somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূতির খালের হাওয়া ১৭ - করোনাকালে আমার বিগত ১ বছরের সক্রিয় ব্লগিং এর ফিরিস্তি, এবং ব্লগ সম্পর্কীয় আমার কিছু পর্যবেক্ষণ

২০ শে মার্চ, ২০২১ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০২০ সালের মার্চের ১৭ তারিখ থেকে আমার অফিস / বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, এবং ১৩ বছর আগে এসএসসি পরীক্ষার বেড়া পার করে আসার পর, প্রথমবারের মতো আমি একটা ছুটি, এবং নিজের মতো করে কাটাবার সময় পাই, যখন আমার মাথায় কোন কাজের চাপ নেই। মন, পৃথিবীর জুড়ে নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অন্যান্য মানুষদের মতই একটা গুমোট অবস্থায় আক্রান্ত ছিল কোভিড ১৯ এর সূত্রে উৎপাদিত এক অজানা অপরিচিত আতঙ্কে। বেতনভাতা, চাকরীবাকরি - এসবের নরমালাইজেশন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তারপর, ইউজিসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অনলাইন ক্লাস শুরু করবার সিদ্ধান্ত দেয়ার পর আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আমাদের কর্মস্থল, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি - প্রথম যে মাস আমরা স্রেফ ছুটিতে ছিলাম, সরকারের সিদ্ধান্তের অনুবর্তী হয়ে , সে মাস সহ আমাদের সকল মাসের বেতনভাতা, এমন কি সমস্ত বোনাসসমূহ সময়মতো আমাদের দিয়ে কর্মচারীদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে। অনেক প্রাইভেট অর্গানাইজেশন কর্মীদের বেতনভাতা ছাঁটাই, বোনাস না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের শুরুরদিকের সাময়িক অনিশ্চয়তা দূর হবার পর আর এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করা লাগে নি। মনোযোগ দিয়ে অনলাইনে ক্লাস নেয়া, আর বাকি সময় রেগুলার জীবনযাপনের পাশাপাশি বই পড়া, চিন্তা করা, লেখা।

সামহয়ারইনব্লগে বিগত এক বছরে আমার একটা বড় সময় ইনভেস্ট করা হয়েছে। সামুতে রেজিস্ট্রেশন আরও সাড়ে সাত বছর আগে করলেও সামুতে সবচে সচেতনভাবে সময় দেয়া, আমার এই একবছরেই। আজকের এই লেখাটি, আমার বিগত একবছরে ব্লগ পর্যবেক্ষণ, নিজের ও অন্যান্য ব্লগলেখকদের লেখা ও কাজের মূল্যায়ন সংক্রান্ত।

সন্দেহাতীতভাবে গত একবছরে আমি আমার ব্লগে সক্রিয় সময়কালের সবচে বেশী লেখা শেয়ার করেছি। ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে নিয়ে ২০২১ সালের মার্চের আজকের দিন (২০) পর্যন্ত এটা আমার শেয়ারকৃত ৭১ তম লেখা। ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করার পর, এক বছরে এতগুলো লেখা আমি কখনো শেয়ার করি নি। আমার ব্লগিয় পরিসংখ্যানে গেলে দেখা যাবে, আমার কৃত মোট পোস্ট সংখ্যা ১১৪। আমার ড্রাফ্‌টে আছে আরও ৯১টি লেখা। সব মিলিয়ে লেখা ২০৫। তার থেকে ৭১ বাদ দিলে থাকে ১৩৪। তারমানে, ছয় বছর পাঁচমাসে আমার শেয়ারকৃত লেখার সংখ্যা ১৩৪, আর গত একবছরে ৭১। এখন, এই লেখার মান কি ছিল, তাতে কার কি লাভ বা ক্ষতি হয়েছে - সে ব্যাপারে আমার মন্তব্য করা নিরর্থক। কিন্তু আমার যে লাভ হয়েছে, তা হল এই যে - গুছিয়ে বয়ান তৈরি করার অভ্যাস গঠন। যেকোনো বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে আমি নিজের মতো আর্গুমেন্ট বিলডআপ করার অভ্যাস তৈরি করেছি গত এক বছরে। আমি মূলত সৃজনশীল কথাসাহিত্যের চর্চাই করেছি আজ পর্যন্ত। পত্রপত্রিকার প্রয়োজনে কখনো কখনো কলাম / প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। কিন্তু নিজের তাড়নায় প্রবন্ধ লেখার চর্চা আমার হয়েছে এই গত এক বছরেই। বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বিউপনিবেশায়ন, চিন্তার কারখানা, সূতীর খালের হাওয়া, আর বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীরনগর - বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস নামে চারটি ধারাবাহিক প্রবন্ধের সিরিজ আমি লিখছি নিয়মিত, যার চারটিই আলাদা বই আকারে ভবিষ্যতে বাজারে আসতে পারে।

নিজের ব্লগে লেখার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা এই পর্যন্ত শেয়ার করে, এখন ব্লগ সংক্রান্ত আমার কিছু পর্যবেক্ষণ শেয়ার করি।

