somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাভারতের গপ্পো - ০২৬ : জতুগৃহ

০৯ ই জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এক বৎসর পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন। নানান গুণে যুধিষ্ঠির তাঁর পিতা পাণ্ডুর চেয়েও বেশী লোকপ্রিয়তা পেলো।

ভীম বলরামের কাছে অসিযুদ্ধ গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ শিখলো। অর্জুন নানাবিধ অস্ত্রের প্রয়ােগে আরো দক্ষ হয়ে উঠলো। সহদেব সর্বপ্রকার নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলো। দ্রোণের শিক্ষার ফলে নকুলও শক্তিশালী যোদ্ধা হয়ে উঠলো। পাণ্ডরা যুদ্ধ করে বহু দেশ জয় করে নিজেদের রাজ্য বিস্তার করলেন।

পাণ্ডবদের বিক্রমের খবর শুনে ধতরাষ্ট্র দুশ্চিন্তায় পরে গেলো। তিনি মন্ত্রিশ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ কণিককের কাছে জানতে চাইলেন এখন পাণ্ডবদের সাথে শত্রুতা করবেন নাকি ওদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।



কণিক বললেন- মহারাজ, উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত অমিত্রকে কলসের ন্যায় কাঁধে বইবেন, তার পর সুযােগ এলেই তাকে পাথরের উপর আছড়ে ফেলবেন। যাঁকে দারুণ কর্ম করতে হবে তিনি বিনীত হয়ে হাস্যমুখে কথা বলবেন, কিন্তু হদয়ে ক্ষুরধার থাকবেন। মৎস্যজীবী যেমন বিনা অপরাধে মৎস্য হত্যা করে, সেইরূপ পরের মর্মচ্ছেদ ও নিষ্ঠর কর্ম না করে বিপুল ঐশ্বর্যলাভ হয় না। কুররাজ, আপনি সকলের শ্রেষ্ঠ; নিজেকে রক্ষা করুন, যেন পাণ্ডবরা আপনার অনিষ্ট না করে; এমন উপায় করুন যাতে শেষে অনুতাপ করতে না হয়।


পাণ্ডবদের হত্যা করার জন্য দুর্যোধন তাঁর মামা সুবলপুত্র শকুনি ও কর্ণের সঙ্গে পরামর্শ করলো। দুর্যোধন ধুতরাষ্ট্রকে বললেন, আপনি অন্ধ বলে রাজ্য পান নি, পাণ্ডু পেয়েছিলেন। কিন্তু পাণ্ডুর পুত্ররাই যদি বংশানুক্রমে রাজ্য পায় তবে আমাদের বংশ উপেক্ষিত হয়ে থাকবে। আপনি কৌশল করে পাণ্ডবদের বারণবতে পাঠিয়ে দেন, তা হলে আমাদের আর ভয় থাকবে না।/sb]



দুর্যোধন আরো জানালো সে অর্থ আর সম্মান দিয়ে প্রজাদের বশ করেছে, ধনাগারও তাঁর হাতে। ভীষ্মের কোনও পক্ষপাত নেই, অশ্বথামা দুর্যোধনের পক্ষে আছেন, দ্রোণও পুত্রের অনুসরণ করবেন, কৃপও তাঁর ভাগিনার সাথে আসবে। শুধু বিদুর পাণ্ডবদের পক্ষে থাকবে।



ধৃতরাষ্ট্রের কয়েকজন মন্ত্রী পাণ্ডবদের কাছে গিয়ে জানালো বারণাবত অতি মনােরম নগর, সেখানে পশুপতির উৎসব উপলক্ষ্যে এখন বহু লােকের সমাগম হয়েছে। এইসব শুনে পাণ্ডবদের বারণাবত যাবার ইচ্ছা হল। ধৃতরাষ্ট্রও পাণ্ডবদের বারণাবত যাওয়ার জন্য বললেন। যুধিষ্ঠির মাতা ও ভাইদের সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করলেন বারণাবতের পথে।

