব না তোকে। ঢংগী।
“কিছু না।” প্রসঙ্গ পাল্টাল আরিফ। “তোর অফিস কেমন লাগতেছে?”
“আঁ... ট্রেনিং চলতেছে।” সাথে সাথে সারা দিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিটুকু ভর করল স্বপ্নার শরীরে। “শেষ হোক। তারপর বোঝা যাবে। খাটুনি খুব...”
হাঁটতে থাকে দুজনে। ভবিষ্যতের স্বপ্নে সুখী দুই যুবক যুবতী।

(পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩)
(শেষ পর্ব)

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:০১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ওরা আমাদের ঐতিহ্যের পোশাককে নোংরা পোশাক হিসেবে পরিচিত করতে চায়। ওরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে চায়।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০


"লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নি'মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।"

এক মৌলভী পোস্ট দিয়েছেন
"শাড়িকে একটি নোংরা পোশাক বানিয়ে দিয়েন না।
শরীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমূদ্র-সৈকতে - ১৬

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯



ছবি তোলার স্থান : মেরিনড্রাইভ, কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
ছবি তোলার তারিখ : পহেলা অক্টোবর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ।

বেড়াবার সবচেয়ে আকর্ষণীয় যায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সমূদ্র সৈকত। কখনো কখনো আমারও সুযোগ হয় বেড়াতে যাবার।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাঁআআআচ্চুউউউ! :) :D ;)

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১৫ ই জুন, ২০২৪ রাত ৯:৩৩



হাঁচতে নাকি জানে না কেউ,
কে বলেছে বোন
এই দেখোনা কত্ত হাঁচির
ওজন শত টন।

কিম হাঁচে বাড়া ভাতে,
বাইডেন হাঁচে তার সাথে সাথে,
লালচে চীনের জোরসে হাঁচি,
কাঁদে সবুজ ঘাস।
মাদার রুশের হাঁচি দেখে
হয় যে বনবাস!!

বনবিবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেইন্ট মার্টিন ও কোক ইস্যু

লিখেছেন নিবারণ, ১৫ ই জুন, ২০২৪ রাত ১১:৩৪

বিগত কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে চর্চিত বিষয়, কোকের বয়কট ও গত দুই দিন ধরে সেইন্ট মার্টিন মায়ানমার দখল করে নেয়ার খবর।

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্রিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, মায়ানমার সেইন্ট মার্টিন দখল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে গান গাইলাম (সাময়িক)

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ১৬ ই জুন, ২০২৪ ভোর ৪:০৮

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে আমি আদর করে 'আই' ডাকি। আইকে দিয়ে অনেক কাজই করাতে হয়। এবারে, আমাদের ৫ ভাইদের নিয়ে একটি গান বুনেছি। আমরা ৫ ভাই অনেক দিন একসাথে হই না। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×