প্রথমত, লকডাউন চললেও, এবং সাধারণ ব্রাউজার দিয়ে প্রবেশ করা গেলেও, এই সময়কালে আমার দৃষ্টিতে ব্লগারদের সক্রিয়তা আগের মতো ছিল না। আমরা যারা ২০১২ - ১৩ সেশনে ব্লগে রেজিস্ট্রেশন করেছি, তার আগের সময়ের কিছু রূপকথা / মিথ আমরা প্রায়ই শুনি, শত শত ব্লগার অ্যাক্টিভ থাকতেন সবসময়, লেখা প্রথম পাতায় আসার পর চোখের নিমিষে তা দ্বিতীয়পাতায় চলে যেতো। এমন অবস্থা আমার মনে পড়ে না আমি দেখেছি কিনা। কারন, সচেতনভাবে খেয়াল করতাম না। ২০১৩ সাল থেকে নিয়ে ২০২০ এর লকডাউনের আগপর্যন্ত আমার লেখায় যারা মন্তব্য করতেন, তাদের লেখাতেই আমি মন্তব্য করতাম। তবুও, সেই প্রাথমিক দিনগুলোর লেখা যখন বের করি, প্রতিটা লেখার পীঠে গড়ে দশটা করে মন্তব্য, আর তিনশো বার পঠিত হবার ইতিহাস দেখতে পাই, বুঝি পার্থক্যটা তৈরি হয়েছে কোথায়। গত একবছরে সংখ্যার দিকও যদি বিবেচনা করি, ব্লগে সক্রিয়তা কম দেখেছি মানুষের। পুরনো যাদের সাথে ব্লগে মিথস্ক্রিয়া হতো, তাদের আশি শতাংশ এখন আর ব্লগে সক্রিয় না।

দ্বিতীয়ত, আমার এই অব্জারভেশনে অনেকেই কষ্ট পাবেন, তবুও, নৈব্যত্তিকভাবে এটা নেয়ার অনুরোধ। গত এক বছরে আলোচনায় অংশ নেয়ার মতো আগ্রহ খুব কম লেখা পাঠের প্রেক্ষিতেই তৈরি হয়েছে। সোজা বাংলায় বললে, পড়েই মন্তব্য করতে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, এমন লেখা কম পেয়েছি।

সাধারণ ফিচারধর্মী যে লেখাগুলো পড়েছি, সেগুলো এতটাই রেটোরিক, এবং সেলফ এক্সপ্লানেটরি যে, মন্তব্য করলে ওগুলোর পীঠে স্রেফ এটাই করা সম্ভব - 'অনেক পরিশ্রম করে পোস্টটা তৈরি করেছেন, এজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।' অথবা, কিছু না পড়েই - 'ভালো লাগলো।' এসমস্ত পীঠ চুলকে দেয়া মন্তব্যে নিজের ব্লগেরও পাঠক বাড়ে। মন্তব্য পাওয়া যায়। কিন্তু আমার আগ্রহ হয় নি এই কাজটা করে নিজের ব্লগের পাঠক বাড়ানোর। লেখা, জনরা এক্সক্লুসিভভাবে, সেটাই বা সেগুলোই উত্তম, যা পাঠকের মনে চিন্তার উদ্রেক ঘটায়। প্রশ্নের জন্ম দেয়। নিজে নিজে সবকিছু ব্যাখ্যা করে দেয় না, বরং পাঠকের জন্যেও ভাবার অবকাশ রেখে দেয়। তথ্যমূলক ফিচার আমার - আপনার থেকে অনেক সুলিখিতভাবে অনলাইনে আছে। আমি আপনি যদি নিজের ভাবনাটুকু নিপাট তথ্যের সঙ্গে যুক্ত না করি, তবে তা আর আমার লেখা হল কীভাবে?

তৃতীয়ত, ব্লগ, গত একবছর, দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্লেইন ধর্মীয়, এবং ইসলামোফোবিক লেখার বন্যায় ব্লগ ভেসে গেছে।

কোরআন সুন্নাহর আলোকে জীবনের এদিক সেদিক ব্যাখ্যার আগ্রহ দেখেছি কারো কারো ভেতরে। মন থেকে , মুসলিম হিসেবে, চেষ্টা করেছি এ প্রয়াসগুলোকে ভালো লাগাবার। কিন্তু এই তাবলীগের প্রয়াস, চিন্তাশীল মুসলিম হিসেবে আমার আত্মার খোরাক হয় নি। কারন, ব্লগে আমি কোরআন হাদিস শিখতে আসি না। ওটার জন্যে নির্দিষ্ট ধর্মীয় জায়গা আছে। জুমার নামাজে খুতবা আছে, মসজিদে মসজিদে সাপ্তাহিক তাফসীর, বা হাদিসের দরস আছে, নিজের কোরআনের তাফসির পাঠের সুযোগ আছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে গেছি, এখন আল্লাহ খোদার নাম নিয়ে লিখতে থাকি ক্রমাগত - এই চিন্তা থেকে ব্লগে ধর্ম নিয়ে লেখা যায় বটে। তবে তাতে ধর্মকে একটা স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, নিজের বেহেস্ত কামানোর একটা রাস্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ব্লগে যেকোনো ধর্মীয় প্রথা নিয়ে লিখতে চাইলে, আমার মতে, দুটো জিনিস প্রয়োজন - এক, সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে যুগজিজ্ঞাসাসমূহের জবাব দেয়ার প্রয়াস; দুই, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে, নিজের বুঝ অনুযায়ী কোরআন বা হাদিসের বর্ণনা।

একটা উদাহরণ দিই।

ওয়াজ মাহফিলের মৌলভি সাহেবানদের নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। তার মধ্যে একটা এই যে - তারা দাবী করেন, কোরআনের ভিতরেই সমস্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাপারস্যাপার ব্যাখ্যা করা আছে। বা, কোরআন সমস্ত বিজ্ঞানের আঁধার। এ দাবী নিয়ে মুসলমানবিদ্বেষী ইসলামোফোবরা ব্যাপক হাসাহাসি করে। আমার মতো সাধারণ মুসলমানেরা বিব্রত হয়। বিরক্ত হয়।

