দুষ্মন্ত -শকুন্তলার পুত্র ভরত বহু দেশ জয় করে সার্বভৌম রাজা হয়েছিলেন। তাঁর বংশের এক রাজার নাম হস্তী, তিনি হস্তিনাপুর নগর স্থাপন করেন। হস্তীর চার পুরুষ পরে কুরু রাজা হন, তাঁর নাম অনুসারে কুরুজাঙ্গল দেশ খ্যাত হয়। তিনি যেখানে তপস্যা করেছিলেন সেই স্থানই কুরুক্ষেত্র। কুরুর অধস্তন সপ্তম পুরুষের নাম প্রতীপ, তাঁর পুত্র শান্তনু।
মহাভিষ ও দেবী গঙ্গার সাক্ষাত
মহাভিষ ইক্ষ্বাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন, তিনি বহু যজ্ঞ করে স্বর্গে গিয়েছিলেন। একদিন মহাভিষ যখন দেবতাদের সঙ্গে ব্রহ্মার সভায় বসে ছিলেন, নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গা দেবীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন বায়ুর প্রভাবে গঙ্গাদেবীর পাতলা বস্ত্র উড়ে গেল। তাই দেখে দেবতারা মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুধু মহাভিষ অপলক দৃষ্টিতে গঙ্গা দেবীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ব্রহ্মা সেটা লক্ষ্য করে বুঝলে স্বর্গে থাকার উপযুক্ত নন। তাই ব্রহ্মা মহাভিষকে শাপ দিলেন মর্ত্যলোকে মানুব সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং পরে আবার স্বর্গে আসতে পারবে। মহাভিষ তখন ঠিক করলেন তিনি প্রতীপ রাজার পুত্র হয়ে জন্ম নিবেন।
অন্যদিকে গঙ্গা দেবী মহাভিষকে ভাবতে ভাবতে মর্ত্যে ফিরে আসার সময় দেখলেন অষ্টবসু দেবতা মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছেন। গঙ্গা দেবী তাদের এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলেন। তখন অষ্টবসুগন জানালেন -
অষ্টবসুদের অভিশাপ
সুমেরু পর্বতের কাছে একটি মনোরম স্থানে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম ছিল। একবার আটজন বসুদেবতা এই আশ্রমে সস্ত্রীক ভ্রমণ করতে যান। বশিষ্ঠ তখন আশ্রমে ছিলেন না। দেবরাজ ইন্দ্রের সুরভী-কামধেনুর কন্যা কামধেনু নন্দিনী সেই আশ্রমেই ছিলো। দ্যু-বসু এই গাভী দেখে বলেন "এর দুধ পান করলে, দশ হাজার বছর যৌবন-প্রাপ্ত হয়ে জীবিত থাকা যায়।"
এই কথা শুনে দ্যু-বসুর স্ত্রী তার সখী রাজকন্যা জিতবতীকে এই গাভী উপহার দিতে চাইলো। স্ত্রীর অনুরোধে দ্যু-বসু কামধেনু নন্দিনীকে চুরি করে নিয়ে চলে গেলেন। পরে বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে দেখলেন কামধেনু নন্দিনী সেখানে নেই। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে বসুদেবদের কামধেনু নন্দিনীকে চুরি করার বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রচন্ড রেগে গিয়ে অষ্টবসুকে মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণের অভিশাপ দেন। এদিকে অভিশাপের কথা জানতে পেরে অষ্টবসু গিয়ে বশিষ্ঠের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকেন। তাতে বশিষ্ঠের রাগ কিছুটা কমলে তিনি অষ্টবসুদের বলেন- "মানুষ হয়ে জন্ম নিলেও তোমরা সকলে এক বৎসর পরে শাপমুক্ত হবে, কিন্তু দ্যু-বসু নিজ কর্মের ফলে দীর্ঘকাল মনুষ্যলোকে বাস করবেন। তিনি ধার্মিক, সর্বশাস্ত্রবিশারদ, পিতার প্রিয়কারী এবং স্ত্রীসম্ভোগত্যাগী হবেন।"
