পূর্বাভাষ
ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল আরিফ। তার কন্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ল, “তো কি করব?”
কিছু বলল না স্বপ্না। এক দৃষ্টিতে নিজের কোলের দিকে তাকিয়ে থাকল। আরিফকে তার কিছু বলবার নেই। কি শান্তনা দেবে সে ছেলেটাকে। আরিফ তো তার সাধ্য মত করেছে। কিন্তু তাই বলে..
চিন্তার সুতো কেটে যায় স্বপ্নার। ঘরময় এতক্ষন এলোমেলো পায়চারী করছিল আরিফ। অসহায় ভাবে নিজের মাথাটা চেপে ধরে বলল, “স্বপ্না, আব্বাকে আমি কখনও এতটা ...”
কথাটা শেষ করল না আরিফ। স্বপ্নার মনে হল ছেলেটা একটু ভাল করে কাঁদছে না কেন? কাঁদলে হয়ত কষ্টটা কিছুটা কমতো। আরিফের অসহায়ত্ব এবার স্বপ্নাকেও ভর করল। নিজেকে নিয়ে বেশ গর্ব ছিল তার, যে কোন সময় যে কারো মন সে ভালো করে দিতে পারে।
আজ আর পারল না স্বপ্না, তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ থেকে সে কান্নাটাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছিল। চোখের পানিটা মুছে ফেলতে গিয়েও মুছল না স্বপ্না। আরিফের আর নুতন করে কষ্ট বাড়বার কিছু নেই। ছেলেটা একেবারে শেষ সীমায় এসে পৌঁচেছে। এর আগে কখনও আরিফকে তার বাবাকে নিয়ে ভাবতে দেখেনি স্বপ্না। সারাক্ষণই তো শুধু অভিযোগ তার বাবাকে নিয়ে। এক টুকরো ম্লান হাসি ফুটে স্বপ্নার ঠোঁটে। আর কিছু না হোক বাপ ছেলের মাঝে দুরত্ব তো কমেছে।
স্বপ্নার সামনে মাটিতে হাঁটু মুড়ে দাঁড়াল আরিফ। তার হাত দুটো ধরল। চোখে মুখে বেপরোয়া আকুতি, “স্বপ্না আর কত?”
স্বপ্নার অশ্রুগুলো আরেকবার চোখের সীমানা টপকাল। হ্যাঁ, আর কত? একটা হাত ছাড়িয়ে নিল সে। চোখ মুছল। আরিফের চেহারা থেকে বেপরোয়া ভাবটুকু হারিয়ে গেল, আকুতিটা যেন আরো জেঁকে বসল চোখে মুখে। স্বপ্নার অন্য হাতটাও ছেড়ে দিল সে। বসে পড়ে নিজের পায়ের উপর। ভাংগা গলায় বলল,
“চেষ্টা তো করলাম।... আমি একটা সংসার চাই.... একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন।”
আরিফের সাথে তার জীবনটা এক সুতোয় বাঁধা। নিজের বুকের মাঝে দুঃখগুলোকে চেপে রেখে অন্যের দুঃখের দায় ভার নেবার শক্তি সবার থাকে না। স্বপ্না জানে না সে কতদূর পর্যন্ত টানতে পারবে। তবে কতটুকু টানতে পারবে না সে সর্ম্পকে তার স্পষ্ট ধারনা বরাবরই আছে। আরিফের গালে আলতো করে হাত বুলালো স্বপ্না। চোখের দিকে তাকাল। স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
“অন্যের বিশ্বাস নষ্ট করে তুই নিজের জীবন গড়তে চাইস?”
“হ্যাঁ চাই।” উঠে দাঁড়াল আরিফ। “আগে চাইতাম না। এখন চাই।”
“পারবি ভাল থাকতে?” কন্ঠটা ধরে আসে স্বপ্নার। এখনও সে আরিফের চোখের দিকে তাকিয়ে। “পরে যখন প্রশ্ন উঠবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি?”
