(পর্ব ১) (পর্ব ২) (পর্ব ৩) (পর্ব ৪) (পর্ব ৫) (পর্ব ৬) (র্পব ৭) (পর্ব ৮) (পর্ব ৯)
১০
দিনগুলো যেন প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়ে চলেছে। আলম সাহেবের কাছে মোট ১১জন কোর্স করছে। মজার ব্যাপার সারা জীবন যে আরিফ টেনেটুনে পাশ করেছে সে এখানে সবার থেকে ভাল করছে। প্রয়োজন বোধ হয় মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। কাজকর্ম সদি সম্ভাবনাময় হয় তবে মন ভাল থাকে। আর মন ভাল থাকলে অনেক কিছুই মেনে নেওয়া যায়। এর মধ্যে কয়েকবারই আব্বার সাথে লেগেছে আরিফের। প্রত্যেকবারই তার মনে হয়েছে কোর্সটা শেষ হোক, ব্যবসাটা শুরু করি তারপর তোমার কথার উত্তর দেব আমি।
দিনগুলো সব মিলিয়ে সত্যিই ভাল যাচ্ছে আরিফের। তবে অন্যদের ভাল থাকার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সে। নদীর পাড়ে ঘুরতে এসেছিল স্বপ্নার সাথে। শুক্রবার ছাড়া তো এখন আর দিনের বেলা সময় পাওয়া যায় না। তাই আজ নদীর পাড়ে বেড়াতে আসা। কোথাও বসার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ইদানিং নদীর পাড়ে জুটিদের ভিড় বেশ বেড়ে গেছে। অন্যদের অসুবিধা না হলেও আরিফ কেন যেন অস্বস্তি বোধ করে পাবলিকলী পারসোনাল আলাপ করতে। তার চেয়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে বেড়ানো অনেক ভাল। তাছাড়া বোনাস হিসেবে অনেকগুলো জুটি দেখার সুযোগ মেলে। সত্যি প্রেম যে সাদা কালো মোটা পাতলা কিছুই মানে না সেটা এই এদের দেখলেই বোঝা যায়।
“মুরগীর বাচ্চা যখন ফুটে,” দেখা হওয়ার পর থেকেই আরিফ এই বিষয়েই আলাপ চালাচ্ছে। “তখন তার একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। আর এই কারণে মা মুরগী তার বাচ্চাদের ডানার তলে রাখে। বুঝলি?”
“হুঁ।” তেতো মুখে বলল স্বপ্না।
“ধীরে ধীরে যত বড় হতে থাকে,” আরিফের উৎসাহ কিছুতেই কমছে না। “তত তাদের ঠান্ডাও কমে যায়। এই কারণে বাচ্চা বড় হলে মা আর তাদেরকে আগের মত ডানার তলে নেয় না। ইন্টারেস্টিং না?”
“না।” রাগে ফেটে পড়ল স্বপ্না। প্রথমটায় ভাল লেগেছিল আরিফের এই আগ্রহটা। এখন বিষাক্ত ঠেকছে। কদিন ধরে অফিসে পরীক্ষার বহর চলছে। ট্রেনিং প্রায় শেষের দিকে। সে ভালই করছে তবে এত খাটুনী ভাল লাগে না। তারউপর আবার আগের মত আর আরিফের সাথে যখন তখন দেখাও করা যায় না। সব মিলিয়ে ভেবেছিল আজকের সময়টা তার ভাল যাবে। নদীর পাড়ে বসে কোথায় শয়তানটা দু চারটা রোমান্টিক কথা বলবে, তা না। তখন থেকে শুধু মুরগী মুরগী করছে। তোকে টাকা দেয়াই উচিৎ হয়নি আমার। ভাবল স্বপ্না।
তবে স্বপ্নার এইসব রাগকে পাত্তা দেওয়ার মত মানুষ আরিফ কোন কালেই ছিল না। সে তার বর্তমান সাফল্য জাহির করতেই ব্যস্ত। অবশ্য তার জীবনে তো বলবার মত সাফল্য খুব একটা নেই। তাই ট্রেনিংএ ভাল করার অনুভুতিটাকে সে চেপে রাখতে পারছে না। আব্বাকে তো বলা যায় না। তাই তার লাগাতার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বেচারা স্বপ্নাকেই শুনতে হচ্ছে।
“দারুণ ইন্টারেষ্টিং।” নিজে নিজেই বলল আরিফ। “তুই আসলে ব্যাপারটা বুঝতে পারতেছিস না। এখন দেখ, আমার খামারে ধর বাচ্চা আছে ১০০টা। এবং সবগুলাই এতিম। মেশিন দিয়ে বাচ্চা ফুটানো হইছে তো..”
