ইন্দ্র একটি বনের ধারে বেরাতে বেরিয়ে দেখলো সেখানে কয়েকজন রূপসী নারী পুকুরে নেমে স্নন করছে। তাই দেখে ইন্দ্রের মনে দুষ্টমি বুদ্ধি এলো, ইন্দ্র বায়ু হয়ে সবার জামা-কাপর একসাথে মিশিয়ে দিলো। মেয়ে গুলির মধ্যে ছিলো শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী এবং অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠা ভুল করে দেবযানীর কাপড় পরে ফেলে। তাই দেখে দেবযানী গেলো রেগে। শর্মিষ্ঠাকে অসুরী, সদাচারহীনা বলে গালি দিয়ে বললো, তুই আমার কাপড় পরলি কেনো?
গালি শুনে শর্মিষ্ঠাও রেগে গেলো। দেবযানীকে বললো তোর পিতা আমার পিতার কর্মচারী, আমার পিতার তোষামোদ করে, আমার পিতার দানে চলে। তুই যাচকের কন্যা, আমি দাতার কন্যা।
আদুম্বস্ব বিদুম্বস্ব দ্রুহ্য কুপ্যস্ব যাচকি।
অনায়ুধা সায়ুধায়া রিক্তা ক্ষুভ্যসি ভিক্ষুকি ।
লপ্স্যসে প্রতিযোদ্ধারং ন হি ত্বাং গণয়াম্যহম।।
অর্থ - যাচকী, যতই বিলাপ কর, গড়াগড়ি দে, বিবাদ কর বা রাগ দেখা, তোর অস্ত্র নেই আমার অস্ত্র আছে। ভিক্ষুকী, তুই নিঃস্ব হয়ে ক্ষোভ করছিস। আমি তোকে গ্রাহ্য করি না, ঝগড়া করবার জন্য তুই নিজের সমান লোক পাবি।
দেবযানী নিজের কাপড় নেয়ার জন্য কাপড় ধরে টানতে লাগলো, তখন শর্মিষ্ঠা তাঁকে এক কূপের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেলো।
সেই সময় হরিণ শিকার করতে বেরিয়ে ক্লান্ত ও পিপাসিত হয়ে রাজা যযাতি সেই কূপের কাছে উপস্থিত হলো। রাজা যযাতি দেখলো কূপের মধ্যে রূপসী এক কন্যা পরে আছে। দেবযানী নিজের পরিচয় দিয়ে বললো তাকে হাত ধরে টেনে তুলতে। যযাতি দেবযানীকে উদ্ধার করে সেখানে রেখে নিজের রাজধানীতে চলে গেলো।
দেবযানীর দাসীর মুখে ঝগড়ার খবর শুনে শুক্র তখনই সেখানে এলো। দেবযানী তার বাবাকে শর্মিষ্ঠার বলা সকল কথা জানালো। সব শুনে শুক্র বলল - "যিনি সজ্জন তাঁর পক্ষে নিজের গুণবর্ণনা কষ্টকর।" ওঠ আমরা শর্মিষ্ঠাকে ক্ষমা করে দেই, কারণ "সাধুজনের ক্ষমাই শ্রেষ্ঠ গুণ। ক্ষমার দ্বারা ক্রোধকে যে নিরস্ত করতে পারে সে সর্ব জগৎ জয় করে"।
দেবযানী বললো - কিন্তু পন্ডিতরা বলেন নীচ লোকের কাছে অপমানিত হওয়ার চেয়ে মরণ ভাল। অস্ত্রাঘাতে যে ক্ষত হয় তা সারে কিন্তু বাকক্ষত সারে না।
মেয়ের কথা শুনে শুক্র এবার দানবরাজ বৃষপর্বার কাছে গিয়ে বললো- "পাপের ফল সদ্য দেখা যায় না, কিন্তু যে বার বার পাপ করে সে সমূলে বিনষ্ট হয়"। আমার নিষ্পাপ শিষ্য কচকে তুমি বার বার হত্যা করিয়েছিলে। তোমার মেয়ে শর্মিষ্ঠা আমার কন্যাকে নানান কটু কথা বলে শুনিয়েছে। শেষে তাকে কূপে ফেলে দিয়েছে। আমরা আর তোমার রাজ্যে বাস করব না।
দানবরাজ বৃষপর্বা শুক্রচার্যকে নানান ভাবে অনুনয় করে ফিরাতে চেষ্টা করতে লাগলো। তখন শুক্র বললো দেবযানী থাকতে রাজি হয় তাহলে আমিও থাকতে রাজি আছি।
দানবরাজ বৃষপর্বা দেবযানীর কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে পড়ে বললো, দেবযানী তুমি যা চাইবে তাই দেব। শুধু এই রাজ্য ছেড়ে চলে যেও না।
দেবযানী বললো- সহস্র কন্যার সহিত শর্মিষ্ঠাকে আমার দাসী হতে হবে, আমার বিয়ে হলে তারা আমার সঙ্গে যাবে।
শুক্রাচার্যের রোষ থেকে বাঁচতে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসীত্ব স্বীকার করে নিলো।
দেবযানী, শর্মিষ্ঠা ও রাজা যযাতির ত্রিমুখী প্রেম
একদিন দেবযানী শর্মিষ্ঠা ও সহস্র দাসীর সঙ্গে বনে বেরাতে গেলে সেখানে শিকার করতে আসা রাজা যযাতি উপস্থিত হয়। যযাতি দেখলেন, রত্নখচিত স্বর্গীয় এক আসনে অপরূপ রূপসী স্বর্ণালংকারে সজ্জিত দেবযানী বসে আছে। স্বর্ণালংকারে সজ্জিত রূপে অতুলনীয়া অন্য একটি মেয়ে নিচু একটি আসনে বসে দেবযানীর পদসেবা করছে।
রাজা যযাতি দেবযানীর সাথে আলাপ করতে লাগলেন। দেবযানী নিজেদের পরিচয় দিলেন। দেবযানির চেয়েও অধিক সর্বাঙ্গসুন্দরী অসুররাজকন্যা শর্মিষ্ঠাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। অসুররাজকন্যা শর্মিষ্ঠা দেবযানির দাসী সেটা জানতে পেরে রাজা অবাক হলো।