দুর্যোধন পরােচন নামক মন্ত্রীকে দ্রুতগামী রথে তখনই বারণাবতে পাঠিয়ে দিলেন। আর বলে দিলেন বারাণাতে গিয়ে শণ, সরস (ধনা) প্রভৃতি দিয়ে একটি সুসজ্জিত গৃহ নির্মাণ করতে হবে। মাটির সঙ্গে প্রচুর ঘী, তৈল, বসা জতু (গালা) মিশিয়ে তার দেওয়ালে লেপ দিয়ে এবং চতুর্দিকে কাঠ, তেল ইত্যাদি দাহ্য পদার্থ এমন করে রাখতে হবে যাতে পাণ্ডবরা বুঝতে না পারে। পাণ্ডবদের সমাদর করে সেখানে বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুদিন পরে যখন তারা নিশ্চিন্তমনে নিদ্রামগ্ন থাকবে তখন সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। পুরােচন তখনই দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে বারণাবতে চলে গেলেন।


বুদ্ধিমান বিদুর দুর্যোধনের কুমতলব বুঝতে পেরেছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির দুজনেই ম্লেচ্ছভাষা জানতেন। যুধিষ্ঠিরের যাত্রাকালে বিদুর শ্লেচ্ছভাষায় তাঁকে বললেন, শত্রুর অভিসন্ধি যে জানে সে যেন বিপদ থেকে নিস্তারের উপায় করে। লৌহ ভিন্ন অন্য অস্ত্রেও প্রাণনাশ হয়। অগ্নিতে শষ্ক বন দগ্ধ হয় কিন্তু গর্তবাসীর হানি হয় না। মানুষ শজারর ন্যায় গর্ত পথে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। যে লােক নক্ষত্র দ্বারা দিক নির্ণয় করতে পারে এবং পথ চিনে রাখে সে নিজেকে এবং আরও পাঁচজনকে বাঁচাতে পারে। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, বুঝেছি

পথে যেতে যেতে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে কাছে জানতে চায় বিদুর অবােধ্য ভাষায় কি বলেছেন। যুধিষ্ঠির জানায় যে বিদুর বলেছেন আমাদের ঘরে আগুন লাগবে, পালাবার জন্য সকল পথই যেন আমরা চিনে রাখি।

পাণ্ডবগণ বারণাবতে পৌছালে পরােচন মহাসমাদরে তাঁদের এক বাসভবনে নিয়ে গিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। দশ দিন পর পাণ্ডবদের অন্য আরেকটি ভবনে নিয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির সেখানে গিয়ে ঘী, বসা ও লাক্ষার গন্ধ পেয়ে ভীমকে বললেন, এই ঘর আগ্নেয় পদার্থ দিয়ে প্রস্তুত করেছে, পাপী পােচন আমাদের দগ্ধ করতে চায়। আমরা যদি পালিয়ে যাই তবে দুর্যোধনের চরেরা আমাদের হত্যা করবে। আমরা এই জতুগৃহের মেঝেতে গর্ত করে তার ভিতরে বাস করব। পরোচন জতুগৃহের দরজার পাশেই নিজের ঘর বানিয়ে ঘুমাতো।

সেই সময়ে বিদুরের পাঠানো একজন লোক এসে নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো সে খুব নিপুন ভাবে খনন কার্য করতে পারে।যুধিষ্ঠির তাকে ঘরের ভিতর থেকে লম্বা একটি সুরঙ্গ তৈরি করতে বললো। লোকটি সেই মতে একটি দীর্ঘ্য সুরঙ্গ প্রস্তুত করলো এবং সুরঙ্গের দুই দিক সুনিপুন ভাবে মাটির সমান করে লুকিয়ে রাখলো।

পাণ্ডবরা দিনের বেলা শিকারে যাবার নাম করে সমস্ত পথ চিনে নিতে লাগলো এবং রাতে সশস্ত্র ও সতর্ক হয়ে সুরঙ্গের মধ্যে বাস করতে লাগলো। এভাবে এক বছর কেটে গেলো। একদিন কুন্তী ব্রাহ্মণভােজন করালেন, অনেক স্ত্রীলােকও এলো, একজন মহিলা তার পাঁচ ছেলেকে নিয়ে খেতে এসেছিল, তারা প্রচুর মদ্যপান করে মৃতপ্রায় হয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো। তখন ভীম পরােচনের শয়নগৃহে, জতুগৃহের চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। সকলে মনে করলো পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী আগুনে পুরে মারা গেছে। হস্তিনাপুরে সংবাদ গেলে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। তিনি কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডবের অন্ত্যেষ্টির জন্য বারণাবতে লােক পাঠালেন।