“মেশিন দিয়ে যে মুরগীর বাচ্চা ফুটানো হয় সেইটা আমি জানি।” সহ্যের শেষ সীমায় স্বপ্না।
“কিন্তু তুই যেইটা জানিস না,” দাঁত কেলিয়ে হাসল আরিফ, “সেইটা হইল আমরা তাপমাত্রার এই সমস্যাটা দূর করি ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালায়।”
“সেইটা জেনে আমি কি করব?” স্বপ্নার অবস্থা কেঁদে ফেলার মত। ইচ্ছে করছে ঘুসি মেরে ছেলেটার দাঁতগুলো সব ভেঙ্গে দেয়।
স্বপ্নার অবস্থাটা বেশ উপভোগ করছে আরিফ। তাই রসিয়ে রসিয়ে তার সদ্য অর্জিত জ্ঞান ঝাড়তে লাগল।
“প্রথম দিকে যতগুলা বাল্ব ব্যবহার করা হয় পরের দিকে আর ততগুলা লাগে না...”
“আরিফ,” ঝটকা মেরে দাঁড়াল স্বপ্না। মাথার দুই পাশের রগদুটো দপদপ করছে তার। একটা মানুষ এতটা বিরক্তিকর হয় কেমন করে। দাঁতে দাঁত চিপে কোন রকমে বলল,
“তুই যদি আর একবার মুরগীর ব্যাপারে কিছু বলছিস, মুরগী শব্দটা উচ্চারণ করছিস তাইলে আমি এইখান থেকে চলে যাব।”
মজা পেল আরিফ। আবারও তার সবগুলো দাঁত বেরিয়ে গেল। তবে স্বপ্নাকে আর ঘাঁটালো না। চেহারায় নির্বিকার ভাব আনার চেষ্টা করে বলল,
“ঠিক আছে। বলব না।”
ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকালো স্বপ্না। তার এখন দুটো ডিসপিরিন দরকার ছিল। মাথার পোকা নেমে গেছে ছেলেটার বকবকানিতে। হাঁটতে শুরু করল স্বপ্না। আরিফ মুখে কুলপ এঁটে তার সঙ্গী হল। ডানে বাঁয়ে দেখবার মত কত মেয়ে, স্বপ্নাকে পাত্তা দেয়ার তার দরকার আছে। আহা, কি ধরণ একেক জনের বসবার। পারলে তো একেবারে কোলে উঠে বসে। লজ্জা শরম সব দেশে থেকে উঠে গেছে। চার পাঁচ বছর আগেও নদীর পাড়ের অবস্থা অন্য রকম ছিল। তারচেয়ে হেঁটে বেড়ানোই ভাল। বলা যায় না তারও যদি আবার কোলে নিতে ইচ্ছো করে অথবা স্বপ্না নিজেই কোলে উঠতে চায়। না বাবা, এরচেয়ে হাঁটতে হাঁটতে লাইভ সিনেমা দেখা অনেক ভাল। সিনেমার নায়ক নায়িকা হওয়ার দরকার নাই। নিজের কাছে বা স্বপ্নার কাছে ছোট হতে চায় না আরিফ। বেশ কিছু দূর হাঁটার পরে মাথা ব্যাথাটা কিছুটা কমাতে স্বপ্না মৃদু কন্ঠে বলল,
“কালকে আমাকে দেখতে আসছিল।”
“তোকে দেখতে আসার আবার কি ....” নিতান্ত তাচ্ছিল্য দিয়ে কথাটা শুরু করলেও মাঝ পথে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল আরিফের। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মাথা থেকে লাইফ সিনেমার আবেশ মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। তবে মুরগীর ট্রেনিংএর সফলতার উৎফুল্লতাটুকু গেল না। কিছুটা যাত্রার ঢংয়ে বলল,
“দেখতে আসছিল? কোন শালা?”