আমার কোরআনের তাফসির পাঠের অভিজ্ঞতা আমাকে এটা বলে, কোরআন - ক্লাসিক্যাল সায়েন্স, বা টেকনোলজি বলতে যা বুঝায়, সেটা শিক্ষাদানের বই না। আমার বুঝ হল, কোরআন মানুষকে আপাত লক্ষ্যহীন জান্তব জীবনকে অতিক্রম করে জীবনের একটা লক্ষ্য নির্ধারণে বিশ্বাসীকে সাহায্য করে। এভাবে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া, আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাবো - এসমস্ত প্রশ্নের উত্তর, এবং পৃথিবী দেখার এক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরিতে সহায়তা করে।

তবে, এটাও বোঝা দরকার যে এ সহায়তা সবার জন্যে নয়। সূরা বাকারার তৃতীয় আয়াতেই স্পষ্ট করে বলা আছে - 'হুদাল্লিল মুত্তাকিন'। অর্থাৎ - এই গ্রন্থ স্রেফ আল্লাহভীরুদের জন্যে পথ প্রদর্শক।

এই প্রিজাম্পশনটা বোঝা দরকার।

যদি আপনি সত্যি সত্যি পথ খোঁজার উদ্দেশ্যে এই মহাগ্রন্থ খুলে বসেন, তবে কোরআন আপনাকে পথ দেখাবে। যদি আপনি আসলেই সাহায্য চান, তবেই শুধুমাত্র কোরআন আপনাকে সাহায্য করবে। কোরআন নিয়ে যারা টাল্টিবাল্টি করে, দেখি তো - আমি যতটুকু জানি তারচে' বেশী কিছু এই বইয়ে আছে কিনা - এইধরনের চ্যালেঞ্জিং মন মানসিকতা নিয়ে যারা কোরআনকে অ্যাপ্রোচ করে , কোরআন তাদের জন্যে উন্মুক্ত হয় না। এইজন্যে আমাদের দোয়া শিক্ষা দেয়া হয় - 'রব্বিশ রহলি সদরি' , হে আমার প্রতিপালক, আমার অন্তরকে আপনি খুলে দিন, উন্মোচন করুন, সক্ষম করুন, প্রস্তুত করুন আপনার প্রদিত জ্ঞানের ভার বহনে।

দ্যাট বিয়িং সেইড, কোরআন গ্যালিলিও, নিউটন, বা আইনস্টাইনের রচিত জার্নাল পেপারের মতো বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলি ব্যাখ্যা করে না, কিন্তু কোরআনে আল্লাহ বার বার বলেন - আসেপাশে তোমরা যা দেখো, আসমান বা জমিন, পর্বত , সমুদ্র, বৃক্ষ এবং জীবজন্তু, তার সবই আমি সৃষ্টি করেছি 'শাআইরিল্লাহ', বা আমার অস্তিমানতার চিহ্ন হিসেবে। অতএব তোমরা বেরিয়ে পড়ো পৃথিবীতে, খুঁজে দেখো, তত্ত্বতালাশ করো আমার সৃষ্টির, যাতে তোমরা সৃষ্টির নিগুঢ় রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে আমার প্রতি বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় করতে পারো। সে অর্থে, কোরআন আমাদের পৃথিবীকে, সৃষ্টিকে আরও গভীরভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে। বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলে।

মুসলমান, আর নাস্তিক বিজ্ঞানীর পার্থক্য হল এই - মুসলমান গবেষক গবেষণা করে সৃষ্টির এক নতুন সূত্র উতঘাটনের পর স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেবে, এবং স্রষ্টার অপার রহস্যের আর একটি নতুন দ্বার উন্মোচনের জন্যে শুকরিয়া আদায় করবে। আর নাস্তিক বিজ্ঞানী, নতুন কিছু আবিষ্কারের পর নিজের মানসিক ক্ষমতা দক্ষতার ওপর ফোকাস আনবে, নিজের সক্ষমতার ওপর বড়াই করবে, এবং দাবী করবে পৃথিবীতে কোন ফার্স্ট মুভার নেই, বরং সবকিছু নিজে নিজেই হয়। তো, এভাবে, কোরআন একজন বিশ্বাসী বিজ্ঞান গবেষকের মস্তিষ্ককে আরও ডাউন টু আর্থ করবে, এবং নতুন নতুন গবেষণার জন্যে প্ররোচিত করবে।

এটা আমার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া কোরআনের সঙ্গে।

কিন্তু কোরআন নিজেই একটা বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ, বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বলতে সায়েন্সের জার্নাল যেমন, তেমন কিছু - এটা প্রমানের জন্যে যদি আমি কোরআন হাদিস থেকে লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতি দিতে থাকি, আমার মনে হয় না এটা আমার কোরআনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সংক্রান্ত সঠিক বুঝের ফসল হবে, বরং এতে করে ইসলামোফোবদের আরও হাসিঠাট্টার উপকরন হাতে তুলে দেয়া হবে।

বরং নিজের কাছে একটা প্রশ্ন করা যাক, কোরআনের লক্ষ্য কী পৃথিবীর ইটপাথর, মাংসের পিণ্ডসমূহকে নিয়ে লেকচার দেয়া? নাকি যে জ্ঞান মানুষ কখনো নিজের চেষ্টায় অর্জন করতে পারতো না, পৃথিবী দেখার সে দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান?

