কিস্তি-২০
পরপর আরও কয়েক রাত। আরও চরমতর তিক্ততার, যন্ত্রণার কয়েক রাত কাটে। সে কি কাকুতি-মিনতি পারভেজের।
চলাফেরা, কথাবার্তা, ঘোরাঘুরি, মার্কেটে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, এমন কি তার গায়ে হাত দেয়া, জড়িয়ে ধরা- সবকিছুতে স্বতস্ফূর্ত অহনা। সারাক্ষণ সঙ্গ দেয় স্বামীকে। শুধু বেঁকে বসে চূড়ান্ত সময়ে। বলে- কাল পরীক্ষা। আমাকে পড়াশোনা করতে দাও। বিরক্ত করো না প্লিজ। এভাবে কাটে দু’-তিনদিন। এরপর নতুন অজুহাত- মাসিক চলছে। অন্তত পাঁচদিন ধারে-কাছে আসা যাবে না। কিন্তু এভাবে শাক দিয়ে কতদিন আর মাছ ঢেকে রাখা যায়। তিন মাসের ছুটি নিয়ে এসেছে পারভেজ। এরই মধ্যে কেটে গেছে প্রায় ২০-২৫ দিন। ক্রমশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে সে। প্রথম দিকে কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়লেও এখন জোর খাটায়। বলে- এটা তার অধিকার। কৈফিয়ত চায়- কেন তাকে এভয়ড করা হচ্ছে। এমনও বলে- তুমি বিবিএ পড়ছো, আর আমি মেট্রিক ফেল, এ জন্যই কি আমাকে এভাবে...।
এসব কথার উত্তর দিতে পারে না অহনা। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। অসম্ভব নিস্পৃহ। সে কি করে বোঝাবে তার কষ্ট, বেদনা। তার ভেতরে কত তোলপাড়, কত বিচ্ছুরণ।
একদিন চরম ক্ষিপ্রতায় পারভেজ চেপে ধরে অহনাকে। আজ বলতেই হবে তাকে অবজ্ঞার কারণ। তাকে বঞ্চিত করার মূল রহস্য।
স্বামীকে নিসপ্রভ করার চেষ্টা করে অহনা। বলে, একটা কথা বলি, রাগ করবে না তো?
বলো।
কাল আমার সঙ্গে একটু ক্লিনিকে যাবে?
দরকার থাকলে অবশ্যই যাবো। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
ওখানে গেলেই জানতে পারবে।
না, আমি এখনই জানতে চাই।
রাগ করো না প্লিজ। তোমার একটা টেস্ট করাবো।
আমার তো কোন রোগ নেই। কিসের টেস্ট করাবে।
ক্লিনিকে গিয়েই না হয় বলি।
না, এখনই বলো।
না মানে, তুমি রাগ করো না প্লিজ।
আমতা আমতা করে অহনা। বলতে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে আসে।
যা বলার পরিস্কার করে বলো।
আমি তোমার একটা এইচআইভি টেস্ট করাতে চাই।
কথাটা শোনা মাত্র থ’ হয়ে যায় পারভেজ। তার মাথাটা টনটন করছে। জমে আসছে আঙুলের ডগা। জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ। শুকনো ঠোঁট ভেজাতে শুষ্ক জিহ্বার ব্যর্থ চেষ্টা। এক সময় সমস্ত চৈতন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। দাঁড়ানো থেকে ধপ করে আছড়ে পড়ে বিছানায়। তার পৃথিবী অন্ধকার। বাইরে তখন অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পতন। বিধ্বস্ত পারভেজ টলতে টলতে বলে, এই কথা! আমার ওপর তোমার এতটাই অবিশ্বাস। এটা তুমি প্রথমদিনই সরাসরি আমাকে বলতে পারতে। এর জন্য এত নাটক, ছলাকলার কি দরকার ছিল।
উদ্ভ্রান্ত পারভেজ ঘর থেকে বেরুতে চায়। পথ আগলে দাঁড়ায় অহনা।
তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ। চোখের সামনে এমন একটা উচ্ছ্বল তাজা প্রাণ। আমার সবচেয়ে প্রিয়, কাছের বান্ধবী। ওর এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাওয়াটা আমাকে শঙ্কিত করে তুলেছে। তাছাড়া...।
অহনার প্রতিরোধ গ্রাহ্য করে না পারভেজ। সে মনে করে এটা তার চরম অপমান। আসলে এসব কিছু নয়, অল্পশিক্ষিত একটা ছেলেকে বিবিএ পড়ুয়া মেয়ে মেনে নিতে পারছে না।
শার্টটা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দেয় পারভেজ। কেচোর মতো ধীর পদক্ষিপ। হঠাৎ যেন রক্তের তেজ মরে এসেছে। ধীরে ধীরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার পাশে গিয়ে শোয় অহনা। নানা কথা বলে। বোঝায়- টেস্ট তুমি একা করবে না। আমিও করাবো। এটা দু’জনের জন্যই মঙ্গল। এটাকে তুমি নেগেটিভ সেন্সে নিও না। আমাদের দেশে হয় না। আসলে প্রতিটি বাবা-মায়ের উচিত বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের মেডিকেল চেকআপ করানো।
কোন কথা বলে না পারভেজ। চোখ বুজে শুয়ে থাকে। কথার ফিরিস্তি খুলে ধরে অহনা। এক সময় টের পায় ঘুমিয়ে পড়েছে পারভেজ।
সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁৎকে ওঠে অহনা। চাদর ছুড়ে ফেলে লাফিয়ে বিছানা থেকে নামে। মাত্র ৪০ মিনিট সময়। এর মধ্যেই ক্লাসে হাজির হতে হবে। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়। যখন বেরিয়ে যাবে তখন চোখ পড়ে বিছানায়। পারভেজ নেই। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ও চাদর নেয়নি। পারভেজ ওর গায়ে চাদর দিয়ে দিয়েছে।