হেসে ফেলল স্বপ্না। যাক, প্রসঙ্গ তাহলে মুরগী থেকে সরানো গেছে।
“কারো শালা না।” চোখে কৌতুক নিয়ে বলল স্বপ্না। “লোকটার নাকি কোন বোন নাই। ব্যাংকে চাকরী করে। আব্বার বেশ পছন্দ হইছে।”
শেষের কথাটুকু স্পষ্ট ভাবেই আরিফকে খোঁচানোর জন্যে বলা। খোঁচাটা লাগলও জায়গা মত। ভ্রু কুঁচকালো আরিফ। তবে যাত্রা ঢং ছাড়তে পারল না। টেনে টেনে বলল,
“আর তোর কি বিবেচনা?”
ছেলেটা বেশ সুখেই আছে। ভাবল স্বপ্না। ভাল, সুখে থাকা ভাল। প্রত্যেকটা মানুষেরই সুখে থাকার অধিকার আছে। আর আরিফ সুখে থাকলে তারও কেন যেন নিজেকে সুখী সুখী মনে হয়। আরিফকে আরেকটা খোঁচা দেয়ার লোভ সামলাতে পারল না স্বপ্না।
“দেখতে শুনতে তো ভালই।” হালকা চলে বলল স্বপ্না।
“মুরগী চোরেরর মত কথা বলবি না।” রাজা বাদশার মত চেঁচিয়ে উঠল আরিফ।
“ওমা...,” কোঁকিয়ে উঠল স্বপ্না। সটান দাঁড়িয়ে গেল। “আবার মুরগী?! খোদা কি করব আমি এই মুরগীটাকে.... ধ্যাত্তের, ছেলেটাকে নিয়ে।”
“হা হা হা...” আনন্দে হাত তালি দিল আরিফ। ছেলে মানুষের মত লাফালাফি শুরু করল। “তোকেও মুরগী ধরছে, দেখছিস?”
স্বপ্না এবার জোরে জোরে হাঁটতে থাকল। আরিফের সাথে আর হাঁটবেই না সে।
“খালি মুরগী, মুরগী....” গজগজ করতে লাগল স্বপ্না। “থাক তুই তোর মুরগী নিয়ে। আমি ব্যাংকের ঐ লোকটাকে বিয়ে করব। তোর মুরগী..”
কথা শেষ করতে দিল না আরিফ। লাফিয়ে স্বপ্নার সামনে আসল।
“করে দেখিস খালি আমি আমার মুরগী বাহিনী নিয়ে....” আরিফের যাত্রা পালা চলতে থাকল প্রায় সন্ধ্যা পযর্ন্ত। মানব না মানব না করেও কেন যেন ছেলেটার সব অত্যাচারই মেনে নেয় স্বপ্না। কেমন যেন একটা ভাল লাগা কাজ করে মেনে নিতে। কি জানি ভালবাসা বোধ হয় এমনই। সন্ধ্যার আগেই মুরগী লালন পালনের সব নিয়ম কানুন মুখস্থ হয়ে গেল স্বপ্নার।
দেখতে দেখতে দুইটা সপ্তাহ কেমন করে যেন পার হয়ে গেল। যে জীবনে একেকটা দিন সহজে পার হতে চায় না সে জীবনে সপ্তাহগুলো যখন ডানা মেলে উড়ে যেতে থাকে তখন নিজেকে সত্যিই বড় সুখী মনে হয়। আবার ভয়ও লাগে। এই সুখ হারিয়ে যাবে না তো। মুনুষ বড় আজব প্রাণী। আজীবন দুঃখের সাথে বসবাস করেও যদি এক ঝলক সুখের দেখা পায় তো সেই সুখকেই আপন ভাবতে থাকে।
“তোর তাইলে কালকে শেষ হচ্ছে?” চায়ের গ্লাস হাতে প্রশ্ন করল নয়ন।
“হ্যাঁ।” নিজের গ্লাসে ছোট্ট করে চুমুক দিল আরিফ।
“কেমন শিখাইল?” নয়নের কন্ঠে আগ্রহ। আনমনে চায়ের গ্লাসটা টেবিলের উপর গোল করে ঘোরাচ্ছে সে। কিছু হিসেব যেন মেলাতে চাইছে।
“ভালই তো মনে হচ্ছে।” চায়ের গ্লাস নামিয়ে রেখে হাতের আংগুলগুলো ফোটালো আরিফ। দুদিন ধরে কিছুটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে তার মনে। বার বার প্রশ্ন জাগছে ট্রেনিং তো শেষ হচ্ছে। এরপর?