মুসলমান হিসেবে নিজেকে প্রশ্ন করলে আমরা সমস্যাটা কোথায় তৈরি করছি, বুঝতে পারার কথা।

এই গেলো ব্লগে তাবলীগ করার উদ্দেশ্যে আশা ধর্ম নিয়ে লেখা পোস্টগুলোর ব্যাপারে আমার অভিমত।

অপরদিকে, রেডিকেল / মিলিট্যান্ট / ষ্টেট এথিজম ইত্যাদি একটা উল্লেখযোগ্য পরিসরে প্র্যাকটিস হওয়া শুরু হবার পর, ইসলামোফোবিয়া - একটা ক্যারিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ইসলামবিদ্বেষ, বা, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মুসলমানবিদ্বেষ আরও প্রবল হয়েছে, এবং, দিন যত যাবে, তা আরও প্রবল হবে। আমাদের এই প্লাটফর্মেই অনেকেই মুক্তমনা, আধুনিক, বিজ্ঞানমনসতা বলতে মূলত ইসলামোফোবিয়া প্রমোট করেন। এটার নানাবিধ কারন থাকতে পারে -

১। কেউ কেউ আসলেই নিজের 'আধুনিক' হওয়ার প্রমাণস্বরূপ আমমানুষের ধর্মবিশ্বাসকে গালি দেয়াকে গুরুত্বপূর্ণ কৃতকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেন, এবং যেহেতু আমাদের দেশ মুসলিম প্রধান, কাজেই আগে বাংলাদেশের মুসলমানদেরই গালি দেয়া , তাদের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, তাদের ব্যাঙ্গবিদ্রুপ করাকে দরকারি কাজ মনে করেন। তারা ভুলে যান এই 'আধুনিকতা' র সংজ্ঞা পশ্চিমা লেন্সে তৈরি, এবং সবকিছুকে ইহুদী নাসারাদের ষড়যন্ত্র মনে করতে না চাইলেও, একদা ঔপনিবেশিক একটি দেশের মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দ্বারা সৃষ্ট সমস্ত সংজ্ঞাকে, সমস্ত তত্ত্বকে আপনার সতর্ক দৃষ্টিতে দেখতে হবে, বিবেচনা করতে হবে। নাহলে সমূহ বিপদ। কি বিপদ, এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণামূলক, বা জার্নালিস্টিক লেখা লিখা হয়েছে। পড়ে দেখেন। যাই হোক, এই একটা গ্রুপ অথেনটিক বিশ্বাসের জায়গা থেকে , নিজের অজান্তে ইসলামোফোবিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তা ছড়ান। পাশ্চাত্য আধুনিকতার সংজ্ঞায় তাদের ঈমান, ধর্মান্ধ বলে যাদেরকে তারা গালি দেন, তাদের চে' কোনভাবেই আলাদা কিছু নয়।

২। কেউ কেউ ইসলামোফোবিয়াকে, এক্স মুসলিম পরিচয়কে পুঁজি করে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। আমার এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অনেক তথ্য প্রমাণ নেটে আছে। ব্লগে গেল বছর কিছু ইসলামোফোবের সঙ্গে তর্কের সূত্রে ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে তসলিমা নাসরিনের খুব সম্ভবত বাংলা ট্রিবিউনের একটা লেখা পেয়েছিলাম, যাতে তসলিমা উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন, আজকাল বাংলাদেশের অনেকে একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে কমিউনিটি রিলিজিয়নকে বালছাল দু চারটে গালাগালি করে বিদেশে অ্যাসাইলেম নেয়ার চেষ্টা করে। অথচ তার সময় ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল, এবং তিনি অনেক কঠোর চেষ্টার দ্বারা বিদেশের মাটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। তার অর্থ এই দাঁড়ায়, তিনি ইসলামোফোবিয়ার পক্ষে বটে, কিন্তু তিনি এটাও মনে করেন যে, বাংলাদেশে কতিপয় মানুষ আপামর জনতার ধর্মবিশ্বাসকে গালি দেয়াকে এখন পাশ্চাত্যে পাড়ি জমাবার টিকেট হিসেবে বিবেচনা করছে।

৩। মুসলমানদের দমন পীড়ন নিষ্পেষণ চালানোটা আজ পৃথিবীর বেশ কিছু দেশের জন্যেই রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। তারা পেশাদার কলম সৈনিক ভাড়া করতে পারেন, যারা মুসলমানদের মোরাল অবস্থানটাকে নীচে দেখিয়ে উপস্থাপন করবে তাদের লেখনীর দ্বারা, যাতে বিলিভার মুসলিমসদের নিচু মনমানসিকতার জীব হিসেবে রিপ্রেজেন্ট করে তাদের জোর জবরদস্তিমূলক 'এনলাইটেন' করার মহান উদ্যোগ হাতে নেয়া যায়।

যাই হোক, এ সব কিছুর ব্যাপারে আমি সচেতন। জাস্ট গত একসপ্তাহে এই ব্লগে যে পোস্ট এবং মন্তব্য জমা পড়েছে, তা থেকে কোট করে করে, বা স্ক্রিনশট দেখিয়ে দেখিয়ে আমি বোঝাতে পারবো, মূলত আমি - আপনি যে মুসলমান, স্রেফ এই পরিচয়টার জন্যে আমাকে আপনাকে লজ্জিত, হীনমন্য করবার জন্যে কতোজন সক্রিয় আছে।

এরা সংঘবদ্ধ। এক সঙ্গে কাজ করে। মুসলমানদের কাধ থেকে অপরাধবোধের বোঝা হালকা করবার প্রয়াসে লিখিত যেকোনো পোস্টে এরা দলবদ্ধভাবে বিবিধ ছদ্মনাম, বা নিকের আড়ালে এসে হাজির হয়। আফসোসের ব্যাপার, আমরা যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশিল পরিচয়সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, বা ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লিখি, আমাদের মধ্যে এই অ্যালায়েন্সটা, অন্তত গত এক বছরে আমার চোখে পড়ে নি।

