রহমত মিয়া ভড়কে গেল। এ কী ঝামেলা ! মেয়ে মানুষকে বিশ্বাস নেই। এটা আবার কোন চাল কে জানে। সে সাবধান হয়ে গেল। একে যত তাড়াতাড়ি বিদায় করা যায়, ততই মঙ্গল। তবে তার আগে একটু খুঁচিয়ে দেখা দরকার। রহমত মিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কানতাছ ক্যান ?’
‘সাব, আমার সব শ্যাষ’, শাহিদার মা নাক ঝাড়ল। অফিসের মেঝেতে মুখের লালা ঝরছে।
রহমত মিয়া বিরক্তিতে ভ্র“ কোঁচকাল। মেঝেটা নোংরা হচ্ছে। শাহিদার মা হে হে করে কেঁদেই চলেছে। রহমত মিয়া ধমক দিল, ‘হেই বেডি, চুপ কর। কী হইছে হেইডা কও।’
শাহিদার মা চুপ মেরে গেল। ভয় পাওয়া চোখে রহমত মিয়ার দিকে তাকাল। তারপর ঘাড় গোঁজ করে থর থর করে কাঁপতে লাগল।
রহমত মিয়া দ্বিধায় পড়ে গেল। বলল, ‘কী হইছে তোমার ? কথা কইতাছ না ক্যান ?’
‘সাব, নুরু মিয়া আমার সব্বোনাশ কইরা ফালাইছে।’
‘কী করছে নুরু মিয়া ?’
‘হেই কতা আমি ক্যামনে কই ?’
এবার রহমত মিয়া রাগ করল, ‘কথা না কইলে আইছ ক্যা ? চেহারা দেহাইতে ?’
শাহিদার মা হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘অহন আমার মাইয়ার কী অইব ?’
রহমত মিয়া বিরক্ত হল। বলল, ‘ তোমার মাইয়ার আবার কী হইল ?’
দাঁত চিবিয়ে বলল শাহিদার মা, ‘নুরু, শুয়োরের বাচ্চা, আমার মাইয়ারে শেষ কইরা ফালাইছে।’
‘কী করছে নুরু তোমার মাইয়ার ?’
শাহিদার মা কপাল চাপড়াতে লাগল। বলল, ‘কচি বেবুজ মাইয়া আমার, কুত্তার বাচ্চায় শেষ কইরা ফালাইছে।’
হঠাৎ রহমত মিয়া বুঝে ফেলল কী হয়েছে। সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। তার ব্যাপারটা আবার শাহিদা ফাঁস করে দিল নাকি ? তবে তো ইজ্জত গেছে। মহা সমস্যা বেঁধে গেছে। রহমত মিয়া সতর্ক হয়ে গেল। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। এখন খুব সূক্ষ্ম হিসাব করে কথা বলতে হবে। কোন ভুল করা চলবে না। কৌশলে শাহিদার মাকে হাত করতে হবে। দরকার হলে টাকা পয়সার লোভ দেখাতে হবে। নচেৎ বিপদ।
রহমত মিয়া সতর্ক চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। এই সন্ধ্যায় আশে পাশে বিশেষ কেউ নেই। তবু সে সাবধান করে দিল শাহিদার মাকে, ‘আস্তে, এত চিল্লাচিল্লি করতাছ ক্যা ? মাইনসে শুনলে ইজ্জত যাইব।’
‘ইজ্জতের আর বাকি নাই’, শাহিদার মা হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল।
রহমত মিয়া রিভলভিং চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসল। বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি আমারে পুরা ঘটনাটা খুইল্লা কও তো।’
শাহিদার মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘ঘটনা আর কী, আজগর আলীর অইহানে আমারে কাম দিছিল নুরু মিয়া। হেইহানে আমার মাইয়ারে একলা পায়া এই কামডা করছে। আপনে এর বিচার করেন।’
রহমত মিয়া চিন্তায় পড়ে গেল। বলল, ‘তুমি আমারে এট্টু ভাবতে দেও।’
শাহিদার মা গুন গুন করে কাঁদতে লাগল। রহমত মিয়া বিব্রত ভঙ্গিতে চেয়ারের হাতল হাতড়াতে লাগল। সে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।
তাছাড়া নুরু মিয়ার বিচার করার ক্ষমতা তার নেই। তার কেন , নুরু মিয়ার বিচার করার ক্ষমতা এই এলাকার কারো নাই। নুরু মিয়া উঠতি ক্যাডার। বস্তি ঘিরে তার বিশাল বাহিনী। পলিটিক্যাল কানেকশনে নুরু মিয়ার বিরাট ক্ষমতা। তার দল এখন ক্ষমতায়। তাকে ঘাটিয়ে কে আর ঝাড়ে বংশে ধ্বংস হতে চায় ?