“কাজে নামলে বোঝা যাবে।” বলল আরিফ।
ঠিক এই কথাটাই ভাবছিল নয়ন। গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিল। বলল,
“কাজে নামবি কি ভাবে?”
আরিফের অস্থিরতাটা আরো বাড়ল। চুলে হাত চালাল অস্থির ভাবে। এখন মনে হচ্ছে ঝোঁকের মাথায় আলম স্যারের কাছে ট্রেনিঙ নেয়াটা বোধ হয় ঠিক হল না। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ব্যবসা শুরু করার জন্যে টাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। তার টাকার ব্যবস্থা কি ভাবে হবে? চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“ভাবতেছি লাবু ভাইয়ের কাছে যাব একবার।”
“ভাবতেছি আবার কি?” বিরক্ত হল নয়ন। সোজা হয়ে বসল। “ট্রেনিং শেষ করে সোজা লাবু ভাইয়ের কাছে যায় বলবি, আমি মুরগীর খামার করা শিখছি, এখন আপনি আমাকে একটা ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দেন, ব্যাস।”
“হ্যাঁ, তাই করব।” চায়ে চুমুক দিল আরিফ।
নয়ন আবার টেবিলে চায়ের গ্লাস ঘোরাতে লাগল। তারও কি আরিফের সাথে ট্রেনিংটা নেয়া উচিৎ ছিল? ভাবল নয়ন। কিছু একটা তো করতে হবে। আর কতদিন বেকার থাকবে?
“তুই শুরু কর।” আনমনে বলল নয়ন, “দেখা যাক কি হয়। সব কিছু ঠিক থাকলে আমিও ঠিক করছি যুব উন্নয়নের নেক্সস্ট কোর্সে ঢুকে যাব।”
“হ্যাঁ, ঢুক।” একটা র্দীঘশ্বাস ছাড়ল আরিফ, “বয়স তো কম হইল না আমাদের।”
“বয়স?” উত্তেজিত হয় নয়ন। নিজের মাথার হালকা চুলে হাত বুলিয়ে হাসল । “আমাকে তো তোর চেয়ে বুড়া দেখায়।”
হোটেলের দরজায় মীম আর সাগর এসে দাঁড়ালো। আজ বোধহয় তাদের মিশন সফল হয়নি। দুজনের চেহারাতেই বিষন্নতা। দরজার বাইরে সাইকেল স্ট্যান্ড করে ভিতরে এসে আরিফদের পাশে বসল দুই প্রেমিক।
“কাদের ভাই চা দেন।” গম্ভীর কন্ঠে বলল মীম।
নয়নের দিকে তাকালো আরিফ। চোখে প্রশ্ন। নয়ন কাঁধ ঝাঁকালো। সে জানে না। মাত্র আধ ঘন্টা আগে মীমরা রুমা কাপ টুর্নামেন্ট শেষ করে বেরিয়ে যায়। কদিন ধরে নুতন খেলা চলছে তাদের। একজন টেবিলের উপর আঙ্গুল ঠেকিয়ে হাতটাকে খাড়া করে রাখবে। অন্যজন সেই হাতে চাপড় মারার চেষ্টা করবে। প্রথম জন নিজের হাত বাঁচানোর চেষ্টা করবে। যে বেশী সংখ্যক মারতে পারবে সেই বিজয়ী। দুজনেই প্রায় সমান এক্সপার্ট এই মারামারি খেলাতে। আজকে জিতেছিল মীম। মিশনে যাবার সময় দুজনেই বেশ হাসিখুশি ছিল। হঠাৎ কি এমন ঘটল?
“কি রে?” প্রশ্ন করল আরিফ। “তোদের মিশন শেষ হইল?”
