আট
উদ্বেগে রহমত মিয়া কোন কাজে মন দিতে পারছে না। তার কেবলই মনে হতে লাগল এই বুঝি শাহিদার মা এল। শাহিদার মা আসবে তো ? তার পরিকল্পনা মতো কাজ হবে তো ?
চিন্তায় কাল রাতে রহমত মিয়ার ঘুম হয় নি। একবার আনন্দে চঞ্চল হয়েছে, পর মুহূর্তে বিষাদে আক্রান্ত হয়েছে। বার বার পরিকল্পনার দূর্বল ও সবল দিক, খুটিনাটি দিক বিবেচনা করেছে। শাহিদার মাকে কী বলবে তা বার বার আউড়ে দেখেছে। কোথাও ভুল করা যাবে না। ভুল করলে সর্বনাশ। সে আগুন নিয়ে খেলছে। আগুন নিয়ে খেললে ভুল করা যায় না।
আজ সন্ধ্যায় স মিলে ওভার টাইম ছিল। রহমত মিয়া ম্যানেজার বুড়োকে ডেকে বলল, ‘আইজ ওভার টাইম বাদ দেন।’
‘কিন্তু সাব, কাজ ছিল যে ...’
‘কাজ কাইল করাইবেন। আইজ মিল বন্ধ করেন।’
‘কিন্তু সাব ....’
‘আবার কিন্তু কী’, রহমত মিয়া চটে গেল,‘মিল কি আপনের, না আমার ? যান, মিল বন্ধ করেন।’
বুড়ো কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে বুড়ো মিল বন্ধ করে মিস্ত্রিদের বিদায় করে দিল। মিলের গেটে তালা মেরে অফিসে এসে বলল, ‘সাব, আমি তাইলে যাই।’
‘যান।’
‘আপনে যাবেন না ?’
রহমত মিয়া খেঁকিয়ে উঠল, ‘সেইটা আপনের দরকার আছে ? আপনে যান।’
বুড়ো ছাতাটা বগলের তলায় ঢুকিয়ে চলে গেল।
রহমত মিয়া একা বসে রইল। এখন বিকাল ৫ টা। এ সময়েই শাহিদার মায়ের আসার কথা। নিশ্চয়ই আসবে। যার এত বড় বিপদ, সে না এসে পারে ?
রহমত মিয়া চোখ বন্ধ করে রিভলভিং চেয়ারে বসে রইল। হিম-শীতল মাথাটা কাজ করছে। ফাহমিদা আশে পাশে না থাকায় ইদানিং হিম-শীতল মাথাটা ভালো কাজ করে। ফাহমিদা কাছে থাকলেই ব্রেইনে হিটিং সিস্টেম চালু হয়ে যায়। সে তার ঠাণ্ডা মাথাটা চালু করে দিল।
প্রথম থেকে সে খুটিয়ে খুটিয়ে তার পরিকল্পনাটা বিশ্লেষণ করল। না, কোথাও ভুল নেই। পরিকল্পনা মতো কাজ না হওয়ার কোন কারণ নেই। আর পরিকল্পনা মতো কাজ হলে একটা বিরাট কাজ হয়ে যাবে। আজগর আলী পথে বসে যাবে। ইজ্জত সম্মান নিয়ে ভেগে যেতে হবে।
কিন্তু শাহিদার মা দেরি করছে কেন ? হঠাৎ করে আবার মত পাল্টে ফেলল না তো ? তাহলেই সেরেছে। সব গুবলেট হয়ে যাবে।
যে কথাগুলো শাহিদার মাকে বলবে, সেগুলো আবারও আউড়ে নিতে লাগল রহমত মিয়া। প্রত্যেক কথার জবাবে শাহিদার মা কী বলবে কিংবা সম্ভাব্য কী প্রশ্ন করতে পারে, সেটা ভেবে নিল। শাহিদার মায়ের প্রশ্নের উত্তরে তার কী বলতে হবে, সেটাও ভেবে নিল। যে করেই হোক শাহিদার মাকে বোঝাতে হবে। তার পরিকল্পনাকে ওই মহিলার মাথায় ঢোকাতে হবে। পরিকল্পনা মতো কাজ হলে শাহিদার মায়েরও লাভ হবে।
‘সাব’, রহমত মিয়া চমকে উঠল। শাহিদার মা এসেছে। রহমত মিয়ার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘আইলা তাইলে ? আমি তো ভাবছি, আইবা না’, কথাটা বলেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল রহমত মিয়ার। পরিকল্পনায় এই কথা দিয়ে শুরু করার কথা ছিল না।
‘আমার মাইয়ার বিপদ, আর আমি ঘরে পইড়া থাকমু ?’ উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল শাহিদার মা।
‘তাও কথা, মাইয়া তো তোমার।’
শাহিদা মা মেঝেতে বসতে বসতে বলল, ‘অহন সাব, কী ব্যবস্তা করলেন ?
