somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাভারতের গপ্পো - ০১৪ : রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার কাহিনী

২৮ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



একদিন রাজা দুষ্মন্ত বনে গেলেন হরিণ শিকার করতে। শিকার করতে করতে এক সময় তিনি দালছাড়া হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধার্ত ও পিপাসিত হয়ে পথ হারিয়ে এক মনোরম বনে পৌছে গেলেন। তখন রাজা দুষ্মন্ত মালিনী নদীর তীরে কন্ব মুনির আশ্রম দেখতে পেলেন। দেখলেন আশ্রমে হিংস্র জন্তুরাও শান্তভাবে ঘুরে বেরাচ্ছে। দুষ্মন্ত আশ্রমের ভিরতে প্রবেশ করে মহর্ষি কন্বের দেখা না পেয়ে তাঁর কুটীরে গিয়ে তাঁকে ডাকলেন। তখন কুটিরের ভিতর থেকে সুনিতম্বিনী রূপবতী যুবতী একটি মেয়ে বারিয়ে এসে জানালো কম্ব মুনি তার পিতা। তিনি ফল সংগ্রহ করতে বনে গেছেন, শীঘ্রই ফিরে আসবেন। মেয়েটি রাজাকে আদর করে বসিয়ে তাঁর জন্য খাবার সাজিয়ে দিল।




এই সুনিতম্বিনী রূপযৌবনবতী মেয়েটিকে দেখে রাজা দুষ্মন্তের খুবই পছন্দ হয়ে গেলো। রাজা দুষ্মন্ত জানতেন কম্ব মুনি ঊর্ধ্বরেতা (শুক্র ক্ষয় করে নাই এমন ব্যক্তি) তপস্বী তার কোনো কন্যা থাকতে পারে না। তাই রাজা মেয়েটির কাছে তার জন্ম রহস্য জানতে চাইলে মেয়েটি (শকুন্তলা) রাজাকে জানালো -


শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত



অতীতে একসময় বিশ্বামিত্র কঠোর তপস্যা করছিলেন। তাই দেখে দেবরাজ ইন্দ্র চিন্তায় পরে যান। তিনি বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য অপ্সরা মেনকাকে পাঠান। মেনকা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে নানান যৌনাবেদনময়ী নৃত্য করতে লাগলো। সেই সময় মেনাকার পরনে ছিলো শ্বেতশুভ্র পাতলা বসন। নৃত্যরত অবস্থায় হঠাত বাতাস তার গায়ের সেই বসন খুলে নিয়ে গেলো।



সুনিতম্বিনী রূপযৌবনবতী সর্বাঙ্গসুন্দরী বিবস্ত্রা মেনকাকে দেখে বিশ্বামিত্র মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বিশ্বামিত্র তার কঠোর তপস্যা ত্যাগ করে অপ্সরা মেনকার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন। ইন্দ্র আর মেনকার উদ্দেশ্য সফল হলো। বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যা ভঙ্গ হয়েছে। সেইসাথে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে অপ্সরা মেনকা গর্ভবতী হয়ে পরলো। যথা সময়ে মেনকা একটি কন্যা সন্তান প্রসব করলো। সেই সদ্যজাতা কন্যা শিশুটিকে মেনকা মালিনী নদীর তীরে ফেলে দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় ফিরে গেলো।


বাঘ-সিংহে ভরা জনমানবহীন বনের ধারে সেই শিশু কন্যাটিকে (শকুন্ত) পাখিরা রক্ষা করতে লাগল। মহর্ষি কন্ব স্নান করতে গিয়ে শিশু কন্যাটিকে দেখতে পেয়ে আশ্রমে নিয়ে এসে নিজের মেয়ের মতো করে লালন-পালন করতে থাকেন। শিশু কন্যাটিকে শকুন্ত রক্ষা করছিলো বলে কম্ব মনি মেয়েটির নাম রাখেন শকুন্তলা।








দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা মিলন



রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার সমস্ত কথা শুনে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে মিলিতো হতে চাইলেন। তিনি শকুন্তলাকে সুবর্ণমালা, বিবিধ বস্ত্র, নিজের কানের দুল, বুকের অলংকার, বিভিন্ন দেশের মণিরত্ন, হরিণের চামরা এমনকি নিজের রাজ্য পর্যন্ত দিয়ে দিতে চাইলেন।

শকুন্তলা রাজি হলেও তার পিতার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললো রাজাকে। কিন্তু দুষ্মন্তের একটুও অপেক্ষা করতে চাইছিলেন না। তাই তিনি শকুন্তলাকে বার বার তখনই গান্ধর্বরীতিতে (এতে মালা বদলে বিয়ে হয়) বিবাহ করার জন্য বলতে লাগলেন। দুষ্মন্তের বার বার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত শকুন্তলা গান্ধর্বরীতিতে বিবাহ করতে রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু বিয়ের আগে শকুন্তলা রাজা দুষ্মন্তকে শর্ত দিলো তাদের যে পুত্র জন্ম নিবে সে যুবরাজ হবে এবং দুষ্মন্তের পরে সেই পুত্রই রাজ্যের রাজা হবে।

কামের তারনায় উত্তেজিত রাজা দুষ্মন্ত বিনা বাক্য ব্যয়ে শকুন্তলার শর্তে রাজি হয়ে গেলেন। এবার শকুন্তলাও সানন্দে দুষ্মন্তের সঙ্গে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হলো। সম্ভোগ সমপ্ত হলে রাজা দুষ্মন্ত আর একমূহুর্তও আশ্রমে থাকতে চাইলেন না। শকুন্তলাকে আশ্রমে রেখে একাই রাজধানীর পথে রওনা হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় শকুন্তলাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন রাজধানীতে পৌছেই তিনি (হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতি) চতুরঙ্গিণী সেনা পাঠাবেন শকুন্তলাকে নিয়ে যেতে।


এদিকে কিছুক্ষণ পরে কম্ব মুনি আশ্রমে ফিরে এলেন। কিন্তু রাজার সাথে মিলিতো হওয়ার কারণে পিতার সামনে যেতে শকুন্তলা লজ্জা পেলো। তখন কম্ব মুনি দিব্যদৃষ্টিতে রাজা ও শকুন্তলার মিলনের বিষয়টি জেনে নিয়ে শকুন্তলাকে জানালেন - পিতার অনুমতি না নিয়ে শকুন্তলার পুরুষ সম্ভোগে ধর্মের হানি হয় নি। নির্জনে বিনা মন্ত্রপাঠে কামুক পুরুষ ও কামুকী নারীর যে মিলন তাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে তাই শ্রেষ্ট।



তিন বছর পরে শকুন্তলা একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলো। শকুন্তলার ছেলেটি কন্ব মুনির আশ্রমেই লালিত-পালিত হতে লাগল। দেখতে দেখতে ছেলেটির বয়স ছয় বছর হয়ে গেল। এরই মাঝে ছেলেটি প্রচন্ড বলশালী হয়ে উঠল, সে অসাধারণ বলবিক্রমে বন থেকে বাঘ, সিংহ, মহিষ, হাতি ইত্যাদি ধরে এনে আশ্রমের গাছের সাথে বেঁধে রাখত। সকল জন্তুকেই সে দমন করতে পারতো বলে আশ্রমবাসীরা তার নাম দিলেন সর্বদমন



এবার কন্ব মুনি তার শিষ্যদের ডেকে বললেন - "সর্বদমনের যুবরাজ হবার সময় হয়েছে। তাছাড়া নারীরা দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে বাস করলে নিন্দা হয়, তাতে সুনাম চরিত্র ও ধর্মও নষ্ট হতে পারে। তোমরা শীঘ্র শকুন্তলা আর তার পুত্রকে রাজা দুষ্মন্তের কাছে দিয়ে এস।"