“না রে, ভাই।” সাগরের কন্ঠে বিরক্তি। “কিচ্ছু বুঝলাম না। মেয়েটা আজকে বাইরেই আসল না। কয়েকবার করে চক্কর মারলাম।”
আরেকটু হলেই নয়নের গলায় চা আটকে যেত। খেতে খেতে হাসাটা বেশ বিপদজনক। আরিফ নয়নের পিঠ চাপড়ে দিল। তার মুখেও হাসি। নয়ন গ্লাসটা একবারে নামিয়ে রাখল। আর খাবে না। সাগর আর মীম মুখ শক্ত করে রাস্তার দিকে তাকাল।
“হয়ত অসুখ হইছে।” শান্তনা দিল আরিফ।
“হ্যাঁ।” চিন্তিত কন্ঠে বলল মীম। “সেইটা হইতে পারে।”
“অথবা কারো সাথে ভাগছে।” ফোড়ন কাটল নয়ন।
সাগর নয়ন হয়ে আরিফের দিকে তাকাল। আরিফ সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো। ভাবখানা, বলা যায় না সত্যি হতেই পারে। সাগরের চোখ দুটো গোল হয়ে গেল।
“দেখ দোস্ত, ভয় দেখাবি না।” বলল সাগর। “আমাদের এত সব পরিকল্পনা। শেয়ারে বিয়ে করব, দুই বন্ধু ভাই ভাই হয়ে এক ঘরে থাকব..”
আরিফ নয়নের উপর গড়িয়ে পড়ল। মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপছে সে। নয়ন চুপচাপ। শুধু সার্কাসের ক্লাউনের মত ঠোঁটদুটোকে দু পাশে টেনে রেখেছে। কাদের ভাই দু গ্লাস চা দিয়ে গেল।
“হ্যাঁ।” মীম সিরিয়াস কন্ঠে বলল। “ঐ মেয়ে কারো সাথে ভাগতেই পারে না। আমাদের মত এমন নিষ্ঠাবান প্রেমিক ও কোথায় পারে বল?”
আরিফ আর পারল না। হা হা করে হেসে ফেলল। নয়ন তো আগে থেকেই শব্দ না করেই হাসছিল। কোমরে হাত দিয়ে ওদের দিকে তাকালো মীম। ধমক দিতে গিয়ে শেষে নিজেও হেসে ফেলল। নিজেদের অবস্থায় নিজেদেরই দয়া করতে ইচ্ছা করল সাগরের। ডানে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে চায়ের গ্লাসটা তুলে নি সে।
“আপনি সোজা ব্যাপারটা বুঝতে পারতেছেন না ক্যান?” লাবু ভাই বলল। “মেয়েটার লাশ আপনার পুকুর পাড়ে পাওয়া গেছে। এখন পুলিশ তো আপনাকেই সন্দেহ করবে।”
লাবু ভাইয়ের আজ গোছল ও নাস্তা দুটোই হয়ে গেছে। বাইরে বের হবে একটু পড়ে। সেই দিনকার সেই বৃদ্ধটি লাবু ভাইয়ের সামনে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তার পাশে বসে নয়ন আর আরিফ অপেক্ষা করছে লাবু ভাইয়ের আজকের দরবারের শেষ বিচার শালিসটা শেষ হওয়ার জন্যে।
“আমরা তো চিনিই না মেয়েটাকে।” মিনমিন করে বলল বৃদ্ধা।
“ওহো... কথাটা বোঝেন।” এবার বিরক্ত লাবু ভাই। “পুলিশ আপনার ঐখানে লাশ পাইছে। আপনার ছেলেকে তাদের সন্দেহ হইছে। এরেস্ট করছে। পুলিশের কাজ পুলিশ করছে। জজের কাজ জজ করতেছে, উকিলের কাজও উকিল করতেছে। এখন আপনার কাজ হইল আপনার ছেলে যে খুনটা করে নাই তার সাক্ষী প্রমাণ জোগাড় করা। পুলিশ কিন্তু এখনও প্রমাণ করতে পারে নাই যে আপনার ছেলে খুনি।”
লাবু ভাইয়ের এমন অভীনব যুক্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারল না বৃদ্ধ। সরল কন্ঠে বলল,
“পুলিশ তো এখন বলতেছে আমার ছেলের সাথে নাকি মেয়েটার সম্বন্ধ ছিল।”
“পুলিশ অনেক কিছুই বলে।” হাত নেড়ে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিল লাবু ভাই। “জজ পুলিশের সব কথায় কান দেয় না। আপনি খোঁজ লাগান মেয়েটা কোন গ্রামের? পুলিশ তার মত করে খুঁজতেছে। আপনি আপনার মত করে খোঁজ খবর করেন। বুঝলেন আমার কথা?”