নিজেদের এই অভিশাপের করুন কাহিনী শুনিয়ে এবার অষ্টবুরা দেবী গঙ্গাকে অনুরোধ করলো- "আমরা মানবীর গর্ভে যেতে চাই না, আপনিই আমাদের পুত্ররূপে প্রসব করুন, প্রতীপের পুত্র শান্তনু আমাদের পিতা হবেন। জন্মের পরেই আপনি আমাদের জলে ফেলে দিবেন, যাতে আমরা শীঘ্র নিষ্কৃতি পাই।"
গঙ্গা অষ্টবসুর অনুরোধে রাজি হলেন, কিন্তু শান্তনুর সঙ্গে তার সংগম যাতে ব্যর্থ না হয় তার জন্য একটি পুত্রকে জীবিতো রাখতে চাইলেন। তাই অষ্টবসুগণ প্রত্যেকে নিজ বীর্যের অষ্টমাংশ দিয়ে একটি পুত্রের জন্ম দিবে এবং সেই পুত্রটি জীবিত থাকবে। এই পুত্র বলবান হবে কিন্তু তার কোনো সন্তান হবে না।
রাজা প্রতীপ ও দেবী গঙ্গার সাক্ষাৎ
একদিন রাজা প্রতীপ গঙ্গার তীরে বসে জপ করেছিলেন এমন সময় গঙ্গাদেবী রূপযৌবনবতী সর্বাঙ্গসুন্দরী নারীরূপ ধারণ করে গঙ্গার জল থেকে উঠে এসে প্রতীপের ডান ঊরুতে বসলেন।
রাজা প্রতীপ বললেন - "কল্যাণী, তুমি কি চাও?"
গঙ্গা বললেন - "আমি দেবকন্যা, অগম্যা নই, আমাকে বিবাহ করুন।"
রাজা প্রতীপ বললেন - "তুমি আমার বাম ঊরুতে না বসে ডান ঊরুতে বসেছ, যেখানে পুত্র, কন্যা আর পুত্রবধূর স্থান। তুমি আমার পুত্রবধূ হ্ইয়ো।"
গঙ্গা বললেন - "ঠিক আছে, কিন্তু আমার কোনও কাজে আপনার পুত্র আপত্তি করতে পারবে না।"
রাজা প্রতীপ সম্মত হলেন। তখন গঙ্গা অন্তর্ধান করলেন আর প্রতীপ ও তাঁর পত্নী পুত্রলাভের জন্য তপস্যা করতে লাগলেন। রাজা মহাষিভ তাঁদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করল। তাঁর নাম রাখা হল শান্তনু।
শান্তনু ও গঙ্গার প্রেম কাহিনী
শান্তনু যখন যুবক হয়ে উঠল তখন তাঁর পিতা প্রতীক তাঁকে জানালেন তাঁর জন্য একটি রূপবতী কন্যা ঠিক করা আছে। সেই রূপবতী কন্যা যখন তার কাছে উপস্থিত হবে তখন তাঁকে গ্রহণ করতে হবে এবং তাঁর সকল কামনা পূরণ করতে হবে। সেই কন্যার কোনো কাজে বাঁধা দেয়া যাবে না এবং তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা করা যাবে না। এই কথা জানিয়ে রাজা প্রতীপ তাঁর পুত্র শান্তনুকে রাজ্যের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করে নিজে বনে চলে গেলেন।
একদিন শান্তনু গঙ্গার তীরে এক পরমা সুন্দরী নারীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না এই পরমা রূপসী নারীটি দেবী-দানবী-অপ্সরা না মানবী! মুগ্ধ শান্তনু তখন সেই নারীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। তখন গঙ্গা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হল, তবে শর্ত দিলো যে সে শুভ বা অশুভ যাই করুক না কেনো রাজা কখনোই তার কাজে বাঁধা দিতে পারবে না। যদি কখনো বাঁধা দেয় অথবা গাল-মন্দ কেরন বা তিরস্কার করেন তাহলে গঙ্গা তাকে তখনই ত্যাগ করবে। রাজা শান্তনু তাতেই রাজি হলেন।
স্ত্রী গঙ্গার স্বভাবচরিত্র রূপগুণ ও সেবায় তৃপ্ত শান্তনু সুখেই সংসার করতে লাগলেন। এই সময়ে তাঁর আটটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছিলো গঙ্গার গর্ভে। প্রত্যেক ছেলের জন্মের পরেই গঙ্গা সেই ফুটফুটে ছেলেটিকে জলে নিক্ষেপ করে বলতেন, এই তোমার প্রিয়কাজ করলাম। শান্তনু অসন্তুষ্ট হলেও কিছু বলতেন না, কারণি কিছু বললেই গঙ্গা তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে।
অষ্টম পুত্র প্রসবের পর গঙ্গা হাসছেন দেখে শান্তনু বললেন, একে জলে ফেলে মেরো না। তুমি পুত্রঘাতিনী, তোমার পরিচিয় কি, তুমি কে, কেন এই মহাপাপ করছ?
