দ্বিজেন শর্মা বলছিলেন – “কোনো বাগানই পূর্ণতা পায় না শিউলি না থাকে যদি”।
শিউলি মূলত শরতেরই ফুল। তবে হেমন্তও বঞ্চিত নয় শিউলির শোভা ও সৌরভ থেকে। ফুল ফোটা ক্রমেই কমে এলেও কার্তিকের শেষা পর্যন্ত দেখা পাওয়া যায় শিউলির। কোনও কোনও গাছে সারা বছরই ফুল হয়!
শিউলি ফুলের কলিরা মুখ তুলে চায় সন্ধ্যায়। বেলা ডোবার পর থেকে ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে। ততোক্ষণে চারধারে আঁধার নেমে আসলেও বাতাসে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস জানিয়ে দেয় শিউলির অস্তিত্ব। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে শিউলির কমলা রঙের বৃন্তের উপরে দুধসাদা পাপড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো থাকে।
রাতের এই রূপসীর আয়ু বড়ই স্বল্প। সন্ধ্যায় ফুটে ঝরে পড়ে সূর্যোদয়ের আগেই। গাছের আকার বড় হলে ফুলও ফোটে প্রচুর। রাত শেষে গাছতলা ভরে ওঠে সাদা ফুলের স্নিগ্ধ সমারোহে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার অনেক কবিতা-গানে শিউলি বা শেফালির কথা লিখেছেন। নিচে তার ১০ নমুনা রইলো।
১
শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।
শেফালি পুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা।।
২
তোমারি অশ্রু ঝলে শিউলি তলে সিক্ত শরতে,
হিমানীর পরশ বুলাও ঘুম ভেঙে দাও দ্বার যদি রোধি।।
৩
এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে।
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।।
৪
শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ
এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই।
৫
রংমহলের রংমশাল মোরা আমরা রূপের দীপালি।
রূপের কাননে আমরা ফুলদল কুন্দ মল্লিকা শেফালি।।
৬
আজ শরতে আনন্দ ধরে না রে ধরণীতে।
একি অপরূপ সেজেছে বসুন্ধরা নীলে হরিতে।।
আনো ডালা ভরি কুন্দ ও শেফালি,
আজ শারদোৎসব জ্বালো দীপালি।
৭
মৌমাছি কয়, গুন গুন গান গাই
মুখোমুখি দু’জনে সেইখানে যাই
শারদীয়া শেফালি গায়ে পড়ে কয় —
‘ব্রজের মধুবন — এই তো ব্রজের মধুবন।।
৮
রুম ঝুম ঝুম ঝুম নূপুর বোলে
বন-পথে যায় কে বালিকা, গলে শেফালিকা,
মালতী মালিকা দোলে॥
৯
চপল বিদ্যুতে হেরি সে চপলার
ঝিলিক হানে কণ্ঠের মণিহার,
নীল আঁচল হতে তৃষিত ধরার পথে
ছুড়ে ফেলে মুঠি মুঠি বৃষ্টি শেফালিকা।।
১০
নটকানো রঙ শাড়ি পরে কে বালিকা
ভোর না হতে যায় কুড়াতে শেফালিকা।
শিউলির Scientific Name : Nyctanthes arbortristis
লাতিন Nyctanthes-এর অর্থ হচ্ছে “সন্ধ্যায় ফোটা” এবং arbortristis-এর মানে হচ্ছে “বিষন্ন গাছ”। সন্ধ্যায় ফোটা আর সকালে বিষন্ন ভাবে ঝিরে পরা থেকেই এই নামকরণ সম্ভবতো। এরজন্যই ইংরেজিতে শিউলি গাছের একটি নাম হচ্ছে "Tree of sorrow.