“হ্যাঁ।” মাথা ঝাঁকালো বৃদ্ধ। তবে সবটা বুঝেছে বলে মনে হল না। অবশ্য তার ছেলে যে এখনও বিপদ মুক্ত নয় এটা সে ভাল মতই বুঝেছে। তাই তার দুচিন্তাও যাচ্ছে না।
যে দায়িত্ব পুলিশের সেই দ্বায়িত্ব লাবু ভাই বৃদ্ধের উপর চাপাচ্ছে কেন নয়ন ঠিক বুঝতে পারল না। আরিফের দিকে তাকালো সে। আরিফের চোখেও একই প্রশ্ন। অবশ্য একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। এদেশে পুলিশের ভরশা নাই। তাই পুলিশের পাশাপাশি সিনেমার নায়কের মত যদি নিজেও ভিলেনের পিছনে ছোটা যায় তো ভাল। নয়ত মন্দ কপাল। এই বৃদ্ধের সেই সামর্থ্য নেই। আর লাবু ভাইয়ের সেটা না বুঝতে পারার কিছু নাই। অর্থাৎ লাবু ভাই এখন শুধু ফর্মালিটিস পালন করছে। এই কেস থেকে লাবু ভাই মোটামুটি হাত তুলে নিয়েছে। তাই এই জাতীয় কথা বার্তা বলছে। আরিফের ভয় হল, তার উপর থেকে হাত তুলে নেবে না তো?
“উকিলের ফিস আমি কমায় দিছি।” সহানুভুতির সুরে বলল লাবু ভাই। “এখন যত তাড়াতাড়ি পারেন মেয়েটার সর্ম্পকে খোঁজ খবর করেন। যান। আমার দিক থেকে যতটুকু করার আমি করব।”
নয়নদের দিকে একবার তাকালো বৃদ্ধ। চোখে মুখে অসহায়ত্ব। তারপর লাবু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঠিক আছে।” উঠে দাঁড়াল বৃদ্ধ। দরজার দিকে পা বাড়িয়েও থেমে দাঁড়ালো। “স্যার, আগামী ডেট ১৪ তারিখে পড়ছে।”
“ঠিক আছে।” মাথা ঝাঁকালো লাবু ভাই। “আপনি দুই দিন আগে আমাকে একটু স্মরণ করায় দিয়েন। যান।”
“স্লামালেকুম।” হাত তুলে কপালে ঠেকালো বৃদ্ধ।
“ওয়ালাইকুম সালাম।” লাবু ভাইও হাত তুলে সালাম নিল। নয়ন খেয়াল করেছে তাদের সাথে লাবু ভাই হাত তুলে সালাম নেয় না। এটা কি যে যেমন তার সাথে সেই রকম আচরণ। হতে পারে। নেতারা এরকম অনেক কিছুই করে। দেখা যাক আরিফের ব্যাপারে কি করছে?
“মামলা যে দিকে যাচ্ছে...” চিন্তিত ভঙ্গিতে আরিফদের বলল লাবু ভাই। “বাঁচা মুশকিল। ছেলেটাকে আমি চিনি। ভাল ছেলে।”
চুপচাপ কি যেন ভাবল লাবু ভাই। বোধহয় বৃদ্ধের জন্যে কিছু করতে না পারায় অস্বস্তিতে ভুগছে। নেতা হলেও মানুষ তো। শেষে একটা শ্বাস ফেলে আরিফদের দিকে তাকালো। “যাহোক। তারপর বল, তোদের কি অবস্থা?”
