কিস্তি-১৫
বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছেন জাফর সাহেব। বহুদিনের অভ্যাস। মাঝখানে বেশ কিছু দিন পড়া হয় নি। অফিস থেকে ফিরে আঁকার জন্য অপেক্ষা করেছেন। তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। সন্ধ্যার পর পত্রিকা পড়তে অসুবিধা হয়। চোখের আলো অক্ষর চিনতে পারে না। ঝাপসা লাগে। পত্রিকা পড়ায় মন বসছে না। তিনি ছোটছেলে সামিকে ডাকলেন। জানতে চাইলেন- অঙ্ক পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সামি বললো- ভাল হয়েছে। তিনি প্রশ্নটা নিয়ে আসতে বললেন। সামি প্রশ্ন নিয়ে এলে দু’তিনটি অঙ্ক ধরলেন জাফর সাহেব। সামি ঠিক ঠিক উত্তর দিলো। তিনি জানতে চাইলেন নিপুণ বাসায় আছে কিনা? সামি জানালো- ভাইয়া বাসায় নেই।
কিছুদিন ধরে জাফর সাহেব লক্ষ্য করছেন নিপুণ সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে না। অনেক রাত করে ফেরে। মাঝে মাঝে তিনি ঘুমিয়ে পড়ার পর বাসায় ফিরে সে। আগে সন্ধ্যার পর পর বাসায় ফিরতো। এখন কোথায় থাকে, কি করে জানা দরকার। সামি বললো- বাবা, কোন বিষয়ে আমার এখন কোন অসুবিধা নেই। দেখ এবার আমি খুব ভাল রেজাল্ট করবো। জাফর সাহেব বললেন- কারণ কি? সামি বললো- আমারে এখন ভাইয়া পড়ায়। খুব ভাল করে সব বিষয় বুঝিয়ে দেয়। শুনে খুব খুশি হলেন জাফর সাহেব।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাসায় ফিরলো অহনা। বিষণ্ন মনে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জাফর সাহেব মেয়ের মুখের দিকে না তাকিয়ে বললেন- কিরে মা ফিরতে এত দেরি করলি যে?
ক্লাস শেষে হাসপাতালে গিয়েছিলাম বাবা।
হাসপাতালে কেন?
আমার বান্ধবী নীদ খুব অসুস্থ। তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
কি হয়েছে তার।
নীদ বাঁচবে না বাবা।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অহনা। বাবার পায়ের কাছে বসে তার হাঁটুতে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জাফর সাহেব জানতে চাইলেন- কি হয়েছে নীদের। তুই কি করে জানলি বাঁচবে না। রোগ হয়েছে চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যাবে। এতে কান্নার কি হলো।
না বাবা, নীদ বাঁচবে না। এত হাসিখুশি, চঞ্চল মেয়েটা...।
কথা জড়িয়ে যাচ্ছে অহনার। সে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলছেন জাফর সাহেব। এতে তার কান্না আরও বেড়ে যাচ্ছে। অহনা বলছে-
জানো বাবা, আমাকে দেখা মাত্র যে নীদ গলা জড়িয়ে ধরতো। কথা শুরু হলে থামানো যেত না। মাঝে মাঝে আমি খুব বিরক্ত হতাম। সেই নীদ আজ আমার সঙ্গে একটা কথাও বললো না। আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত। এ কষ্ট আমি সইতে পারছি না বাবা। ও কেন আমার দিকে তাকালো না বাবা।
মারে, শান্ত হ। নীদ তোকে খুব ভালবাসে। তোকে কষ্ট না দেয়ার জন্যই নীদ তোর দিকে তাকায় নি। তুই শান্ত হ মা। আমাকে খুলে বল কি হয়েছে তার।
বাবা নীদের এইচআইভি পজেটিভ।
কথাটি শেষ হতেই জাফর সাহেবের চোখ বড় হয়ে গেল। তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর অহনাকে টেনে উঠিয়ে পাশের চেয়ারটাতে বসালেন। তিনি বসলেন। দু’জনই নীরব। জাফর সাহেব ভাবছেন- কি করে হলো এটা মেয়ের কাছে জানতে চাওয়া ঠিক হবে কিনা। ওই প্রসঙ্গে না গিয়ে জাফর সাহেব মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন- মারে, সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
বাবার এই কথায় অহনার চোখ বিস্ফোরিত। আবেগ যেন আরও উথলে উঠেছে। সে বললো- বাবা এইটা কি কইরা আল্লাহর ইচ্ছা হয়! একজনের পাপে অন্যজন শেষ হয়ে যাবে এইটা আল্লাহর ইচ্ছা না বাবা। এইটা...এইটা...