শিউলির অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : শেফালি, শেফালিকা।
সংস্কৃত নাম : নালাকুমকুমাকা, হারসিঙ্গারাপুস্পক, সুকলাঙ্গি, রাজানিহাসা, মালিকা, পারিজাত, পারিজাতা, পারিজাতাকা, অপরাজিতা, বিজয়া, নিসাহাসা, প্রহার্ষিনী, প্রভোলানালিকা, বাথারি, ভুথাকেশি, সীতামাঞ্জারি, সুবাহা, নিশিপুস্পিকা, রাগাপুস্পি, খারাপাত্রাকা, প্রযক্তা, প্রযক্তি।
Common Name : Night-flowering Jasmine, coral jasmine, Harsingar, Tree of sorrow.
হিন্দু ধর্ম মতে শিউলি স্বর্গের ফুল।
হিন্দু পুরাণে অবশ্য শিউলির পরিচিতি পারিজাত নামে। পৌরাণিক কাহিনীতে বার বার এসেছে পারিজাত ফুলের কথা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, বেদনার প্রতীক স্বল্পায়ুর এ ফুল। যার সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ব্যর্থ প্রেমের করুণ গল্প।
পারিজাতিকা নামের এক রাজকুমারী সূর্যকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু সূর্যের সাথে মিলন হবার নয় বলে সে মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে। সেই রাজকন্যা পারিজাতিকার চিতাভষ্ম থেকে জন্ম নেয় শিউলি ফুলের গাছ। তাই শিউলি ফুলের আরেক নাম পারিজাত। পারিজাত মনের দুঃখে ক্ষোভে সূর্যের মুখ দেখতে চায় না বলেই সকাল বেলায় সূর্য উঠার আগেই ঝরে পড়ে গাছ থেকে।
পারিজাতের বাস ছিল স্বর্গে। পারিজাত স্বর্গে শোভা হয়ে নিজের ঘ্রাণে মুগ্ধ করত দেব দেবীদের। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী-সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন। যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পরে সুগন্ধ ছড়ায়। এদিকে স্বর্গের রাজা দেবরাজা ইন্দ্র ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান। তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু ফল কোনদিন আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না। (এখনতো হচ্ছে!! কি করে হচ্ছে সেই কাহিনী আমার জানা নেই।)
হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীরা ঝরা শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যান পূজার জন্য। শিউলি এমনই এক ফুল যেটি ঝরে গেলেও পূজায় ব্যবহারে কোনো বাঁধা নেই। এই ফুলকে দুর্গা পূজার আগমনি ফুলের মর্যাদা দিয়েছে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছেও পবিত্র পুষ্প হিসেবে বিবেচিত হয় শিউলি।
শিউলি এই উপমহাদেশেরই নিজস্ব উদ্ভিদ। আদি নিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে।
শিউলি ফুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ফুল ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রাদেশিক ফুল।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অনেক কবিতা-গানে শিউলি বা শেফালির কথা লিখেছেন। নিচে তার ১০ নমুনা রইলো।
১
গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে,
মধুপ হোথা যাস নে--
ফুলের মধু লুটিতে গিয়ে
কাঁটার ঘা খাস নে!
হেথায় বেলা, হোথায় চাঁপা,
শেফালী হোথা ফুটিয়ে--
ওদের কাছে মনের ব্যথা
বল রে মুখ ফুটিয়ে!