নড়ে চড়ে বসল আরিফ। বুক কাঁপছে তার। বৃদ্ধের অবস্থা দেখে আস্থা হারিয়ে ফেলছে। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
“লাবু ভাই, আমি তো মুরগীর ট্রেনিং শেষ করলাম।”
“ভাল কথা, কাজ শুরু কর।”
কথার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল লাবু ভাই যে এ বিষয়ে কথা বলতে মোটেও আগ্রহী নয় সে। দমে গেল আরিফ। র্দূভাগ্য কি কোন দিনই তার পিছু ছাড়বে না। ঢক গিলে নয়নের দিকে তাকালো আরিফ সাহায্যের আশায়। নয়ন গলাটা একটু কেশে পরীস্কার করে নিল। বলল,
“একটা ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দেন না, লাবু ভাই।”
ভ্রু কুঁচকালো লাবু ভাই। রেগে গেছে। তার যতটুকু করবার সে করেছে ছেলেগুলোর জন্যে। আগামী ইলেকশনের জন্যে এটাই যথেষ্ট। বরং জনগনকে বলতে পারবে আমি এদের ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু দেশের অবকাঠামোগত কমতির কারণে তারা সেই সাহায্যকে কাজে লাগতে পারেনি। তবে এটা এই ছেলেগুলার দোষ না। আমাকে আরেকবার র্নিবাচিত করেন আমি ব্যাক্তিগত ভাবে একটা পুওর ফান্ড বানাবো। যা দিয়ে এদের জীবিকার ব্যবস্থা হবে। গরীব দেশ। সব তো সরকার পারবে না। আমাদেরই ব্যক্তিগত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী নির্বাচনের ভাষন এখনই তৈরী হয়ে যাওয়াতে বেশ তৃপ্ত বোধ করল লাবু ভাই।
“তোরা না... ” বিরক্ত কন্ঠে বলল লাবু ভাই। “আমাকে কি তোদের ব্যাংক মনে হচ্ছে?”
“তা মনে হচ্ছে না।” বলল আরিফ। অনুনয় করল। “কিন্তু আপনি যদি চান তাইলে আমার লোন হয়ে যাবে।”
বৃদ্ধের সাথে যেভাবে কথা বলছিল, ঠিক সেভাবে কথা বলা শুরু করল লাবু ভাই।
“তোদের বাড়ির জমিটা মটগেজ রাখবি, লোন নিবি। এই খানে আবার আমাকে টানতেছিস কেন?”
প্রমান গুনল আরিফ। তার ধারণা সত্যি। ভাই আর কিছু করবে না তার জন্যে। নিজের অজান্তে বৃদ্ধের মতই মিনমিন করে উঠল আরিফ।
“আব্বা জমি মটগেজ রাখতে রাজি হবে না।”
ব্যপারটা লাবু ভাইয়ের জন্যে আরো সহজ হয়ে গেল। কায়দা করে ভ্রু কুঁচকে আরিফের দিকে তাকাল লাবু ভাই। কর্তৃত্বপরায়ণ কন্ঠে জানতে চাইল,
“কথা বলছিস তোর আব্বার সাথে?”
“আব্বা রাজি হবে না।” গোঁয়ারের মত বলল আরিফ। “আমি জানি।”
আব্বাকে সে চেনে। আব্বা মরে গেলেও জমি মটগেজ রাখতে দেবে না। রাগ হল আব্বার উপর। জমি মটগেজ রাখতে পারলে লাবু ভাইয়ের মত মানুষকে আর তেল দিতে হত না। ট্রেনিংয়ে সে সবচেয়ে ভাল করেছে। আব্বার তো আর সেটা চোখে পড়বে না। মানুষটা এত র্স্বাথপর কেন?