রহমত মিয়া একটু ভেবে নিল। পরিকল্পনাটা মানসচোখে ঘেটে নিল। তার ঠোঁটের কোণে একটা সূক্ষ্ম হাসি চলে এল। এত সূক্ষ্ম যে সেটা শাহিদার মায়ের চোখে পড়ল না।
রহমত মিয়া চেয়ারের হাতল হাতাতে হাতাতে বলল, ‘কালকা থিকা একটা ব্যাপার ভাইবা কুল পাইতাছি না। নুরু মিয়া আজগর আলীর বাইত এত বড় আকাম করল, আজগর আলী দেহে নাই ?
শাহিদার মা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। সন্দেহের ছায়া পড়ল তার চোখে। রহমত মিয়ার সূক্ষ্ম হাসিটা খানিকটা বাড়ল, চোখের কোণে দেখা দিল হাসির ঝিলিক। বিষে ধরেছে। সন্দেহ এমন একটা বিষ, যেটা খুব দ্রুতই মানুষকে কাবু করে। এ বিষ ছড়িয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে।
শাহিদার মা আমতা আমতা করে বলল, ‘কী জানি, হেইডা তো জানি না।’
কুটিল হাসিতে রহমত মিয়ার চোখ চক চক করছে। এবার সন্দেহের আরেকটা তীর ছুঁড়ে দিল রহমত মিয়া। বলল, ‘ আমার তো মনে অয় আজগর আলী হগল কিছুই জানে। পরানের দোস্ত রে একটু সুযোগ দিছে।’
শাহিদার মা হা হয়ে গেল। বিষ ধরেছে। খুব দ্রুতই ধরেছে। তার সন্দেহ হতে লাগল। রহমত মিয়া যা বলছে সেটা হতে বিচিত্র কী ? কথায় যুক্তি আছে।
রহমত মিয়া শাহিদার মায়ের দিকে ঝুঁকে এল। গলা নামিয়ে বলল, ‘হুনো, বোজাই যাইতাছে, আজগর আলী তোমার সব্বোনাশ করছে। হেয়ও লগে আছিল। দুইজন মিল্যা আকাম করছে।’
শাহিদার মা হতভম্ব হয়ে গেল, ‘আপনে এইডা কী কইতেছেন ?’
‘ঠিকই কইতাছি।’
শাহিদার মা দ্বিধায় পড়ে গেল, ‘কিন্তুক শাহিদা যে কয় নুরু মিয়ার কতা।’
‘কেমনে দুই জনের নাম কয় ? শরম ভরম নাই ?’
শাহিদার মায়ের কাছে বিষয়টা ভালো লাগল না। তার মেয়ে তার কাছে কিছু গোপন করে না। কে বলল করে না ? সে যে পোয়াতি হয়েছে, সেটা কি গোপন করে নাই ? নইলে অনেক আগেই খালাস করে ফেলা যেত এই আপদ। বদের হাড্ডি হয়েছে মেয়েটা।
তারপরও শাহিদার মা মিনমিন করে বলল, ‘কতাডা আমার বিশ্বাস অয় না।’
রহমত মিয়া বিরক্ত হল। রিভলভিং চেয়ারটা নিয়ে মোচড়া মোচড়ি করল। বলল,‘আজগর আলীরে তুমি কয় দিন ধইরা চিন ? অরে আমি আট বছর ধইরা চিনি। অরে আমি মিল থিক্যা কের লেইগ্যা বাইর কইরা দিছি, জান ?’
শাহিদার মা তার মুখের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল। এটাই চেয়েছিল রহমত মিয়া। শাহিদার মার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অয় মিলের থিকা টাকা চুরি কইরা নুরু মিয়ার লগে মাইয়া ফুর্তি করছিল। এই অফিসে। আমি অরে হাতেনাতে ধরছি। আজগর আলীর চরিত্র কেমন, আমি জানি না ? হেয় আর নুরু মিয়া মাইয়া লয়া ফুর্তি করে। দুই জন এক লগেই করে। একলা করে না।’
শাহিদার মায়ের মাথা ঘুরতে লাগল। তার মেয়ে কী ভীষণ বিপদে পড়েছে। এখন কী হবে ? তার মাথা গুলিয়ে গেল। সে যন্ত্রের মতো প্রশ্ন করল, ‘অহন আপনে তাইলে কী কন ?’
রহমত মিয়া নাটকীয় কায়দায় চোখ নাচাল। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আমি তো কই, আজগর আলীই আসল বদমাইশ। নুরু মিয়া খালি লগে আছিল।’
‘অহন তাইলে কি আমি দুই জনের নামে নালিশ দিমু ?’, বোকার মতো প্রশ্ন করল শাহিদার মা।
চলবে ...
প্রথম পর্ব । দ্বিতীয় পর্ব । তৃতীয় পর্ব । চতুর্থ পর্ব । পঞ্চম পর্ব । ষষ্ঠ পর্ব । সপ্তম পর্ব । অষ্টম পর্ব । নবম পর্ব । দশম পর্ব । একাদশ পর্ব । দ্বাদশ পর্ব । ত্রয়োদশ পর্ব । চতুর্দশ পর্ব । ষোড়শ পর্ব ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১২:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