রহমত মিয়া কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর শাহিদার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমারে একটা কথা কই। মাথা গরম কইর না। খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভাইবা দেখ।
‘কন, কী করতে অইব?’
রহমত মিয়া আমতা আমতা করে বলল, ‘আমি কই কি - তুমি আবার রাগ কইর না, কই কি এই জিনিসটা চাইপ্যা যাও। বিচার করলে লোক জানাজানি হইব, ইজ্জত যাইব। মাইয়ারে বিয়া দেওন লাগব না ?’
‘মাইয়ার পেডে যে পাপ আছে হেরে চাইপ্যা রাখমু ক্যামনে ?’
প্রশ্নটা ধা করে রহমত মিয়াকে আঘাত করল। এতটা রহমত মিয়া ভাবে নি। চট করে এতটা ভাবাও যায় না। রহমত মিয়া ঠাণ্ডা মাথাটা চালু করে দিল। হিম-শীতল মাথা।
নুরু মিয়ার এই বিষয়টা প্রতিকার করা দরকার। এ যে বড়ো অন্যায়। কিন্তু কে বিচার করবে ? নুরু মিয়ার বিচার করে জান হারাবে কে ?
রহমত মিয়া একটু ভেবে বলল, ‘কী আর করবা ? সবই কপালের ফের। একটা কাম করো, মাইয়াডার পেট খালাস কইরা দেও।’
‘ডাকতর সাবরে দেহাইছিলাম। হেয় কইল, অহন খালাস করলে মাইয়ার জান লয়া টানাটানি লাগব। হারামী মাইয়া আমার, আমারে কিচ্ছু কয় নাই।’
রহমত মিয়া গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। হিম শীতল মাথা ভালো কাজ দিচ্ছে। কী ভীষণ বিপদ ! এক দিকে জান, অন্য দিকে সম্মান। হঠাৎ রহমত মিয়ার মাথায় একটা সূক্ষ্ম চিন্তা খেলে গেল। এই তো মোক্ষম সুযোগ ! উহ, এত বড় সুযোগ আসবে, ভাবা যায় ?
রহমত মিয়া ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আকামডা আজগর আলী ঘরে হইছে , ঠিক না ?
‘হ।’
রহমত মিয়ার ঠোঁটে বাঁকা হাসি খেলে গেল। এই সেই সুযোগ - যে সুযোগের জন্য সে অনেক দিন থেকে ওৎ পেতে ছিল।
রহমত মিয়া গলা খাকড়ি দিয়ে পরিষ্কার করল। নিচু গলায় বলল, ‘শাহিদার মা, হুনো।’
‘কন।’
‘তুমি কুনো চিন্তা কইর না। তোমার মাইয়া বিচার পাইব।’
‘হাচা কইতাছেন ?’, শাহিদার মায়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘সত্যি কইতাছি। তয় একটা কথা, আমি যা কমু হেই কতা মানতে হইব। আমার কথা মানবা না তো, আমি এই সবে নাই।’
ব্যগ্র কণ্ঠে বলল শাহিদার মা, ‘আপনে যা কইবেন, আমি হেইডাই করমু।’
রহমত মিয়া একটা কুটিল হাসি দিয়ে বলল, ‘তাইলে অহন বাইত যাও। নিশ্চিন্ত থাক। কুনো চিন্তা কইর না। সব ঠিক হয়া যাইব। আমি ব্যবস্তা কইরা দিমু। কাইল বিকালে আইবা।’
শাহিদার মা হঠাৎ রহমত মিয়া পা জড়িয়ে ধরল, ‘আপনে মানুষ না, ফেরেশতা।’
‘আরে কী ঝামেলা ! অহন যাও তো’, রহমত মিয়া পা ছাড়িয়ে নিল।
শাহিদার মা আঁচলে চোখ মুছে চলে গেল। রহমত মিয়া মনে মনে হাসল। সে ফেরেশতা নাকি শয়তান সময় মতো টের পাবে।
রহমত মিয়ার গলা ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছা করছে। কী আনন্দ ! কী আনন্দ !
চলবে ...
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । সপ্তম পর্ব । অষ্টম পর্ব । নবম পর্ব । দশম পর্ব । একাদশ পর্ব । দ্বাদশ পর্ব । ত্রয়োদশ পর্ব । পঞ্চদশ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