“লাবু ভাই,” এবার নয়ন অনুনয় করল। “আপনার তো এখানকার সবগুলা ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথেই কম বেশী পরিচয় আছে। একটা ব্যবস্থা করে দেন না।”
নয়নের অনুনয়ে রাগটা কমল লাবু ভাইয়ের। এই ছেলেও তাহলে নরম গলায় কথা বলতে পারে। হুঁ হুঁ বাবা, বেকায়দায় পড়লে নাকি বাঘেও ধান খায়। মেঝের দিকে তাকিয়ে কি করা যায় ভাবল কিছুক্ষণ লাবু ভাই। সমস্যা তেমন গুরুতর না। নরমালি মটগেজ ছাড়া লোন পাওয়া যায় না। এখন বাকি থাকল তার নিজেস্ব প্রভাব। নিজের কাছে স্বীকার করতে অসুবিধা নাই যে বিশেষ কেস ছাড়া ব্যাংককে বাধ্য করা তার সম্ভব না। আর এটা বিশেষ কেস নয়। সুতরাং তার কাজ হল কয়েকটা ব্যাংকের ম্যানেজারকে একবার করে আরিফের কথাটা বলে দেয়া। তারপর যা বোঝার আরিফ বুঝবে।
পানির গ্লাস আর ঔষধ হাতে সোমা এসে দাঁড়ালো লাবু ভাইয়ের সামনে।
“আব্বা। তোমার ঔষধ।” বলল সোমা।
লাবু ভাই ঝট করে নয়নের দিকে তাকালো। আরিফও তাকালো নয়নের দিকে। নয়ন নিবিষ্ট মনে ঘরের দেয়াল দেখতে লাগল।
“দে।” হাত বাড়িয়ে ঔষুধ নিল লাবু ভাই। নিজের অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটানোর জন্যে ঔষধ খেতে খেতে জানতে চাইল, “চা খাবি তোরা?”
“খাওয়াবেন?” লাবু ভাইয়ের দিকে তাকাল নয়ন।
লাবু ভাইয়ের চেহারায় বিরক্তিটা আবার ফেরত আসল। এই ছেলেটা আসলেই বান্দর। সোমার সামনে কায়দা মত পেয়ে এখন আবার বাঁদরামী শুরু করেছে। সোমাও দেখা যায় নয়নের দিকে তাকাচ্ছে। ভাবল লাবু ভাই। তবে নয়ন অবশ্য তাকাচ্ছে না। বোধ হয় রিস্ক নিতে রাজী নয়। বেশ কড়া বন্ধুত্ব দেখা যায় দুজনের মাঝে। আরিফের ক্ষতি চায় না ছেলেটা। ভাল , এটা ভাল।
“না মানে,” কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করল নয়ন। “আপনি নাকি বাড়িতে কাউকে চা খাওয়ান না শুনছিলাম।”
এবার হেসে ফেলল লাবু ভাই। মেয়ের সামনে বিব্রতকর অবস্থা। সোমাও হাসছে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে।
“তোরা এত বদমাইশ।” সোমার হাতে পানির গ্লাসটা দিল লাবু ভাই। সোমাকে তাড়াতাড়ি এ ঘর থেকে বিদায় করতে চাইল লাবু ভাই। বলল,“দুই কাপ চা দিতে বল তো।”
চলে গেল সোমা। এবার নয়নকে ধরল লাবু ভাই।
“সারা দিনে আমার এইখানে কত লোক আসে তুই জানিস? সবাইকে চা নাস্তা খাওয়াইলে তো আমি ফকির হয়ে যাব।”
“হ্যাঁ।” সমঝদারের মত মাথা ঝাঁকালো নয়ন।
“তাইলে লাবু ভাই...”
ইচ্ছা করেই কথা শেষ করল না আরিফ। আব্দারের সুর তার কন্ঠে। লাবু ভাইয়ের ঠোঁটে হাসি দেখে মনে আবার আশা জাগতে শুরু করেছে তার। ডানে বাঁয়ে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁলো লাবু ভাই। এই ছেলেগুলোর সাথে আর পারা গেল না। ঠিক আছে কয়েকটা ফোন করা তো শুধু। করে দেবে। ধমকের সুরে বলল,
“আচ্ছা দেখি কি করতে পারি। না করলে তো আবার বলবি..”
কথা শেষ করতে দিল না নয়ন। দাঁত কেলিয়ে বলল,
“কিচ্ছু বলব না লাবু ভাই। আমরা সবাই জানি আপনি কত ভাল মানুষ।”
হেসে ফেলল আরিফ। ভ্রু কুঁচকে নয়নের দিকে তাকালো লাবু ভাই। তবে ভুরুর নীচের চোখ দুটোয় স্নেহের ছোঁয়া।
(পর্ব ১১) (পর্ব ১২) (পর্ব ১৩)
(শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১২