আজ হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো অহনার। পারভেজ আসার পর থেকে সকালে সেই ফোনটা আর আসছে না। মাথাটা জমে আছে। অনেক রাত অবধি জেগে ছিল। ঘুম কম হয়েছে। ঘুম অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরে কম হচ্ছে। বিশেষ করে পারভেজ আসার পর থেকে। এত অবসন্ন লাগছে যে ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করছে না। পারভেজ আসার পর থেকে প্রতিদিন ওকে ভার্সিটি পৌঁছে দেয় সে। আজ কোথায় গেল। সে যাই হোক এখন ওসব ভাবার সময় নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অহনা।
এরপর যত দিন যায় পারভেজ তত বেশি সংযত। ঠাণ্ডা বরফের স্তুপে ডুবে থাকে। চলাফেরায় প্রাণ নেই। অনেক কম কথা বলে। সারাদিন বাইরে থাকে। এর মাঝখানে দু’দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসে।
সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে পারভেজ। অন্যদিনের তুলনায় একটু প্রাণবন্ত মনে হয়। শ্বশুর-শাশুড়িকে ডেকে বলে, কাল দুপুর সাড়ে ১২টায় তার ফ্লাইট।
জাফর সাহেব বলেন, তোমার তো আরও ১ মাস পর যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ আব্বা। কিন্তু জরুরি একটা কাজ আছে। না গেলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পারভেজের কথা শোনে অহনা। বুঝতে অসুবিধা হয় না ওর সঙ্গে রাগ করেই এত আগে চলে যাওয়া। ঘরে গিয়ে অহনাকে কিছুই বলে না পারভেজ। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ে। অহনা কথা বলতে চাইলে- দেখি, হু, হা বলে জবাব দেয়। পাশ ফিরে শুয়ে বলে- আমাকে ঘুমাতে দাও।
খুব ভোরে আজ ঘুম ভাঙে অহনার। ঘুমানোর আগে গভীর রাত পর্যন্ত কি সব যন্ত্রণাদায়ক কুৎসিত অধ্যায়। স্নায়ুগ্রন্থিগুলো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কেমন অবশ, অসুস্থ লাগছে। সামনে চোখ পড়তেই দেখে দরজা খোলা। বিছানায় তাকিয়ে দেখে পারভেজ নেই। এত সকালে কোথায় গেল।
নাহ্ আর ভাল্লাগে না কোনকিছু। অসম্ভব ছটফটানি। এই একঘেয়ে, জরাজীর্ণ, জঘন্য পৃথিবীর কোন আঁচড় লাগতে দেবো না কোথাও। শিরদাঁড়ায় কম্পন শুরু হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে মেঝেতে দু’পা খাড়া করে অহনা। অস্ফুট উচ্চারণ-
যেখানে খুশি যাক। যা খুশি করুক। আমি মরে গেলে কারও কিছু আসবে যাবে না। পৃথিবী যেমন আছে তেমনি থাকবে। ও একা কষ্ট করছে? আমার বুঝি কোন যন্ত্রণা নেই। আমার হৃদপিণ্ডের থর কাঁপুনি, সর্বাঙ্গ জ্বলে যাওয়ার শাস্তি আমি ভোগ করছি না! একা একা জ্বলবো, পুড়বো, কাতরাবো, ছটফট করবো, এক সময় স্থির হয়ে যাবো। কি প্রয়োজন এসব বিষাক্ত, ক্লিশিত কষ্ট শুষে নেয়ার। নিজেকে এই রকম যন্ত্রণাময় অসহ্য মানুষে রূপান্তরিত করে কি লাভ? তাতেই কি আমার ওপর থেকে এই আনন্দময়, বীভৎস পৃথিবীর স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে?
ভাবনাগুলোও সব এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত।
খাট ছেড়ে নিঃশব্দে রান্নাঘরের দিকে হাঁটে অহনা। রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সকাল ন’টার দিকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হয় অহনা, পারভেজ ও নিপুণ। সাড়ে দশটায় পৌঁছে যায় ওরা। অন্তত দুই ঘণ্টা আগে বোর্ডিং পাস নিতে হবে। বিমানবন্দরে ঢুকতে আজ কোন অসুবিধা হয় নি। কোথাও বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি। কড়াকড়ির খর্গ আজ অনেকটা শিথিল। পথে খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেছে পারভেজ। নানা বিষয়ে। যেন কিছুই হয় নি। সে কথায় নিপুণের প্রসঙ্গও এসেছে।
আগামীকাল শেষপর্ব
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-১
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-২
ধারাবাহিক উপন্যাস নগ্নবেলা কিস্তি-৩
নগ্নবেলা কিস্তি-৪
নগ্নবেলা-৫
নগ্নবেলা-৬
নগ্নবেলা-৭
নগ্নবেলা-৮
নগ্নবেলা-৯
নগ্নবেলা-১০
নগ্নবেলা-১১
নগ্নবেলা-১২
নগ্নবেলা-১৩
নগ্নবেলা-১৪
নগ্নবেলা-১৫
নগ্নবেলা-১৬
নগ্নবেলা-১৭
নগ্নবেলা-১৮
নগ্নবেলা-১৯
আলোচিত ব্লগ
হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!
হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ



ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন
মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন
তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।