এদের নিজেও এই একবছরে বহুবার এদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছি, কারন, এরা মূলত চায় আমাকে আমার ধর্মীয় পরিচয়, আমার বিশ্বাসের জন্যে আমাকে লজ্জিত বোধ করাতে। আমি তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই।

কিন্তু আমাদের বিচ্ছিন্নভাবে রুখে দাঁড়ানোর ফলশ্রুতিতে যে তারা তাদের মিশন বন্ধ করবে, এমনটা নয়। তারা সার্কুলার একটা ডিবেট চালিয়ে যাবে, যে ডিবেটের কোন শেষ নাই।

এই ব্লগে সক্রিয় ইসলামোফোবদের লেখার মান, মেধা মিলিট্যান্ট এথিস্ট বা ইসলামোফোবদের গুরুদের ধারেকাছ দিয়েও না। আমি খুব খুশী হতাম, যদি তারা ক্রিস্টোফার হিচেন্স, স্যাম হ্যারিস, রিচারড ডকিন্সের লেখা পড়ে, সেগুলো নিয়ে , সেগুলোর উপর ভিত্তি করে নিজেদের যুক্তিউপাত্তগুলি তৈরি করতো । একটা পারটিকুলার ধর্মবিশ্বাসকে স্রেফ গালিগালাজ করাই তো যথেষ্ট না। আপনি যদি আসলেই মানুষের বিশ্বাসকে বদলাতে চান, তাহলে সবার আগে আপনাকে তার ইগোতে আঘাত দেয়া বন্ধ করতে হবে। আমি প্রচুর পরিমাণে ফোর হর্সম্যান অফ এইথিজমের লেকচার শুনি, তাদের কাউন্টার আর্গুমেন্টগুলোও শুনি, নিজে নিজে তাদের রেফিউট করার চেষ্টা করি। প্রফেসর হুমায়ূন আজাদের লেখাও, পড়া, অনেকাংশেই আমার কাছে সময়ের অপচয় মনে হয়, কারন তিনি নিজেও সেকেন্ডারি সোর্স। তার "নাস্তিক্য" বা ইসলামোফোবিয়া বারট্র্যান্ড রাসেলের দ্বারা ইন্সপায়ারড। কাজেই আমার রাসেলকে বুঝলেই আজাদের যুক্তি বোঝা সহজ হয়ে যায়।

যাই হোক, ইসলামোফোবিয়া স্প্রেড করার মিশনে যারা আছে, তাদের নিয়ে কোন শেষ কথা আমি বলতে পারলাম না। কারন, আগেই বললাম, এটা একটা পেশা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে পরিচয় সন্ত্রাস ছড়িয়ে পয়সা কামানো যায়, পাশ্চাত্যের দেশে অ্যাসাইলেম নেয়া যায়, যুক্তি দিয়ে একটা পেশাকে তো বন্ধ করা সম্ভব না।

তবে ভবিষ্যতে দিন যত যাবে, আমি ধর্ম নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলা তত কমানোর জন্যে সচেতনভাবে চেষ্টা করবো। কারন আমার লাইফের মূল মিশন ঔপন্যাসিক হওয়া। মুসলমানদের পক্ষে কথা বলতে বলতে নিশ্চিতভাবে আমার বিরুদ্ধে জামাত শিবির জঙ্গির ট্যাগ ব্যাবহার করবে এমন মানুষজন যারা একটা পার্টিকুলার সেক্টের মানুষকে, অর্থাৎ মুসলিমদের পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যে সম্ভব নয়, এটা মানতে চাইবে না। এবং, আমার সাধারণজ্ঞান বলে, সেই ট্যাগিং এর মুহূর্তে আমার পক্ষে কথা বলতে আম পাবলিকদের কেউ এগিয়ে আসবে না।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আমার জীবনে পড়া গভীরতম ঔপন্যাসিকদের একজন। কমলকুমার অনেক শ্রদ্ধেয় লেখক। তারা দুজনেই তাদের সনাতনধর্মের ঈশ্বর / তাদের মন্ত্রগুরুর নাম বইয়ের শুরুতে লিখে উপন্যাস শুরু করেন। কিন্তু আমি যদি বাংলাদেশী মুসলিম ঔপন্যাসিক হিসেবে শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিখে উপন্যাস শুরু করি, এডিট করে হলেও আমার 'জামাতের কোন সেশনে মূল আলোচক' হিসেবে ছবি বের করা হবে, যদিও, জামাত যখন শেষ ক্ষমতায় ছিল, আমি তখন নিতান্ত স্কুলের শিশু।

ধর্মের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা দেখতে দেখতে আমি খানিকটা বিরক্ত। নিজের ধর্মের দুর্বল রিপ্রেজেন্টেশন দেখতে কষ্ট লাগে। আবার ধর্মবিশ্বাসীদের হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা দেখেও আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। ক্যুরা ডট কম, বা রিডিটে গেলে দেখা যায় কতো ইন্টারেস্টিং বিষয়ে বছর জুড়ে পৃথিবীর মানুষ আলোচনা করে। অথচ আমরা এখনও ধর্ম বাদ দিয়ে, বা ধর্ম নিয়ে হলেও প্রাসঙ্গিক সময়ের প্রেক্ষিতে গঠনমূলক কোন আলোচনা করতে পারছি না, বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া - এটা হতাশার।

চতুর্থত, ধর্মের ইস্যু বাদ দিয়ে এবার সৃজনশীল লেখার ব্যাপারে মন্তব্য করি।

গত এক বছরে গল্প কবিতা, গভীরভাবে মনে নাড়া দিয়ে যাওয়ার মতো, আমার চোখে খুব স্বল্পই চোখে পড়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমার সেট করা 'গভীরভাবে মনে নাড়া দিয়ে যাওয়া' -র স্কেল কি। উত্তর হচ্ছে, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে পঠিত বিশ্বসাহিত্য, আমার এই স্কেল তৈরির মানদণ্ড। বা, মানদণ্ডের মানদণ্ড।