কথা বলতে পারছে না অহনা। জাফর সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে শান্ত করতে চাইছেন। এমন একটা বিষয় যে তিনি মেয়ের সঙ্গে এটা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করতে পারছেন না। কি করে হলো- এ কথাটিও বলতে তিনি সঙ্কোচ বোধ করছেন। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে অহনাই শুরু করলো- জানো বাবা, নীদের বিয়ে হয়েছিল। স্বামী প্রবাসী। তার কাছ থেকেই...।
জাফর সাহেব থমকে গেলেন। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলেন তিনি। নিচু স্বরে খুবই হালকা করে বললেন- কোন দেশে থাকে স্বামী।
ইতালি।
জাফর সাহেবের বুকটা ধক করে উঠলো। অহনার স্বামীও তো ইতালি থাকে। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখেও পানি জমতে শুরু করেছে। যে কোন মুহূর্তে টপ করে পড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি সামলে নিতে এবং মেয়েকে শান্ত করার জন্য জাফর সাহেব বললেন- মা অহনা, আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি। খেতে খুব ইচ্ছা করছে।
উঠে দাঁড়ালো অহনা। চোখ মুছলো সে। বললো- তুমি বসো বাবা, আমি চা করে নিয়ে আসছি।
চায়ে হালকা একটু চিনি দিস।
চিনি কেন বাবা? তোমার না ডায়াবেটিস?
হ্যাঁ, হালকা চিনি দিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। মুখটা কেমন তিতা হয়ে গেছে।
তোমাকে মুড়ি দেই বাবা।
আচ্ছা দে।
রান্না ঘরে চলে গেল অহনা। কিছুক্ষণ পর এসে বাবাকে মুড়ি দিয়ে গেল। বললো- চা হতে একটু সময় লাগবে, ততক্ষণে তুমি মুড়ি চিবাতে থাক।
দশ মিনিট পর চা নিয়ে এলো অহনা। চায়ে চুমুক দিয়ে জাফর সাহেব বললেন- ইস চায়ে এত চিনি দিছস ক্যান। তোরে না হালকা চিনি বললাম।
হালকা-ই দিয়েছি বাবা। আসলে চিনি ছাড়া চা খেয়ে অভ্যাস তো তাই মিষ্টি বেশি লাগছে।
তোর মা কি করছে।
টিভি দেখছে।
তোর পড়াশোনা কেমন চলছে।
ভাল বাবা।
পারভেজের সঙ্গে কথাটথা হয়? ও ফোনটোন করে?
হ্যাঁ করে।
ও কেমন আছে? কাজকর্ম কেমন চলছে।
ভাল বাবা, ও ভাল আছে।
ভাল কথা মা অহনা, পারভেজ যেন কবে আসতেছে?