চোখ সরিয়ে নিল আরিফ। স্বপ্নার প্রশ্নের উত্তর তার দিতে ইচ্ছা করছে না।
১
দিনাজপুর। এককালের উত্তরের সর্বশেষ শহর। এখন পঞ্চগড় জেলা সে স্থান দখল করেছে। তাতে অবশ্য এই প্রাচীন জনপদের মানুষগুলোর জীবন যাত্রার কোন পরির্বতন আসেনি। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের তো নয়ই। মানচিত্রের বিভাজন সংস্কৃতিমনা মানুষদের মাঝে শহরের মান মর্যাদা নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন করলেও শহরের সীমিত আয়ের মানুষদের কাছে বর্তমান দিনাজপুর আর অতীতের বৃহত্তর দিনাজপুরের মাঝে কোনই তফাৎ নেই।
তেমনি একজন সীমিত আয়ের সমান্য সরকারী কর্মচারীর সন্তান আরিফ। বছর দুয়েক আগে সদ্য মাষ্টার্স পাশ যুবক ছিল। বর্তমানে পরিপূর্ণ বেকার। মা নেই। ছোট একটা বোন আছে, বিথী। সংসারের একমাত্র নারী বিধায় ঘরকন্নার কাজটুকু তাকেই দেখতে হয় মা গত হওয়ার পর থেকেই। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখন গ্রাজুয়েশনের ছাত্রী। তবে নিয়মিত ক্লাশ করা তার কখনই হয়ে ওঠে না। কারণটা অতি অবশ্যই সংসার।
আব্বা কদিন আগেও সকালবেলা তাড়াহুড়া করে অফিসে বেরিয়ে যেতেন। ইদানিং আর যেতে হয় না। এল পি আর-এ আছেন তিনি। চাকরির সমাপ্তি ঘটবার আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। বর্তমানে তার নিয়মিত কাজ ছেলের জন্যে পেপার থেকে চাকরির র্সাকুলার খোঁজা। প্রত্যেকদিন নাস্তা সেরেই তিনি উঁচু বারান্দার ধারে এক পা ঝুলিয়ে বসেন। মেঝেতে পেপার বিছিয়ে উবু হয়ে পড়তে থাকেন।
আরিফ কোনদিনই আব্বার সাথে নাস্তা করার ঝুঁকি নেয় না। নয়ত নাস্তার বদলে আব্বার গালমন্দ আর পরার্মশ শুনেই পেট ভরাতে হয়। তাই কিছুটা অভ্যাস বশতঃ আর কিছুটা আব্বাকে এড়ানোর জন্যে আরিফ ইদানিং একটু দেরী করেই ঘুম থেকে ওঠে। অবশ্য অব্বার বর্তমান প্রভাতী পোস্টিং বারান্দা হওয়াতে শেষ রক্ষাটা আর হয় না। নাস্তা খাবার পরপরই গালি খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বারান্দায় পা রাখতে হয় আরিফকে।
“কোথায় যাচ্ছিস?”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আরিফের। আজ পর্যন্ত কোনদিন বারান্দা থেকে উঠানে পা রাখতে পারল না সে আব্বার এই গৎবাঁধা প্রশ্নটা করবার আগে। তবে মেজাজ যতই খারাপ হোক সেটা প্রকাশ করবার উপায় নাই। হাজার হোক জন্মদাতা পিতা। তারচেয়েও বড় কথা এখনও তার পয়সাতেই খাওয়া দাওয়া করতে হয়। তবে অস্বস্তিটুকু বোধহয় প্রকাশ করা যেতেই পারে। সুতরাং নিমিষেই ভ্রু দুটো কুঁচকে ফেলল আরিফ।
“বাইরে।”
“বাইরে কোথায়?”
মনে মনে উত্তর তৈরী করার চেষ্টা করল আরিফ। তবে আব্বার মনঃপুত হতে পারে এমন খুঁজে পেল না। অবশ্য সেটা পাওয়ার কথাও না। কথাটা আরিফ যেমন জানে তেমনি আব্বাও জানেন। তাই ছেলের উত্তরের জন্যে বেশীক্ষণ অপেক্ষা না করে পেপারের পড়তে পড়তেই তিনি মূল প্রসঙ্গ টানলেন,
“পেপারে একটা চাকরির সার্কুলার বের হইছে। দেখছিস?”
মেজাজটা আরো খারাপ হল আরিফের। গোমরা মুখে বলল,
“না।”
“কেন?”