ব্লগে আগে থেকেই যারা গল্প কবিতার লেখক হিসেবে বিখ্যাত, তাদের এখনকার লেখা পড়লে মনে হয়, তারা একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন। আমি ব্লগে লেখা পড়ি আজ প্রায় ৭ -৮ বছর। এই লম্বা সময় ধরে এই চক্রে ঘুরপাক খাওয়াটা কোন সিরিয়াস লেখকের জন্যে ভালো কথা নয়। তাদের উচিৎ গল্পের ফর্ম, স্ত্রাকচার, বলার ভঙ্গী, সংলাপ লেখা, চরিত্র নির্মাণে বৈচিত্র সৃষ্টিতে মনোযোগী হওয়া। সিনেমা দেখে তার কাহিনী একটু এদিক ওদিক করে লিখে ফেলা, একই প্যাটার্নের সাইকো সিচুয়েশনে গল্পের প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা নিজেকে গড়পড়তা আরেকজন লেখক বানায়। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করা একজন লেখকের জন্যে সবচে বুদ্ধিমানের কাজ। আর গল্প বলার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে নতুন নতুন লেখকের লেখা পড়ে, যারা বিখ্যাত, যারা ক্লাসিক, যারা লেজেন্ড।

নতুন কবিতা যারা লিখছেন, তাদের অনেকের কবিতা পড়ে মনে হয়েছে, নিজের মনে হঠাৎ জেগে ওঠা একটা অনুভূতিকে কোনভাবে শব্দের কাঠামোতে আটকে ছেড়ে দেয়াটাই কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিৎ, পরিচিত, পূর্বব্যবহৃত উপমার কোন পরিবর্তন ছাড়া ব্যবহার, যেকোনো কবির জন্যে আত্মহত্যার সামিল। এজন্যে মনের ভেতরে ভাবকে জারিত হবার সময় দিতে হবে। অনুভূতির বুদবুদের অপর কবিতার কাঠামো দাঁড় করানোটা সমস্যা তৈরি করবে। কবিতা লেখা হয়ে গেলে পরেও নিজের কবিতার কাছে বারবার ফিরে আসতে হবে। শব্দ, বাক্য, ছন্দ (যদি ব্যবহার করা হয়) অদল বদল করে দেখতে হবে। নতুন নতুন শব্দ প্রয়োগ করতে হবে নিরীক্ষামূলকভাবে। কবিতা পড়তে হবে প্রচুর। বাংলা এবং অন্যান্যভাষায়, অনুবাদ কবিতা সহ।

গল্প - উপন্যাস নতুন যারা লিখছেন, তাদের ক্ষেত্রেও বেশী পড়া, এবং একটা গল্প দুবার তিনবার করে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে, গল্পের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা থেকে বর্ণনা আরম্ভ করে, ন্যারেটিভ পয়েন্ট অফ ভিউ বদলে লেখার অভ্যাস করা উচিৎ।

এগুলো আমার ব্যক্তিগত অভিমত। কারুর ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে আহত হবার প্রয়োজন নেই। আপনি যদি ঠিক করে নেন আপনি আজীবন আমি - তুমি মার্কা প্রেমের, বা একই প্যাটার্নের সাইকো থ্রিলার লিখে যাবেন বরাবর, সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। আমার মতামত এখানে কোন গুরুত্ব বহন করে না।

পঞ্চমত , ব্লগে গত এক বছরে যাদের লেখায় সবচে বেশী মন্তব্য জমা পড়েছে, তাদের অনেকের মধ্যেই আমি ফিচার লেখার ঝোঁক লক্ষ্য করেছি। ফিচার লিখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে তারা তা লিখতে পারেন। কিন্তু, খুশী হতাম যদি তারা তাদের পছন্দের কোনো একটা বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতে থাকতেন, এবং তাতে নিজের জ্ঞানের গভীরতা বাড়ানো। দুঃখ লাগে যখন দেখি দর্শন নিয়ে, সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে, ইতিহাস নিয়ে, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে, ভাষাতত্ত্ব নিয়ে, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে, ফিজিক্স, ক্যামিস্ত্রি, বায়োলজির মতো ক্লাসিক্যাল বিষয়াদি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে কেউ লিখছেন না। মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের অহংকার আর গর্বের শেষ নেই আমাদের মাতৃভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা বাড়াতে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিবিধ শাখাপ্রশাখা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বাংলায় লেখা প্রয়োজন। এই দায়িত্ব নেয়ার জন্যে তরুণ যারা ব্লগে সংযুক্ত হচ্ছেন, তাদের আহবান জানাচ্ছি।

ষষ্ঠত , অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন দেশের সমসাময়িক রাজনীতিতে বা সোশ্যাল ফেনোমেনায় আলোচিত যা কিছু, তা নিয়েই গুছিয়ে ছোট করে কয়েক প্যারায়, ২০০ -৩০০ শব্দে ব্লগ লিখতে। যদি স্রেফ কি ঘটনা ঘটেছে, আর ঘটনাটা আপনার মনের সহজাত আবেগের স্ফুরণ কীভাবে ঘটিয়েছে এতটুকু লেখা ছাড়াও উক্ত ঘটনার পূর্বপর ইতিহাস, অতীতের কোন ফেনোমেনার মধ্যে এই ঘটনার সূত্র প্রোথিত তা নিয়ে আপনার আন্দাজ, এবং ভবিষ্যতের জন্যে আমাদের কি শিক্ষা এই ঘটনা থেকে নেয়ার আছে, এই অতীত - বর্তমান - ভবিষ্যৎ প্রাসঙ্গিকিকরনের চেইনটা মেইনটেইন করতে পারেন, তবে তা পাঠকের জন্যেও ভালো, লেখক হিসেবে এই প্রচেষ্টা আপনার চিন্তাশীল সত্ত্বাকেও ডেভলাপ করতে সহায়তা করবে।