কন্ব মুনির কথা মতো শুকুন্তলাকে রাজর প্রাসাদে পৌঁছিয়ে দিয়ে শিষ্যরা ফিরে গেলো। শকুন্তলা দুষ্মন্তের দরবারে গিয়ে তাদের ছেলে ভরতকে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করার প্রতিজ্ঞার কথা দুষ্মন্তকে মনি করিয়ে দিলো। কিন্তু রাজা দুষ্মন্ত পূর্বের সকল কথা মনে থাকলেও শুকুন্তলাকে না চেনার ভান করলো। শুকুন্তলাকে দুষ্ট তাপসী, ছলনাময়ী ইত্যাদি বলে অপবাদ দিল। রাজা বললো - "তোমার সঙ্গে আমার ধর্ম, অর্থ বা কামের কোনও সম্পর্ক হয় নি, তুমি যাও বা থাক বা যা ইচ্ছা করতে পার।"



লজ্জায় ও দুঃখে শকুন্তলা স্তব্ধ হয়ে গেলো। কান্নায় তাঁর চক্ষু রক্তবর্ণ হল, ঠোট কাঁপতে লাগল। শকুন্তলা বললো - "রাজি যদি আমাকে মিথ্যে অস্বীকার করো তাহলে তোমার মাথা শতধা বিদীর্ণ হবে। আমাকে যদি পরিত্যাগ কর তবে আমি আশ্রমে ফিরে যাব, কিন্তু এই বালক তোমার পুত্র, একে ত্যাগ করতে পার না।"

দুষ্মন্ত বললেন- "তোমার গর্ভে আমার কোনো পুত্র হয়েছিল তা আমার মনে নেই। নারীরা মিথ্যা কথাই বলে থাকে। তোমার জননী মেনকা অসতী ও নির্দয়া, তোমার পিতা বিশ্বামিত্র কামুক ও নির্দয়। তুমি নিজেও ভ্রষ্টার মতো কথা বলছ। তুমি দূর হও।"

শকুন্তলা এবার রেগে গিয়ে বললো- "মেনকা দেবতাদের মধ্যে গণ্যা। রাজা তুমি নিজে দুর্জন তাই সজ্জনকে দুর্জন বলছো। তুমি মিথ্যুক, তোমার সঙ্গে আমার মিলন সম্ভব হবে না, আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সাহায্য না পেলেও আমার পুত্র এই পৃথিবীতে রাজত্ব করবে।"
কথা শেষ করে শকুন্তলা চলে যেতে নিলো।

তখন অন্তরীক্ষ থেকে দৈববাণী এলো- "শকুন্তলা সত্য বলেছে, তুমিই তাঁর পুত্রের পিতা, তাকে ভরণপোষণ কর, তার নাম ভরত হক।"

এবার রাজা পুরোহিত ও অমাত্যদের বললেন- "আপনারা দৈববাণী শুনলেন, আমি নিজেও ওই বালককে পুত্র বলে জানি, কিন্তু যদি কেবল শকুন্তলার কথায় তাকে পুত্র হিসেবে মেনে নিতাম তবে লোকে দোষ দিত।"

তারপর দুষ্মন্ত তাঁর পুত্র ভরত ও স্ত্রী শকুন্তলাকে আনন্দিত মনে গ্রহণ করলেন।




====================================================================

বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যের মহাকাব্য মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। আমি মনে করি "যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মানুভূতিতে খোঁচা দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।" এই গ্রন্থে প্রচুর কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে পেশ করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তারা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন। মনে রাখতে হবে আমার এই পোস্ট কোনো ভাবেই ধর্মীয় পোস্ট নয়।

লেখার সূত্র : কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু।
ছবির সূত্র : এই সিরিজে ব্যবহৃত সকল ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত।


====================================================================

সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১, মহাভারতের গপ্পো - ০০২, মহাভারতের গপ্পো - ০০৩, মহাভারতের গপ্পো - ০০৪
মহাভারতের গপ্পো - ০০৫, মহাভারতের গপ্পো - ০০৬, মহাভারতের গপ্পো - ০০৭, মহাভারতের গপ্পো - ০০৮
মহাভারতের গপ্পো - ০০৯, মহাভারতের গপ্পো - ০১০, মহাভারতের গপ্পো - ০১১, মহাভারতের গপ্পো - ০১২
মহাভারতের গপ্পো - ০১৩,

====================================================================
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১:৪০
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×