সাত
ইউসুফ আলী খান এসে উপস্থিত। রহমত মিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই গবেট লোকটা আবার কোন ফালতু কাজ নিয়ে এল ? যথেষঠ তো ক্ষতি করা হয়েছে । আর কেন ? পথে বসিয়ে ছাড়বে দেখছি।
ইউসুফ আলী খানে মুখ হাসি হাসি। মুখভর্তি পান। থুতনির কাছে পানের কষের সুক্ষ্ম রেখা। চোখ দুটো মার্বেলের মতো চক চক করছে। কোন বদ মতলব কে জানে। ইউসুফ আলী খান একটা চেয়ার টেনে বসলেন। বললেন, ‘রহমত, ব্যবসাপাতি অহন কেমন ?’
রহমত মিয়ার মুখে একদলা থুথু এসে গেল। থুথুটা ফেলা যাবে না। শ্বশুরের সঙ্গে বেয়াদবি হয়ে যাবে। কী মুশকিল ! সে থুথু গিলে ফেলল। বলল, ‘ব্যবসাপাতি খুবই খারাপ। কয় দিন পর রাস্তায় বওন লাগব।’
‘ফাউ কতা কয় ক্যা, মিয়া ?’
‘আপনের লগে ফাউ কতা কইয়া লাভ আছে ? আপনেই ফাউ কতা কন।’
ইউসুফ আলী খান বোবা হয়ে গেলেন। কী ভীষণ অপমান ! রহমত মিয়া বেয়াদব নয়। কিন্তু ইদানিং তার মুখের কোন ঠিক ঠিকানা থাকে না। কাকে যে কী বলে হিসেব করে বলে না। নিশ্চয়ই কোথাও গড়বড় হয়েছে। এই মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার। নইলে আরও অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা। সবচেয়ে ভালো হয় কেটে পড়লে। ইউসুফ আলী খান কাঁধ ঝাকিয়ে সহজ হওয়ার ভান করলেন। বললেন,‘আইজ উঠি। অনেক কাম।’
‘জ্বী, আচ্ছা। স্লামালাইকুম।’
ইউসুফ আলী খান উঠে চলে গেলেন। মেয়ের জামাই কেন বিগড়ে গেল এ চিন্তায় তিনি হাসফাস করতে লাগলেন। তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেল।
রহমত মিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচল। ফালতু কচকচানি বন্ধ হল। এ লোকটা বিরাট ক্ষতি করেছে। তার মাথায় গাধার বুদ্ধি। নইলে লাখ দুয়েক টাকার মাল গায়েব হওয়াতে কেউ সব কর্মচারীকে বিদায় করে না। এতগুলো লোক যোগাতে গিয়ে প্রায় মাসখানেক মিল চললই না। তার উপর বিশ্বাসী লোকগুলোকে বিদায় করে মিলের আয় কমে গেছে।
আজ সকালে আজগর আলীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হারামীর বাচ্চার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। চোখে মুখে নতুন চেকনাই। গায়ে আদি কাপড়ের ফুরফুরে পাঞ্জাবি। রহমত মিয়ার মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল। শালা দেখি আমার মতো পাঞ্জাবি লাগাইছে ?
পাছায় কষে একটা লাথি দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তাই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। খুব কঠিন একটা ব্যবস্থা। ইদানিং বড়ো বাড় বেড়েছে হারামীর বাচ্চার।
রহমত মিয়া তার রিভলভিং চেয়ারে ঝিম মেরে বসে রইল। তার মাথায় তিনটি সূত্র কাজ করছে। এক, আজগর আলীর চোখে সর্বপ্রথম চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ল কেন ? দুই, আজগর আলী কিভাবে বুঝল যে, সেই রাতেই চুরি হয়েছে ? তিন, আজগর আলী হঠাৎ মালদার হল কিভাবে ? নতুন দোকান দিয়ে বিরাট ব্যবসা। একেবারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।
রহমত মিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বছরখানেক থেকে তার মাথায় এই তিনটি সূত্র খেলা করছে। আজগর আলীই সেই ভেতরের লোক। ঘরের ইঁদুর। এ ইঁদুর নিধন করতে হবে। বছরখানেক থেকে সে এই সুযোগ খুঁজছে।
ইস্, কী বিপদটাই না ছিল সে রাতে ! খারাপ মেয়ে লোকটি তার ইজ্জত সম্মান মেরে দিত। ভাগ্যিস কেউ আসার আগে দরজায় তালা মেরে ভেগে যেতে পেরেছিল। অল্পের জন্য ইজ্জত পাংচার হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। খোদা সহায় । অনেক রাতে ঘটনাটি ঘটেছিল বলে খুব বেশি এ কান ও কানও হয় নি।
রহমত মিয়া রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল। দুই আড়াই লাখ টাকা কোন ব্যাপার না। টাকার জন্য তার দুঃখ নেই। আজগর আলী কেন তার মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাইল ? সে আজগর আলীকে কোন দিনও ক্ষমা করবে না। কেবল সময় ও সুযোগের অপেক্ষা। আজগর আলীকে একটা বিপদে ফেলতে হবে। এমন একটা বিপদ যাতে ওর ইজ্জত সম্মান সব পাংচার হয়ে যায়।
ম্যানেজার বুড়ো এল। বলল, ‘স্যাহেব, আজহার সাহেবের কাছে কি একবার যামু?’