তখন গঙ্গা বললেন - "তুমি পুত্র চাও, অতএব এই পুত্রকে হত্যা করব না। কিন্তু তোমার কাছে থাকাও আমার শেষ হলো। এরপর দেবী গঙ্গা নিজের পরিচয় দিলেন এবং অষ্টবসুগণের অভিশাপের বিষয় রাজাকে জানালেন। বললেন অভিশপ্ত বসুগণের অনুরোধে গঙ্গা তাদের প্রসব করে জলে নিক্ষেপ করেছেন। শুধু এই অষ্টম পুত্র দ্যু-বসু দীর্ঘজীবী হয়ে বহুকাল মনুষ্যলোকে বাস করবেন এবং পুনর্বার স্বর্গলোকে যাবেন। এই বলে গঙ্গা নবজাত পুত্রকে নিয়ে চলে গেলেন।
শান্তনু ভগ্নহৃদয়ে দুঃখিত মন নিয়ে তাঁর রাজধানী হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন। তিনি সকল আনন্দর উদযাপন বাদ দিয়ে এবং স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে ধর্মানুসারে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। ছত্রিশ বছর তিনি স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে বনে বস করেছিলেন।
একদিন তিনি এটি হরিণের পিছু নিয়ে গঙ্গাতীরে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে এসে একটি দেবকুমারতুল্য দীর্ঘকায় যুবকের দেখা পেলেন। যুবকের সাথে কথা বলে শান্তনু মুগ্ধ হয়ে গেলেন, এরই মাঝে যুবকটি কোথায় যেনো চলে গেলো। শান্তনু বুঝতে পারলেন এটিই গঙ্গার গর্ভে জন্ম নেয়া তার অষ্টম পুত্র। রাজা শান্তনু তখন গঙ্গকে ডেলে বললেন তাঁর পুত্রকে দেখাতে।
তখন গঙ্গা সেই পুত্রের হাত ধরে আবির্ভূত হলেন। এবার রাজা শান্তনু তার অষ্টম পুত্র দেবব্রতকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন। দেবব্রতকে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করলেন। রাজ্যের সকলেই এই গুণবান রাজকুমারকে পছন্দ করলো।
====================================================================
বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যের মহাকাব্য মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। আমি মনে করি "যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মানুভূতিতে খোঁচা দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।" এই গ্রন্থে প্রচুর কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে পেশ করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তারা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন। মনে রাখতে হবে আমার এই পোস্ট কোনো ভাবেই ধর্মীয় পোস্ট নয়।
লেখার সূত্র : কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু।
ছবির সূত্র : এই সিরিজে ব্যবহৃত সকল ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত।
====================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১, মহাভারতের গপ্পো - ০০২, মহাভারতের গপ্পো - ০০৩, মহাভারতের গপ্পো - ০০৪
মহাভারতের গপ্পো - ০০৫, মহাভারতের গপ্পো - ০০৬, মহাভারতের গপ্পো - ০০৭, মহাভারতের গপ্পো - ০০৮
মহাভারতের গপ্পো - ০০৯, মহাভারতের গপ্পো - ০১০, মহাভারতের গপ্পো - ০১১, মহাভারতের গপ্পো - ০১২
মহাভারতের গপ্পো - ০১৩, মহাভারতের গপ্পো - ০১৪
====================================================================
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০২১ দুপুর ১:১৪