সপ্তমত , আমার খুব অবাক লাগে, ইভেন গ্লোবাল পপ কালচার নিয়েও লেখার মতো লোক গত এক বছরে এই ব্লগে কম দেখেছি। পপুলার টিভিসিরিজ, সিনেমা, মিউজিক, সাহিত্য - এগুলো নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হওয়ার কথা। সেটা যদি এই ব্লগে না হয়, তার অর্থ হবে, পপ কালচারে আগ্রহী স্মার্ট ছেলেপেলেরা আর ছড়িয়ে চিন্তা করতে, এবং লিখে তাদের চিন্তা অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে আগ্রহী নয়। তারা কেবল কালচার কঞ্জ্যুম করবে, তা অ্যানালাইসিস করতে তারা প্রস্তুত নয়। এবং, অপরপক্ষে, ব্লগে আমরা যারা আছি, আমরাও আর পপ কালচারের ব্যাপারে সচেতন নই, আধুনিক নই, স্মার্ট নই। ভাইকিংস সিরিজের শেষ সিজন রিলিজ পেলো গত বছর, তার একটু আগে জোকার মুভি অ্যাকাদেমি অ্যাওয়ার্ডের অনেকগুলো ক্যাটাগরিতে বিজয় ছিনিয়ে আনলো, কোরিয়ান ব্যান্ড বিটিএস বিশ্বজুড়ে একবিংশ শতাব্দীর বিটলসে পরিণত হল, জাস্টিস লীগের স্নাইডার'স কাট মুক্তি পেলো সেদিন, পাওলো কোয়েলহোর নতুন বই দা আর্চার প্রকাশিত হল, খাবিব নমাগমেদফ এমএমএ ফাইট থেকে পাউন্ড ফর পাউন্ড গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম হিসেবে রিটায়ার করলো, জর্ডান পিটারসন - সারাজীবন ডিপ্রেশন এড়াতে মেডিকেশন সাজেস্ট করবার পর, এইতো সেদিন মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এলেন, রাশিয়ার একটা হসপিটালে খুব আনঅর্থডক্স প্রক্রিয়ায় পুরো শরীর ডিটক্স করে। স্লাভয় জিজেক এদিকে রিফিউজি , এলজিবিটি কমিউনিটি, পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ওপর বিতর্কিত মন্তব্য করে নোম চমস্কি দ্বারা তার ওপর রেসিজমের আরোপকে জাস্টিফাই করলেন। কতোকিছুই তো হয়ে গেলো পপ কালচারে। এগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্লেষণধর্মী লেখার অভাব বোধ করেছি।

শেষকথাঃ


এতক্ষণ মূলত সমালোচনা করলাম, কারন গঠনমূলক সমালোচনা মানুষের উন্নতিতে সহায়তা করে। ওটা বাদে, ভালো লাগার মতো কিছু বিষয়ও ছিল গত এক বছরে, ব্লগে।

ব্লগার রিম সাবরিনা জাহান সরকারের লেখা 'নভোনীল' ব্লগার পদ্মপুকুরের আগ্রহে পর্ব পর্ব আকারে অন্যান্য ব্লগাররা লেখেন, কন্টিনিউ করেন। এটা একটা ভালো উদ্যোগ ছিল। ব্লগারদের পারস্পারিক হৃদ্যতার চোখে পড়ার মতো একটা উদাহরণ ছিল। করোনা লকডাউনে ব্লগার কল্পদ্রুমের লেখা গল্প ভালো লেগেছে। ব্লগার অজ্ঞবালক গল্প লিখছেন। আরও লিখছেন ব্লগার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান তমাল, ব্লগার আখেনটান।

ব্লগার আখেনটানের এক মন্তব্যের সূত্র ধরে তাকে বেশ কিছু কটু কথা শোনাই, বিবর্তনবাদকে কিভাবে নাজি বাহিনী তাদের প্রোপাগান্ডার স্বপক্ষে ব্যবহার করেছিল - তা নিয়ে লেখা আমার একটি পোষ্টে। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করছি। যদিও, ঘটনার পরপর একটি পোস্টে আয়োজিত এক মিলাদমাহফিলে আমাকে প্রচুর গালিগালাজ করে তিনি ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল সহব্লগাররা প্রাথমিক ঝাল মিটিয়েছেন। তবুও যদি তার মনে খেদ থাকে, আশা করি আমার আজকের স্বগতোক্তি কিছুটা হলেও তার মনঃকষ্ট উপশমে সহায়তা করবে।