রহমত মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, ‘একবার ক্যান , পঞ্চাশবার যান। সকালেই তো কইছি। আজকা কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার আনবেন। ’
‘জ্বী, আচ্ছা, সাব’, বুড়ো হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। এখনও তার বগলে ছাতাটা ঝিমাচ্ছে।
পুরোনো লোকদের মধ্যে এই একটা লোককে ফেরত আনা গেছে। বড় ভালো এবং বিশ্বস্ত লোক। এই লোকটাকে বিদায় করাটা ভুল হয়েছিল। আজকাল এই ধরনের সৎ লোক পাওয়াটা খুবই মুশকিল।
রহমত মিয়া খেয়াল করল, বুড়ো খানিকটা মোটা হয়ে গেছে। দু বছর আগে বুড়োর ছেলে মারা গেল। তারপর থেকেই বুড়ো মোটা হচ্ছে। এটা কি পুত্রশোকে দেহ স্ফীতি ? আশ্চর্য ব্যাপার।
বাইরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। বুড়ো মিলে তালা দিচ্ছে। আজ মিলে ওভার টাইম নাই। মিস্ত্রিদের বিদায় করা হয়েছে। এখন অফিসে তালা দিলেই আজকের মতো কাজ শেষ। তবু রহমত মিয়া বসে রইল। কেন যেন গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।
ইদানিং বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। বাড়ি ফিরে কী হবে ? ফাহমিদা আবারও রাগ করে বাপের বাড়ি গেছে। তাকে ফিরিয়ে আনা দরকার। যত বজ্জাত হোক, ঘরের বৌ তো। কত দিন হয়ে গেল। ফাহমিদার সাথে আর বনিবনা হল না। আর বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। তবু ফিরিয়ে আনা দরকার। মান ইজ্জতের ব্যাপার। তাছাড়া ইদানিং কেন যেন খুব একা একা লাগে।
হঠাৎ দরজার শব্দে রহমত মিয়া বাস্তবে ফিরে এল। শাহিদার মা ঢুকছে। শাহিদার মা তার অফিসে কেন ? রহমত মিয়া অবাক হল। বলল, ‘কী ব্যাপার, তুমি ?’
শাহিদার মা কাচুমাচু করে তার পায়ের কাছে এসে বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে ঘাড় ভেঙ্গে বসে রইল। রহমত মিয়া খেয়াল করল, শাহিদার মায়ের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। গায়ে ব্লাউজ না থাকায় আঁচল ভেদ করে কাঁধের হাড় ফুটে উঠেছে। গালের মাংস চিমসে হয়ে বসে গেছে। চোখের নিচে কালসিটে দাগ।
রহমত মিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি অসুখ বিসুক হইছে নিহি ? বহুত হুগায়া গেছ গা যে ?’
‘আমার সব্বোনাশ হয়া গেছে গো, সাব’, শাহিদার মা হাত পা ছুঁড়ে হাস্যকর ভঙ্গিতে কাঁদতে শুরু করল।
চলবে ...
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । সপ্তম পর্ব । অষ্টম পর্ব । নবম পর্ব । দশম পর্ব । একাদশ পর্ব । দ্বাদশ পর্ব । চতুর্দশ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