আগামী সোমবার সকাল সাতটায় ওর বিমান ঢাকায় ল্যান্ড করার কথা।
একথা-সেকথার গল্প করে করে রাত দশটা বেজে গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় গেলেন জাফর সাহেব। তার মন থেকে কিছুতেই নীদের বিষয়টি দূর করতে পারছেন না। নিষ্পাপ একটা মেয়ে। স্বামীর পাপে নিঃশেষ হয়ে গেল। তার মেয়ের কি হবে? পারভেজ কতটা সৎ ও নিরাপদ। এপাশ-ওপাশ করছেন জাফর সাহেব। মাথার ওপরে ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তবুও তিনি ঘামছেন। চিকন ঘাম। প্রেসার বেড়ে গেল কিনা বুঝতে পারছেন না। উঠে কি একটা ঘুমের ট্যাবলেট খাবেন? সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। পাশে রাবেয়া খাতুন নাক ডাকছেন। বিছানা ছেড়ে উঠলেন তিনি। ভাবলেন বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসবেন। রাত ক’টা বাজে। বাতি জ্বালালে রাবেয়া খাতুনের ঘুম ভেঙে যাবে। তাই অন্ধকার হাতড়ে তিনি রুম থেকে বেরুলেন। বারান্দার কাছাকাছি যেতেই তিনি শুনলেন নিচু স্বরে কে যেন কথা বলছে। আরেকটু সামনে যেতে স্পষ্ট হলো বারান্দায় নিপুণ। তিনি ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।
অহনার রুমে বাতি জ্বলছে। পড়ার টেবিলে বসে আছে সে। সামনে বই খোলা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বইয়ের দিকে। তবে পড়ছে না। পড়তে মন চাইছে না। এক হাত গালে। অন্য হাত টেবিলের ওপর। ফ্যানের বাতাসে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। সামনে পরীক্ষা। এ সময়ে পড়াশুনা করা জরুরি। কিন্তু শরীর মন জুড়ে আছে নীদ। তার কথাটি কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অহনার চোখে ভাসছে- নীদ তার গলা জড়িয়ে ধরছে। হাত ধরে জোর করে মধুর ক্যান্টিনে নিয়ে যাচ্ছে চা-সিঙ্গারা, সমুচা খাওয়াতে। একনাগাড়ে কেবলই তার কথা বলে যাচ্ছে। অহনাকে কিছুই বলতে দিচ্ছে না।
ফোন বাজছে অহনার। সেদিকে খেয়াল নেই তার। বার বার বেজেই চলেছে। ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা। ডান হাতে ফোনটা কাত করে কে ফোন করেছে নম্বরটা দেখলো অহনা। আননোন নম্বর। তার মানে পারভেজ ফোন করেছে। সে ফোন করলে আননোন নম্বর লেখা ওঠে। বেশ কয়েকবার বাজার পর ফোনটা ধরলো অহনা। ওপাশ থেকে ভেসে এলো-
কেমন আছো জান।
ভাল।
কি ব্যাপার, কখন থাইক্যা ফোন করতাছি, ধরতাছো না যে? এতক্ষণ কোথায় ছিলা?
পড়ছিলাম।
পড়লে বুঝি ফোন ধরা যায় না?
সামনে পরীক্ষা। তাই...।
কেমন আছো?
ভাল।
আব্বা-আম্মা, সামি, নিপুণ, ওরা কেমন আছে।
ভাল। সবাই ভাল।
তুমি কেমন আছো?
আমিও ভাল।
আমি কাছে নাই ভাল থাকো কেমনে।
ভাল না থেকে উপায় কি?
আমি কেমন আছি জানতে চাইলা না?
কেমন আছো?
ভাল না। তুমি কাছে নাই ভাল থাকি কেমনে। ভাল্লাগে না, কিচ্ছু ভাল্লাগে না। সব ছাইড়াছুইড়া তোমার কাছে চইলা আসতে মন চায়।
আগামী সোমবারই তো আসতেছ।
আরে ওইখানেই হইছে বড় সমস্যা। এতদিন একরকম ছিলাম। এখন মনে হইতাছে সময় কেন যায় না।
আর তো মাত্র পাঁচদিন।
চলবে
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
নগ্নবেলা কিস্তি-৪
নগ্নবেলা-৫
নগ্নবেলা-৬
নগ্নবেলা-৭
নগ্নবেলা-৮
নগ্নবেলা-৯
নগ্নবেলা-১০
নগ্নবেলা-১১
নগ্নবেলা-১২
নগ্নবেলা-১৩
নগ্নবেলা-১৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