এদিকে রাজা যযাতিকে দেখে দেবযানীর খুব পছন্দ হয়ে যায়। তাই সে রাজাকে বলে তাকে বিয়ে করলে শর্মিষ্ঠা আর সমস্ত দাসী রাজার অধিন হবে। যযাতি ক্ষত্রিয় রাজা বলে ব্রাহ্মণ কন্যা দেবযানীর প্রস্তাবে রাজি হয় না। , সুন্দরী , আমি আপনার যোগ্য নই , আপনার পিতা ক্ষত্রিয় রাজাকে কন্যাদান করবেন না। দেবযানী জানালো ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয় পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। দেবযানী তখন তাঁর পিতাকে ডেকে এনে বললো এই রাজা যযাতি তার পাণি গ্রহন করে কূপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন। আপনি আমাকে এর সাথে বিয়ে দিন। আমি একে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না।
শুক্র বললেন- "প্রণয় ধর্মের অপেক্ষা রাখে না।" আমি আমার মেয়ে দেবযানীকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিলাম। আর বৃষপর্বার কন্যা কুমারী শর্মিষ্ঠাকে স্বসম্মানে রাখবে। কিন্তু একে কখনো শয্যাসঙ্গী করোনা।
দেবযানী শর্মিষ্ঠা আর দাসীদের নিয়ে যযাতি তাঁর রাজধানীতে ফিরে গেলেন। দেবযানীকে নিজের মহর্ষী করে প্রাসাদে স্থান দিলেন।
দেবযানীর অনুমতি নিয়ে তিনি অশোক বনের কাছে শর্মিষ্ঠার জন্য আলাদা বাড়ি নির্মাণ করে দিলেন। সহস্র দাসীও শর্মিষ্ঠার কাছে রইল।
অনেক দিন পরে দেবযানীর একটি ছেলে জন্ম নিলো। তাই দেখে শর্মিষ্ঠা ভাবলো তারও একজন স্বামী চাই, পুত্র চাই, নইলে তার এই ভরা যৌবন বৃথা হয়ে যাবে।
একদিন রাজা যযাতি বেড়াতে বেড়াতে অশোক বনে এসে পড়লেন। তখন শর্মিষ্ঠা রাজাকে তাঁর সাথে মিলনের জন্য আহবান করলো। রাজা যযাতি শুক্রাচার্যের নিষেদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন শর্মিষ্ঠাকে।
তখন শর্মিষ্ঠা বললো-
ন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি ন স্ত্রীষু রাজন্ ন বিবাহকালে।
প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি।
অর্থ- পরিহাসে, স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জনে, বিবাহকালে, প্রাণসংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনায়, এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না।
রাজা যযাতি বললেন- "আমি রাজা হয়ে যদি মিথ্যা কথা বলিতাহলে প্রজারাও মিথ্যা বলা শুরু করবে।
শর্মিষ্ঠা আরো বললো- "যিনি সখীর পতি তিনি নিজের পতির তুল্য, দেবযানীকে বিবাহ করে আপনিও আমার পতি হয়েছেন। পুত্রহীনার পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনার প্রসাদে পুত্রবতী হয়ে আমি ধর্মাচরণ করতে চাই।"
তখন যযাতি শর্মিষ্ঠার সাথে মিলিতো হয়ে তাঁর প্রার্থনা পূরণ করলেন।
====================================================================
বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যের মহাকাব্য মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। আমি মনে করি "যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মানুভূতিতে খোঁচা দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।" এই গ্রন্থে প্রচুর কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে পেশ করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তারা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন। মনে রাখতে হবে আমার এই পোস্ট কোনো ভাবেই ধর্মীয় পোস্ট নয়।
লেখার সূত্র : কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু।
ছবির সূত্র : এই সিরিজে ব্যবহৃত সকল ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত।
====================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১, মহাভারতের গপ্পো - ০০২, মহাভারতের গপ্পো - ০০৩, মহাভারতের গপ্পো - ০০৪
মহাভারতের গপ্পো - ০০৫, মহাভারতের গপ্পো - ০০৬, মহাভারতের গপ্পো - ০০৭, মহাভারতের গপ্পো - ০০৮
মহাভারতের গপ্পো - ০০৯, মহাভারতের গপ্পো - ০১০, মহাভারতের গপ্পো - ০১১
====================================================================
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১২:৩৪