ব্লগার পদ্মপুকুরের লেখা ভালো লাগতো, দীর্ঘদিন তিনি আর লেখেন না। কবিতা পড়ে ভালো লেগেছে ব্লগার স্বর্ণবন্ধনের, খায়রুল আহসান স্যারের, মনিরা সুলতানা আপার, ব্লগার ইসিয়াক ভাই, ব্লগার নেয়ামুল নাহিদের। মিস করা বলতে যা বোঝায়, সেই অনুভূতিটুকু কাজ করে ব্লগার শের শায়েরীর প্রতি। তার সঙ্গে আমার সুন্দর একটা ইন্টারেকশন গড়ে উঠছিল, এমন সময় তিনি পুরোপুরি ব্লগে উপস্থিতি বন্ধ করে দিলেন। মাঈনুদ্দিন মইনুল ভাইকে মিস করি, যদিও আমার বর্ষপূর্তি পোস্টে তিনি আমাকে উইশ করেছিলেন। ব্লগার উদাসী স্বপ্নের কথা মনে পড়ে প্রায়ই। ধর্ম - ধর্মগুরুদের নিয়ে নোংরা শব্দ ব্যবহার, এবং হেইট স্পিচ ছড়ানো বন্ধ করলে, সে ব্লগের অ্যাসেট হতে পারতো। উদাসীর সারিন্দা নিকগুলিকে আগেও বিরক্ত লাগতো, এখনও লাগে। ব্লগার নতুন নকিবের ইসলাম সংক্রান্ত লেখাগুলো আরও অন্তর্ভেদী, আরও বিশ্লেষী, আরও প্রাসঙ্গিক হোক - এই কামনা করি। ব্লগার স্থিতধীর লেখায় বিশ্লেষণী মনভাব, ব্লগার প্রান্তের ইতিহাস সচেতনতা ভালো লেগেছে। যদিও, ব্লগার স্থিতধী প্রায়ই শ্যাম এবং কুল দুইই রাখার চেষ্টা করেন। এটা পরিত্যাগ করলে ওনার উপকার হবে।

স্বামী বিশুদ্ধানন্দ, ব্লগার পদ্মপুকু মনিরা সুলতানা আপা, ব্লগার আমি সাজিদ, ব্লগার মাইদুল সরকারের সঙ্গে মন্তব্যের ঘরে ইন্টার‍্যাকশন ভালো লাগে, লাগছে। ব্লগার রাজীব নূরের সমসাময়িক জেনোফোবিক মন্তব্য বন্ধ করলে তাকেও অপছন্দ করার কিছু ছিল না। চাঁদগাজী আর একই প্যাটার্নের আরও দুটো নিককে কমেন্ট মডারেশনের আওতায় এনেছি, তারা নিয়মিতভাবে বাকস্বাধীনতার নামে বুলিং করায়। তারা চাইলে এখনও গঠনমূলক মন্তব্য করতে পারে। ঘৃণাবাক্য না থাকলে তাদের মতামত সাদরে গৃহীত হবে।

স্বামী বিশুদ্ধানন্দের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে লেখা শেষ করছি। ওনার মন্তব্যে উনি আমাকে প্রশংসা করেছিলেন, কারো নাম উল্লেখ না করে পোস্টটি লেখায়। কিন্তু গত একবছরের সচেতন চলার পথে যাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উপকৃত হয়েছি, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন ছাড়া লেখাটি শেষ করা উচিৎ হতো না বলে মনে হয়েছে।

ব্লগে আমরা লিখে মনোভাব প্রকাশ করি। তাই আমাদের চিন্তাগুলো হয়ে উঠুক আরও বিশ্লেষী, আমাদের লেখা, আমাদের মন্তব্য হয়ে উঠুক আরও গোছানো। ব্লগ হয়ে উঠুক প্রকৃতঅর্থে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একটা জায়গা।

গত এক বছরে আমার পছন্দের কিছু লেখার লিঙ্ক দিয়ে এই ডায়রি শেষ করছি -

১। এই লেখাটি দিয়ে আমি করোনাকালীন ব্লগিং শুরু করি - করোনার দিনে জার্নাল

২। সাম্প্রদায়িকতার ছকে রবীন্দ্রভাবনাঃ বিচ্ছিন্নতা বনাম আত্তীকরণের রাজনীতি

৩। বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বি - উপনিবেশিকরন পর্ব ১ঃ গৌতম বুদ্ধ - পাশ্চাত্য দর্শন/তত্ত্বের ঔপনিবেশিক প্রোপ্যাগান্ডার বিরুদ্ধে প্রারম্ভিক নোকতা

৪। বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বি - উপনিবেশায়ন, নোকতা ২ঃ পাশ্চাত্য দর্শনের ঐতিহাসিক বেআদবি

৫। বাঙ্গাল মস্তিষ্কের বি - উপনিবেশায়ন, নোকতা ৩ঃ ওরিয়েন্টালিজম, মিডিয়া, এবং "জঙ্গি" মুসলমান

৬। বাঙাল মস্তিস্কের বি উপনিবেশায়ন - ৪ঃ বাক স্বাধীনতা, প্রাচ্যে - পাশ্চাত্যে

৭। প্রসঙ্গঃ পেইড নাস্তিক, পেইড নাস্তিকতা, ইসলামোফোবিয়া, বাংলাদেশ

৮। বরেন্দ্রভূম থেকে জাহাঙ্গীরনগর - বাংলার চিত্রকলার ইতিহাস, পর্ব - ১০ঃ শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় ও সাধনা

৯। চিন্তার কারখানা ২ - আপনি কি হিটলারের চেয়েও বড় (ডারউইনীয়) বিবর্তনবাদের সমর্থক?

১০। শিক্ষক দিবস ২০২০ঃ বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা - যেমনটা দেখেছি / দেখছি

১১। সূতির খালের হাওয়া - ৮ঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এবং 'লেখক - চিন্তক' পরিচিতির নির্মাণ - বিনির্মাণ

১২। চিন্তার কারখানা ৬ঃ মিলিট্যান্ট এথিজম / ষ্টেট এথিজমের করায়ত্ব পৃথিবী কেমন হবে?

১৩। সূতীর খালের হাওয়া ১৪ঃ বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের রাজনীতিবিমুখতা

১৪। গল্পঃ নির্বাচিত দেবদূত

১৫। অনুবাদ কবিতা - যখন ভালোবাসা এসে দাঁড়ায় দ্বারে





সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০২১ সকাল ১০:০৪
১০টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×