অন্য দিকে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী সুরঙ্গে প্রবেশ করলেন। তারা সুরেঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। মহাবল ভীম কুন্তীকে কাঁধে এবং নকুল-সহদেবকে কোলে নিয়ে যুধিষ্ঠির-অর্জুনের হাত ধরে বনের পথে চললেন। বিদুরের একজন বিশ্বস্ত অনুচর পাণ্ডবগণকে গঙ্গা পার করে দিলো।



নৌকা থেকে নেমে পাণ্ডবরা নক্ষত্র দেখে পথনির্ণয় করে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন। দুর্গম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পরদিন সন্ধ্যাকালে তারা একটি ভয়ঙ্কর বনে উপস্থিত হলেন। ক্লান্ত হয়ে সকলে সেখানে ঘুমিয়ে পরলো। শুধু ভীম জেগে থেকে নানা প্রকার চিন্তা করতে লাগলেন।




====================================================================

বিশেষ ঘোষণা : হিন্দুদের ধর্মীয় সাহিত্যের মহাকাব্য মহাভারতের কথা আমরা সকলেই জানি। আমি এটিকে পড়ছি একটি কল্পকাহিনীর সাহিত্য হিসেবে, ধর্মগ্রন্থ হিসেবে নয়। আমি মনে করি "যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে। অন্যের বিশ্বাস বা ধর্মানুভূতিতে খোঁচা দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।" এই গ্রন্থে প্রচুর কল্পকাহিনী রয়েছে। সেগুলিই আমি এই সিরিজে পেশ করবো। যারা মহাভারত পড়েননি তারা এখান থেকে ধারাবাহিক ভাবে সেগুলি জেনে যাবেন। মনে রাখতে হবে আমার এই পোস্ট কোনো ভাবেই ধর্মীয় পোস্ট নয়।

লেখার সূত্র : কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কৃত মহাভারত : অনুবাদক - রাজশেখর বসু।
ছবির সূত্র : এই সিরিজে ব্যবহৃত সকল ছবি বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত।


বি.দ্র. : আগামী দুই দিনের জন্য আশ্রমে যাচ্ছি। তাই প্রথম পাতাতে আরেকটি পোস্ট থাকার পরেও এই পোস্টটি করলাম। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি দেখবেন।
=================================================================
সিরিজের পুরনো পর্বগুলি দেখতে -
মহাভারতের গপ্পো - ০০১, মহাভারতের গপ্পো - ০০২, মহাভারতের গপ্পো - ০০৩, মহাভারতের গপ্পো - ০০৪
মহাভারতের গপ্পো - ০০৫, মহাভারতের গপ্পো - ০০৬, মহাভারতের গপ্পো - ০০৭, মহাভারতের গপ্পো - ০০৮
মহাভারতের গপ্পো - ০০৯, মহাভারতের গপ্পো - ০১০, মহাভারতের গপ্পো - ০১১, মহাভারতের গপ্পো - ০১২
মহাভারতের গপ্পো - ০১৩, মহাভারতের গপ্পো - ০১৪, মহাভারতের গপ্পো - ০১৫, মহাভারতের গপ্পো - ০১৬
মহাভারতের গপ্পো - ০১৭, মহাভারতের গপ্পো - ০১৮, মহাভারতের গপ্পো - ০১৯, মহাভারতের গপ্পো - ০২০
মহাভারতের গপ্পো - ০২১, মহাভারতের গপ্পো - ০২২, মহাভারতের গপ্পো - ০২৩, মহাভারতের গপ্পো - ০২৪
মহাভারতের গপ্পো - ০২৫
=================================================================
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১২:১৭
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×