এবার আরিফের দিকে তাকালেন আব্বা। চোখ সরিয়ে নিলো আরিফ। ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে লাগলো সে। এত অবাক হবার তো কিছু নাই। বেশ অনেক দিন হল আরিফ চাকরীর সার্কুলার খোঁজা বাদ দিয়েছে। আব্বা সেটা জানে। তারপরও প্রতিদিন এত ঘটা করে অবাক হবার নাটকটা কি জন্যে?
“তাহলে বাসায় পেপার রাখতেছি কি জন্যে? একএকটা পেপারের দাম ৭/৮ টাকা। দুই টুকরা কাগজ, তার দাম এত। নে দেখ।”
মাঝের একটা পাতা আলাদা করে বাড়িয়ে ধরলেন আব্বা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিলো আরিফ তবে দেখল না।
“দেখে আর কি করব? চাকরী তো হবে না। জানা কথা।”
এবার আব্বা গম্ভীর হলেন,“কেন? মানুষের চাকরী হয় না?”
আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবার কোন মানে হয় না। আলোচনা প্রায় শেষের দিকে চলে এসেছে। উঠানে পা রাখলো আরিফ। গম্ভীর কন্ঠে বলল,“চাচা মামার জোর থাকলে হয়।”
আব্বা আবার পেপারে মন দিলেন। তবে আরিফ জানে আজকের অধিবেশন এখানেই মুলতুবি নয়। আব্বা এখন তার নিজেস্ব দর্শন ঝাড়বেন কিছুক্ষণ।
“আজকে আমাকে তুই যে কথাটা শুনাচ্ছিস একদিন তোর ছেলেও তোকে এই একই কথা শুনাবে। তুইও আমার মতই এক বাপের এক বেটা।”
আরে, নুতন কথা! কি হয়েছে আব্বার আজকে? এতক্ষন তো নিয়মিত ফর্মুলা অনুযায়ী চলছিল। হঠাৎ ফর্মুলা ব্রেক করল মানে কপালে আজকে ভালই দুঃখ আছে। আজকে অধিবেশন শেষ হতে সময় লাগবে। সুতরাং বিরক্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল আরিফ। আব্বার অবশ্য ছেলের চেহারার অভিব্যাক্তি নিয়ে বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নাই। তিনি পেপারে চোখ বুলাতে বুলাতে তার কথা চালিয়ে গেলেন,
“অবশ্য তোর যা অবস্থা। তোকে মেয়ে দিবে কে? কোন ভদ্রলোক তো তার নিজের মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দিতে রাজী হবে না....”
এটা সহ্য করা যায় না। আব্বা আমার সর্ম্পকে কতটুকু জানে। মাথার ভিতরটা টগবগ করে উঠল আরিফের। সে জানত আব্বা আজকে একেবারে নুতন অস্ত্র ব্যবহার করছে। কিন্তু সে অস্ত্র যে এতটা ধারালো হবে সেটা সে আশা করেনি। আব্বা তখনও নির্বিকার পেপার ওল্টাতে ওল্টাতে তার বক্তব্য ঝেড়ে যাচ্ছেন,
“কোন চাকরী বাকরী নাই মার্স্টাস পাশ করে বাপের ঘাড়ে বসে আছিস।”
একে তো আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। তাতে হাওয়া দেওয়ার জন্যে এবার বিথী বারান্দায় এসে হাজির হল। অবশ্য বিথীর বারান্দায় আসাটা উদ্দেশ্য প্রনোদিত নয়। নাস্তার পালা শেষ হতেই সে প্রতিদিন ঘর মোছে। তারপর শুরু হয় দিনের রান্না বান্না। এটা এ বাড়ির প্রতিদিনকার স্বাভাবিক রুটিন হলেও আজ তো আব্বা তার নিয়মিত রুটিন ব্রেক করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে বিথীর বারান্দা মুছতে আসাটা আরিফের ইজ্জতের জন্যে সমূহ হানিকারক হতে পারে। সুতরাং দাঁতে দাঁত চিপে দাঁড়িয়ে থাকল আরিফ।
“সকাল দশটায় ঘুম থেকে উঠে লাট সাহেবের মত নাস্তা খেয়ে বের হয়ে যাইস। এরপর সারাটা দিনে খাবার সময় ছাড়া তোর চেহারাও আর দেখা যায় না।”