২
গোলাপ মালতী, শিউলি সেঁউতি,
পারিজাত নরগেশ,
সব ফুলবাস মিলি এক ঠাঁই
ভরিল কাননদেশ।
৩
শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে
শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে॥
আমলকি-ডাল সাজল কাঙাল, খসিয়ে দিল পল্লবজাল,
কাশের হাসি হাওয়ায় ভাসি যায় সে চলে॥
৪
সারা বেলা শিউলিবনে আছি মগন আপন মনে,
কিসের ভুল রেখে গেলে আমার বুকে ব্যথার বাঁশিখানি॥
আমি যা বলিতে চাই হল বলা
ওই শিশিরে শিশিরে অশ্রু-গলা।
৫
শরতের আলোতে সুন্দর আসে,
ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসে,
হৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা ॥
৬
ওলো শেফালি, ওলো শেফালি,
আমার সবুজ ছায়ার প্রদোষে তুই জ্বালিস দীপালি॥
তারার বাণী আকাশ থেকে তোমার রূপ দিল এঁকে
শ্যামল পাতায় থরে থরে আখর রুপালি॥
তোমারবুকের খসা গন্ধ-আঁচল রইল পাতা সে
আমার গোপন কাননবীথির বিবশ বাতাশে।
৭
দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলি চায়
প্রভাতের কিনারায়।
ডাক দিয়েছে রে শিউলি ফুলেরে--
আ য় আ য় আ য়॥
৮
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা--
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা ॥
৯
শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির-ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুণরাঙা চরণ ফেলে
নয়ন-ভুলানো এলে॥
আলোছায়ার আঁচলখানি লুটিয়ে পড়ে বনে বনে,
ফুলগুলি ওই মুখে চেয়ে কী কথা কয় মনে মনে॥
১০
শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল॥
রাতের বায় কোন্ মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল॥
শিউলির ভেষজ গুণ রয়েছে। শিউলি পাতার রস স্বাদে তিতা হলেও মৌসুমি জ্বর, গলা বসা, ক্রিমি, জন্ডিস ও খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত সমস্যায় দু-তিন চামচ সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়।
তাছাড়া অতীতে খাবারের রং হিসেবে শিউলি বোঁটার ব্যবহার ছিল। শিউলির বোঁটা গুলো শুকিয়ে গুঁড়ো করে পাউডার করে হালকা গরম জলে মেশালে চমৎকার হলদে কমলা বা জর্দা রঙ হয়।
শিউলির ফল চ্যাপ্টা হৃদপিণ্ডাকৃতির। ফলটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা তৈরি কর যায়, আবার গুটিকলমেও বিস্তার সম্ভব।
তথ্যসূত্র : অন্তর্জাল
=================================================================
আজি যত কুসুম কলি ফুটিলো কাননে
ফুলেদের কথা
অশোক, অর্কিড, অলকানন্দা (বেগুনী), অলকানন্দা (হলুদ), অলকানন্দা, আকন্দ, আমরুল, অপরাজিতা, উর্বশী,
কলাবতী, কচুরিপানা ফুল, কসমস, কালো পঙ্গপাল, কর্ণফ্লাওয়ার, কন্টকলতা, ক্যালেনডুলা
গাঁদা, গেন্ধা, গন্ধা, গামারি, গোলাপ, গোলাপি আমরুল, গ্লুকাস ক্যাসিয়া, গৌরিচৌরি,
ঘোড়া চক্কর
চন্দ্রপ্রভা,
জ্যাকারান্ডা,
ঝুমকোলতা
ডালিয়া
তমাল, তারাঝরা
দাঁতরাঙ্গা, দাদমর্দন, দেবকাঞ্চন, দোলনচাঁপা
ধুতুরা
নাগেশ্বর, নাগলিঙ্গম, নীল হুড়হুড়ে, নীল জ্যাকারান্ডা,
পপী, পুন্নাগ
ফাল্গুনমঞ্জরী, ফুরুস (সাদা)
বরুণ, বড়নখা, বিড়াল নখা, বাদুড় ফুল, বাগানবিলাস, বোতল ব্রাশ, ব্লিডিং হার্ট, বন পালং
ভাট ফুল
মাধবীলতা, মধুমঞ্জরি
রঙ্গন, রুদ্রপলাশ, রাজ অশোক, রাধাচূড়া, রাণীচূড়া
লতা পারুল
শাপলা (সাদা), শিউলি, শিবজটা, শ্বেত অপরাজিতা, শ্বেত অকন্দ, সুলতান চাঁপা, সোনাপাতি,
জবা - ১, জবা - ২, সাদা জবা, ঝুমকো জবা, লঙ্কা জবা, পঞ্চমুখী জবা, বহুদল জবা, রক্ত জবা, হলুদ জবা, গোলাপী জবা
=================================================================
ফুলেদের ছবি
ফুলের রাণী গোলাপ - ০১, ফুলের রাণী গোলাপ - ০২, ফুলের রাণী গোলাপ - ০৩, ফুলের রাণী গোলাপ - ০৪
ফুলের রাণী গোলাপ - ০৫, ফুলের রাণী গোলাপ - ০৬, ফুলের রাণী গোলাপ - ০৭, ফুলের রাণী গোলাপ - ০৮
ফুলের রাণী গোলাপ - ০৯, ফুলের রাণী গোলাপ - ১০, ফুলের রাণী গোলাপ - ১১, ফুলের রাণী গোলাপ - ১২
ফুলের রাণী গোলাপ - ১৩
রাতের গোলাপ - ০১, রাতের গোলাপ - ০২, রাতের গোলাপ - ০৩, রাতের গোলাপ - ০৪
অর্কিড-২, অর্কিড-৩, অর্কিড-৪, অর্কিড-৫, অলকানন্দা (বেগুনী)-২, অলকানন্দা (বেগুনী)-৩, আমরুল-২,
কচুরিপানা ফুল-২, কসমস-২, কসমস-৩, কসমস-৪, কসমস-৫, কসমস-৬, কর্ণফ্লাওয়ার-২,
গ্লুকাস ক্যাসিয়া-২, গ্লুকাস ক্যাসিয়া-৩, গোলাপি আমরুল-২,
ঝুমকোলতা-২
ডালিয়া-২, ডালিয়া-৩, ডালিয়া-৪,
তারাঝরা- ২
দাঁতরাঙ্গা-২, দাদমর্দন-২, দাদমর্দন-৩, দাদমর্দন-৪, দোলনচাঁপা-২
নাগেশ্বর-২, নাগলিঙ্গম-২, নাগলিঙ্গম-৩
পপী-২, পপী-৩, পপী-৪, পপী-৫, ফাল্গুনমঞ্জরী-২,
বাগানবিলাস-২, বাগানবিলাস-৩, বাদুড় ফুল-২, বোতল ব্রাশ-২, বোতল ব্রাশ-৩, বোতল ব্রাশ-৪, বিড়াল নখা-২, বোতল ব্রাশ-৪
মাধবীলতা-২, মাধবীলতা-৩
রুদ্রপলাশ-২, রুদ্রপলাশ-৩, রাজ অশোক-২, রাজ অশোক-৩, রাধাচূড়া-২, রাধাচূড়া-৩, রাধাচূড়া-৪, রাধাচূড়া-৫, রঙ্গন-২,
লতা পারুল-২, লতা পারুল-৩, লতা পারুল-৪
শিউলি-২, সুলতান চাঁপা-২
গামারির হলুদ বন্যা, আরো কিছু গামারি, শিমুল গাছে আগুন, অশোক ফুলের ছবি, নাগেশ্বর ও ভমর, পলাশ ফুটেছে......, ডালিয়া, ধুতরা ফুল, একটি দাঁতরাঙ্গা ফুল
মিষ্টি জলপাইয়ের ফুল, ডালের ফুল, চুকাই ফুল, চুকুর ফুল, সরষে ফুল,
=================================================================
গাছেদের কথা
বাংলাদেশের সংরক্ষিত উদ্ভিদের সচিত্র তালিকা, অশোক সমগ্র, কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া ও কনকচূড়া বিতর্ক, চাঁপা নিয়ে চাপাবাজি, আতা কাহিনী, বিলম্ব, মাছি ফাঁদ উদ্ভিদ, জল জমানি পাতা, শিউলি
=================================================================
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই আগস্ট, ২০২২ রাত ১:০৯