শেষ রক্ষা আর হল না। বিথীর ঠোঁটে সুক্ষ হাসির রেখা। অবশ্য আরিফকে নিয়ে যে সরাসরি হাসবার সাহস বিথীর কখনও হবে না এ ব্যাপারে আরিফ হানড্রেট পারসেন্ট নিশ্চিত। কিন্তু তবুও ইজ্জতের একেবারে দফারফা। এবং এত কিছুর পরও আব্বার অধিবেশন এখানেই সমাপ্ত হবার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এটা রীতিমত আশংকাজনক।
“মানলাম”, পেপারের পাতা ওল্টালেন আব্বা,“চাকরী সহজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষের একটা চেষ্টা তো থাকে। তোর তো কোন নড়াচড়া দেখি না আমি। ... আমি মরলে তোর কপালে যে কি আছে, তা তুইই জানিস।”
এটা পুরোনো কথা। এবং অনেকবার বলা হয়েছে। সুতরাং এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেতেই পারে। তবে যেহেতু পিতা, তাই কোন শব্দ না করে শুধু ঠোঁট নেড়ে আরিফ তার প্রতিবাদ জানালো চরম বিরক্তি নিয়ে। অবশ্য প্রতিবাদটুকু সরব হলেই বোধ হয় ভাল হত।
“বউএর খাবার জোগাড় করা তো দূরের কথা। তুই তোর নিজের খাবারই জোগাড় করতে পারবি না।” আব্বার জঙ্গী বিমান এবার আনবিক বোমা নিক্ষেপ করল।
বুড়ো বুড়ো মানুষগুলোর কাছে এত ধারালো ধারালো সব অস্ত্র থাকে কি করে? কলিজায় একেবারে খ্যাচ করে বিঁধে। তবে এই-ই শেষ নয়, দগদগে কাটা ঘা এর উপরে এবার নুনের ছিটা দিতে আরিফের দৃঢ়তম বিশ্বাসকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে ফিক করে হেসে উঠল বিথী। এরপরে আর এখানে থাকার কোন মানেই হয় না। ঝটকা মেরে আব্বার দেয়া পেপারটা বারান্দায় রেখে গটগট করে বেরিয়ে গেল আরিফ। আব্বা তার গমন পথের দিকে একবার তাকালেন তারপর আবার পেপারে দৃষ্টি দিলেন। তবে মন দিতে পারলেন না। ছেলেটার যে কি হবে?
“আব্বা, উঠ। ঐদিকে বস । আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।”
তাড়া দিল বিথী। তার বারান্দা মোছা প্রায় শেষ। পানি ভরা বালতিটা আব্বার পাশে এনে ঘর মোছা ন্যাকড়াটা চিপে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। অর্থাৎ এখনই উঠতে হবে। তারপরও আব্বা শেষ বারের মত পেপারে চোখ বোলাতে লাগলেন।
“নাহ, কোন খবর নাই। অযথাই মাসে মাসে এতগুলো টাকা নষ্ট।”
খবর নিয়ে বিথীর বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নাই। বারান্দা মুছে তাকে রান্নায় বসতে হবে। সুতরাং আব্বার ঘাড়ের উপর সে আগের মতই দাঁড়িয়ে থাকল। অবশেষে পেপার ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন আব্বা।
“কাল থেকে পেপারওয়ারাকে মানা করে দিবি। আরিফেরও তো চাকরীর সার্কুলার দেখার আগ্রহ নাই ... অযথা।”
“তাহলে টিভিটা ঠিক করে আনো।” মুছতে শুরু করল বিথী। “দুই মাস ধরে নষ্ট হয়ে আছে। প্রতিদিন মানুষের বাসায় যায়ে টিভি দেখতে ভাল লাগে না।”
বিরক্ত হলেন আব্বা। ছেলেটা সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মেয়েটা আছে টিভি নিয়ে। ঘরের ভিতর যাবার জন্যে ঘুরলেন তিনি।
“আচ্ছা দেখি ... খালি খরচ এই সংসারটাতে।”
(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯) (পর্ব ১০) (পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩) (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৫৫